কলাবতী বলল, ”যদি সরাকে সামনের বছর শ্যামাপুকুরের দরকার না হয় তা হলে সাড়ে তিন লাখ টাকা তো ফেরত দিতে হবে।”
সুশি বলল, ”ব্যাংকাকা তাও বলেছেন। সরা যদি বড় কোনও চোট পায়, ওর খেলা যদি পড়ে যায় তা হলে শ্যামপুকুর তো ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না। কিন্তু মহিলার এক কথা, যে টাকা ঘরে একবার ঢুকেছে আর তা বেরোবে না।”
ঘন্টু বলল, ”সুখিকাকিমা খুব কষ্ট করে সংসার চালান। বিরাজকাকা শ্যাওড়াফুলিতে একটা মিষ্টির দোকানে কাজ করেন। বড় মেয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে, পাত্র প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়, চেয়েছে মোটরবাইক, কালার টিভি আর একটা ঘর তোলার টাকা।”
কলাবতী কিছুক্ষণ ঘন্টুর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, ”চলো, সরার সঙ্গে একবার কথা বলি। ওর বুট আর প্যান্ট জোগাড় হয়েছে?”
”হয়েছে।”
ব্যাংকাকা কথা বলছিলেন সরার সঙ্গে, আজকের খেলা প্রসঙ্গে। লোক লাগিয়ে জেনেছেন, কলকাতার প্লেয়াররা রি—প্লে খেলার জন্য যে টাকা চেয়েছে বিদ্যুৎপুর তা দিতে পারবে না তাই কলকাতা থেকে কেউ আসছে না। এটা রীতিমতো সুখবর। আরও বললেন তিনি রটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন কটক থেকে ওড়িশার সন্তাোষ ট্রফি প্লেয়ার সরানন্দ মহাপাত্র তারকেশ্বরে মানতের চুল দিতে এসেছিল, ওখানকার এক পাণ্ডাকে ধরে তিনি সরানন্দকে বোলতায় এনে ফেলেছেন। আজ সে বি এস সি—র স্ট্রাইকার খেলবে।
কলাবতীদের দেখে ব্যাংকাকা বললেন, ”সরার মা যা বলল তা আমি ওকে বলেছি। মোটরবাইক আর যখন আসেনি মনে হয় আর আসবে না। কিন্তু বিপদের সম্ভাবনাটা তো রয়েই গেল।”
”তা তো রইলই।” সরার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
চিন্তিত মুখে কলাবতী বলল, ”অত টাকা বাড়িতে রাখাটাও তো বিপজ্জনক। বাড়িও তো খুব শক্তপোক্ত নয়। যে—কোনওদিন ডাকাতি হয়ে যেতে পারে।”
সুশি বলল, ”ডাকাতরা এখন যা সাহসী হয়েছে, কলকাতায় দিনের বেলা ভিড় বাসেও ডাকাতি হচ্ছে, ভিড় ট্রেনে গুলি করে দিব্যি পালিয়ে যাচ্ছে।” বলতে বলতে সে শিউরে উঠল। ”দরজার যা অবস্থা দেখলুম একটা টোকা দিলেই ভেঙে পড়বে। তারপর বাক্স ভেঙে টাকা বার করে নিতে দু’মিনিট।” সে দুটো আঙুল তুলে দেখাল।
”টাকা পাওয়া অত সোজা নয়।” সরা তাচ্ছিল্যভরে বলল। ”ব্রাদার্সের টাকা পলিথিনের চারটে ব্যাগে মুড়ে মা পেছনের ডোবায় ইট বেঁধে ডুবিয়ে রেখেছে।”
”আর শ্যামপুকুরের টাকা?” কলাবতী উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।
”তারও ব্যবস্থা হয়েছে। রান্নাঘরের মাচায় চেলাকাঠের ভেতর থলেয় ভরে অ্যাটাচিটা রাখা আছে। ডাকাতের বাবাও খুঁজে পাবে না।” সরার দু’চোখে চাপা গর্ব। ”বুদ্ধিটা আমারই।”
”যাক, ডাকাতরা তা হলে খুঁজে পাবে না।” কলাবতী হাঁফ ছাড়ল। ”কিন্তু তুমি বাঁচবে কী করে? শ্যামপুকুর বলছে তুমি তাদের। ব্রাদার্সও ক্লেম করছে। এই টানাপোড়েনে তুমি তো কোনওদিকেই যেতে পারবে না।”
সরা মুষড়ে পড়ল। ”একটা ক্লাবের টাকা ফিরিয়ে না দিলে এ বছরটা আমার নষ্ট হবে। আই এফ এ আমার ট্রান্সফার দেবে না। মা যে কী সর্বনাশ আমার করতে বসেছে তা জানে না।” সরা মাথা নিচু করে দু’হাতে কপাল চেপে ধরল।
ঘরের সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল সরার মানসিক যন্ত্রণা দেখে। কলাবতী ফিসফিস করে সুশির কানে কয়েকটা কথা বলে সরাকে বলল, ”তুমি এই নিয়ে আর ভেবো না, আজকের ম্যাচটা খোলা মনে খেলে দাও। টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যাপারটা আমি দেখছি। পতিত ভটচাযের ফোন নম্বর আর ঠিকানাটা দাও। উনি করেন কী?”
”হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট।”
”তাই নাকি! আমার কাকাও তো হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। সরানন্দ মহাপাত্র, এবার ম্যাচের কথা ভাবো। সুশি, আয় তো একটু কথা আছে।” কলাবতীর সঙ্গে সুশি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দোতলায় শোওয়ার ঘরে এসে কলাবতী বলল, ”আবার সেই স্কুল স্পোর্টসের গো অ্যাজ ইউ লাইকের মতো ব্যাপারটা করলে কেমন হয় বল তো? সেদিন গুণ্ডা সেজেছিলুম, এবার ডাকাত। বিখ্যাত মেকআপ ম্যান রাঙাদাকে দরকার, আর ঘন্টুকেও।”
ভ্যাবাচাকা খেয়ে সুশি বলল, ”তার মানে!”
”বলছি।”
কলাবতী বুঝিয়ে বলতে শুরু করল।
.
* * *
যত ভিড় হওয়ার কথা তার দ্বিগুণ ভিড় হয়েছে বোলতায় ফুটবল মাঠে শুধু ওড়িশার সরানন্দকে দেখার জন্য। ব্যাংকাকার কেরামতি আছে, সকালে কয়েক ঘণ্টা সাইকেল রিকশায় মাইক আর চোঙা দিয়ে যে প্রচার তিনি ক্লাবের দুটি ছেলেকে দিয়ে চালিয়েছেন তাতেই দর্শকসংখ্যা হাজারতিনেক বেড়ে প্রায় ছ’হাজারে পৌঁছে গেছে। এটা বোলতার মাঠের রেকর্ড।
খেলা শুরুর দশ মিনিট আগে একটা বেডকভারে মাথা আর শরীর মুড়ে সরা পৌঁছল ক্লাবঘরে। ড্রেস করে বুট পায়ে দিতে গিয়ে ঝামেলা হল। বুটটা ছোট। বুড়ো আঙুল দুটো কুঁকড়ে গুটিয়ে না রাখলে জুতোর মধ্যে পায়ের পাতা ছড়ানো যাচ্ছে না। কী করা যায়। ভূদেব খেটো একজনকে ডেকে বললেন, ”দৌড়ে ফণী চাটুজ্যের বাড়িতে যা। বুটের বুড়ো আঙুলের জায়গা দুটো বঁটি দিয়ে এক্ষুনি কেটে নিয়ে আয়।” রেফারি তখন মাঠে টিম নামার জন্য হুইসল বাজাচ্ছেন।
যার বুট ধার করা হয়েছে সে বেঁকে বসল। বুট সে কাটতে দেবে না। ব্যাংকাকা আর ভূদেব একান্তে ছোট্ট একটা বৈঠক সেরে তাকে জানিয়ে দিলেন, নতুন বুট কিনে দেওয়া হবে। বিদ্যুৎপুর টিম মাঠে নেমে পড়েছে। রেফারি ঘন—ঘন হুইসল দিচ্ছেন বি এস সি—কে মাঠে নামার জন্য কিন্তু নামবে কী করে, সরানন্দের কাটা বুট তখনও যে ফিরে আসেনি।