টিচাররা দৌড়বেন, কিংবা, বলা ভাল, মাথায় সরা নিয়ে হাঁটবেন, অতএব মেয়েরা প্রবল উৎসাহে স্টার্টিং লাইনের কাছে ভিড় করে দাঁড়াল। কিন্তু প্রতিযোগীরা অনুপস্থিত।
অ্যামপ্লিফায়ারে আবার অনুরোধ হল যাকে বিদীর্ণ হলোও বলা যায় : ”আবার অনুরোধ করা হচ্ছে…” ইত্যাদি।
”বড়দি, কেউ তো আসছে না।”
বিপন্ন মুখে অসীমা দত্ত বললেন। হেডমিস্ট্রেস ভীতমুখে তাকালেন সভাপতির দিকে। গোটা পনেরো সার্টিফিকেটে সই করা তখনও বাকি। এঞ্জিনের পিস্টনের মতো কলম চালাতে চালাতে সভাপতি মুখ না তুলেই বললেন, ”এক্ষেত্রে পাবলিক অর্থাৎ ছাত্রীদের হাতে রেসের ব্যবস্থাটা তুলে দিন। ওরাই টিচারদের টেনে নিয়ে দাঁড় করাবে। আপনি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসে যেতে হবে।”
হেডমিস্ট্রেস অসীমা দত্তর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকালেন।
”বুঝেছি।” এই বলে অসীমা দত্ত মেয়েদের ভিড়ের দিকে হনহনিয়ে এগিয়ে গেলেন।
মিনিট দুই পরেই দেখা গেল টিচাররা যেখানে জটলা করে আলাদা দাঁড়িয়ে ছিলেন, অন্তত জনা কুড়ি ছাত্রী সেদিকে হইহই করে ছুটে যাচ্ছে।
”রেবাদি, আপনাকে ছুটতেই হবে।”
”অন্নপূর্ণাদি, নামতেই হবে।… আপনার ছোটা আজ দেখব।”
”না, না, কোনো কথা শুনব না আমরা, সেদিন ক্লাসে আপনি যে বললেন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন!”
”বলেছিলাম। কিন্তু বড্ড মাথা ধরেছে…”
”ধরুক মাথা, এইটুকু তো দৌড়বেন।”
মেয়েরা টিচারদের ঘিরে হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। একটু দূরে ননীগোপালবাবু আর বসন্তবাবু মিটমিট করে হাসছেন। মেয়েদের কলরব তখন কোলাহলে পৌঁছে গেছে। কী করে ওরা যেন জানতে পেরেছে, মেয়ে টিচাররা রেস বয়কট করেছেন। হঠাৎ একটি ছাত্রী মুঠোকরা হাত আকাশের দিকে তুলে চিৎকার করল : ”আমাদের দাবি মানতে হবে, দিদিদের রেসে নামতে হবে।”
সঙ্গে—সঙ্গে আর একজন চিৎকার করল: ”ব্যালান্স রেস, ব্যালান্স রেস।” জনা দশেক মেয়ে একসঙ্গে বলল: ”হবেই শেষ, হবেই শেষ।”
”ব্যালান্স রেস বয়কট…”
”মানছি না, মানব না।”
”কাঁকুড়গাছি উচ্চচ মাধ্যমিক…”
”জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।”
এই সময় হঠাৎ অ্যামপ্লিফায়ার আর্তনাদ করে উঠল : ”গো অ্যাজ ইউ লাইকের প্রতিযোগীরা, তোমরা এবার শামিয়ানার সামনে এসো। তোমাদের প্রতিযোগিতা শুরু হচ্ছে।”
মেয়ে টিচাররা এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করছিলেন। হঠাৎ সাত আটজন একসঙ্গে এগিয়ে গেলেন স্টার্টিং লাইনের দিকে। ছাত্রীরা স্লোগান বন্ধ রেখে হইহই করে তাদের সঙ্গ নিল।
দুই পুরুষ টিচারের সঙ্গে সাতজন মেয়ে টিচার মাথায় এক হাতে সরা ধরে স্টার্টারের হুইসলের অপেক্ষায়। রেস শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সরাধরা হাতটা নামিয়ে ওঁরা এগোবেন।
সারা মাঠে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা। ছাত্রীরা, সংখ্যায় প্রায় দেড়শো, তাদের সঙ্গে আসা বাড়ির লোকেদের ধরলে দুশো—কথা বন্ধ রেখে স্টার্টিং লাইনের দিকে তাকিয়ে। সভাপতি সই করা বন্ধ রেখে ফিসফিসিয়ে বললেন, ”আপনার স্কুলের মেয়েরা খুবই প্রগতিশীল।”
হেডমিস্ট্রেস মাথা হেলিয়ে আরো ফিসফিস করে তৃপ্তকণ্ঠে বললেন, ”কাল ওরা ছুটি চেয়েছে, ভাবছি দু—দিন দেব।”
হুইসল বাজল। মেয়েদের কণ্ঠ থেকে ”হা আ আ” একটা শব্দ পার্কের এবং আশপাশের কাক পায়রা চড়াইদের চমকে দিয়ে আকাশের দিকে উঠে গেল।
রেস শুরু হয়ে গেছে। পনেরো মিটার যাবার পরই অঘটন। চার ফুট দশ ইঞ্চির এবং পঁচাত্তর কিলোগ্রামের, সংস্কৃতের অন্নপূর্ণা পাইন কীভাবে যেন হোঁচট খেয়ে ননীগোপালবাবুর পিঠের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। দুজনের মাথা থেকে সরা তো ছিটকে গেলই, পিঠের উপর পঁচাত্তর কিলোর বোঝা নিয়ে জমি থেকে উঠতে গিয়ে ননীগোপালবাবুর ডান হাতের কবজিটাও মুচকে গেল।
বসন্তবাবু চমৎকার ব্যালান্সে সরা মাথায় রেখে দু—হাত পাশে ছড়িয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর সামনে ছিলেন আরতি ঘটক এবং তিরিশ মিটারের মাথায় তাঁর সরা পড়ে যাবার উপক্রম হতেই হাত দিয়ে সরা ধরে ফেলে বাতিল হয়েছেন। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির ও পঞ্চাশ কিলোগ্রামের ভূগোলের ব্রততী বেদজ্ঞ, যিনি ঠিক বসন্তবাবুর পিছনেই আসছেন, হঠাৎ তাঁর পদক্ষেপ দীর্ঘ করলেন। আর পায়ে পা জড়িয়ে বসন্তবাবু টলে পড়তে পড়তে সামলে নিয়ে দেখলেন সরাটা মাথা থেকে মাটিতে পড়ে চার টুকরো হয়ে গেল। ফিনিশং লাইন থেকে তখন তিনি সাত—আট মিটার দূরে।
রাগে ক্ষোভে বসন্তবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ”ফাউল, ফাউল… ব্রততী আমারে ল্যাং মারসে। আমি প্রোটেস্ট করত্যাসি। দিস ইজ আনফেয়ার।”
”চোওপ, প্রোটেস্ট ফ্রোটেস্ট আবার কী… ল্যাং মেরেচে তো বেশ করেচে।”
প্রায় দুশো জোড়া চোখ বিস্ফারিত, দুশো হৃৎপিণ্ড কণ্ঠনালিতে আটকানো অবস্থায় দেখল ছিপছিপে পাতলা গড়নের একটি শ্যামলা রঙের ছেলে, চোখে কালো কাচের চশমা, মাথায় হলদে কাপড়ের টুপি—সাধারণত তাসা নাচের ছেলেরা যা পরে, টুপির তলায় কিছু চুল ঝুলে রয়েছে ঘাড় আর কানের উপর। শরীর ঢেকে ঢলঢলে ফুলহাতা লাল জামা আর জিনস। চিবুক ঢেকে হালকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা পাতলা মুখের গড়নকে কিছুটা ভারিক্কি করে তুলেছে। পরিষ্কার এক মস্তান। পার্কের দুধারেই বস্তি, সম্ভবত সেখান থেকেই উদ্ভূত। কোমরে হাত রেখে পা ফাঁক করে ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকেই বোঝা যায়, হিন্দি ফিল্মের পোকা। বাঁ হাতে শিখদের মত একটি লোহার বালা।