কলাবতী বলল, ”এখানে তো বল নেই, তা হলে ট্রায়াল দিয়ে দেখা যেত।”
সরা ডান দিক থেকে উঁচু হয়ে আসা একটা কাল্পনিক বল বাঁ দিকের গোলের দিকে হেড করার জন্য লাফিয়ে উঠে বাঁ দিকে সজোরে মাথাটা ঝটকা দিয়ে ঘোরাল। মাথা থেকে পরচুলটা ছিটকে উড়ে গেল। লুফে নিল কলাবতী।
মাথা নেড়ে সরা বলল, ”চলবে না। একদম অচল। শেষে মাঠের মধ্যে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”
কলাবতী বলল, ”তা হলে দাড়িটা—”
”একদম নয়। কেউ যদি দাড়ি টেনে দেয়?” সরা ভ্রূ তুলে বলল।
”তা হলে ভুরু দুটো—” রাঙাদা ক্ষুরটা বাগিয়ে এগোল।
পিছিয়ে গিয়ে সরা বলল, ”আমি তো বলেইছি ক্ষুর আর শরীরে ঠেকাতে দোব না। এই ন্যাড়া মাথা নিয়েই কটকের প্লেয়ার হয়ে নামব। যতদিন না ভালমতো চুল গজায় একটা টুপি পরতে হবে। হ্যাঁ রে ঘন্টু আছে কিছু? আর আমায় পরার মতো কিছু এনে দে, খালি গায়ে আর কতক্ষণ থাকব।”
ঘন্টু বলল, ”বাড়ি গিয়ে দেখছি, আমার মাপের প্যান্টশার্ট হয়ে যাবে বোধ হয়।”
”আর কলাবতী, কালই কিন্তু বাবার সঙ্গে দেখা করে টাকাটা শ্যামাপুকুরের ব্রজদাকে ফেরত দিয়ে কোর্ট পেপারটা ফিরিয়ে আনতে বোলো। এই হয়েছে এক যন্ত্রণা। টোকেনটা ঠিকমতো রেখে দিয়েছতো?
কলাবতী বলল, ”রেখেছি। ফাইনাল খেলার পর পাবে।”
”সে কী!” সরা প্রায় চিৎকার করে উঠল। ”কথা ছিল একটা মার্চ, শুধু সেমিফাইনালটা। এখন বলছ ফাইনালের পর?”
”বংশীবদন না পেলে কলেজ হওয়া আটকে যেতে পারে। এখানকার লোকজন এখন মেতে রয়েছে এই শিল্ড নিয়ে। বোলতার টুর্নামেন্ট কিন্তু বোলতা একবারও জেতেনি। তুমি যদি জিতিয়ে দাও এরা তা হলে এত খুশি হবে যে কেউ আর জমিটায় কলেজ করতে আপত্তি করবে না। তুমি জানো না, শিবমন্দিরের সামনের জমিটা সুশিরা দান করতে চেয়েছিল কলেজ করার জন্য। ভূত আছে বলে এখানকার বহু লোকের আপত্তিতে জমিটা নিতে সাহস করেননি কলেজ কমিটি। ভূতের বাসা যে ওখানে নেই তা তো কমিটির চেয়ারম্যান ভূদেবজ্যাঠা নিজেই দেখেছেন। পাতালঘরে রাত কাটিয়ে তুমি তা প্রমাণও করে দিয়েছ। এখানকার কেউ এখনও সেটা জানে না কিন্তু জানিয়ে দিতে হবে। তুমিই তা নিজের মুখে জানাবে।…প্লিজ সরা একটা ভাল কাজ করো। যে অন্যায় করেছ তার প্রায়শ্চিত্ত হবে।” মৃদু গম্ভীরস্বরে ধীরে—ধীরে কথাগুলো বলে কলাবতী হাতজোড় করে সরার দিকে তাকিয়ে রইল।
সরা মুখ নিচু করে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে মুখ তুলে বলল, ”ঠিক আছে, আমি দুটো ম্যাচই খেলব, অবশ্য যদি সেমিফাইনালটা জিততে পারি। ঘন্টু একজোড়া বুট কারও কাছ থেকে চেয়ে এনে দে আর শর্টস।”
ঘন্টু বলল, ”কাল সকালেই পেয়ে যাবি।”
.
পরদিন সকালে ঘন্টু আর ব্যাংকাকার সঙ্গে সুশি গেল সরাদের বাড়ি দাসপাড়ায়। রাত্রে কলাবতী সুশির সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে, সে বাইরের মেয়ে, সুশি বোলতার। এই ব্যাপারে বাইরের কারুর নাক গলানোর থেকে স্থানীয় কেউ কথা বললে সেটা বেশি গুরুত্ব পাবে। সবার কাছে ওরা শুনেছে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা একটা বড় অ্যাটাটি কেসে ভরে শ্যামপুকুরের ব্রজদা এই বোলতায় এসে তার বাবা বিরাজ দাস আর মা সুখদা অর্থাৎ সুখি দাসের হাতে দিয়ে গেছে। তখন সরা ছিল ইন্ডিয়া ক্যাম্পে সল্টলেকের সাই হস্টেলে। ব্রজদা টোকেনটা চেয়েছিল, সরা বলেছিল টোকেন ব্রাদার্সের পতিত ভটচাযের কাছে রয়ে গেছে। আসলে মিথ্যে বলেছিল, মিথ্যে ডায়েরি করেছিল, ওটা তখন তার কাছেই ছিল, এখন সেটা কলাবতীর হেফাজতে।
কলাবতী ছিপ দিয়ে নৌকোয় বসে ছিল ঘাট থেকে কিছুটা দূরে, দিঘিতে। দু’বার ছিপে টান দিয়ে একটাও মাছ পায়নি। বিরক্ত হয়ে দাঁড় বেয়ে ঘাটের দিকে আসছে, তখন সুশির ডাক সে শুনতে পেল।
”কী হল, রাজি?” নৌকো থেকে নেমে ব্যগ্র কলাবতী জানতে চাইল।
”রাজি। কোনওমতে পালিয়ে বেঁচেছি।” সুশি হাঁফ ছাড়ার ভাব দেখিয়ে বলল, ”কী একখানা মহিলা রে বাবা! বলে, ‘টাকাফাকা ফেরত হবে না। আমাদের ভয় দেখিয়ে গেছে ছোট বন্দুক দেখিয়ে বলেছে দানা খাইবে দেবে। ঠিক আছে আমরাও ঘোলের পানা খাইয়ে ছাড়ব।’…টাকা ছাড়বে না কালু। সরার বাবা মনে হল নিমরাজি কিন্তু মা একদম নয়।”
কলাবতী বলল, ”তোরা ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেছিলি?”
”ব্যাংকাকা যতটা সম্ভব বলার বলেছেন। লোকগুলো আমাদের বাড়িতে এসে সরাকে খুঁজে গেছে, ওদের সন্দেহ, সরা আমাদের বাড়িতে লুকিয়ে আছে। আমরা এখন বিপদে পড়েছি, বলে গেছে টাকা ফেরত না পেলে সরার হাঁটুতে গুলি করে চিরতরে ওর খেলার জীবন শেষ করে দেবে। ব্যাংকাকা অনেক করে বোঝাল কিন্তু সরার মা কিছুতেই বুঝবে না। দুটো ক্লাব থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে, এত টাকা ওরা হাতে পেয়ে কী রকম যেন আধাপাগল হয়ে গেছে। ছেলের হাঁটু যাবে তো যাক তবু টাকা ছাড়বে না।” সুশি একনিশ্বাসে বলে গেল।
”ওদের বাড়িতে আর আছে কে?”
”দুটো দিদি, বিয়ে হয়নি।” ঘন্টু বলল।
সুশি যোগ করল, ”বাড়িটা টালির চালের। প্লাস্টার খসে ইট বেরিয়ে পড়েছে, দু’খানা মাত্র ঘর আর একটা রক। তার মেঝেতে সিমেন্ট নেই। আমরা ভেতরে আর ঢুকিনি। সরার মা আরও কী বলল জানিস, পরের বছর ছেলে শ্যামাপুকুরে খেলবে এই টাকা তারই অ্যাডভান্স, এ বছর ছেলে খেলবে ব্রাদার্সে!”