”নিশ্চয় আছে। ছুরি, কাঁচি, ক্ষুর, ব্লেড ছাড়া বড় বড় মেকআপ ম্যানদের কি চলে? একবার কেদার রায় পালা হচ্ছে। কার্ভালো বলল পিস্তল না হলে স্টেজে নামবে না। কোথায় পিস্তল! মনে পড়ল পঞ্চাননের ছেলের হাতে যেন টয় পিস্তল দেখেছি। দৌড়ে গেলুম। একটা হজমোলার শিশি দিয়ে নিয়ে নিলুম। ওটা আর ফেরত দিইনি।” বলতে—বলতে রাঙাদা টিনের বাক্সটা খুলে একটা একবিঘত লম্বা কাঁচি আর চিরুনি বার করল। ”এবার তুমি এই চেয়ারটায় বোসো। জাস্ট টু মিনিট লাগবে।”
রাঙাদা চিরুনি দিয়ে চুল টেনে মুঠোয় ধরে কাস্তে দিয়ে ধানকাটার মতো কাঁচি চালাল। শব্দ হচ্ছে কচকচ, গোছা গোছা চুল সরার কাঁধে, বুকে ঝরে পড়তে লাগল। হাত দিয়ে ঘাড়ের কাছ থেকে একগোছা চুল তুলে চোখের সামনে ধরেই সরা চেঁচিয়ে উঠল, ”এ কি, আমার মাথা যে আপনি খালি করে দিলেন!” সে মাথায় হাত বুলিয়ে চুলের পরিমাণ মেপে প্রায় কাঁদো—কাঁদো হয়ে বলল, ”একমাস কি, এ তো এক বছরের ধাক্কায় পড়ে গেলুম।”
সুশি ফিসফিস করে কলাবতীর কানে বলল, ”কালু সর্বনাশ করেছে রে। এ কী চুলকাটা! ধানকাটার পর মাঠ যেমন দেখায় সরার মাথা তো তাই হয়ে গেছে!”
”চুপ কর। দেখার জন্য আয়না চাইলে মুশকিলে পড়ে যাব।”
রাঙাদা পরচুলটা সরার মাথায় বসাল। মাথার মাপের থেকে সেটা এখনও ছোট। রাঙাদা ঠোঁট কামড়ে একমিনিট সরার মাথার দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁচিটা তুলে নিল। আঁতকে সরার চোখদুটো বড় হয়ে উঠল। রাঙাদা সরার ডাইনে বাঁয়ে পেছনে ঘুরে ঘুরে ওর মাথাটাকে জরিপ করতে করতে বলল ”মাথাটাকে যদি ঝুনো নারকোলের সাইজে আনা যায় তা হলে—” কথা শেষ না করেই কাঁচি দিয়ে কচকচ করে কিছু চুল উচ্ছেদ করে দিল।
সরা সটান দাঁড়িয়ে উঠল। দাঁত চেপে বলল, ”আপনার কাছে আয়না আছে?”
”অবশ্যই।” রাঙাদা গর্বিত স্বরে বলল, ”বড় বড় মেকআপ ম্যানদের কাছে আয়না থাকবে না, এ কী একটা জিজ্ঞেস করা মতো কথা হল?” বাক্স থেকে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতার মাপের আয়না বার করে সরার হাতে দিল। মাথাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আয়নায় দেখতে সরার চোখ জলে ভরে উঠল।
কলাবতী ফিসফিস করে বলল, ”সুশি, এবার কেটে পড়।”
কেটে পড়ার আগেই সরা দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গর্জন করল, ”এই, তোমরা দু’জন আমার এই সর্বনাশটা করালে। তোমাদের জন্যই আমার মাথাটা গেল।”
”আহহা, রাগছ কেন, মাথাটা তো তোমার অনেক আগেই গেছে। এখন ওটাকে বাঁচাবার চেষ্টা চলছে।” সুশি সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলল।
”কী এমন খারাপ দেখাচ্ছে! চমৎকার মাথা। আরও ভাল দেখাবে যদি ন্যাড়া হয়ে যাও, তা হলে পরচুলটাও ফিট করবে, তাই না রাঙাদা?”
কলাবতীর পরামর্শে ঝকঝক করে উঠল রাঙাদার চোখ। ”নিশ্চয় নিশ্চয়। ন্যাড়া হলে দারুণ খুলে যাবে মাথার রূপ। পরচুলটাও এঁটে যাবে।”
কলাবতী জানতে চাইল, ”আপনার কাছে ক্ষুর আছে?”
”কী যে বলো, বড় বড় মেকআপ ম্যানদের—”। রাঙাদা বাক্স থেকে একটা ক্ষুর বার করল। ”জল আনো, মাথাটা ভেজাতে হবে।”
সুশি ছুটল জল আনতে। সরা আয়নায় বারবার মাথাটা দেখে বুঝে গেল, চুলের এই অবস্থা দেখলে লোকে হাসবে, পাগল বলবে। তার থেকে ন্যাড়া হয়ে যাওয়াই ভাল। তবু এত যত্নে তৈরি করা চুলের শোভা এভাবে ধ্বংস হলে মন খারাপ না হয়ে যায় না। সরা যারপরনাই মনমরা হয়ে পড়ল।
সরার মুখের করুণ অবস্থা দেখে কলাবতী বলল, ”দুঃখ হচ্ছে? আরে পৃথিবীর সবথেকে দামি ব্রাজিলের রোনাল্ডোও তো ন্যাড়া, টিভিতে ওর খেলা দ্যাখোনি?”
”দেখেছি, কার সঙ্গে কার তুলনা করছ। আমি ন্যাড়া হলে কি রোনাল্ডো হয়ে যাব?”
”খানিকটা তো হয়ে যাবে। কলকাতার মাঠে সেটাই যথেষ্ট। ন্যাড়া রোনাল্ডো পঞ্চাশ কোটি পেলে, ন্যাড়া স্বরাজ পাঁচ লাখ তো পেতেই পারে।”
রাঙাদা ক্ষুরে শান দিচ্ছিল। সুশি জগভর্তি জল এনে সরার মাথায় ঢেলে দিল। সরা ভয়ে ভয়ে বলল, ”আপনি ক্ষুর চালাতে জানেন তো?”
”কী যে বলো। মেকআপ ম্যানদের ক্ষুর ব্লেড কাঁচি—” বলতে বলতে রাঙাদা কাজ শুরু করে দিল। মিনিটদশেকের মধ্যেই সরার মাথা সাফ হয়ে গেল। আয়নাটা মুখের সামনে ধরে বিড় বিড় করে সরা বলল, ”সত্যিই পাপ করেছিলুম তা নইলে কি আজ এই অবস্থা হয়!”
”আচ্ছা কালু, সরাকে পরচুল পরাবার আর দরকার কী? এই তো দিব্যি ওকে অচেনা লাগছে।” সুশি দু’পা পিছিয়ে চোখ দুটো সরু করে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলল।
”কিন্তু আমি তো এখনও ওকে চিনতে পারছি। আমার কাকা একবার বলেছিল ভুরু কামিয়ে দিলে মানুষকে নাকি একদম চেনা যায় না। ক্রিমিনালরা লোকের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য তাই করে। এজন্যই ভুরু কামানো লোক দেখলেই পুলিশ সঙ্গে—সঙ্গে অ্যারেস্ট করে। অবশ্য সরাকে করবে না। এখন থেকে তো ও ইন্ডিয়ার রোনাল্ডো, কে ওকে অ্যারেস্ট করবে!”
সরা চোখ পিটপিট করে কলাবতীর কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ”তুমিই হচ্ছ পালের গোদা। যত বদবুদ্ধি বেরোয় তোমার মাথা থেকেই। চুল গেছে, এবার ভুরু দুটোকেও লোপাট করাতে চাও। এই বলে দিচ্ছি, আর একটা কথাও আর আমি শুনব না, তাতে যদি দানা খেতে হয় খাব।…এই যে দাদা, পরচুলটা মাথায় আঁটুন তো।”
রাঙাদা পরচুল সরার মাথায় টেনেটুনে বসাল। কিন্তু ঠিকমতো আঁটল না, সামান্য ছোট হয়েছে। সরা হাত দিয়ে চেপে বসাবার চেষ্টা করতে—করতে বলল, ”হেড করতে পারব তো?”