সুশি এবার জুড়ে দিল, ”তা ছাড়া তোমার ভোলটাও একটু পালটে দিলে চট করে ওরা চিনতে পারবে না, এমনকী, বোলতার জনগণও নয়। তারা তো বলতে গেলে তোমাকে দেখেইনি শুধু নামটাই শুনেছে। আমরা রটিয়ে দোব কটক থেকে প্লেয়ার আনিয়েছি, দু—চারটে ওড়িয়া কথা বলতে পারবে তো?”
”দারুণ বুদ্ধি তো তোদের।” ভূদেব আপ্লুত মুখে বললেন, ”বাবা স্বরাজ, আর তুমি আপত্তি কোরো না।”
”করবে না জ্যাঠামশাই, ও খুব বাধ্য ছেলে, আপনার মতো বয়স্ক লোকের অনুরোধ ও ফেলবে না। তা ছাড়া আমি তো ওর বাড়িতে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করে বলব শ্যামাপুকুরের অ্যাডভান্সটা ফিরিয়ে দিতে। সেটা ফিরিয়ে দিলে সরার হাঁটু নিশ্চিন্ত হয়ে যাবে। অবশ্য শ্যামপুকুর নিতে রাজি হবে কি না জানি না। থানায় ডায়েরি করে বলেছে টোকেন হারিয়ে গেছে, আবার খবরের কাগজের লোককে বলেছে শ্যামপুকুর জোর করে ওকে দিয়ে মিথ্যে ডায়েরি করিয়েছে, এতে তো শ্যামপুকুরের লোকেরা খেপে রয়েছেই।”
”বাবা স্বরাজ, তোমার মতো এমন কীর্তিমান অকুতোভয় ছেলে সামান্য ওই চারটে লোকের ভয়ে মাঠে নামবে না তাই কি হয়?”
ভূদেব সরার পিঠে হাত বুলোলেন। সরা মাথা নামিয়ে বসে ছিল। তার মুখে অনুশোচনা। মুখ তুলে সে কলাবতীকে বলল, ”টোকেনটা ফেরত দেবে তো?”
”দোব।”
.
স্নান করে, পেটভরে ভাত আর সুশির ধরা মাছগুলোর ঝোল খেয়ে সরা চার ঘণ্টা টানা ঘুমোল। ওকে ব্যাংকাকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাত্রে আস্ত একটা মুরগির রোস্ট খাওয়াবেন। ঘুম থেকে সে যখন উঠল তখন ভয় অনেকটা কেটে গেছে। এখন সে এইটুকু অন্তত বুঝেছে যে—পরিস্থিতিতে সে পড়েছিল সেটা অতটা বিপজ্জনক অবস্থায় আর নেই। শ্যামপুকুরের লোকেরা আর বোধ হয় তাকে খুঁজতে আসবে না। তবু সাবধানে থাকতে হবে। এই বাড়ির লোকেরা, বিশেষত মেয়ে দুটি তার বন্ধুই, তার ভাল করতেই চায়, তবে বড্ড চিমটি কেটে কথা বলে। কী আর করা যাবে, যে—কাজ সে করে ফেলেছে তাতে সারা দেশে যদি ছ্যা ছ্যা পড়ে যায় তাতে মাথা নিচু করে থাকা ছাড়া আর কী সে করতে পারে! তবে ওই কালো লম্বা মেয়েটার একটা কথা তার মাথায় খটখট করে গাঁট্টা মেরে চলেছে—’তুমি তো ফুটবলার হতে চাও না, টাকা কামাতে চাও।’ একটা মেয়ের মুখে এমন কথা শুনলে লজ্জা করে।
ইতিমধ্যে কলাবতী ঘন্টুর সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করে ফেলেছে সরার ভোল পালটানোর ব্যাপারে কী করা যায়। ঘন্টুই বুদ্ধিটা দিল। ”ওকে পরচুলা পরিয়ে গোঁফদাড়ি লাগিয়ে খেলতে নামালে কেমন হয়। আমাদের এখানে ‘বোলতার চাক’ নামে একটা নাটকের দল আছে। রাঙাদা আমার খুড়তুতো দাদা, সে ওই চাকের মেকআপ ম্যান। ওর কাছে মেকআপের জিনিস আছে। রাঙাদাকে বললেই করে দেবে।”
শুনেই তো কলাবতী প্রায় লাফিয়ে উঠল। ”ঠিক হ্যায়। লাগাও মেকআপ।” বলে সে সুশির পিঠে একটা কিল মেরে বসল। ঘন্টু ছুটল রাঙাদার কাছে। কলাবতী বৈঠকখানা ঘরে এসে সরাকে বলল, ”ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমাকে মেকআপ নিতে হবে।”
কথাটা সরার মাথায় ঢুকতে আধ মিনিট সময় নিল। ”মেক আপ! কেন, আমায় কি যাত্রা করতে হবে?”
”প্রায় তাই।” গম্ভীর মুখে সুশি বলল, ”তোমার হাঁটুর গঙ্গাযাত্রা বন্ধ করতে তোমাকে ফুটবল যাত্রা করতে হবে। খুব সামান্য ব্যাপার, দাড়ি—গোঁফ চুল পরতে হবে। কেউ তা হলে চিনতে পারবে না, তুমি সেফ থাকবে।”
গত চব্বিশঘণ্টায় সরার মুখে এই প্রথম হাসি দেখা দিল। ”দাড়ি—গোঁফ লাগিয়ে একবার ছোটবেলায় স্কুলে থিয়েটার করেছিলুম। গোঁফটা ভীষণ সুড়সুড়ি দিচ্ছিল নাকে। এমন হেঁচে ছিলুম যে, খুলে পড়ে যায়। যদি সেরকম এবারও হয়?”
”হবে না, হবে না।” কলাবতী ওকে আশ্বস্ত করল। ”রাঙাদার একটা স্পেশ্যাল আঠা আছে। গোঁফ—দাড়ি এমন এঁটে থাকবে যে, কম করে তিনদিন তেলে চুবিয়ে রাখলে তবেই তোলা যাবে।”
”তিনদিন! আমার দাড়ি গোঁফ থাকবে? না আমি মেকআপ নোব না।”
তাড়াতাড়ি সুশি বলল, ”কালু ভুল বলেছে। তিনদিন নয় ঘণ্টাতিনেক জম্পেশ হয়ে এঁটে থাকবে। তুমি পারবে না তিনঘণ্টা চুল, দাড়ি—গোঁফ সহ্য করতে?”
সরা মাথা নেড়ে যেতে থাকল, ওরাও তাকে বুঝিয়ে যেতে লাগল যতক্ষণ না রাঙাদা হাতে একটা টিনের ছোট্ট বাক্স আর একটা পরচুল নিয়ে হাজির হল। খ্যাংরাকাঠির মতো দেহ, পুরু কাচের চশমা, ধুতির ওপর বুশশার্ট পরা রাঙাদার বয়স তিরিশ না পঁয়তাল্লিশ বোঝা যায় না।
”পরচুল নিয়ে কী ঝামেলা রে বাবা।” ঘন্টু হাঁফ ছাড়ল। ”সবই বুড়োদের সাদা পরচুল, একটা ছিল কটা রঙের সাহেবের পার্টের জন্য। শেষকালে পাওয়া গেল একটা কালো চুল। সরা পরে দ্যাখ তো।”
সরা পরার আগেই রাঙাদা বলল, ”আমার এটা তো ছোট্ট রাজপুত্তুরের মাথায় লাগাবার জন্য। কিন্তু এর মাথাটা যে দুর্বাসার মতো বড়, তার ওপর অত লম্বা চুল, এই পরচুল তো ওর মাথায় বসবেই না।” রাঙাদার প্রবল সন্দেহ মাথা নাড়ার মধ্যে দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।
”তা হলে কী হবে?” কলাবতী হতাশ স্বরে বলল।
”কী আবার হবে। চুল কেটে মাথাটার সাইজ কমাতে হবে।” সুশি চটপট সমাধান করে দিল মাথা—সমস্যার।
”না, না, চুল আমি কাটব না।” সরা আঁতকে উঠে বসল।
”কেন কাটবে না! একমাসের মধ্যেই যেমন ছিল তেমনই হয়ে যাবে। রাঙাদা, আপনার কাছে কাঁচি আছে?”