”না।”
”কাঁচা হলুদ…”
”ওসব কিচ্ছু খাওনি।”
”কাল রাতে ইসবগুলও খাইনি তো?”
”না, তাও নয়।”
”কী ভাবে নোলা পরীক্ষা করবেন?”
”গাড়ি নিয়ে আজ বেইরেছিলেন। রয়েলের চাপ, সাবিরের রেজালা, মাধবের ঝাল আলুদ্দম, বিজলীর ফিশ ওর্লি, অম্বরের তন্দুরি চিকেন, অনাদির মোগলাই পরোটা, অমৃতের দই, নকুড়ের কড়াপাক…”
”থাম থাম।”
”আরো আছে যে…তপসে ভাজা, ভাপা ইলিশ।”
”মরে যাব উফফ, মরে যাবে।”
”সামনে থাকবে কিন্তু খাবে না, খেয়েছ কি ডাট চাট লম্বা হয়ে যাবে। তুমি কালুকে জানিয়ে দাও এখুনি।”
”এখন কী করে বাবার সামনে জানাব, আগে বলতে হয়তো, পাঁঠা কোথাকার।”
”ইশারা করে করে মানা করে দিও, কালুর খুব বুদ্ধি আছে, ধরে ফেলবে।”
সত্যশেখর পাংশু নার্ভাস অবস্থায় ফিরে এসে চেয়ারে বসল। কলাবতী জিজ্ঞাসু কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে সত্যশেখর বাবার দিকে চোখের ইশারা করে, মুখের কাছে আঙুল দিয়ে গ্রাস তুলে মাথা নেড়ে কিছু বোঝাবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, তখন রাজশেখর ছবি থেকে চোখ তুলে বেশ জোরেই হেসে উঠলেন। কলাবতী কাকার ইশারার মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে খুবই ধাঁধায় পড়ে গেল।
”মেয়েটা টিপিক্যাল হরির মতোই হয়েছে বটে। সিংগিদের কী করে জব্দ করা যায় সেটা খুব ভালোই শিখে গেছে।”
”এজন্য তো কাকাই দায়ী। কাকাই তো বড়দিকে খেপিয়ে দেয় জিভ দেখিয়ে।”
”আমি, কক্ষনো না! লাস্ট ওকে জিভ দেখিয়েছি নাইন্টিন সিক্সটি সেভেনে, বিলেতে। তারপর ওর সঙ্গে আমার দেখা এই ক্রিকেট ম্যাচে।”
এখানে আবার একটা পূর্ব কথা বলে রাখা দরকার।
সত্যশেখর আর মলয়া তাদের বাবাদের মতোই বাল্যবয়স থেকেই পরিচিত। দুজনের যত ভাব, তত ঝগড়া। অবশ্য ঝগড়ার কারণগুলোর প্রত্যেকটাই ঠিক তাদের বাবাদের মতোই বংশগত মানমর্যাদাকে কেন্দ্র করে। দুজনের দেখা হলেই ওদের মধ্যে বুনো ওলের সঙ্গে বাঘা তেঁতুলের মতো একটা সম্পর্ক দেখা দেয়। সত্যশেখরের ছোটবেলার অভ্যাস জিভ দেখিয়ে মলয়াকে রাগিয়ে দেওয়া। চুলে পাক ধরলেও সে আজও অভ্যাসটা ছাড়তে পারেনি। ব্যারিস্টার হবার জন্য সে যখন বিলেত যায়, মলয়াও তখন সেখানে শিক্ষা ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনো করতে গেছল। দুজনের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হত, এবং সাক্ষাৎগুলি অবশ্যম্ভাবী পরিণত হত ঝগড়ায়। একজন যদি বলে সূর্য পশ্চিমদিকে ওঠে তাহলে অন্যজন অবধারিত বলবে, ‘কিন্তু অস্ত যায় উত্তরে।’ দুজনে প্রায় একই সময়ে দেশে ফিরে আসে। একজন এখন প্র্যাকটিস করছে কলকাতা হাইকোর্টে আর অন্যজন কাঁকুড়গাছিতে মেয়েদের স্কুলে হেডমিস্ট্রেস এবং সেই স্কুলেই কলাবতী পড়ে। ছিপছিপে, চল্লিশের কাছাকাছি অবিবাহিতা বড়দি যে কালুকে একটু বেশিই স্নেহ করেন, এটা স্কুলের দারোয়ান থেকে টিচার্স—রুমের প্রত্যেকেই জানে।
রাজশেখর একটা ছবি তুলে বললেন, ”সতুকে যখন কাঁধে তুলে নাচছিল, তখন যে ওর জিভটা বেরিয়ে গেছল সেটা কি লক্ষ করেছিলিস কালু?”
”তখন কেমন যেন মনে হয়েছিল কাকা একবার না একবার জিভ বার করবেই। বড়দির হাতে ক্যামেরা অথচ কাকার জিভ শান্তশিষ্ট, তাই কখনো হয়।”
সত্যশেখরের হঠাৎ বিষম লাগায় দুজনে মুচকি হাসল।
”দাদু, এই ছবিটায় কি বোঝা যাচ্ছে এটা আমিই?”
রাজশেখর ঝুঁকে পড়লেন কলাবতীর হাতের ছবিটার উপর। সেই অবসরে সত্যশেখর আবার ইশারা করে বোঝাতে চাইল খাবার—দাবার সম্পর্কে খুব সাবধান, এখনি ডায়েট চার্টের প্রতিক্রিয়া জানার পরীক্ষা হবে, লোভ দমন করতে হবে। কিন্তু এবারও কলাবতী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেল।
”কালু, তোর নাকটাই যা গোলমাল করছে। গোপী ঘোষের ছেলের নাক কি এত টিকোলো?” রাজশেখর চোখ তুলে নাতনির নাক দেখতে গিয়ে ভ্রূ কোঁচকালেন। ”কালু, মুখটা অমন করে আছিস কেন, পেট কামড়াচ্ছে? বাইরে কিছু খেয়েছিস নিশ্চয়?”
”কিচ্ছু খাইনি তো, শুধু—শুধু পেট কামড়াবে কেন!”
”কালুর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে। আচ্ছা বাবা, থানকুনি পাতার রসে কি খিদে বাড়ে?”
”নিশ্চয়! তা ছাড়া পেট ঠান্ডা রাখে, অম্বল—টম্বল হয় না।”
”তাই। আমার ইদানীং যা খিদে বেড়েছে কী বলব। কাঁঠালের বিচি আর ওল—ভাতে যে এত টেস্টফুল, কচুর মুখি যে এত প্যালেটেবল, জানতামই না। বোধহয় নিমপাতা আর কাঁচা হলুদের অ্যাকশন, তাই না?”
”হতে পারে।” রাজশেখর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। ঘাড় বেঁকিয়ে তিনি দরজার দিকে তাকাতেই অপেক্ষমাণ মুরারি এগিয়ে এল।
”সব রেডি আছে, আনব কি?”
”হ্যাঁ, এদের খুব খিদে পেয়েছে মনে হচ্ছে।”
মুরারি বেরিয়ে যাবার সময় করুণভাবে একবার সত্যশেখরের দিকে তাকিয়ে গেল।
”দাদু এই ছবিটা দিয়ে কি প্রমাণ করা যাবে আমিই খেলেছি?” কলাবতী একটা ছবি তুলে শূন্যস্থান পূরণের মতো টেবলে খাবার এসে পৌঁছবার আগের সময়টা ভরাট করার জন্যই বলল।
”ডিফিকাল্ট, ভেএরি ডিফিকাল্ট। দুলু আর কালু দৈর্ঘ্যে প্রস্থে প্রায় এক। তা যদি না হত, তাহলে সেদিনই ধরা পড়ে যেত। তবে এই ছবিটা দিয়ে পতু মুখুজ্যে হয়তো জল ঘোলা করার চেষ্টা করবে। তা এখানে তো একজন আইনজানা লোক রয়েছে, সে কী বলে?”
রাজশেখর ভ্রূ তুলে ব্যারিস্টার ছেলের দিকে ট্যারা চোখে তাকালেন।
সত্যশেখর দু’বার কেসে বাঁ হাতের তর্জনী দিয়ে কপালে টোকা মারতে মারতে প্রচণ্ড গম্ভীর হবার জন্য বারো সেকেন্ড সময় নিল।