”আমাদের স্কুলের বড়দি, হেডমিস্ট্রেস মলয়া মুখার্জি।”
”হুঁ উ উ…হরিশঙ্করের মেয়ে?”
”হ্যাঁ।”
এখানে এবার কিছু পূর্বকথা জানিয়ে রাখা দরকার। হুগলি জেলায় আটঘরা আর বকদিঘি নামে পাশাপাশি দুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম আছে। দুই গ্রামের দুই জমিদার—বংশ সিংহ ও মুখুজ্যেদের মধ্যে আকচাআকচি প্রবল। সামান্য বা অসামান্য সব ব্যাপারেই উভয়ের মধ্যে রেষারেষি। জমিদারি প্রথা উঠে যাবার পর সেটা কেন্দ্রীভূত হয়েছে দুই গ্রামের মধ্যে বছরে একবার একটি ক্রিকেট ম্যাচকে উপলক্ষ করে। মহা ধুমধামে দুর্গোৎসবের মতো এই বাৎসরিক ম্যাচ হয়। এক মাস আগে থেকেই দুই গ্রামের ছেলে—বুড়ো—মেয়ে পুরুষ টেনশ্যনে ভুগতে শুরু করে। প্রতিবার এই খেলায় একটা—না—একটা ঝঞ্ঝাট বাধেই, আর তাই নিয়ে হুলুস্থুলু পড়ে যায়।
আটঘরার জমিদারবাড়ির নাতনি কলাবতী বাংলার মেয়ে ক্রিকেট দলে খেলে। খুবই সম্ভাবনাময় ব্যাটসউওম্যান, টেস্টম্যাচ খেলার জন্য যে ডাক পাবেই তাতে সন্দেহ নেই। ওর খুবই ইচ্ছে, এবং রাজশেখরেরও, এই বাৎসরিক ম্যাচে খেলার। কিন্তু বকদিঘির অধিনায়ক পতু মুখুজ্যে সাফ জানিয়ে দেয়, কোনো মেয়েকে এই ম্যাচে তারা খেলতে দেবে না।
প্রাক্তন এম পি এবং বর্তমানে এম এল এ গোপীনাথ ঘোষের ছেলে ব্রজদুলাল ওরফে দুলু গতবারের ম্যাচে আটঘরা দলে ছিল। খেলা শুরুর ঠিক আগে কলাবতীর পরামর্শে দুলু ‘হঠাৎ’ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে ড্রেসিংরুমে শুয়ে থাকে। তার হয়ে ফিল্ড করে সাবস্টিটিউট হাবু ময়রার ছেলে বিশু। কিন্তু ব্যাটিংয়ের সময়, হাতে মাত্র দুটি উইকেট নিয়ে জয়ের জন্য আটঘরার যখন ১৭ রান দরকার, তখন ম্যালেরিয়ায় কাহিল দুলু ব্যাট হাতে নামে ফুলহাতা সোয়েটারে, মাফলারে এবং পানামা টুপিতে এমন ভাবে নিজেকে ঢাকাঢুকি দিয়ে যে, নাক আর চোখ দুটি ছাড়া তার আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। দুলুর ব্যাটিংই শেষ পর্যন্ত যখন জয় এনে দেয় তখন নন—স্ট্রাইকার ছিলেন ১১ রানে অপরাজিত রাজশেখর।
তবে এই জয়ে সত্যশেখরেরও অবদান ছিল। তেরোটি ওভারবাউন্ডারি মেরে আচমকা একটা সেঞ্চুরি করে ফেলে সে রীতিমতো নার্ভাস হয়ে যায়। আটঘরার জনতা মাঠের মধ্যে নেমে এসে তাকে কাঁধে তুলে নাচানাচি করে—এই বাৎসরিকীতে আগে কেউ সেঞ্চুরি করেনি। সুতরাং সেঞ্চুরিটি ঐতিহাসিক।
একটা বল হুক করার সময় দুলুর মাথা থেকে পানামা টুপিটা পড়ে গেছল। ফিল্ডাররা সবাই তখন বলের দিকে তাকিয়ে। সেই অবসরে দ্রুত টুপিটা কুড়িয়ে সে মাথায় পরে নেয়। বকদিঘি শিবিরে দর্শকদের মধ্যে ছিল হরিশঙ্কর এবং নিত্যসঙ্গী নিক্কন ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে মলয়া। বহু ছবি সে ম্যাচ চলার সময় মাঠের চারপাশ ঘুরে—ঘুরে তোলে। বিশেষ করে সত্যশেখর ও ব্যাটসম্যান দুলুর।
ম্যাচশেষে পতু মুখুজ্যে আটঘরা শিবিরে এসে রাজশেখর সিংগির নাতনির খোঁজ করেছিল। কিন্তু কলাবতীকে পাওয়া যায়নি। তবে ড্রেসিংরুমে আপাদমস্তক মুড়ি দেওয়া ম্যালেরিয়ায় কাহিল দুলুকে কোঁকোঁ আওয়াজ করে কাঁপতে দেখা গেছল। পতু মুখুজ্যেকে অবশ্য বেশি কথা বলতে দেয়নি আটঘরা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান পটল হালদার। তবে পতু বলে গেছল সে ছবি দিয়ে প্রমাণ করে দেবে, গোপী ঘোষের ছেলে দুলুর বদলে রাজশেখর সিংগির নাতনি কালু ব্যাট করেছে। পটল হালদার তখনই ঘোষণা করে সত্যশেখরের সেঞ্চুরিকে স্মরণীয় করে রাখতে সে একটা স্তম্ভ গড়ে দেবে।
রাজশেখর রুটি পরীক্ষা শেষ করে মুচকি হেসে বললেন, ”কীসের ছবি?…তুই ব্যাট করেছিলি তারই প্রমাণ?”
কলাবতী ঘাড় নাড়ল। দেয়াল—ঘড়িতে দশটা বাজছে। সত্যশেখর একতলা থেকে এইসময় উঠে এল। রাজশেখরের শেষ কথাটি কানে যাওয়ায় কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করল, ”প্রমাণ! কীসের প্রমাণ?”
কলাবতী খামটা থেকে একগোছা রঙিন ছবি বার করল। কয়েকটা দিল দাদুকে, কয়েকটা কাকাকে।
”হরির মেয়ের হাত দেখছি খুবই পাকা, ছবিগুলো ভালোই এসেছে।” রাজশেখরের চোখে তারিফ ফুটে উঠল। রুটিতে যতটা মনোযোগ দিয়েছিলেন, ছবিগুলোয় ততটাই দিলেন।
”হাত পাকা হবে না কেন, বিলেতেই তো ক্যামেরা কিনে শুরু করে। এতদিনে হাত পাকবে না!” সত্যশেখর হাতের ছবিগুলো টেবলে সাজিয়ে রাখল। এইসময় বারান্দার দিকের দরজায় মুরারির মুখ উঁকি দিতে দেখা গেল। সত্যশেখরের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সে হাত নাড়ছে।
”কাকা, এই ছবিটা কেমন?”
কলাবতী একটা ছবি নিজের মুখের কাছে ধরল। সত্যশেখর ছবি দেখার জন্য মুখ তুলতেই সে চোখের ইশারায় মুরারিকে দেখিয়ে দিল। সত্যশেখর তাকাতেই মুরারির হাতছানি দেখে বোঝা গেল জরুরি কিছু বলার আছে।
”ওহহো, দেখেছ, ড্রয়ারে চাবি দিয়ে আসতে ভুলে গেছি।”
সত্যশেখর ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দার অন্ধকার কোনায় গিয়ে সে বলল, ”কী হল, ডাকছিস কেন?”
”বলতে একদমই ভুলে গেছি, আজ সকালে তোমাকে কালমেঘ দিইনি, কত্তাবাবু বারণ করিছে। মাঝে—মধ্যে সব বন্ধ থাকবে। ডাট চাট অনুযায়ী খাওয়া দাওয়া হঠাৎ বন্ধ রেখে কত্তাবাবু পরীক্ষা করবেন, তোমাদের খাওয়ার বহর কমিছে কি না, তোমাদের নোলা ঠিকঠাক তৈরি হইছে কিনা।”
”আজ সকালে তাহলে আমাকে কালমেঘের রস দিসনি? মানে খাইনি? বইটি www.boiRboi.blogspot.com থেকে ডাউনলোডকৃত।