”না না,, চায়ে আমার খুব একটা আসক্তি নেই।” বলতে বলতে সত্যশেখর প্রায় দৌড়ে চলে গেল।
”কালমেঘ দারুণ লাগে আমার।” কলাবতী এমনভাবে জিভে আওয়াজ করল যেন সর্ষে দিয়ে কাঁচা আমবাটা নাকের সামনে ধরা হয়েছে।
রাজশেখরের দুটি চোখ ঝকঝক করে উঠল। ছ’ফুটের দশাসই কাঠামোটা টানটান করে পেটে আলতো কয়েকটা চাপড় মেরে বললেন, ”পেটই হচ্ছে স্বাস্থ্যের মূল ঘাঁটি। এটাকে জোরালো রাখতে হলে একটা রেজিমেন্টকে যে রকম ডিসিপ্লিন্ড হতে হয় সেই রকম হতে হবে খাওয়ায়। কালমেঘ, চিরেতা, ব্রাহ্মি শাক, ত্রিফলা এসব হচ্ছে বাংলার নিজস্ব জিনিস। ছোটবেলায় মা খাওয়াতেন, দ্যাখ আজও কেমন শরীরটা রয়েছে। সতুটা দিনদিন পেটুক হয়ে যাচ্ছে, শুনেছি কাঁচাগোল্লা খেতে নাকি মছলন্দপুর গেছল।”
সত্যশেখর সত্যিই গেছল এবং কলাবতীর জন্য প্রায় আধকিলো কাঁচাগোল্লা এনে দিয়েছিল। আর কলাবতীর কাছ থেকে ভাগ পেয়েছিল মুরারি। কিন্তু এ খবর তো দাদুর অজানা থাকারই কথা, তাই সে মনে মনে সাবধান হয়ে গেল।
”সত্যিই কাঁচাগোল্লা খুব বাজে জিনিস। লাখ টাকা দিলেও আমি খাব না। দাদুকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কলাবতী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খুঁজতে লাগল মুরারিকে। দোতলায় উঠোনের বারান্দা থেকে সে দেখতে পেল, মুরারি একটা গ্লাসের উপর রেকাবি বসিয়ে কাকার চেম্বারের দিকে যাচ্ছে। এক নজরে সে চিনতে পারল রেকাবিতে কলা, শশা, কমলালেবু, আঙুর আর গ্লাসে বোধহয় বেলের পানা।
”মুরারিদা, দাদু জানল কী করে কাকার কাঁচাগোল্লা খাওয়ার কথা?”
সত্যশেখর ভীতিগ্রস্ত চাহনির নীচে রেকাবি আর গ্লাসটা টেবলে রেখে মুরারি ভারিক্কি চালে ”এগুলো শেষ করো” বলে যখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, সেই সময় কলাবতী উত্তেজিত হয়ে চেম্বারে ঢুকল।
”তুমি বিট্রে করেছ।”
মুরারি আকাশ থেকে পড়ল। দু’হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে কাঁদো—কাঁদো গলায় বলল, ”মা কালীর দিব্যি, আমি কিচ্ছুটি বলিনি। বিশ্বাস করো, কত্তাবাবুকে আমি…”
”হুমম।”
সত্যশেখর টেবলে যে ঘুঁষিটা বসাল, তাতে মহম্মদ আলি নকআউট হয়ে যেতে পারে।
”এবার বুঝলুম কে আমার সম্পর্কে বাবার কাছে লাগায়। মুরারি…” সত্যশেখর রক্ত জল করা হুঙ্কার দিল চাপা গলায়, ”পরশু তোকে পাঁচ টাকা দিয়েছিলুম ফেলুর দোকান থেকে রাধাবল্লভী আনতে। দশটার বদলে পেয়েছি আটটা, বাকি দুটো কী হল? পয়সা মেরেছিস না খেয়েছিস? মালাই বরফওলাকে ও—মাসের জন্য দিতে হবে বলে বাষট্টি টাকা নিয়েছিস অথচ আমার হিসেবে হচ্ছে বাহান্ন টাকা। কী ভেবেছিস আমাকে? গোরু ভেড়া না মন্ত্রী? বাবাকে এবার বলে দেব, নির্ঘাত বলে দেব।”
”ছোড়দা, তাহলে মরে যাব।”
মুরারির চোখ দিয়ে টপটপ জল ঝরতে শুরু করল।
”কাঁদলে কী হবে, এবার দাদুকে বলে তোমারও ডায়েট চার্ট করাব, কালমেঘের রস, চিরেতার জল, গিমে শাক, ব্রাহ্মীশাক…।”
”এই কান মুলছি, এই নাক খত দিচ্ছি…”
মুরারি কুঁজো হয়ে টেবলের এক ধার থেকে অন্য ধার পর্যন্ত নাক ঘষড়ে গেল।
”কত্তাবাবুর সামনে মিথ্যে বলতে কেমন ভয় ভয় করে। তবু তো রেখে ঢেকে বলি, নইলে তুমি যে চেম্বারে মক্কেল বসিয়ে রেখে রাস্তায় গিয়ে মালাই বরফ খাও, তা কি কখনো বলেছি?”
”বলবি কী করে, তুইও তো আমার সঙ্গে খাস।”
”কাকা তো চেম্বারে, বরফওলাকে ডেকে আনে কে?”
”আমি।”
আসামি অপরাধ কবুল করেছে, জজ এবার কী রায় দেবেন! এমন একটা কৌতূহলী ভঙ্গিতে কলাবতী তাকাল কাকার দিকে। সত্যশেখর রিভলভিং চেয়ারে ডাইনে—বাঁয়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে ”হুমম…হুমম” শব্দ করে যেতে লাগল চোখ বুজে।
”ছোড়দা, নিত্যানন্দে আটটার পর আর কিন্তু জিলিপি ভাজে না, শিঙাড়া সাড়ে আটটা পর্যন্ত।”
সত্যশেখর চোখ খুলে দেয়াল—ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ”অ্যাঁ, তাই তো”, বলেই ড্রয়ার থেকে মানিব্যাগ বার করল।
”কত দেব?”
”কালুও রয়েছে, টাকা দশেকই দাও। নরম বোঁদেও যদি দেখি…।”
টাকা নিয়ে মুরারি বেরিয়ে যাচ্ছিল, কালু হাত ধরে টানল।
”এগুলো কী হবে?”
”ঠিক মুরারি, এই কলা, শশা, বেলের পানা…সক্কালবেলায় এসব কী হবে?”
বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে মুরারি গ্লাস তুলে চোঁ—চোঁ করে বেলের পানা খেয়ে ফেলল।
”ওগুলো এখানেই থাক, পরে এসে খেয়ে নেব।”
”না, এখুনি তোকে খেতে হবে।”
মুরারি কথা না—বাড়িয়ে মিনিট তিনেকের মধ্যে সব ফল কচমচ করে খেয়ে ফেলে রেকাবি আর গ্লাসটা নিয়ে বেরিয়ে গেল।
একটু পরে রাজশেখর নাতনির কাছ থেকে জানলেন তাঁর ছেলে গোগ্রাসে সব ফল খেয়েছে আর এক চুমুকে বেলের পানা।
”ভাতের সঙ্গে উচ্ছে আর পেঁপে—সেদ্ধ, নিম—বেগুন, তারপর সুক্তো, মাগুর কিংবা শিঙ্গির ঝোল হবে মশলা ছাড়া, আনাজের খোসা একদম ছাড়ানো চলবে না। আর কম্পালসারি শাক, ডাঁটা, কচু কিংবা ওল কিংবা থোড় বা মোচা, বিচে কাঁচকলা, মাসকড়াই, গাজর, এইসবের একটা তরকারি আর টক দই। ভাজাভুজি একদম বন্ধ। একমাস পর দেখবি ডায়েট চার্ট ফলো করে লোহা চিবিয়ে তোরা হজম করে ফেলছিস।”
এ তো বিশ্বনাথের ইনিংস!
একমাস পর সেদিন রাত্রে কলাবতী খাওয়ার টেবলে এলে বড় একটা খাম হাতে। রাজশেখর তখন চারখানি রুটি নিজের প্লেটে রাখছিলেন।
”মলয়াদি কতকগুলো ছবি দিলেন তোমায় দেখাবার জন্য।”
”কে মলয়া?” রাজশেখর গভীর মনোযোগে রুটিগুলোর প্রতি—মিলিমিটার যথোপযুক্ত সেঁকা হয়েছে কিনা পরীক্ষা করতে করতে অন্যমনস্কের মতো জানতে চাইলেন। অবশ্য মলয়াকে তিনি খুব ভালোই চেনেন।