সত্যশেখর প্রবলভাবে প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছিল, কিন্তু বাবার কঠিন দৃষ্টি তাকে ম্রিয়মাণ করে দিল, কেননা রাজশেখর একটুও মিথ্যে বলেননি।
”উফফ, এই সব বদভ্যাস এখনও ছাড়তে পারলে না। আজেবাজে রেস্তোরাঁয় নিশ্চয় চপ—কাটলেট গেলো?”
সত্যশেখর টেবিলের দিকে চোখ নামিয়ে চুপ।
”পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স তো হয়ে গেছে, এবার একটু স্বাস্থ্যের দিকে নজর দাও। খাওয়া দাওয়া রেস্ট্রিক্টেড করো, ব্যায়াম—টায়াম তো জীবনে করোনি…সেদিন কে যেন বলল, বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি থামিয়ে তুমি নাকি শর্মার দোকানে ঢুকেছিলে?”
”মাত্র আড়াইশো গ্রাম রাবড়ি…”
”মাত্র হল! উফফ…ওই আড়াইশো গ্রাম হজম করতে কমপক্ষে আড়াই মাইল দৌড়নো দরকার।”
”আমার ওজন লাস্ট টেন ইয়ার্স একই আছে, সত্তর কেজি।” প্রায় বিদ্রোহ করার ভঙ্গিতে সত্যশেখর বলল।
”গুড, ভেরি গুড।”
রাজশেখর কাগজে আরও কিছু লিখে নিয়ে বললেন, ”ডায়েট চার্ট করে দোব, তাই ফলো করবে এবার থেকে।”
এরপর তিনি কলাবতীকে প্রশ্ন শুরু করেন।
”রাত বারোটা—একটা পর্যন্ত রোজ ঘরে আলো জ্বলে। তার মানে গল্পের বই। সকালে মাইল তিনেক দৌড়, টায়ার্ড অবস্থায় পড়ার টেবিলে মিনিট পনেরো, স্কুলে ঘণ্টা ছয়—সাত, বিকেলে জলে সাঁতারের নাম করে ঘণ্টাখানেক কাটানো, কিম্বা জুডো না ক্যারাটে কি যেন বলে, তাই শেখা, তারপর মাস্টারমশায়ের সামনে ঘণ্টা দুই বসে ঢুলুনি, এছাড়া…”
কলাবতী আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু হাত তুলে ‘ব্যস, ব্যস’ বলে উঠতেই সত্যশেখর গম্ভীর মুখে বলল, ”কালুর জন্যও ডায়াট চার্ট দরকার।”
রাজশেখর দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলেন, ”তিনজনের জন্যই চার্ট হবে। খাওয়া একটা গুরুতর ব্যাপার। ঠিকমতো, ঠিক সময়ে, ঠিক পরিমাণ না হলে শরীরের জোর কমে যায়, রোগ জন্মায়। তাছাড়া রান্নার মতো ভোজনও একটা শিল্পকলা, দেখার মতো একটা জিনিস। যখন তখন হাবিজাবি এটা ওটা গেলা, ফেলে ছড়িয়ে পাতটাকে নোংরা করা। আগেরটা পরে পরেরটা আগে খাওয়া, আঙুলগুলোকে সাজিয়ে বাটি থেকে খাবার তোলা, থালায় মাখা, মেপে হাঁ করা, গ্রাস মুখে দেওয়া, তারপর চিবোনো, আহ, দেখার মতো এসব ব্যাপার…এইজন্যই তো লোকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়।”
রাজশেখর যতক্ষণ কথা বলে যাচ্ছিলেন, সত্যশেখর আর কলাবতী তার মধ্যে চোখাচোখি করে মুচকি হেসেছিল। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে প্রায়ই উনি নানান বাতিকের মধ্যে ঢুকে পড়েন, আর হাতের কাছে যাদেরই পান নাজেহাল করে ছাড়েন। কলাবতীর মায়ের অকালমৃত্যু এবং কলাবতীর বাবা দিব্যশেখর সন্ন্যাস নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়া তাঁকে যথেষ্ট আঘাত দিয়েছিল। এরপর তিনি নাতনিকে আশ্রয় করে নিজের জন্যে আলাদা একটা জগৎ বানিয়ে ক্রমশই ছেলেমানুষ হয়ে যেতে থাকেন। বাবার বেদনা আর নিঃসঙ্গতা বুঝে সত্যশেখর তালে তাল দিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে যায়। বিরাট বাড়িতে ছেলে আর নাতনি ছাড়া ঝি, চাকর, বামুন নিয়েই তাঁকে দিন কাটাতে হয়। তিনি যে এককালের দোর্দণ্ড আটঘরার জমিদারদের বংশধর, এটা কখনও ভোলেন না এবং তাঁর রাশভারিত্ব ও আভিজাত্য থেকে কখনও টলেন না।
সত্যশেখর ও কলাবতী নিজেদের মধ্যে মুচকি হাসার তিন দিন পরেই ডায়াট চার্ট অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে যায়।
সকালে খবরের কাগজে চোখ রেখে সত্যশেখর হাত বাড়িয়ে মুরারির কাছ থেকে চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক দিয়েই চেয়ার থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।
”থানকুনি পাতার রস।”
মুরারির শান্ত সাদামাটা মুখে বা কণ্ঠস্বরে কোনোরকমে বিকার ফুটল না ছোড়দার লাফ দিয়ে দাঁড়ানো বা ‘ওয়াক ওয়াক’ করতে দেখে। মুরারি এ বাড়িতে আছে আটত্রিশ বছর। ব্যাপার স্যাপার বোঝে।
”রাস্কেল, এই কি চা?”
”না, এটা চা নয়। চা আসবে কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, ভিজে ছোলা—আদার পর, অবিশ্যি কর্তাবাবু যদি মনে করেন।”
”মনে করেন মানে?”
”এসব খেয়ে তোমার কেমন লাগল, কেমন ব্যাভার করলে, সেসব আমার কাছ থেকে শুনে তারপর ঠিক করবেন চা না দুধ না কালমেঘের রস, কোনটা দেওয়া হবে।”
সত্যশেখরের চোখে জল এসে গেল। মুরারির দুটো হাত চেপে ধরে শুধু বলল, ”আমাকে বাঁচা।”
কলাবতীর হাতে থানকুনি রসের কাপ তুলে দিয়ে মুরারি পিরামিডের স্ফিঙ্কসের মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। গন্ধটা বারদুয়েক শুঁকে রসে আঙুল ডুবিয়ে কলাবতী জিভে ঠেকায়।
”উমম, টেস্টটা খুব খারাপ নয়। মুরারিদা, এই বস্তুটি কাকা খেয়েছে?”
”অদ্ধেক।”
কলাবতী এক ঢোঁকে রসটা খেয়ে নিল।
”দাদু খেয়েছে?”
”সবার আগে।”
কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, ছোলা—আদা পর্ব শেষ হবার পর, রাজশেখর দুজনকে ডেকে পাঠালেন, এবং হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, ‘সপ্লেন্ডিড। ভাবতেই পারিনি তোরা এত সিরিয়াস হবি হেলথ সম্পর্কে। এই তো চাই। একটা ডায়েট চার্ট করছি। সকাল থেকে রাতের খাওয়া চার্ট অনুযায়ী চলবে। কম খাবি, কিন্তু আসল জিনিসটা খাবি। এই যে চা খাওয়া, এতে কী লাভ। বরং বেলের পানা খাও।”
”অ্যাঁ, পানা!…বাবা, সাতটায় আমার মক্কেল আসার কথা আছে, আজ আর্লি আওয়ারেই হেয়ারিং হবে, তাই…।”
”তাহলে যাও। মুরারি চেম্বারে ফল আর দুধ দিয়ে আসবে’খন।”
”চা দেবে না?”
চা শব্দটা রাজশেখর যেন এই প্রথম শুনলেন এমনভাবে দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বললেন, ”কালমেঘের রস খুব উপকারী, চায়ের পর ওটা খেলে হজমে খুব সাহায্য করে।”