এক্সপ্রেস বোলারের চোখে এবার ভয়ের আভাস। ফিল্ডাররা ত্রস্ত। পতু মুখুজ্জে দিশাহারা। নয়জন ফিল্ডার বাউণ্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে গেল তার নির্দেশে। গোপী ঘোষের ছেলে আবার হিহি করে কাঁপছে।
এক্সপ্রেস ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে বল ছাড়ল। একেবারে মাথা লক্ষ করে ফুলটুস। রাজশেখর চোখ বন্ধ করে ফেললেন। মাঠের অনেক জায়গায় ইশশ শব্দ উঠল শিহরন জানিয়ে। কিন্তু ব্যাটসম্যান স্থির, অচঞ্চল। সে ব্যাটটাকে পাখায় বাতাস করার মতো মুখের সামনে ছোট্ট করে নাড়ল। বলটা মিড উইকেটের দিকে আকাশে উঠতে উঠতে বাউণ্ডারি যখন পেরিয়ে যাচ্ছে, এবং সবাই যখন মুখ তুলে হাঁ করে বলের উড়াল দেখছে, তখন গোপী ঘোষের ছেলে তীরবেগে নীল শামিয়ানার দিকে ছুটতে শুরু করল এবং তাকে কাঁধে তুলে নেবার জন্য যারা তাকে তাড়া করেছিল, তাদের পিছনে ফেলে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেল।
পটল হালদার দু’হাত ছড়িয়ে উচ্ছ্বসিত ভিড়ের সামনে বা বন্যার সামনে বাঁধের মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন।
”অসুস্থ। ছেলেটির ম্যালেরিয়া হয়েছে, ওকে আপনারা বিশ্রাম করতে দিন…হবে হবে, পরে ওর সংবর্ধনার ব্যবস্থা হবে…।”
মাঠ থেকে রাজশেখর ফিরে এলেন ভিড় ঠেলে। সত্যশেখর এগিয়ে এসে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে কিছু বলল। রাজশেখরের অট্টহাসিতে শামিয়ানা ভরে গেল।
”তাহলে তিন পুরুষের খেলার রেকর্ড হল।”
ভিড়ের মধ্যে পতু মুখুজ্জের গলা শোনা গেল, ”কই গোপী ঘোষের ছেলে কোথায়, একবার তাকে দেখি।”
”সে ড্রেসিংরুমে শুয়ে আছে।” পটল হালদার বুক চিতিয়ে দাঁড়াল, ”এখন তাকে বিরক্ত করা উচিত নয়।”
”বিরক্ত করব না, শুধু চেহারাটা দেখব।”
কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর পতু মুখুজ্জে ড্রেসিংরুমের পর্দা সরিয়ে উঁকি দেবার অনুমতি পেল আধ মিনিটের জন্য। পর্দা সরিয়ে সে দেখল, একটা আলোয়ানে আপাদমস্তক ঢাকা একটা শরীর, শুধু নাকটুকু দেখা যাচ্ছে। শরীরটায় মাঝে মাঝে কাঁপুনি ধরছে। আর ”অঃ অঃ” শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথার কাছে টুপি, ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস ছড়ানো। ড্রেসিংরুমের কাপড়ের দেয়ালের তলার দিকে খানিকটা ফাঁক রয়েছে।
”রাজশেখর সিংগির নাতনি কোথায়?”
”আছে কোথাও।” পরমেশ উদাসীন ভাবে বলল। ”তাকে তো তোমরা খেলতেই দিলে না।”
পতু মুখুজ্জে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ”আমি প্রমাণ দেব সে খেলেছে। ছবি তোলা হয়েছে। প্রিন্ট হয়ে আসুক, তারপর দেখাব মজা। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সে তুলব, এম সি সি—কে চিঠি দোব…কী করে রেকর্ড হয় দেখব।”
বাইরে সেই সময় পটল হালদারের নেতৃত্বে বিজয় মিছিল থেকে আওয়াজ উঠল, ”আটঘরার সংগ্রামী ক্রিকেট…জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ…”
ডায়েট চার্ট
পেটই হচ্ছে স্বাস্থ্যের মূল ঘাঁটি
কলাবতী রাতে খাওয়ার টেবিলে এল বড় একটা খাম হাতে।
দাদু তখন রুটির গোছা থেকে বেছে ফোস্কা—পড়া চারখানা রুটি প্লেটে তুলে নেওয়ায় ব্যস্ত। রাতে চারখানা রুটি নিজের জন্য বরাদ্দ করেছেন সত্তর বছরে পা দেওয়ার দিন থেকে। চার বছর আগেও তিনি ষোলখানি রুটি খেতেন, যে জন্য আধ কেজি আটা দরকার হত। আটা থেকে ভুষি বাদ দেওয়ার তিনি ঘোরতর বিরোধী। ভূষিতে প্রচুর নাকি পুষ্টি আছে। বয়োবৃদ্ধি এবং খাটুনি হ্রাস, ওই দু’য়ের সঙ্গে মানিয়ে পাকযন্ত্রকে ব্যবহার করলে শরীর অবাঞ্ছিত আচরণে মন দেয় না, আয়ুও বাড়ে, এইরকম একটা ধারণা রাজশেখর সিংহ চিরকালই পোষণ করে আসছেন। আর সেইজন্যই পুত্র সত্যশেখর এবং নাতনি কলাবতীর খাদ্যের পরিমাণ কতটা হবে সেটা তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। দু’জনের জন্য কতটা ক্যালরি শরীরে দিলে কর্মক্ষমতা সতেজ থাকবে এবং চর্বি জমবে না, সে—সব তিনি নানান বইপত্র পড়ে এবং নামকরা এক খাদ্যবিশারদের সঙ্গে পরামর্শ করে (খাদ্যবিশারদকে ৬৪ টাকা ফি দিয়েছিলেন) ঠিক করে দিয়েছেন।
এজন্য তিনি ছেলে ও নাতনিকে জেরাও করেছিলেন। যেমন:
রাজশেখর: সতু, সারাদিনে তুমি কতক্ষণ চেয়ারে বসে কাটাও, কতটা পথ চলাফেরা করো, আর কতক্ষণ বিছানায় শুয়ে কাটাও?
সত্যশেখর হকচকিয়ে তারপর আমতা—আমতা করতেই রাজশেখর ধমক দিয়ে ওঠেন, ”অত মাথা চুলকোবার কী আছে আর কড়িকাঠ গোনারই বা দরকার কী? আমিই বলে দিচ্ছি, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তুমি দশ ঘণ্টা ঘুমোও, দু’ঘণ্টা মোটরে, আর চেম্বারে মক্কেলদের সঙ্গে চেয়ারে বসে, দু’বেলায় মোট ছ’ঘণ্টা, আর হাইকোর্টে বসে কাটাও ছ’ঘণ্টা। এ ছাড়া হাঁটাচলার বা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য তোমার সারাদিনে সময় যায় এক ঘণ্টা। কেমন, ঠিক বলেছি?
সত্যশেখর অসহায়ভাবে ভাইঝি কলাবতীর দিকে তাকিয়ে বলল, ”কালু আমি কি দশঘণ্টা ঘুমোই?”
কলাবতী গম্ভীরমুখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ”দাদুর হিসেবে একটু ভুল হয়ে গেছে। চব্বিশ ঘণ্টায় শোয়া—বসা—চলার যে হিসেব তুমি দিলে, সেটা যোগ করলে হয় পঁচিশ ঘণ্টা।”
”অ্যাঁ, পঁচিশ। বেশ তাহলে চেম্বার থেকে একঘণ্টা কমিয়ে দিচ্ছি।”
”আমি তো রোজই ঘুমোতে যাই এগারোটায় আর মুরারির কাছ থেকে খবরের কাগজ নিই ভোর ছ’টায়, বারান্দায় চা খেতে খেতে রোজই তো দেখি, তুমি আর কালু জগ করতে করতে ফিরছ। সাত ঘণ্টার বেশি আমি ঘুমোই না।”
রাজশেখর টেবিলে রাখা কাগজে কী যেন লিখে নিলেন। তারপর গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন, ”আলুকাবলি আর ফুচকা এখনও তুমি খাও, ঠিক কিনা? ঘুগনি? তাও নিশ্চয়?…ব্যস ব্যস, তর্ক করতে যেও না, গত বুধবার মুরারিকে দিয়ে কী কিনে আনিয়ে চেম্বারে বসে গপ গপ করে খেয়েছিলে তা কি আমি জানি না?”