”বোধহয় হাঁড়িতে কয়েকটা এখনো রয়েছে, দাঁড়াও দেখছি।”
এক মিনিটের মধ্যে কলাবতী হাঁড়ি এনে বেঞ্চের নীচে রাখল।
”গোটা পনেরো আছে। ওদিকে মুখ করে শুয়ে হাত বাড়িয়ে একটা একটা করে তুলবে, কেউ যেন টের না পায়, কেমন?” এই বলে কলাবতী ড্রেসিংরুমের একটা কোণের কাপড় তুলে হামা দিয়ে বেরিয়ে সবার অলক্ষ্যে চলে গেল পিছনে রাখা তাদের ফিয়াট গাড়ির দিকে।
পতু মুখুজ্জে কটমট করে হরিশ কর্মকারের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে দু—চারটে কথা বলার পরই আটঘরার ইনিংস ১৪৪—২ থেকে ১৫৮—৮ হয়ে গেল তিন ওভারের মধ্যে। সত্যশেখর ১০৪ আর চণ্ডী কম্পাউন্ডার ৩১ রানে ফিরে আসে স্টাম্পড ও রান আউট হয়ে। পা দিয়ে একটা স্নিক থামিয়ে গাঁটে চোট পাওয়ায় রানার নিয়ে ব্যাট করতে নামলেন রাজশেখর। তাঁর নিখুঁত কেতাবি স্টান্স, ব্যাট তুলে বল ছেড়ে দেওয়া, এগিয়ে—পিছিয়ে ডিফেন্স করা, প্রতি বল লাইনে গিয়ে খেলা দেখে মাঠে হঠাৎ গাম্ভীর্য নেমে এল। দারোগাবাবু এবং ব্যাঙ্ক—ম্যানেজার রান আউট হলেন ১৫৮ রানের সময়। ব্যাট করতে বাকি হেডমাস্টার আর গোপী ঘোষের ছেলে।
রাজশেখর ১১ রানে ক্রিজে। দুটি গ্লান্স ও একটি লেটকাট থেকে পাওয়া রান। দারোগাবাবু আউট হয়ে চলে যাবার সময় তিনি বলে দিলেন, ”আর সতেরো রান জিততে, ছেলেটাকে নামাতেই হবে।”
”ভাববেন না স্যার, আঠারো বছর পুলিশে আছি, কী করে নামাতে হয়…”
কিন্তু দারোগাবাবু বাউন্ডারি লাইন পেরোবার আগেই দেখা গেল গোপী ঘোষের ছেলে ব্যাট হাতে মাঠে নামছে। ম্যালেরিয়ায় একেবারে কাহিল। ফুলহাতা সোয়েটারে, ঘাড়, গলা, চিবুক ঢাকা মাফলারে আর কপাল ঢেকে চেপে বসানো পানামা টুপিতে ছেলেটার নাক আর চোখ ছাড়া মুখের কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে ঠকঠকিয়ে কেঁপেও উঠছে।
ছেলেটি ক্রিজে আসতেই তাকে পরিস্থিতি বুঝে খেলার জন্য দু—চার কথা বলতে রাজশেখর এগিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ছেলেটি হাত তুলে তাঁকে ফিরে যাবার নির্দেশ যে—ভঙ্গিতে দিল, তাতে তিনি হকচকিয়ে ফিরে গেলেন।
ঝানু ব্যাটসম্যানের মতো ‘লেগ—মিড’ গার্ড নিয়ে বুটের ডগা দিয়ে মাটিতে আঁচড় টানল। পতু মুখুজ্জের মুখে শেয়ালের ধূর্তামি ফুটে উঠেছে। সব ফিল্ডারদের ডেকে সে উইকেট ঘিরে দাঁড় করিয়ে দিল।
এক্সপ্রেস বোলারের ওভার চলছে। বল মুঠোয় নিয়ে সে বীভৎস দৃষ্টিতে গোপী ঘোষের ছেলের দিকে তাকাচ্ছে। প্রথম বলটা পিচের মাঝামাঝি পড়ে মাথাসমান উঠল। ছেলেটি কুঁজো হয়ে মাথা সরিয়ে নিল। বকদিঘির সমর্থকদের মুখে হাসি দেখা দিল। পরের বল গুড লেংথে পড়ে অফ থেকে সরে স্টাম্পের দিকে যাচ্ছিল। ইঞ্চি দুয়েক তোলা ব্যাটটা ঝপ করে নামিয়ে দিল। বলটা ব্যাটের কিনারে লেগে স্লিপের মধ্য দিয়ে বাউন্ডারিতে গেল। জেতার জন্য আর ১৩ রান দরকার। পরের দুটো বলও অবিশ্বাস্যভাবেই গুড লেংথে পড়ল এবং ছেলেটি পিছিয়ে গিয়ে ব্যাট বুকের কাছে তুলে আটকাল। রাজশেখর তারিফ জানাতে মাথা নাড়লেন। মাঠের দু’ধার থেকে দুরকম দীর্ঘশ্বাস পড়ল—আশাভঙ্গের এবং আশাতীতের।
পরের ওভারে মালখণ্ডীর অফস্পিনগুলোকে রাজশেখর সহজেই খেলে দিলেন। তবে একটা বল ব্যাট—প্যাড হয়ে সামান্য উঠেছিল। ফরোয়ার্ড শর্ট—লেগ ঝাঁপিয়ে মাটি থেকে বল তুলে ‘হাউজ দ্যাট’ বলে। হরিশ উপরদিকে আঙুল কিছুটা তুলেছে তখন রাজশেখরের কণ্ঠ থেকে বাজ ডাকার মতো ‘নট আউট’ গর্জে উঠতেই বজ্রাহত আঙুল নিঃসাড়ে নীচে পড়ে যায়।
এক্সপ্রেস বোলার ওভার শুরু করার আগে পতুর সঙ্গে গভীর পরামর্শ করে লংলেগে আর মিড উইকেটে দুজন ফিল্ডার রাখল। গোপী ঘোষের ছেলের আবার জ্বরের কাঁপুনি দেখা দিল। বুকের কাছে মুখ নামিয়ে কুঁকড়ে হিহি করছে। বকদিঘির ফিল্ডাররা তার দিকে তাকাচ্ছে সেইভাবে, বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে যেভাবে ইঁদুরের দিকে তাকায়।
পটল হালদার চুকচুক করে সহানুভূতি জানিয়ে তখন বি ডি ও—কে বলল, ”আটঘরার জন্য জীবন বিপন্ন করেও এই যে সংগ্রাম… জানলেন, আমাকেও উদ্বুদ্ধ করছে। আমি চাঁদা তুলব, স্তম্ভ গড়ব…”
বাবার অনুপস্থিতিতে বহুক্ষণ পর সিগারেট খাওয়ার সুযোগ পেয়ে সত্যশেখর সুযোগের সদ্ব্যবহার করছিল। সে শুধু মিটিমিটি হেসে বলল, ”ও বুর্জোয়া বাড়ির ছেলে।”
প্রথম বলটা যথারীতি শর্টপিচ। গোপী ঘোষের ছেলে ডান পা অফ স্ট্যাম্পের দিকে এনে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটটা ঝলসাল আর মাথা থেকে টুপিটাও তখন পড়ে গেল। ফিল্ডাররা সবাই বলের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটি তাড়াতাড়ি টুপি কুড়িয়ে মাথায় চেপে বসাল। রাজশেখরের চোখ অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা বলতে গিয়ে ঢোঁক গিলে নিলেন।
চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে মলয়া মুখার্জি বিস্মিত কণ্ঠে পাশে—বসা বাবাকে বললেন, ”ছেলেটাকে যেন চেনাচেনা লাগছে!”
নিখুঁত হুক থেকে ছয় রান। আর দরকার সাত রান মাত্র। দ্বিতীয় বল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে, আবার শর্টপিচ। কড়াত করে রাইফেল থেকে বুলেট বেরোবার মতো আওয়াজ হল। স্কোয়্যারকাট করা বলটা নিমেষে পয়েন্ট বাউন্ডারিতে পৌঁছেছে।
দরকার আর তিন রান। ঝপ করে একটা দমবন্ধ করা থমথমে নৈঃশব্দ্য মাঠটাকে ঘিরে ফেলল। উল্লাসের ঝড় ওঠার আগের অবস্থা।