ভয়টা সত্যি হল যখন ষষ্ঠ উইকেটে অতুল মুখুজ্জে আর বিষ্টু মিশির ৩১ মিনিটে ৬৯ রান তুলল। রান আউট, স্টাম্পড, এল বি ডবলু থেকে শুরু করে হিটিং দ্য বল টোয়াইস এমন, কী হ্যান্ডলড দ্য বল—কোনো আইনেই দু’জনকে আউট দেবার সুযোগ বুদ্ধদেবস্যার পেলেন না। ওরা প্রতি বল ব্যাটে খেলেছে এবং বেলচা ও কাস্তে চালানোর মতো ব্যাট চালিয়ে বলগুলো প্রায়শই বাউন্ডারির উপর দিয়ে ফেলেছে। তাই করতে গিয়ে অবশ্য মিশিরজি তিনবার ও অতুলবাবু একবার এক্সট্রাকভার, থার্ডম্যান, লং অন ও পয়েন্ট বাউন্ডারিতে ক্যাচ দেয় এবং প্রতিবারই হাবু ময়রার ছেলে বলের নিকটতম ফিল্ডার ছিল। বস্তুত দুটি ক্যাচ তার তালু থেকে ছিটকে গেছে, একটি তার মাথা চাপা দেওয়া হাতে পড়েছে, এবং শেষেরটি তার এক হাত পিছনে পড়ে এবং সে ধরার কোনো চেষ্টাই করেনি। প্রথম স্লিপ থেকে রাজশেখর বিষণ্ণ, স্তম্ভিত ও বিরক্ত হবার পর তাঁর শেষ ক্রুদ্ধ মন্তব্য দুই শামিয়ানার লোকেরাও শুনতে পায়।
”এটাকে কান ধরে বার করে দাও।” ওভার শেষে রাজশেখর বলেছিলেন।
পরমেশ কাতরস্বরে তখন বলেছিল, ”জ্যাঠামশাই, হাবুর দোকান থেকে এখনো একটা হাঁড়িও পৌঁছয়নি। আমি লক্ষ রেখেছি, হাঁড়িগুলো এলেই ওকে বসিয়ে অন্য কাউকে নামাব।”
ষষ্ঠ উইকেট জুটি ভেঙেছিল রাজশেখরের বলে। পাক্কা সাড়ে সাত মিনিট ধরে তিনি ফিল্ড সাজিয়ে এবং না ছুটে শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়েই বল করেন। প্রথম বলটি তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে উঠতে শুরু করে। বলের ওড়া দেখতে দেখতে অতুল মুখুজ্জের মুখ আকাশমুখো হয়ে যায় এবং বল তাঁর টাক লক্ষ করে অবতরণ করায় তিনি আত্মরক্ষার জন্য পিছিয়ে যেতে যেতে হিট উইকেট হন। নবাগত ব্যাটসম্যান একটা লেগবাই নেয়, যখন বলটা তাঁর পিঠের উপর পড়ে ফাইন লেগের দিকে যায়। মিশিরজি পরের বলেই উইকেটকিপারের পিছনে ওভার বাউন্ডারি মারার জন্য সিলি পয়েন্টের কাছে সরে গিয়ে ব্যাট চালায় এবং ফশকায়। বেলের উপর বল পড়ায় একটা বেল দু টুকরো হয়ে যায়।
ফিল্ডাররা ছুটে এসে রাজশেখরকে ঘিরে নানাভাবে বিস্ময়, প্রশংসা, উল্লাস জানায়। সত্যশেখর উত্তেজিত হয়ে বাবার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে পিঠও চাপড়ে দেয়। তিনি সারা মুখে স্মিতহাসি ছড়িয়ে শুধু বলেন, ”তেত্রিশ বছর পর বল করলুম।” তারপর হলুদ শামিয়ানার দিকে মুখ করে ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মাথার উপর তুলে ধরেন।
মুকুন্দ মালখণ্ডি রাজশেখরের পরের ওভারে পাঁচটি ওভার বাউন্ডারি মারায় তিনি নিজের উপর জবরদস্ত ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে আর বল করেননি। বকদিঘির সর্বোচ্চচ রান করেছিল ‘অতিরিক্ত’ মশাই। ৪৩ রানের অতিরিক্তে বাই ছিল ৩৯। স্থানীয়দের মতে বকু বোসের জীবনে এটাই তার সেরা কিপিং।
বুদ্ধদেবস্যারের অবিমৃশ্যকারিতাজনিত আশঙ্কা সত্যে পরিণত হল লাঞ্চের পর। আটঘরা প্রথম ওভারেই চারটি উইকেট হারাল এক রানে। চারটিই এল বি. ডবলু। তার মধ্যে একটি বল ভুবন সিঙ্গির কপালে, আর দুটি ফুল টস অফ স্ট্যাম্পের দু’ফুট বাইরে ছিল। চতুর্থটির ক্ষেত্রে বল শুধু প্যাড ‘ঘেঁষে’ ছয় ইঞ্চি বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেছল। আশ্চর্যের ব্যাপার, এরপরও স্কুলের বেঞ্চগুলো অক্ষত রইল।
বকদিঘির স্থায়ী আম্পায়ার হরিশ কর্মকার একবার শুধু ভ্রূ তুলে বুদ্ধুস্যারের দিকে তাকিয়ে ওভার শেষে স্কোয়্যার লেগে যাবার সময় মুচকি হাসে। কোথা থেকে এক ফাস্ট বোলার আনিয়েছে বকদিঘি (অবশ্যই খেলার কোয়ালিফিকেশন আছে), যার ছোটার এবং বলের গতি এক্সপ্রেস ট্রেনের মতো, তার তিন ওভারে একটি বল গুড লেংথে এবং উইকেট—সোজা পড়ে।
সত্যশেখর ওপেন করে শূন্য রানে নট আউট ছিল। চণ্ডী কমপাউন্ডার ক্রিজে আসার পরই দুজনে মিলে ৩০ ওভারে ঝড়ের মতো রান নিয়ে গেল ১৪৪—এ। বিষ্টু মিশির আর অতুল মুখুজ্জের স্ট্রোকগুলি একত্র করেই সত্যশেখর স্ট্রোক দিয়ে গেল। বল্লমের মতো ব্যাট চালিয়ে বোলারের মাথার উপর দিয়ে ত্রয়োদশতম ছয়টি নিয়ে সে ১০৪—এ পৌঁছয়।
উল্লাসে ভেঙে পড়ল মাঠ। পিলপিল করে লোক ছুটল মাঠের মধ্যে। সত্যশেখরকে কাঁধে তুলে নাচানাচি হল। তখন, কলাবতী দূর থেকেও দেখতে পেল, কাকার জিবটা হলদে শামিয়ানা লক্ষ করে বারচারেক বেরিয়ে এল। কলাবতীর চোখ পড়ল, বড়দি তার বাবার পাশে সামনের সারিতেই বসে। ক্যামেরাটা চোখের কাছে ধরা।
পটল হালদার উত্তেজিত হয়ে বলল, ”হিস্ট্রিতে এই প্রথম আটঘরার পক্ষে শত রান… আমার প্রধানত্বে এত বড় ব্যাপার ঘটল, কালই পঞ্চায়েত মিটিং ডাকব, চাঁদা তুলব, শত রান স্তম্ভ তৈরি হবে, উদ্বোধন করাব পূর্তমন্ত্রীকে দিয়ে, সংবর্ধনা দোব, মিছিল বেরোবে…”
”এখন খরা চলছে রে পটলা।” ভিড়ের মধ্য থেকে কে একজন ফোড়ন কাটল।
”হোক খরা… সে তো বহুবার হয়েছে, আবার হবে, কিন্তু এই শত রান, এই সেঞ্চুরি হয়তো এই সেঞ্চুরিতে আর ঘটবে না।” পটল হালদার উদ্দীপনায় সংগ্রামী ভঙ্গিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়াল।
গোপীনাথ ঘোষের ছেলে হইচই হট্টগোলে ড্রেসিংরুম থেকে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। কলাবতী ছুটে গিয়ে তাকে ঠেলে ভিতরে পাঠাল।
”করছ কী, ম্যালেরিয়া না তোমার?”
”সেই কোন সকালে খেয়েছি আর তোমরা তো লাঞ্চে রসগোল্লা খেলে।”