শামিয়ানার নীচ থেকে প্লেয়াররা মাঠে যাবে শতরঞ্চের উপর দিয়ে। অনেকে চেয়েছিল ডেকরেটরের কাছ থেকে গালিচা ভাড়া করে আনতে। কিন্তু পঞ্চায়েতপ্রধান পটল হালদারের আপত্তিতে তা আর হয়নি। তার বক্তব্য ছিল : দেশে মর্মান্তিক খরা চলছে, এখন বিলাসিতার সময় নয়।
শতরঞ্চের দু’ধারে সারি সারি বেঞ্চ পাতা। আটঘরা হায়ার সেকেণ্ডারি স্কুল থেকে, পঞ্চাশ টাকা ‘কশান মানি’ জমা দিয়ে সেগুলো আনা হয়েছে। গত বছর বকদিঘির আম্পায়ার এক ওভারেই চারজন আটঘরিয়াকে রান আউট দেওয়ায় যে কাণ্ড ঘটে, তাতে বেঞ্চ মেরামত করতে স্কুলের বিশ টাকা খরচ হয়ে যায়। এবার বেঞ্চ দিতে স্কুল রাজি হয়নি, কিন্তু পঞ্চায়েতপ্রধানের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তে তা সম্ভব হয়েছে। তবে পরমেশের কাছে তিনি আড়ালে বলে রেখেছেন, সোফা ছাড়া আর কোথাও তিনি বসবেন না।
বেঞ্চে ঠাসাঠাসি দর্শক, তার তিন ভাগই গিন্নিবান্নি আর কুচোকাঁচা। যাত্রা দেখতে গিয়ে বসার জায়গা নিয়ে যে ঠেলাঠেলি, চিৎকার, ঝগড়া হয়, সেইরকমই হচ্ছে। দুই রঙের কাগজের শিকল জড়াজড়ি করে মালার মতো মাঠটাকে ঘিরে রয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান, যাকে আড়ালে বহু লোকই ‘পটল প্রধান’ বলে থাকে, তার নির্দেশে দুই গ্রামের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের লড়াকু মোর্চা বজায় রাখতেই মাঠকে এই মাল্যদান। অ্যামপ্লিফায়ারে গতবছর ‘ডিসকো’ গান বাজানো হয়েছিল। পটল প্রধান সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘অপসংস্কৃতি’ আর চলবে না। দুই শামিয়ানার মাথায় লাগানো চোঙা থেকে এবার তাই বেরোচ্ছে ভূপেন হাজারিকা আর সুচিত্রা মিত্র।
কলাবতীর চোখে পড়ল, লম্বাচুল, তারই বয়সী তারই আকৃতির একটি ছেলে এক কোণে চেয়ারে পাংশুমুখে বসে। বারবার ঢোঁক গিলছে আর চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরছে। তার মনে হল এই বোধহয় গোপীনাথ ঘোষের ছোট ছেলে।
”নাহ, হলো না।”
কলাবতী তার পাশে এসে দাঁড়ানো পরমেশের দিকে মুখ ফেরাল।
”পতু মুখুজ্জে রাজি নয়। তিন পুরুষে খেলার রেকর্ড করতে দেবে না। অপোনেন্ট আপত্তি করলে তোমায় নামাই কী করে বলো?”
রাজশেখর টস করে ফিরে এলেন। নিখুঁত ক্রিকেটের পোশাক, মাথায় যৌবনকালের ক্যাপ আর ঋজু দেহে তাঁকে টেস্ট ক্রিকেটারের মতো দেখাচ্ছে। সারা মাঠ তাঁর দিকেই তাকিয়ে।
”ওদের ব্যাট করতে দিলুম।… উইকেটকিপার, প্যাড আপ… এগারোজন ঠিক আছে তো? … সতু কোথায়? … পরমেশ; কে আমাদের ওপেনিং বোলার, ওয়ান চেঞ্জ কে? আমায় সব মাঠে বলে দেবে।”
রাজশেখর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁকে দেখে অন্যরাও ব্যস্ত হবার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিল, এমন কী সত্যশেখরও। সেই সময় কলাবতী গিয়ে বসল গোপীনাথ ঘোষের ছেলের পাশে।
”তুমি কি আজ খেলছ?”
”হ্যাঁ… তবে…”
”তবে কী, নার্ভাস লাগছে?”
”পেটের মধ্যে কী রকম গুলোচ্ছে!”
”বমি বমি ভাব আসছে তো?”
”হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেকটা তাই।”
”তার মানে আজ তুমি ক্যাচ ফেলবে। ইজি সিটার মিস করবে।” কলাবতী নিশ্চিতস্বরে বলল। ”আজ তুমি নির্ঘাত পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়ে বকদিঘিকে গোটা দশেক বাউণ্ডারি পাইয়ে দেবে।..ওহ, লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে এক একটা রানের যা দাম! ফিল্ডিংই তো আসল ব্যাপার, আর তোমার জন্য যদি আটঘরা হেরে যায়!”
”তাহলে কী হবে?”
”গত বছরের ব্যাপার শোনোনি? লাস্ট ওভারে সিলি মিড—অন লোপ্পাই ক্যাচ ফেলে দেওয়ায় আটঘরা জেতা ম্যাচটা হেরেছে। খেলার পর এখানকার ছেলেরা সিলি মিড—অনের চুল খাবলা খাবলা করে কেটে রিকশায় চাপিয়ে সারা আটঘরা ঘুরিয়েছিল। উফফ, সে যে কী লজ্জার ব্যাপার না, তোমায় কী বলব।”
ছেলেটি আঁতকে উঠে তার সযত্নে তৈরি ‘অমিতাভ বচ্চচন’ চুলে হাত রেখে বলল, ”তাহলে?’
”তাহলে তুমি আর নেমো না, বরং ড্রেসিংরুমের বেঞ্চে গিয়ে শুয়ে পড়ো। বলবে হঠাৎ ম্যালেরিয়া ধরেছে। যাও যাও, শিগগিরি যাও। আর শোনো, এক—আধবার কোঁ কোঁ, হুঁ হুঁ শব্দ কোরো।”
”আম্পায়াররা মাঠে নেমে গেছে, হারি আপ, হারি আপ।”
উইকেটকিপার বকু বোস কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ”প্যাডের বকলেসটা ছিঁড়ে গেল নন্তুবাবু, একটা দড়িটড়ি…”
”অত জোরে টানতে গেলেন কেন… এখন কোথায় যে দড়ি পাই…”
”হারি আপ, হারি আপ।”
”ওরে, গোপী ঘোষের ছেলে যে ড্রেসিংরুমে শুয়ে ম্যালেরিয়ায় কঁকাচ্ছে, কী হবে এখন?
”টুয়েলফথম্যান কে হয়েছে?”
”সে তো হাবু ময়রার ছেলে বিশু। ডাক ডাক ওকে।”
বিশুর বেলবটম আকাশী—নীল রঙের প্যান্ট দেখেই রাজশেখর ভ্রূ কোঁচকালেন।
পরমেশ কানে কানে বলল, ”ছেড়ে দিন জ্যাঠামশাই, লাঞ্চের সন্দেশ আর দই হাবু দিচ্ছে। আমি গিয়ে ততক্ষণে অপোনেন্ট ক্যাপ্টেনের পারমিশনটা নিয়ে আসি সাবস্টিটিউট নামাচ্ছি বলে।”
পরমেশ ছুটে মাঠের মধ্য দিয়ে হলুদ শামিয়ানার দিকে চলে গেল। রাজশেখর তাঁর দল নিয়ে মাঠে নামলেন।
আড়াই ঘণ্টা পর ৪০ ওভারের শেষে বকদিঘির ইনিংস শেষ হল নয় উইকেটে ১৭৪ রানে। দুই দল নিজেদের শামিয়ানায় ফিরে গেল লাঞ্চের জন্য। বকদিঘি প্রথম পাঁচটি উইকেট হারায় ১৪ রানে—তিনটি রান আউট, দুটি স্টাম্পড।
দর্শকদের মধ্যে যাঁরা এই ম্যাচের রীতিনীতি জানেন তাঁরা আটঘরা তরফের স্থায়ী আম্পায়ার অঙ্কের শিক্ষক বুদ্ধদেবস্যারের অবিমৃশ্যকারিতায় ভয় পেলেন।
”বুদ্ধস্যার এটা কী করলেন, খেলার গোড়াতেই পাঁচটা উইকেট নিলেন! এবার বড় রান করার মতো যদি কেউ খেলে দেয়, তখন কী করবেন? তাকে কী করে আউট করবেন?”