–ঠিক আছে। আমার কাছে থাক এটা। আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখবখন!
ডন ছোঁ মেরে আধুলিটা তুলে নিয়ে ছিটকে সরে গেল। রাগী মুখ করে বলল, দিচ্ছি তোমায়! অত করে মার কাছে বকুনি খেয়ে এটা ফিরে পেলুম। এ দিয়ে ম্যাজিক করব।
পরদিন ভোরে জগিং করতে গিয়ে নদীর ধারে পোড়োমন্দির চক্কর দিচ্ছি, হঠাৎ খেয়াল হল শ্রীমান সঙ্গে নেই। ঘুরে দেখি অনেকটা দূরে খেলার মাঠে ছোট্টটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেতেই ঊ্যা করে বলল,–আধুলিটা হারিয়ে গেছে মামা!
রাগ করে বললুম,–বেশ হয়েছে হতভাগা ছেলে! আধুলি হাতে নিয়ে কেউ দৌড়ায়?
ডন আমাকে খামচে ধরে থামাল। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল,-খুঁজে দাও না মামা। আমার ম্যাজিক করা হবে না যে!
ঘাসে শিশির চকচক করছে। সূর্যটা সবে বিছানা থেকে উঠে বসে হাই তুলছে। পিটপিটে চাউনি। তার ওপর উত্তরে হাওয়ার ঠান্ডা হিম দুষ্টুমি। এমন সময় একটা আধুলি খুঁজে বের করা বড় কষ্টসাধ্য কাজ। ডনের খাতিরে তবু অনেক কষ্ট করতে হল। কিন্তু তার পাত্র পাওয়া গেল না। ডনকে বললুম,–ঠিক এখানেই পড়েছে তার মানে কী? অন্য কোথাও ফেলেছিস তাহলে।
ডন জোরের সঙ্গে বলল,–এখানেই!
কিন্তু প্রচণ্ড খুঁজেও আধুলিটা পাওয়া গেল না। কাজেই আমাদের পায়ের শব্দে রাস্তার মোড়ের অন্ধ-ভিখিরি নড়েচড়ে বসলেও তার মগে ঠকাস করে সেই মিঠে শব্দটা বাজল না। বেচারা নিশ্চয় খুব মনমরা হয়ে গেল।
মনমরা হয়ে রইল শ্রীমানও। শরীর খারাপ বলে স্কুলে গেল না। বিকেল নাগাদ ভাবলুম ছেলেটাকে চাঙ্গা করা উচিত। আমার ডাক শুনে ডন চোখ পিটপিট করতে করতে ঘরে ঢুকল। তারপর নিজের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল, কী?
ওকে টেনে আদর করে বললুম, যা হওয়ার হয়ে গেছে! ও নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। চল, বাইরে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি। মন ভালো হয়ে যাবে।
ডন ঘাড় গোঁজ করে বলল, শ্যাব–একটা আধুলি দাও, নতুন আধুলি না হলে নেব না কিন্তু।
আধুলি? –চিন্তিত হয়ে বললুম। আধুলি যদি না থাকে, সিকি হলে চলবে না?
ডন ঠোঁটের কোণায় কেমন একটু হাসল,–তোমার টেবিলের ড্রয়ার খুঁজে দ্যাখো না।
টেবিলের ড্রয়ারে খুচরো পয়সা রাখি, একথা সত্য। ডনের এ খবর জানা থাকার কথা নয়–এ বাড়ির কারুরই নয়। খুঁজতে গিয়ে পেয়েও গেলুম একটা আধুলি। এবং চকচকে আনকোরা আধুলিটা। ডনের তর সইল না, খপ করে কেড়ে নিল। তারপর উল্টে-পাল্টে দেখতে-দেখতে আচমকা এক চিল-চিকুর ছাড়ল, মামা, ও মামা! ম্যাজিক, মামা, ম্যাজিক!
অবাক হয়ে বললুম, কী রে?
সেই লাল ফুটকিটা। ডন নাচতে নাচতে বলল, আমার আধুলি। আমার আধুলি। দ্যাখো, দ্যাখো!
হাঁ করে তাকিয়ে ছিলুম। ওর হাত থেকে আধুলিটা নিয়ে আরও অবাক হলুম। এ কী! সত্যি সেই লাল ফুটকিওয়ালা আধুলিটা যে! কোথায় পেলুম এটা কার, কিছুতেই মনে পড়ল না। কিন্তু জিনিসটা যে অলৌকিক এতে আর সন্দেহ থাকা উচিত নয়।
আর এত ঠিক, এই পড়ে পাওয়া অলৌকিক আধুলি যখন ডনকে ভালোবেসে ফেলেছে, তবে ডন এটা মোড়ের অন্ধ-ভিখিরিকে দিক কিংবা হারিয়ে ফেলুক, আবার তার কাছে এ-হাত সেহাত ঘুরে ফিরে আসবেই। নিজেকে চেনাবার জন্যে কপালে একটা লাল ফুটকি তো থাকবেই। সুতরাং ডন দৌড়ে বেরিয়ে গেলে ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলুম। এমন ভাগ্নের মামা হওয়াটাও তো কম গর্বের কথা নয়।
আজমগড়ের অশরীরী
তখন আমি ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের সিপাহিবিদ্রোহ নিয়ে গবেষণা করছিলুম। সেই কাজে আমাকে আজমগড়ে যেতে হয়েছিল।
আজমগড় উত্তরপ্রদেশে গঙ্গার ধারে একটা ছোট্ট শহর। সেখানে একটা কেল্লার ধ্বংসাবশেষ আছে। তবে ওটা দেখবার জন্য পর্যটকদের বিশেষ উৎসাহ নেই। ওখানে বিশাল গঙ্গার বুকে একটা চরে পক্ষীনিবাস আছে। পাখি দেখবার জন্যই শীতকালে পর্যটকদের ভিড় হয়। ধ্বংসস্তূপ দেখে কে-ই বা আনন্দ পায়?
আমি গিয়েছিলুম মার্চের গোড়ার দিকে। তখন আর তত শীত ছিল না। পর্যটকদের ভিড়ও ছিল না। ভাঙাচোরা নবাবি প্রাসাদের পাশে গঙ্গার তীরে প্যালেস হোটেলে উঠেছিলুম। পর্যটন মরশুমের শেষে এই দোতলা থ্রি-স্টারমার্কা হোটেলে তখন ঘরভাড়াও কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
হোটেলের ম্যানেজার সুখলাল ঠাকুর খুব অমায়িক মানুষ। আমি সিপাহিবিদ্রোহ সম্পর্কে গবেষণা করছি জেনে খুব খাতির করেছিলেন। সিপাহিবিদ্রোহের অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। এসব গল্প নিছক গল্পই। আমার গবেষণায় তা কাজে লাগবে না। তবে ওঁর এ কথাটি অবশ্যই খাঁটি। এই আজমগড়ে সিপাহিদের সঙ্গে এককাট্টা হয়ে অনেক হিন্দু-মুসলিম সাধারণ মানুষও ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।
মিঃ ঠাকুর শুধু একটা ব্যাপারে আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সূর্যাস্তের পর আমি যেন কেল্লাবাড়ি এলাকায় না থাকি। তাঁকে প্রশ্ন করে কোনও যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাইনি। তিনি মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে শুধু বলেছিলেন, সূর্যাস্তের পর ওই এলাকায় থাকলে বিপদ হতে পারে।
–কী বিপদ?
প্যালেস হোটেলের ম্যানেজার কিছু বলতে যাচ্ছেন, এমনসময় কজন সায়েব-মেম দলবেঁধে হোটেলের লাউঞ্জে ঢুকলেন। তিনি তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আমি ক্যামেরায় কেল্লাবাড়ি আর গঙ্গার ছবি তুলে বেড়ালুম। কোথাও-কোথাও ধ্বংসাবশেষে ঝোঁপজঙ্গল আছে। গঙ্গার তীরে একস্থানে খাড়া পাথরের পাঁচিল নেমে গেছে জলের তলায়। কোথাও ভাঙাচোরা পাথরের ঘাট শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম সেই ফাঁসির মঞ্চটিকে, যেখানে ইংরেজ সেনাধ্যক্ষ জন হকটন বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছিলেন। সেই বিদ্রোহীদের দলে ছিলেন নবাব আজম খানের কন্যা রেশমা বেগম। দিল্লির জাতীয় মহাফেজখানার কাগজপত্রে এই পিতা-পুত্রীর নাম খুঁজে পেয়েছিলুম। আর পেয়েছিলাম একটা স্কেচম্যাপ। সেটা এঁকেছিলেন এক আইরিশ শিল্পী–টমাস পিট। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে সেই শিল্পী এ অঞ্চলে বেড়াতে এসেছিলেন। স্কেচম্যাপে কেল্লাবাড়ির সীমানা ছাড়াও খুঁটিনাটি অনেকগুলি স্থান চিহ্নিত করা ছিল। সির মঞ্চ, বিদ্রোহীদের কবরখানা, রেশমা বেগমের গোপন অস্ত্রাগার–এরকম অনেককিছুই ছিল ওতে। আমি জীর্ণ ম্যাপ থেকে কপি করে এনেছিলুম।