–দেখুন, বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে যায়। বরং একটু ফঁক করে…
কথা কেড়ে লোকটা খাপ্পা মেজাজে বলল, ধ্যাতমশাই! বললুম না? আবার কে এসে ঢুকবে, তখন আমারই ঝামেলা হবে। আপনার আর কী! বন্ধ করুন বলছি।
অগত্যা ফের শুয়ে পড়লুম। কিন্তু ঘুমের দফারফা হয়ে গেছে। বদ্ধ ঘরের অন্ধকারে অস্বস্তি, তার ওপর প্রচণ্ড হিমকাঠ পিঠের তলায়। সঙ্গে গরম চাদরও নেই। প্যান্ট-কোট হিমে বরফ হয়ে গেছে। পাশের লোকটার গায়ে কম্বল। তাই আরামে ঘুমোচ্ছে। নাকও ডাকছে।
কতক্ষণ পরে চুপিচুপি উঠে বসলুম। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছের জানালার পাল্লাটা প্রায় নিঃশব্দে ঠেলে ইঞ্চি দুই ফঁক করে রাখলুম। তারপর শুয়ে পড়লুম ফের। এবার বদ্ধ ঘরের সেই অস্বস্তিটা কেটে গেল।
হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কখন। হঠাৎ কী একটা দুদ্দাড় শব্দে উঠে বসলুম দুড়মুড় করে। কামরা আগের মতো ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। জানালার সেই ফঁকটা আর নেই। কিন্তু ভেতরে একটা ধস্তাধস্তি বেধেছে যেন। কে, কে বলে চেঁচিয়ে উঠে দেশলাই হাতড়াতে থাকলুম। খুঁজে পাওয়া গেল না। ওদিকে দরজাটা দমাস করে খুলে গেল। বাইরে পায়ের শব্দ শুনতে পেলুম। কে যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার পাশের বার্থে কেউ এসে বসল। বললুম, কী ব্যাপার বলুন তো?
–কিছু না। আপনি শুয়ে পড়ুন। কেকরাডিহি লাইনে এমন হয়েই থাকে।
কণ্ঠস্বর শুনে একটু চমকে উঠলুম। পাশের বার্থের লোকটার গলার স্বর ছিল একটু খ্যানখেনে। এটা কেমন গুরুগম্ভীর যেন। দেশলাইটা খুঁজে পাওয়া গেল এতক্ষণে। সিগারেট ধরানোর ছলে কাঠি জ্বেলে সেই মিটমিটে আলোয় যাকে দেখলুম, সে অন্য লোক। তবে তার গায়ের কম্বলটা আগের লোকেরই মনে হচ্ছে। এ লোকটার নাক বেজায় চ্যাপ্টা। তাছাড়া, মুখে একরাশ গোঁফদাড়ি। মাথার টুপিটাও অন্য রকম। গম্ভীর স্বরে বলল,–কী দেখছেন?
অবাক হয়ে বললুম, আগের ভদ্রলোক কোথায় গেলেন বলুন তো?
–কেন? আমাকে কি সঙ্গী হিসেবে পছন্দ হচ্ছে না?
–না না–মানে, বলছিলুম কী, আপনিও কি জানালার ফাঁক গলিয়ে ঢুকেছেন?
–ঠিক তাই। বুঝলেন না? যা ঠান্ডা পড়েছে।
–তা পড়েছে। কিন্তু আপনিও দেখছি একজন ম্যাজিশিয়ান।
–তা বলতেও পারেন।
–আগের ভদ্রলোক কোথায় গেলেন?
হ্যা হ্যা করে হেসে নতুন সঙ্গী বলল,–বেজায় ভয় পেয়ে পালিয়েছে। ব্যাটাচ্ছেলে কাতুকুতুতে ওস্তাদ। কিন্তু আমি কী করি জানেন তো? কামড়ে দিই। আপনি?
আমি? আমি কিছুই পারি না বলে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। সিগারেটের আগুনে ঘড়ির কাঁটা দেখে নিলুম। দুটো পাঁচ। আর ঘণ্টাতিনেক এসব উপদ্রব সহ্য করে কাটাতে পারলে আর চিন্তা নেই। ঘুম আর এসে কাজ নেই।
পাশের নতুন সঙ্গীর কিন্তু নড়াচড়ার শব্দ নেই। শুয়ে পড়লে টের পেতুম।
তাই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ওই যে বলল কামড়ে দেওয়ার স্বভাব আছে! হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে কামড়ে দেবে না তো? ভাব করার জন্যে বললুম, কী? শুতে ইচ্ছে করছে না?
প্রকাণ্ড হাই তোলার শব্দ করে বলল, নাঃ। আপনি ঘুমোন।
–ঘুম আসছে কই? বদ্ধ ঘরে আমার দম আটকে যায়। সম্ভবত, জানালা খুললে আপনারও আপত্তি হবে। কাজেই…
–না, না। আপত্তির কারণটা বুঝলেন না? আবার কেউ ঢুকে গণ্ডগোল বাধাবে যে।
আগের ভদ্রলোক বলছিলেন, জানালার গরাদ গলিয়ে ঢোকা শিখতে হলে নাকি একটু কষ্ট করতে হবে। কিন্তু কষ্টটা কী, সেটা চেপে গেলেন। আপনি বলতে পারেন ব্যাপারটা কী?
–খুব পারি। তবে আপনি ভয় পাবেন যে!
–মোটেও না। দেখুন না, আমি কি ভয় পেয়েছি?
হ্যাঁ হ্যাঁ করে হাসল সে। যাক ওসব কথা। আপনার সিগারেট খাওয়া দেখে লোভ হচ্ছে। একটা সিগারেট দিন, টানি।
সিগারেট দিয়ে দেশলাই কাঠি জ্বেলে ধরিয়ে দিতে গিয়ে আবার চমকে উঠলুম। আরে, এ তো সেই গোর্ফদাড়িওলা লোকটা নয়। কুমড়োর মতো মুখ, চকচকে টাক এ আবার কখন এল?
কিন্তু তক্ষুনি গণ্ডগোল বেধে গেল। পাশ থেকে কে চেঁচামেচি করে বলল, এই মশাই। আমার সিগারেট আপনি টানছেন যে। জিগ্যেস করুন তো ওঁকে, কে সিগারেট চাইল।
ফস করে আবার কাঠি জ্বাললুম দেখি, গোঁফদাড়িওলা লোকটি কুমড়ামুখো লোকটির পাশে বসে আছে। তার মুখে-চোখে রাগ ঠিকরে বেরুচ্ছে। ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, কী মুশকিল। আপনি আবার কীভাবে ঢুকলেন?
নতুন লোকটি অদ্ভুত হেসে বলল, আমি আগে থেকেই ছিলুম। অনেকক্ষণ থেকে সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছিলুম। সাহস করে আসতে পারছিলাম না। এ ভদ্রলোকের যে কামড়ে দেওয়া অভ্যেস।
গোঁফদাড়ি হেঁড়ে গলায় বলল,-এবার যদি কামড়ে দিই।
–সিগারেটের ছ্যাকা দেব। আসুন না কামড়াতে।
বিবাদ মিটিয়ে দিতে বললুম,–আহা, ঠান্ডার রাতে কামড়াকামড়ি ভালো কাজ নয়। নিন, আপনিও একটা সিগারেট নিন।
আমি আবার পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লুম। চোখ দুটো পাশের বার্থের দিকে। দুটো সিগারেট জুলজুল করে জ্বলছে অন্ধকারে। এবার কেন কে জানে, ঘুমে চোখের পাতা জড়িয়ে যাচ্ছিল। তারপর কখন সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছি।
হইহট্টগোলে সেই ঘুম যখন ভাঙল, তখন দেখি কামরা জুড়ে একদঙ্গল লোক। বোঁচকাকুঁচকিও কম নেই। এখন আলো জ্বলছে। জানালাগুলো হাট করে খোলা এই রে! সর্বনাশ হয়েছে তাহলে। গরাদ গলিয়েই পিলপিল করে এরা বুঝি ঢুকে পড়েছে। ধুড়মুড় করে উঠে বসলুম। অমনি খালি জায়গা পেয়ে একদল লোক হইহই করে এসে বসে পড়ল। দুজনকে সিগারেট দিয়ে সামলেছি, এতজনকে কীভাবে সামলাব ভেবে খুব ভয় পেয়ে গেলুম।