কনকনে ঠান্ডার রাত। এরই মধ্যে জংশন স্টেশন একেবারে ঝিম মেরে গেছে। তাছাড়া, তেমন কিছু বড় জংশনও নয়। লোকজনের ভিড় এমনিতে কম। চায়ের দোকানি ঘুমঘুম গলায় পরামর্শ দিল,–পাঁচ লম্বর পেলাটফরমে কেকরাডিহির টেরেন রেডি আছে। চোলিয়ে যান। আরামসে জুত করুন।
শুনে তো লাফিয়ে উঠলুম আনন্দে। ওভারব্রিজ হয়ে পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে দেখি, সত্যি তাই। ইঞ্জিনবিহীন একটা ট্রেন কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্ল্যাটফর্মে জন মানুষটি নেই। মাথার ওপর ছাউনি বলতেও কিছু নেই। একফালি চাঁদ নজরে পড়ল, শীতে তার চেহারাও খুব করুণ।
কিন্তু যে কামরার দরজা খুলতে যাই, সেটাই ভেতর থেকে আটকানো। জানলাগুলোও বন্ধ। বুঝলুম ভেতরে বুদ্ধিমান লোকগুলো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রচুর লোক জমে উঠেছে! দরজা খুলে তা বরবাদ করার ইচ্ছে নেই কারুর। অবশ্য চোর-ডাকাতের ভয়ও একটা কারণ হতে পারে। দরজা টানাটানি করে কোথাও কোনও সাড়া পেলুম না।
হন্যে হয়ে শেষদিকটায় গিয়ে শেষ চেষ্টা করলুম। তখন আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। চাচামেচি করে বললুম, দরজায় বোমা মেরে উড়িয়ে দেব বলে দিচ্ছি। আমার কাছে বোমা আছে কিন্তু।
এই শাসানিতেই যেন কাজ হল। একটা জানালা একটু খুলে গেল। তারপর ভারি গলায় কে বলল, কী আছে বললেন?
কথাটা চেপে গিয়ে বললুম,–আহা, দরজাটা খুলুন না। ঠান্ডায় জমে গেলুম যে!
ভেতরের লোকটি বলল,–বোমা না কী বলছিলেন যেন?
আরে না, না। হাসবার চেষ্টা করে বললুম,–ওটা কথার কথা। দয়া করে দরজাটা খুলে দিন।
–মাথা খারাপ মশাই? বোমাওয়ালা লোককে ঢুকিয়ে শেষে বিপদে পড়ি আর কী! বোমা মারতে হয়, অন্য কামরায় গিয়ে মারুন। আমি ঝামেলা ভালোবাসি না।
লোকটা জানালার পাল্লা নামিয়ে দিল দমাস শব্দে। অদ্ভুত লোক তো! রাগে দুঃখে অস্থির হয়ে কী করব ভাবছি, সেই সময় গুনগুন করে গান গাইতে-গাইতে একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখলুম। এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় গুনগুনিয়ে গান গেয়ে কেউ আমারই মতো এক বগি থেকে আরেক বগি পর্যন্ত ফুঁ মেরে বেড়াচ্ছে বুঝি। মিটমিটে আলোয় লোকটির চেহারা নজরে এল। ঢ্যাঙা, হনুমান-টুপিপরা লোক। গায়ে আস্ত কম্বল জড়ানো। লম্বা বিরাট একটা নাক ঠেলে বেরিয়েছে মুখ থেকে। থমকে দাঁড়িয়ে গেল আমাকে দেখে। তারপর খি-খি করে হাসল।–ঢোকার ছিদ্র পেলেন না বুঝি? মশাই, এ লাইনের ব্যাপারই এরকম। সেজন্য সূচ হয়ে ঢুকতে হয়। তারপর দরকার হলে ফাল হয়ে বেরুন না কেন?
কথার মানে কিছু বুঝলুম না। পাগল-টাগল নয় তো? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সে বলল, আপনি দেখছি একেবারে কচি খোকা! বুঝলেন না কথাটা?
ঠান্ডার রাত। জনহীন প্ল্যাটফর্মে পাগলকে ঘাঁটানো উচিত হবে না। বললুম, বুঝলুম বইকী!
কচু বুঝেছেন! এই দেখুন, সুচ হয়ে কেমন করে ঢুকতে হয়। বলে লোকটার সামনেকার একটা জানালা খামচে ধরে এক হ্যাঁচকা টানে ওপরে ওঠাল।
তারপর আমাকে হকচকিয়ে দিল বলা যায়। জানালায় গরাদ আছে। অথচ কী করে সে তার অতবড় শরীরটা নিয়ে ভেতরে গলিয়ে গেল কে জানে! ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
কিন্তু তারপরেই ভেতরে গণ্ডগোল বেধে গেছে। আগের লোকটা চেঁচিয়ে উঠেছে খ্যানখেনে গলায়,–এ কী মশাই! এ কী করছেন? একি! একি! আরে…
এবং কামরার দরজা প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেল। সম্ভবত আগের লোকটাই বোঁচকাকুঁচকি-বিছানাপত্র নিয়ে একলাফে নিচে এসে পড়ল। তারপর দুদ্দাড় শব্দ করে ওভারব্রিজের সিঁড়ির দিকে দৌড়ল।
দেখলুম, একটা বালিশ ছিটকে পড়েছে প্ল্যাটফর্মে। কিন্তু আর ফিরেও তাকাল না এদিকে। এবার সুচহওয়া লোকটিকে দেখতে পেলুম দরজায়। খিকখিক করে হেসে বলল,-বেজায় ভয় পেয়ে গেছে। যাক গে, ভালোই হল। আসুন, আসুন। এক্ষুনি আবার কেউ এসে হাজির হবে। আর শুনুন, ওই বালিশটা কুড়িয়ে নিয়ে আসুন। আরামে শুতে পারবেন।
বালিশটা কুড়িয়ে নিলুম। ঠিকই বলেছে। বালিশটা শোয়ার পক্ষে আরামদায়কই হবে। এর মালিক যে আর এদিকে এ-রাতে পা বাড়াবে না, সেটা বোঝাই যায়। ব্যাপারটা যাই হোক, ভারি হাস্যকর তো বটেই।
কামরার ভেতরটা ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। লোকটা দরজা বন্ধ করে ভেতর থেকে ছিটকিনি নামিয়ে আটকে দিল। দেশলাই জ্বেলে একটা খালি বার্থে বসে পড়লুম। লম্বানেকো লোকটা বসল পাশের বার্থে! তারপর আগের মতো খিকখিক করে হেসে বলল, খুব জব্দ হয়েছে। একা পুরো একটা কামরা দখল করে বসে ছিল ব্যাটাচ্ছেলে!
আমিও একচোট হেসে বললুম, ডাকাত ভেবেই পালিয়েছে, বুঝলেন!
–উঁহু, ডাকাত ভাবেনি। অন্য কিছু ভেবে থাকবে।
–কিন্তু আপনি গরাদের ফাঁক দিয়ে ঢুকলেন কী করে বলুন তো?
–কিছু কঠিন নয়। সে আপনিও পারেন। তবে তার আগে আপনাকে একটু কষ্ট করতে হবে।
আগ্রহ দেখিয়ে বললুম, কী কষ্ট?
লোকটা অন্ধকারে অদ্ভুত শব্দে হাই তুলে বলল,-যাকগে ওসব কথা। বললেনও কি আপনি সে কষ্ট করবেন?
–কেন করব না? অমন সরু ফাঁক গলিয়ে ঘরে ঢোকাটা যে ম্যাজিক মশাই। আমার ধারণা, আপনি একজন ম্যাজিশিয়ান।
–তা বলতে পারেন। তবে আমার এখন ঘুম পাচ্ছে।
অন্ধকারে নড়াচড়ার শব্দ হল। বুঝলুম ম্যাজিশিয়ান লোকটা শুয়ে পড়ল। বালিশটা পেয়ে আমার ভালোই হয়েছে। আমিও শুয়ে পড়লুম। কিন্তু অন্ধকারটা অসহ্য লাগছিল। দম আটকে যাওয়ার দাখিল। তা ছাড়া, বদ্ধ জায়গায় শোওয়ার অভ্যাস নেই। তাই একটু পরে উঠে পড়লুম। মাথার কাছের জানালাটা যেই ওঠাতে গেছি, লোকটা হাঁ-হাঁ করে উঠল।করেন কী, করেন কী। সূচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুনোর মতো লোকের অভাব নেই বুঝতে পারছেন না? অসুবিধেটা কীসের?