বলে সাধুবাবা ঝোঁপঝাড়ের ভিতর দিয়ে তারা তারা তারা বলতে-বলতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
ততক্ষণে দিনের আলো কমে এসেছে। গাছপালায় পাখিদের হল্লা গেছে বেড়ে। ছোটমামাকে বলতে যাচ্ছি, এবার বাড়ি চলুন ছোটমামা-এমন সময় ছোটমামার হুইলে ছিপের ফাতনা আচমকা ডুবে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ছোটমামা খ্যাচ মারলেন। আর অবাক হয়ে দেখলুম, আবার সেই মড়ার খুলিটা আমাদের পিছনে ঝোঁপের ভেতরে ছিটকে পড়ল। ছোটমামা দৌড়ে গিয়ে এবার খুলিটা চেপে ধরলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন,-এবার? এবার কী করে পালাবে বাছাধন?
বললুম,–ছোটমামা! চলুন। খুলিটা সাধুবাবাকে দিয়ে আসবেন।
তাই চলবলে ছোটমামা পা বাড়ালেন।
বললুম, ছিপদুটো পড়ে রইল যে?
–থাক না। ফেরার সময় নিয়ে যাব।
ঝোঁপঝাড়ের পর উঁচু-উঁচু গাছের ঘন জঙ্গল। এখনই জঙ্গলের ভেতর আবছা আঁধার জমেছে। ছোটমামা বললেন,–পুঁটু! শ্মশানকালীর মন্দির তো দেখতে পাচ্ছি না!
ওই সময় কানে এল কারা চাপাস্বরে কথা বলছে। ছোটমামা সেদিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর দেখলুম, খানিকটা খোলামেলা জায়গায় চারজন লোক একটা খাঁটিয়া নিয়ে বসে আছে। খাঁটিয়াতে একটা মড়া।
খুলি হাতে নিয়ে ছোটমামা যেই বলেছেন,-এখানে শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায় বলতে পারেন? অমনি লোকগুলো লাফ দিয়ে উঠে ওরে বাবা! এরা আবার কারা? বলে দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন, যা বাবা! ওরা হঠাৎ অমন করে পালিয়ে গেল কেন? এই খুলিটা দেখে ভয় পেল নাকি?
তারপর তিনি মড়ার খাঁটিয়ার কাছে গেলেন। গলা অবধি চাদর ঢাকা মড়ার মাথাটা বেরিয়ে আছে। ছোটমামা বললেন,–বেশ শৌখিন লোক ছিল মনে হচ্ছে। বুঝলি পুঁটু! চুলগুলোর কেতা দেখছিস? চোখে সোনালি ফ্রেমের দামি চশমা। গোঁফটার কেতাও আছে। দেখে কিন্তু মড়া বলে মনেই হয় না। আমার ধারণা হার্ট অ্যাটাকে মারা পড়েছে। আহা! এমন শৌখিন লোকের মারা যাওয়া উচিত হয়নি।
ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি এটা শ্মশান। এখানে-ওখানে চিতার পোড়া কাঠ আর ছাই। ভাঙা কলসিও পড়ে আছে। এই মড়াটার জন্য কোনও কাঠের পাজা দেখতে পেলুম না। খাঁটিয়ার কয়েক হাত দূরে ঝিলের জল আবছা দেখা যাচ্ছিল। মনে হল, লোকগুলো মড়া পোড়ানোর কাঠের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু একটা খুলি দেখে ওরা অত ভয় পেল কেন?
ছোটমামা মড়াটা দেখতে-দেখতে আনমনে বললেন, কিন্তু শ্মশানকালীর মন্দিরটা কোথায়?
তারপরই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা ঠকাস করে খাঁটিয়ার মড়ার নাকের ওপর পড়ল। অমনি মড়াটা আর্তনাদ করে উঠল, উঁহু হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি! তারপর লাফ দিয়ে উঠে খুলিটা দেখামাত্র জ্যান্ত মানুষের মতো দৌড়ে জঙ্গলের ভেতর উধাও হয়ে গেল। আবছা আলোয় দেখলুম, পরনে ধুতি, গায়ে নকশাদার সিল্কের পাঞ্জাবি। ছোটমামাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললুম,–ছোটমামা! ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে।
ছোটমামা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুলিটা চেপে ধরলেন। কারণ এই সুযোগে খুলিটা আবার পালিয়ে যাচ্ছিল।
এতক্ষণে সেই সাধুবাবার কণ্ঠস্বর কানে এল। তারা! তারা! তারা! ব্রহ্মময়ী মা গো!
তারপর একটু তফাতে গাছের ফাঁকে আগুনের আঁচ দেখতে পেলুম।
ছোটমামাকে সেটা দেখিয়ে দিলুম। উনি হন্তদন্ত হয়ে সেদিকে এগিয়ে চললেন। গাছপালার ভেতর একটা জরাজীর্ণ মন্দির দেখা গেল। তার উঁচু চত্বরে ধুনি জ্বেলে বসে আছেন সেই সাধুবাবা।
ছোটমামা বললেন, সাধুবাবা! সাধুবাবা! এই নিন পাঁচু-চোরের খুলি।
সাধুবাবা ঘুরে খুলিটা দেখে সহাস্যে বললেন,–পেয়েছিস ব্যাটাছেলেকে? দে! শিগগির দে!
ছোটমামা খুলিটা দিতে যাচ্ছেন, আবার সেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। ছোটমামার হাত ফসকে খুলিটা সজোরে গিয়ে সাধুবাবার বুকে পড়ল। সাধুবাবা চিৎ হয়ে পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করলেন,–উ হু হু! গেছি রে বাবা! গেছি!
তারপর দেখলুম, তার জটার পেছনে আগুন ধরে গেছে। কারণ তিনি জ্বলন্ত ধুনির ওপর পড়ে গিয়েছিলেন। জটায় আগুনের আঁচ টের পেয়ে সাধুবাবা লাফ দিয়ে চত্বর থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন। তারপর আবছা আঁধারে ঝপাং করে জলের শব্দ হল। বুঝলুম, সাধুবাবা আগুন নেভাতে ঝিলের জলে ঝাঁপ দিয়েছেন।
এদিকে খুলিটাও সুযোগ বুঝে গড়াতে শুরু করেছে। ছোটমামা খুলিটা ধরার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পারছিলেন না। ওটা কখনও লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে, কখনও গড়িয়ে চলছে। আমরা যেখানে ছিপ ফেলেছিলুম, সেখানে গিয়ে পৌঁছতেই জলের ভেতর থেকে একটা কঙ্কালের দুটো হাত ভেসে উঠল এবং খুলিটা লুফে নিয়ে আবার জলে ডুবে গেল। এতক্ষণে ছোটমামা ভয় পেয়ে কঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, পুঁটু রে! আর এখানে থাকা ঠিক নয়। ছিপ তুলে নে। মোনা-ওঝা ঠিকই বলেছিল রে! দুজনে ঝটপট ছিপ গুটিয়ে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাঁধের ওপর উঠলুম। তারপর বাঁধের পথে বাড়ি ফিরে চললুম। কিছুদূর চলার পর ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, সবই হল রে পুঁটু। সাধুবাবার কাছে মাছ ধরার মন্ত্রটা শেখা হল না।
অন্ধকারে রাতবিরেতে
কেকরাডিহি যেতে হলে ভামপুর জংশনে নেমে অন্য ট্রেনে চাপতে হবে। কিন্তু ভামপুর পৌঁছতেই রাত এগারোটা বেজে গেল। ট্রেন ঘণ্টাছয়েক লেট। খোঁজ নিয়ে জানলুম, কেকরাডিহি প্যাসেঞ্জার রাত নটায় ছেড়ে গেছে। পরের ট্রেন সেই ভোর সাড়ে পাঁচটার আগে নয়।