কথাটা শুনেই আমি ওঁর কাছে চলে গেলুম। ছোটমামা একটা শুকনো কাঠি দিয়ে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, কোনও মানে হয়?
খুলিটা দেখেই আমার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। তারপর দেখি, খুলিটা লাফাতে লাফাতে জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ছোটমামা গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে আছেন। আমি তো ভয়ের চোটে এমন ভ্যাবলা হয়ে গেছি, যেন আমার পাদুটো মাটির সঙ্গে আঠা দিয়ে আটকানো।
ছোটমামা বিড়বিড় করছিলেন, এ কী রে পুঁটু? এ কী রে! এ কী হচ্ছে? অ্যাঁ?
তারপর দেখলুম খুলিটা লাফাতে লাফাতে গিয়ে জলে পড়ল। জলের ওপর কিছুদূর পর্যন্ত বুজকুড়ি উঠে সেগুলো ভেঙে গেল। ছোটমামা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললেন,–এ কী বিচ্ছিরি ব্যাপার বল তো পুঁটু?
বললুম,–ছোটমামা! আমার বড্ড ভয় করছে। চলুন। আমরা এখান থেকে এখুনি চলে যাই।
ছোটমামার এই এক স্বভাব। হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠলেন যেন। বললেন, ধুস! একটা মড়ার খুলি দেখে ভয় পাব আমরা? কী বলিস পুঁটু? বলেছিলুম না আমরা অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি?
বলে উনি আবার বঁড়শিতে টোপ গেঁথে ছিপ ফেললেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,–দেখলি তো খ্যাচ মারা কাকে বলে?
তারপর বসে আছি তো আছি। কিন্তু আর ফাতনা নড়ে না। আমি জলের দিকে ভয়ে-ভয়ে তাকাতে গিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি। কে জানে বাবা! এবার যদি আমার বঁড়শিতে টোপ খেতে আসে খুলিটা!
তার চেয়ে সাংঘাতিক ব্যাপার, মড়ার খুলি একেবারে জ্যান্ত।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ আমাদের বাঁদিকে ঝোঁপঝাড়ের ভেতর কে ভরাট গলায় বলে উঠল,–তারা তারা তারা। তারা তারা তারা! ব্রহ্মময়ী মাগো!
আমরা চমকে উঠে ঘুরে বসেছিলুম। দেখলুম, মোনা-ওঝার মতোই জটাজুটধারী একটা মাথা ঝোঁপের ওপর দেখা যাচ্ছে। তারপর ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে এলেন এক সাধুবাবা। পরনে হাঁটু অবধি পরা লাল কাপড়। এক হাতে ত্রিশূল, অন্য হাতে কমণ্ডলু। তিনি অমায়িক কণ্ঠস্বরে বললেন,-বাড়ি কোথায় গো তোমাদের?
ছোটমামা বললেন,-বাবুগঞ্জ।
–অতদূর থেকে তোমরা এখানে ছিপ ফেলতে এসেছ? ভালো করোনি।
–কেন বলুন তো?
–এটা শ্মশানকালীর এলাকা। ওই দেখছ ঘন গাছপালা। সেখানেই মায়ের মন্দির। তার পাশে শ্মশান। তোমরা এখানে বেশিক্ষণ থেকো না বাবারা!
ছোটমামা হাসতে-হাসতে বললেন, আপনি যা-ই বলুন সাধুবাবা! একটা মাছ ধরে এখান থেকে নড়ছি না।
–ওরে পাগল! এ ঝিলে আর মাছ কোথায়? যা দু-চারটে ছিল, কবে মারা পড়েছে।
–মাছ না পাই, মড়ার খুলিই বঁড়শি বিঁধিয়ে তুলব।
সাধুবাবা চমকে উঠে বললেন, তার মানে? তার মানে?
ছোটমামা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বললেন,–এই তো কিছুক্ষণ আগে একটা জ্যান্ত মড়ার খুলি টোপ খাচ্ছিল। এক খ্যাচ মেরে তাকে ডাঙায় তুললুম।
–তারপর? তারপর?
–খুলিটা থেকে বঁড়শি ছাড়িয়ে নিতেই ওটা লাফাতে লাফাতে জলে গিয়ে পড়ল।
–তোমরা তবু ভয় পেলে না?
ছোটমামা বললেন, নাহ। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে এসেছি যে সাধুবাবা! আমাদের অত সহজে ভয় পেলে চলে?
সাধুবাবা চাপাস্বরে বললেন,–কিন্তু তোমরা কি জানো ওই খুলিটা কার?
ছোটমামা তাচ্ছিল্য করে বললেন,–তা কেমন করে জানব? জানার দরকারই বা কী?
সাধুবাবা গম্ভীরমুখে বললেন, দরকার আছে। ওই খুলিটা পাঁচু নামে একজন চোরের। তোমরা তার নাম শোনোনি মনে হচ্ছে। পাঁচু ছিল এই তল্লাটের এক ধূর্ত সিঁধেল চোর। সে অনেকদিন আগেকার কথা। এক রাত্রে পাঁচু গেরস্থবাড়িতে সিঁদ কাটতে বেরিয়েছে। এমনসময় পড়বি তো পড় একেবারে বন্ধু দারোগার মুখোমুখি।
বন্ধুবিহারী ধাড়া ছিলেন পুঁদে দারোগা। পাঁচুকে দেখে তিনি টর্চ জ্বেলে পাকড়ো পাকড়ো বলে তাড়া করলেন। তার সঙ্গে দুজন কনস্টেবল ছিল। তারাও পাঁচু চোরকে তাড়া করল। তারপর ঠিক এইখানে এসে যখন পাঁচুকে তিনজনে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন, অমনি পাঁচু লাফ দিয়ে ঝিলের জলে পড়ল। দারোগা পিস্তলের গুলি ছুড়লেন। তখন পাঁচু জলে ডুব দিল।
ছোটমামার মন ফাতনার দিকে। শুধু বললেন, হুঁ।
গল্পটা আমি মন দিয়ে শুনছিলুম। তাই বললুম,–তারপর কী হল সাধুবাবা?
সাধুবাবা শ্বাস ছেড়ে বললেন,-পাঁচু ডুব দিল তো দিল। আর মাথা তুলল না। তখন দারোগাবাবু দুই কনস্টেবলকে পাহারায় রেখে থানায় ফিরে গেলেন। রাত পুইয়ে সকাল হয়ে গেল। কিন্তু কোথায় পাঁচু? আসলে কী হয়েছিল জানো? ঝিলের জলের তলায় ঘন দাম আর শ্যাওলা আছে। বেচারা পাঁচু তাতে আটকে গিয়ে আর মাথা তুলতে পারেনি। শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়েছিল।
এবার ছোটমামা বললেন, তারপর জেলে ডেকে এনে জাল ফেলে পাঁচুর মড়া ভোলা হয়েছিল বুঝি?
সাধুবাবা হাসলেন।ওরে পাগল! দেখতে পাচ্ছ না ঝিলের জলের অবস্থা? কত দাম, শ্যাওলা আর কতরকমের জলজ উদ্ভিদ। জাল ফেললে সেই জাল কি আর তোলা যেত? ছিঁড়ে ফর্দাই হয়ে যেত না? তাই কোনও জেলেই জাল ফেলতে রাজি হল না। পাঁচুর মড়া জলের তলায় আটকে রইল। তারপর এতদিনে তার খুলিটা তোমাদের বঁড়শিতে আটকে গিয়েছিল। বুঝলে তো?
ছোটমামা আনমনে আবার বললেন, হুঁ।
সাধুবাবা বললেন,–তো শোনো বাবারা! আবার যদি পাঁচুর খুলি তোমাদের ছিপে ওঠে, তাহলে খুলিটা আমাকে দিয়ে যেও। কেমন? ওই যে দেখছ জঙ্গল! ওর মধ্যে আছে শ্মশানকালীর মন্দির। ওখানে আমাকে পেয়ে যাবে। খুলিটার বদলে আমি তোমাদের একটা মন্ত্র শিখিয়ে দেব। সেই মন্ত্র পড়ে বঁড়শিতে ফুঁ দিলেই তোমরা প্রচুর মাছ ধরতে পারবে। যাই হোক, এখন আমি যাই। মায়ের পুজোর সময় হয়ে এল।