মোনার মাথায় জটা। মুখে গোঁফ-দাড়ি। ওপর পাটির একটা দাঁত ভাঙা। তাই গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর কপালে দগদগে সিঁদুরের ঘটা সত্ত্বেও হাসলে তাকে খুব অমায়িক ও সরল মানুষ মনে হয়। কিন্তু যখন সে গম্ভীর হয়ে থাকে, তখন তাকে দেখলে বড় গা ছমছম করে। তার চোখদুটো যে বেজায় লাল।
মোনা-ওঝা আমাদের দেখে কেন কে জানে ফিক করে হাসল। তারপর বলল,–ছোটবাবু, ভাগ্নেকে সঙ্গে নিয়ে ছিপ ফেলতে বেরিয়েছেন বুঝি? ভালো! তা কোথায় ছিপ ফেলবেন?
ছোটমামা বললেন,–সিঙ্গিমশাইয়ের মাঠপুকুরে।
মোনা বলল,–ওই পুকুরে আর মাছ আছে নাকি? এই তো গত মাসে সিঙ্গিমশাই জেলেদের সব মাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। সারাদিন জাল ফেলে-ফেলে জেলেরা মাছের ছানাপোনাসুদ্ধ ঘেঁকে তুলে নিয়েছে।
ছোটমামা অবাক হয়ে বললেন,–সে কী মোনাদা! সিঙ্গিমশাইয়ের কাছে আজ সকালে যখন ছিপ ফেলার জন্য পারমিশন চাইতে গেলুম, উনি বললেন, দুটোর বেশি ধোরো না যেন।
মোনা-ওঝা হেসে কুটিকুটি হল। –মিথ্যে! একেবারে মিথ্যে! বুঝলেন ছোটবাবু? চোরের জ্বালায় মাত্র আড়াইশো-তিনশো গ্রাম ওজন হলেই পোনামাছগুলো বিক্রি করে দেন সিঙ্গিমশাই। তাছাড়া আপনার হুইলে ধরার যোগ্য মাছ কি ওখানে কখনও ছিল? তবে হ্যাঁ। এই খোকাবাবুর ছিপে ধরার মতো পুঁটিমাছ থাকলেও থাকতে পারে।
ছোটমামা খাপ্পা হয়ে বললেন,-মিথ্যুক! হাড়কেল্পন! আমাকে খামোকা হয়রান করল! টাউন থেকে শখ করে এত দামি হুইল কিনে আনলুম। সকাল থেকে কতরকমের চার আর টোপ তৈরি করলুম!
মোনা বলল,–এক কাজ করুন ছোটবাবু! একটু কষ্ট করে দোমোহানির ঝিলে চলে যান। ঝিলে কিন্তু প্রকাণ্ড-প্রকাণ্ড মাছ আছে। ঝাঁপুইহাটির কালিবাবু এই তো দুহপ্তা আগে একটা পাঁচ কেজি রুই তুললেন। আমার চোখের সামনে, ছোটবাবু! মা কালীর দিব্যি!
ছোটমামা একটু দ্বিধার সঙ্গে বললেন, কিন্তু বড় দূরে যে!
দুর কী বলছেন? নাক বরাবর ধানক্ষেতের আল ধরে হেঁটে গিয়ে ওই বাঁধে উঠুন। মাত্র আধঘণ্টা হাঁটতে হবে।বলে মোনা আমার দিকে তাকাল, কি খোকাবাবু? যেতে পারবে না মামার সঙ্গে?
কী আর বলব? মাথাটা একটু কাত করলুম শুধু। পুঁটিমাছ ধরার ইচ্ছেটা চাগিয়ে উঠেছে যে!
ছোটমামা হঠাৎ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। বললেন, আয় পুঁটু! মোনাদা ঠিকই বলেছে, মাছ পাই বা না পাই, একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাক না। তাছাড়া তোর ট্রেনিংটা ওইরকম ঝিল-জঙ্গলে শুরু করাই উচিত।
ছোটমামাকে অনুসরণ করলুম। পিছন থেকে মোনা-ওঝা বলল,–তবে একটা কথা ছোটবাবু! সূর্য ডোবার পর আর এখানে কিন্তু থাকবেন না। সঙ্গে খোকাবাবু আছে বলেই সাবধান করে দিলুম।
ছোটমামা বললেন,–ছাড় তো বুজরুকে কথা। আমরা অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছি। তাই না পুঁটু? ওঁর কথায় অগত্যা সায় দিতেই হল। যদিও মোনা-ওঝার কথাটা শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল।…
বাঁধের নিচে ঝিলটা বাঁকা হয়ে একটু দূরের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়েছে। কিন্তু ছিপ ফেলার মতো কঁকা জায়গা চোখে পড়ল না। ঝিলে ঘন দাম, পদ্ম আর শালুক ফুলের ঝাঁক। কোথাও শোলাগাছ গজিয়েছে দামের ওপর। ছোটমামা অনেক খোঁজাখুঁজি করে ছিপ ফেলার মতো খানিকটা কঁকা জায়গা আবিষ্কার করলেন। তারপর বললেন,–বুঝলি পুঁটু? এখানেই ঝাঁপুইহাটির কোন কালীবাবু ছিপ ফেলেছিলেন মনে হচ্ছে। এই দ্যাখ, এক টুকরো ছেঁড়া কাগজ পড়ে আছে। হুঁ! সিগারেটের ফিল্টারটিপও অজস্র। কালীবাবু খুব সিগারেট খান বোঝা যাচ্ছে।
ঝিলের উত্তর পাড়ে এই জায়গাটা ছায়ায় ঢাকা। কারণ, বাঁধে একটা বটগাছ আছে। তার লম্বা ডালপালা ঝিলের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। ছোটমামা ঝটপট চার ফেলে ছিপ সোজা রাখার জন্য ঝোঁপ থেকে একটা আঁকশির মতো ডাল ভেঙে আনলেন। এক হাঁটু জলে নেমে সেটা কাদায় পুঁতে বললেন,–তোর ছিপটা ছোট্ট তো! ওটা হাতে ধরে থাকতে পারবি। আমারটা যে হুইল ছিপ। ডগাটা আঁকশির মাথায় রাখলে তবে ছিপটা সোজা থাকবে।
মাঝে-মাঝে শিরশিরে বাতাস বইছিল। রোদে হাঁটার কষ্টটা শিগগির দূর হয়ে গেল। মামা-ভাগ্নে দুজনে দুটো ছিপ ফেলে বসে রইলুম। ঝিলের ওপারে ঘন বাঁশবন। সেখানে একঝাক পাখি তুমুল হল্লা করছিল। জল-মাকড়শারা জলের ওপর তরতরিয়ে ছোটাছুটি করছিল। একটা লাল গাফড়িং ছোটমামার ছিপের ফাতনা ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলা করছিল। হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে একটা জলপিপি পাখি পিপি করে ডাকতে ডাকতে দূরে ঝিলের জলে কোথাও বসল।
এতক্ষণে মনে পড়ল, ছোটমামা আমাকে খ্যাচ মারা শেখাবেন। কিন্তু কথাটা তুলতেই উনি চাপাস্বরে বললেন, আমার চারে মাছ এসে গেছে। বুজকুড়ি দেখতে পাচ্ছিস না? মাছটা টোপ খেলেই আমি ছিপটা যেভাবে জোরে তুলব, সেটাই এ্যাচ। তুই লক্ষ রাখিস।
আমার ছিপের ফাতনা দুবার কেঁপে আবার স্থির হয়ে গেল। খ্যাচ মারা ব্যাপারটা না দেখা পর্যন্ত কী আর করা যাবে!
কিছুক্ষণ পরে দেখি, ছোটমামার ছিপের ফাতনা নড়তে শুরু করেছে। ছোটমামা ছিপের হুইলবাঁধা গোড়ার দিকটা চেপে ধরে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তারপর ফাতনাটা যেই ডুবে গেল, অমনি ছোটমামা জোরে ছিপটা তুলে ফেললেন। সাঁই করে একটা শব্দ হল। কিন্তু কী অবাক! ছোটমামার বঁড়শিতে বিঁধে যে জিনিসটা ছিটকে আমাদের পেছনে গিয়ে পড়ল, সেটা তো মাছ নয়!
ছোটমামা ছিপ ফেলে এক লাফে পেছনে বাঁধের গায়ে ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে গেলেন। তারপর ফাঁসফেঁসে গলায় বলে উঠলেন, কী সর্বনাশ! এটা দেখছি একটা মড়ার খুলি!