খাপ্পা হয়ে বললুম, নিকুচি করেছে তোমার হাওয়া-বাতাসের! মামাবাবু এসে যদি দেখেন, এভাবে আমরা বাড়ি পাহারা দিয়েছি, তোমারও চাকরি যাবে, আমিও মুখ দেখাতে পারব না। ওঠো, চলো দেখি কী ভাঙল।
রমলাল অন্ধকারে বলল, আপনি গিয়ে দেখুন দাদাবাবু। আমি যাব না।
রাগ হলে মানুষের সাহস বাড়ে। বালিশের পাশ থেকে টর্চ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলুম! সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় টের পেলুম বাতাসটা হঠাৎ থেমে গেছে।
বাতাস বলা আর উচিত হবে না। একে ঝড় বলাই ভালো। শরৎকালে এমন ক্ষণিক ঝড় ভারি অদ্ভুত বটে! বছরের এসময়টা ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিও হয় এবং তা একনাগাড়ে কয়েকদিন থাকে। কিন্তু এই আচমকা ঝড়ের স্থায়িত্ব মাত্র কয়েক মিনিট। তাছাড়া একফেঁটা বৃষ্টি নেই। আকাশ সারাদিন প্রায় নির্মেঘ ছিল। রাতেও তাই। আকাশভরা তারা ঝকমক করছে দেখছি। নিচের তলায় পৌঁছে মনে পড়ল, যাঃ! চাবির গোছাটা আনতে ভুলে গেছি। মামাবাবু সব চাবির ডুপ্লিকেট দিয়ে গেছেন। বলে গেছেন প্রতিদিন সব ঘর যেন রামলালকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিই। পরিচ্ছন্নতার বড় বাতিক ওঁর।
টর্চের আলো বসার ঘরের দরজায় পড়তেই চমকে উঠলুম! দরজা হাট করে খোলা। মরিয়া হয়ে ভেতরে ঢুকে গেলুম। যা ভেবেছি তাই। ঘরের দেয়ালে প্রকাণ্ড সব বিদেশি পেন্টিং টাঙানো ছিল। দাদামশাইয়ের মস্ত একটা ছবি ছিল। মহাপুরুষদের ছবি ছিল খানকতক। একটাও দেয়ালে আর নেই। মুখ থুবড়ে নিচে পড়ে খানখান হয়ে গেছে সব কাঁচ। ফ্রেম পর্যন্ত ভেঙে গেছে।
আরও অদ্ভুত ব্যাপার, সারা ঘরে যেন হুলুস্থুল লড়াই করেছে কারা। সোফাগুলো উল্টে পড়েছে। ডিভানটা কাত হয়ে রয়েছে। বইয়ের দুটো আলমারি টানাটানি করে স্থানচ্যুত করেছে কারা।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছি ব্যাপার দেখে। অবশ্য আঙুল টর্চের বোতাম থেকে সরে যেতেই অন্ধকার ঘিরে ফেলল এবং তখন সচেতন হয়ে আবার বোতাম টিপলুম।
উজ্জ্বল এক ঝলক আলো কোণের দিকে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার হৎপিন্ডে রক্ত ছলকে উঠল। সারা শরীর হিম হয়ে গেল যেন। কোণের মেঝে ও দেয়ালে চাপচাপ রঙটাটকা রক্ত জ্বলজ্বল করছে।
আর এক মুহূর্ত দাঁড়াবার বা ব্যাপারটা ভালো করে দেখার সাহস হল না। ভক্ষুনি ঘুরে কাঁপতে কাঁপতে এবং টলতে টলতে প্রায় দৌড়ে চললুম।
সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে টর্চটাও গেল বিগড়ে। চেঁচিয়ে উঠলুম, রামলাল! রামলাল!
রামলাল মোমহাতে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বলল, কী হল দাদাবাবু? ভাঙা গলায় অতি কষ্টে বললুম,–নিচের ঘরে কাকে খুন করা হয়েছে।
রামলাল আশ্চর্য, ফিক করে হাসল। আগের ভঙ্গিতে বলল, ও কিছু না। হাওয়া-বাতাসের কাজ। চলে আসুন, দাদাবাবু।…
সমস্ত ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এবং ভয়ঙ্কর। কিন্তু সকালে দুরুদুরু বুকে নিচের সেই ঘরে গিয়ে আমি অবাক হয়ে দেখি, রাতের সেই ভয়ঙ্কর প্রলয়ের এতটুকু চিহ্ন নেই কোথাও কোথাও একফোঁটা রক্ত কেন, এতটুকু লাল দাগ পর্যন্ত নেই।
তাহলে কি ব্যাপারটা নিছক দুঃস্বপ্ন?
মোটেও না। একই স্বপ্ন দুজনে তো একসঙ্গে দেখা অসম্ভব। তাছাড়া রামলাল বলল, কর্তাবাবু বাড়ি না থাকলে এমনটা হয়। বাড়ির ছোটবড় সবাই তা জানে। তাই রাতের ঘটনা নিয়ে আপনার মতো কেউ মাথা খারাপ করে না।
শরতের উজ্জ্বল রোদে বাড়ি এবং পরিবেশ কী সুন্দর দেখাচ্ছিল। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল রাতের ঘটনাগুলো। দিনমানে হাওয়া নেই। কেমন একটা গুমোট ভাব। বিকেল অবধি রামলালের সঙ্গে সেই বসার ঘরে ক্যারাম খেললুম। তারপর রোদ কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে অস্বস্তি জেগে উঠল। রাত হলেই এই বাড়িটা জেগে উঠবে। তাকে জাগিয়ে তুলবে এসে এক অদ্ভুত ঝোড়ো হাওয়া। বড় অবিশ্বাস্য লাগে।
এ রাতে শোওয়ার সময় মনে-মনে ঠিক করেছিলুম যা কিছু ঘটুক রামলালের মতো নির্বিকার থাকব। রামলাল যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমতে শুরু করল। কিন্তু আমি জানি ঘটনা শুরু হলে সে জেগে যাবে। যথারীতি লোডশেডিং চলছে। বাইরে চারদিকে একটা অস্বাভাবিক স্তব্ধতা। যেন মঞ্চের পরদা ওঠার প্রতীক্ষায় স্থাবরজঙ্গম রুদ্ধশ্বসে রয়েছে। রাত দশটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আবার বাগানের দিকে শনশন শব্দ শুনতে পেলুম। অমনি একটা জেদ এসে গেল। নিচের ঘরটাতে কাল রাতে এক হত্যাকাণ্ডের শেষ দৃশ্যে উপস্থিত হয়ে ছিলুম, আজ গোড়া থেকে উপস্থিত থাকার ইচ্ছে পেয়ে বসল।
পাছে রামলাল বাধা দেয়, তাই টর্চ নিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেলুম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ততক্ষণে সেই অদ্ভুত রহস্যময় ঝোড়ো-বাতাস হুলুস্থুল বাধিয়েছে। এসে। সিঁড়িতে পা রাখা দায়। ঝড়ের ধাক্কায় টাল খাচ্ছি শুধু।
সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমেই আলো ফেললুম বসার ঘরের দরজায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না, যা দেখলুম। ঘরের দরজাটা পুরোনো এবং প্রকাণ্ড। মচমচ খটাং-খট শব্দে দুটো কপাট খুলে গেল। বাতাসটা শনশন করে ঢুকে গেল তক্ষুনি। ভেতরে তোলপাড় শুরু হল।
এক লাফে নেমে ঘরে ঢুকে পড়লুম। টর্চের আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভেসে উঠল পাতা চাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে বেঁটে একটা শরীর–মানুষেরই শরীর। পরনে প্যান্টশার্ট আর মাথার টুপিও যেন আছে। সে একটা ছবি টেনে নামাচ্ছিল। আমার দিকে ঘুরল। মুখটা যেন চীনাদের মতো। সেই মুহূর্তে টর্চটা বিগড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলুম, রামলাল! রামলাল!