সে কথা বলতেই এই গল্প।
বাড়িটা শহরতলি এলাকায়। একেবারে সুনসান নির্জন আর গাছপালা, পুকুর ডোবাও প্রচুর। মনেই হবে না শহরের নাকের ডগায় এমন পাড়াগেঁয়ে পরিবেশ থাকতে পারে। তাছাড়া খুব পুরোনো আমলের বাড়ি। চারদিকে বাগান, পুকুর, একটা বাঁশবন পর্যন্ত।
রামলালের বয়স হলেও শরীরখানা এখনও জোয়ানের মতো তাগড়াই। বোঝ যায়, এক সময় রীতিমতো ব্যায়ামবীর ছিল। আর এমন মানুষ কাছে থাকলে পরিবেশ যাই হোক, কোনওরকম–ভাবনা থাকার কথা নয়। চোর-ডাকাতের সামনে রামলাল গোঁফে তা দিয়ে দাঁড়ালেই লেজ তুলে পালিয়ে যেতে পথ পাবে না।
হ্যাঁ, প্রথমদিন সে কথাই মনে হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যার মুখে বাইরে গেট বন্ধ করতে গিয়ে যখন রামলাল আমাকে ডেকে বলল, দাদাবাবু, আপনি একটু দাঁড়ান তো এখানে, আমার কেমন ডর লাগছে,–তখনই আঁচ করলুম, লোকটাকে যতটা সাহসী ভেবেছিলুম, ততটা হয়তো নয়।
গেট বন্ধ করে ঝটপট ঘরে ঢুকে রামলাল একটু হেসে বলল, চোর, গুণ্ডা, ডাকু-তাদের সঙ্গে একহাত লড়া যায় দাদাবাবু! কিন্তু হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে তো লড়া যায় না!
অবাক হয়ে বললুম, তার মানে? ও রামলাল, হাওয়া-বাতাস ব্যাপারটা কী?
রামলাল চোখ টিপে বলল,–সে আছে। কর্তাবাবু যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ততক্ষণ কোনও ঝামেলা হয় না। রাতবিরেতে উনি বাড়ি না থাকলে ব্যাটা পেয়ে বসে!
কেমন অস্বস্তি হয় ওর কথাটা শুনে। বললুম, কার কথা বলছ, খুলে বলল তো রামলাল?
রামলাল ফের চোখ টিপে বলল,–আছেন তো! মালুম হয়ে যাবে।
হয়তো মালুম খানিকটা হল কিছুক্ষণ পরেই। দোতালার একটা ঘরে বসে ফের একদফা চা খেতে-খেতে একটা গোয়েন্দা-উপন্যাস সবে খুলেছি। রামলাল নিচের তলায় কিচেনে রাতের জন্য রান্না করছে এবং মাঝে-মাঝে তার হেঁড়ে গলার গানও শুনতে পাচ্ছি। হঠাৎ একটা বাতাস উঠল শনশনিয়ে। বাগানের দিকে যেন হুলুস্থুল শুরু হল। তারপর বাঁশবন থেকে বিচ্ছিরি কাঁচকাঁচ শব্দ শোনা যেতে লাগল। ঘরের জানালার কপাটগুলো খটখট করে নড়তে থাকল। আর সেই সময় গেল আলো নিভে। সারা এলাকা অন্ধকার হয়ে গেল দেখে বুঝলুম লোডশেডিং। কিন্তু ততক্ষণে রামলালের গানটা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপর সিঁড়িতে ধুপধাপদুদ্দাড় শব্দ করে সে এসে হাজির হল। হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, কিচেনে হ্যারিকেন ছিল। খুঁজে পেলুম না। শিগগির মোম জ্বালুন দাদাবাবু!
টেবিলের ড্রয়ার হাতড়ে মোমবাতি বের করে জ্বেলে নিলুম। আশ্চর্য, বাতাসটা আর নেই। বললুম, কী ব্যাপার রামলাল? তুমি কি ভয় পেয়েছ?
রামলাল কাচুমাচু মুখে হাসল। বলল,–পাইনি, আবার পেয়েছিও। বুঝলেন দাদাবাবু? হাওয়া-বাতাসের সঙ্গে এঁটে ওঠা মুশকিল। দেখুন না, গালটা এখনও বরফ হয়ে আছে। হাওয়া-বাতাসের চড় বলে কথা।
বিরক্ত হয়ে বললুম, ধ্যাত্তেরি, তোমার হাওয়া-বাতাসের নিকুচি করেছে। তুমি কী বলতে চাইছ, বুজতে পারছি না!
রামলাল তেমনি চোখ টিপে রহস্যময় হেসে বলল,–আছেন যখন এ বাড়িতে, সব মালুম হয়ে যাবে। এখন কৃপা করে একটু কিচেনে এসে বসুন দাদাবাবু। ব্যাটা বড় জ্বালাচ্ছে।
ওর কথা শুনে এবং ভাবভঙ্গি দেখে অস্বস্তি বেড়ে গিয়েছিল। তবে লোকটা গায়ে-গতরে যেমন, সাহসের বেলায় মোটেও তেমনটি নয় তাহলে। রান্না ও খাওয়া শেষ হলে ওপরের ঘরে শুতে এলুম। আমিই ওকে এ ঘরে শুতে বলতুম, কিন্তু কিছু বলার আগে রামলাল নিজেই অনুরোধ করল, আমার ঘরেই মেঝেতে শুতে পারলে রাতে ঘুমটা তার হবে। নইলে নাকি ওই হাওয়া-বাতাস তাকে ঘুমোতেই দেবে না।
বাতাসের কি প্রাণ আছে? বাতাস কীভাবে এবং কেন মানুষকে জ্বালাতন করবে আমি ভেবেই পাচ্ছিলাম না। ততক্ষণে আলো এসেছে। মেঝেয় শতরঞ্চির ওপর চাদর পেতে রামলাল নাক ডাকতে শুরু করেছে। ভিন্ন জায়গায় আমার সহজে ঘুম আসে না। তাছাড়া ওই অস্বস্তি। বিছানায় শুয়ে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় গোয়েন্দা-উপন্যাসটা পড়ার চেষ্টা করছি। এমন সময় আবার সেই উটকো বাতাসটা বাগানের দিকে শনশনিয়ে উঠল। তারপর জানালা খটখটিয়ে ঘুরে ঢুকল। জোরে ফ্যান চালিয়ে দিয়েছিলাম মশার অত্যাচারে। ভাবলুম, ভালোই হল, বাইরের এই হতচ্ছাড়া বাতাসটা এসে মশাগুলোর দফা-রফা করুক।
কিন্তু ফের সেই লোডশেডিং। তারপর বাঁশবনের কাঁচকোঁচ আওয়াজের মধ্যে ক্রমশ যেন যন্ত্রণাকাতর মানুষের গোঙানি শুনতে পেলুম। কে যেন প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ককিয়েককিয়ে কাঁদছে। আমার গায়ে কাঁটা দিল। এ কখনও কানের ভুল নয়। তাছাড়া ঘরের ভেতর বাতাসটা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চারদিকে বাইরে এবং ভেতরে প্রচণ্ড হুলুস্থুল চলছে। আমি কাঠ হয়ে পড়ে রইলুম। উঠে জানালা বন্ধ করার সাহসও হল না।
তারপর আচমকা নিচের তলায় প্রচণ্ড শব্দে কী একটা পড়ে গেল শুনলুম। পড়ার বিকট ঝনঝন শব্দে বুঝি প্রকাণ্ড একটা কাঁচ ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল। আর চুপ করে থাকতে পারলুম না। ডাকলুম, রামলাল! রামলাল! ওঠ, শিগগির ওঠ তো!
অবাক হয়ে দেখি, রামলাল কখন জেগে গেছে। সে ভারী গলায় বলল, চুপসে শুয়ে থাকুন দাদাবাবু! ও কিছু না!
উঠে দাঁড়িয়ে বললুম,–কী বলছ তুমি? নিশ্চয় নিচের কোনও ঘরের জানালা খুলে গেছে! ছবিটবি পড়ে ভেঙে গেছে।
রামলাল বলল,–ও হাওয়া-বাতাসের কাণ্ড দাদাবাবু! চুপচাপ শুয়ে থাকুন।