আজ্ঞে আমি কলকাতা থেকে আসছি। যাব কাঞ্চনপুর। বাস ফেল করে বড় বিপদে পড়েছি।
একজন বলল, তাই বলুন। তা বিপদটা কী?
–একদল কালোকালোলোক আমাকে ফলো করে আসছে।
–সর্বনাশ! আপনি কি হরির হোটেলে খেয়েছেন?
–খেয়েছি। বড্ড খিদে পেয়েছিল।
অমনি আবার হইচই পড়ে গেল।–ওরে! এ হরির হোটেলে খেয়েছে রে। কী সর্বনাশ! আবার একা নয়, সঙ্গে হরির হোটেলে খাওয়া পুরো দলটাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের গাঁয়ে এসেছে।
এইসব বলতে-বলতে লোকগুলো মন্দিরের পিছনে উধাও হয়ে গেল। তারপর গ্রামের কুকুরগুলো ডাকতে লাগল। আমি এবার কী করব ভাবছি, সেইসময় দেখলুম উঁচু চত্বরের পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। বললুম,–দেখুন তো মশাই, কী অদ্ভুত ব্যাপার? বিপদে পড়ে এখানে ছুটে এলুম। অথচ ওঁরা অমন করে পালিয়ে গেলেন!
লোকটি খিকখিক করে হেসে বলল,–পালাবারই কথা। আপনি হরির হোটেলে খেয়েছেন কিনা।
করুণ স্বরে বললুম,–কেন? হরির হোটেলে খেলে কী হয়?
–যে খায়, সে ভেদবমি করে টসে যায়।
–আমি কিন্তু টেসে যাইনি। হরিবাবু আমাকে অ্যান্টাসিড দিয়েছিলেন। দুটো খেয়েছি।
–দুটোতে কাজ হয় না মশাই! এখনও আপনার পেটে হরির হোটেলের ভাত আছে তো। তারই গন্ধে যত গণ্ডগোল বেধেছে। কারা আপনাকে ফলো করেছে বলছিলেন যেন?
–হ্যাঁ। একজন-দুজন করে অন্তত তিরিশ-চল্লিশ জন হবে। জ্যোৎস্নায় সব কালোকালো মূর্তি।
–তারা হরির হোটেলে খেয়ে টেসে গেছে। কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে। হরির রান্নাটা যে সুস্বাদু! সেই লোভে পড়ে পেট পুরে খেলেই কেলেঙ্কারি। ওরা ভেদবমি করে টেঁসে গিয়েছে বটে, কিন্তু লোভটা যায়নি। আপনার পেট থেকে হরির সুস্বাদু রান্নার গন্ধ টের পেয়েই ওরা আপনার পিছু নিয়েছে। বুঝলেন তো?
–বুঝলুম। কিন্তু আপনি দয়া করে আমাকে কাঞ্চনপুরে পৌঁছে দিন।
–কাঞ্চনপুর আরও প্রায় এক কিলোমিটার। সেখানে কাদের বাড়ি যাবেন?
–নির্মল সিংহের বাড়ি।
–ও! সিঙ্গিমশাইদের বাড়ি? চলুন। আমার বাড়িও ওই গ্রামে। তবে সাবধান, আপনি আগে আগে চলুন। আমি যাব পেছনে!
–কেন? আমাকে কি আপনি ভয় পাচ্ছেন?
–কিচ্ছু বলা যায় না! হরির হোটেলে এ পর্যন্ত যারা খেয়েছে তারা সবাই ফেঁসে গেছে।
–আহা! বলছি তো আমার কিছু হয়নি।
লোকটি খিকখিক করে হেসে বলল, টাটকা কেঁসে যাওয়া বডি তো! তাই প্রথম-প্রথম কিছু টের পাওয়া যায় না। মনে হয়, এই তো দিব্য আমার বডিখানা আস্ত আছে! কিন্তু আত্মার ভ্রম। আসলে বডি কখন চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
–কী অদ্ভুত!
–মোটেও না। এমন হতে পারে আপনার বডির স্মৃতি আপনাকে এখনও আস্ত রেখেছে। যাক গে। চলুন। পিছনে তাকাবেন না। আমিও তাকাব না।
কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর বললুম,–দেখুন! আপনার যেমন আমাকে ভয় করছে, তেমনি আমারও আপনাকে ভয় করছে! কখন পিছন থেকে আপনি কী করে বসবেন!
–ঘাড় মটকে দেব বলতে চান?
–যা অবস্থা, তাতে এবার ওটুকুই যা বাকি।
–বাজে কথা বলবেন না! আপনি বড় অকৃতজ্ঞ মানুষ তো!
–আমাকে মানুষ বললেন যখন, তখন আর আমাকে ভয় কেন? বরং আপনার ভয় পাওয়া উচিত যারা আমাকে ফলো করে আসছিল, তাদের।
লোকটি থমকে দাঁড়াল। এই রে! একেবারে ভুলে গেছি। আমার জামার পাশপকেটে টর্চ আছে। বের করা যাক। আগে আপনাকে টর্চের আলোয় দেখে নিই। তারপর এখনও কেউ পিছনে ফলো করছে কি না দেখা যাক।
বলে সে টর্চ জ্বেলে আমাকে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পিছনের দিকে টর্চের আলো ফেলল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেই আলোয় দেখলুম, একদঙ্গল আস্ত কঙ্কাল ছিটকে দুধারে গাছপালার মধ্যে লুকিয়ে পড়ল।
আর লোকটাও সেই দৃশ্য দেখে প্রচণ্ড বেগে দৌড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। আমার সৌভাগ্য, তার হাত থেকে জ্বলন্ত টর্চটা ছিটকে পড়েছিল। সেটা আমি কুড়িয়ে নির্ভয়ে এবার নিয়ে হেঁটে চললুম।
মাঝে-মাঝে পিছু ফিরে টর্চের আলো ফেলছিলুম। কিন্তু আর কেউ আমাকে অনুসরণ করছিল না। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর রাস্তার বাঁকের মুখে মোটরসাইকেলের উজ্জ্বল আলো দেখা গেল। তারপর মোটর সাইকেলটা আমার কাছে এসে থেমে গেল। নির্মলের সাড়া পেলুম। যা ভেবেছিলুম! এতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করে হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল, আজ তো শনিবার। পুঁটু কি অত ভিড়ের মধ্যে বাসে উঠতে পারবে? হা রে! হেঁটে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? আয়! ব্যাকসিটে বোস! দোষটা আমারই। বুঝলি?
মোটরসাইকেলের ব্যাকসিটে চুপচাপ উঠে বসলুম। যা ধকল গেছে, এখন আর কোনও কথা নয়।
না। পরেও আর কোনও কথা নয়। এমনকী হরির হোটেলে খাওয়ার কথাও চেপে যাব। হরির দেওয়া অ্যান্টাসিডের ট্যাবলেট দেখিয়ে বলব,–রাতে কিছু খাব না! পেটের অবস্থা ভালো না।
তাছাড়া আমি হরির হটেলে খেয়ে এসেছি শুনলে নির্মল নির্ঘাত আমাকে ফেলে পালানোর চেষ্টা করবে। তার মানে, মোটরসাইকেলের অ্যাকসিডেন্ট এবং আমি নিজেই ভূত হয়ে যাব। সর্বনাশ!
শুধু একটাই ভাবনা, হরির হোটেলের ভাত যতক্ষণ না পুরো হজম হচ্ছে, ততক্ষণ কি নির্মলের বাড়ির আনাচে-কানাচে সেই ছায়াকালো কালো মিছিলের মূর্তিগুলো গন্ধ শুঁকতে ঘুরঘুর করে বেড়াবে? দেখা যাক।…
হাওয়া-বাতাস
সোমবার পুজোর সময় আমার মামাবাড়ির ছোট-বড় সবাই মিলে হিমালয়ে ভ্রমণে গেলে বাড়ি পাহারার দায়িত্ব পড়েছিল আমার কাঁধে। অবশ্য আমি একা নই, বাড়ির পুরোনো কাজের লোক রামলালও ছিল। লোকটা রাঁধুনি হিসেবে খাসা। দুজনে মনের আনন্দে যথেচ্ছ খেতুম আর ক্যারাম পিটতুম। শুধু রাতের বেলাটা–