ঠিক এই সময় আমার মনে পড়ে গেল, আজ বেলা এগারোটায় খেয়েছি। তাপর ট্রেনে বার তিনেক বিস্বাদ চা। আর একই সময়ে ডাল-ভাতমাছের ঝোলমিশ্রিত লোভনীয় খাদ্যের তীব্র ঘ্রাণ আমার বাঙালি পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধার উদ্রেক করল।
সটান হোটেলে ঢুকে কাছের বেঞ্চে বসলুম। ব্যাগটা একপাশে রেখে বললুম,–আমার খুব খিদে পেয়েছে। শিগগির ব্যবস্থা করুন হরিবাবু। ডাল-ভাত যা হোক–
হরি ডাকল,–খ্যাঁদা! ও ঘেঁদু! ঘুমোলি নাকি?
ভেতর থেকে ঢোলা হাফপ্যান্ট পরা একটা নাদুসনুদুস গোলগাল গড়নের যুবক এসে একগাল হেসে বলল,–তখন তোমাকে বলেছিলুম না হরিদা, দু-মুঠো চাল বেশি করে নিই? আর তরকারি তো অনেক আছে।
হরি বলল,–তা হলে স্যারকে একখানা পুরো মিল দে!
কিছুক্ষণের মধ্যে গোগ্রাসে এক থালা ভাত-ডাল-তরকারি-মাছ পরম তৃপ্তিতে খেয়ে সেঁকুর উঠল। হাতমুখ ধুয়ে এবং মুছে বললুম,–অপূর্ব! খাসা আপনার হোটেলের রান্না! খেয়ে এমন তৃপ্তি জীবনে পাইনি!
হরি বলল,–অথচ ব্যাটাচ্ছেলেরা আমার হোটেলের বদনাম রটায়! কী আর বলব স্যার? আমার নামে থানায় পুলিশের কাছে নালিশ পর্যন্ত করেছিল। যাকগে সেসব কথা। আপনি আমার অতিথি। আপনার কাছে দাম নেব না।
কিছুতেই হরি মিলের দাম নিল না। অবশেষে বললুম, ঠিক আছে। তাহলে আমাকে রাত্রে থাকার জন্য একটা ঘর ভাড়া দিন।
হরি জিভ কেটে বলল, ঘর তো নেই স্যার! আমার হোটেল শুধু খাওয়ার হোটেল। এখানে থাকার ব্যবস্থা নেই। আমি আর খাদা ওপরের ঘরে রাত্তির কাটাই। নিচে কি থাকবার জো আছে? নানা উপদ্রবের চোটে অস্থির হতে হবে।
–কী উপদ্রব? হরিবাবু! আমি এই বেঞ্চে শুয়ে রাত কাটাতে পারব। কোনও উপদ্রব গ্রাহ্য করব না।
হরি হাসল। আপনার মাথা খারাপ? কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমারও খিদে পেয়েছে। তা আপনি যাবেন কোথায়?
–কাঞ্চনপুর।
–দিব্যি জ্যোৎস্না-রাত্তির! মোটে তত তিন কিলোমিটার রাস্তা। হাঁটতে-হাঁটতে চলে যান। কোনও ভয় করবেন না। আমাদের এ তল্লাটে আর যা কিছু থাক, চোর ছিনতাইবাজ-ডাকাত নেই। মনের আনন্দে গান গাইতে-গাইতে চলে যান।
অগত্যা হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছি, হরি হঠাৎ ব্যস্তভাবে ডাকল, স্যার! শুনুন স্যার!
ঘুরে দাঁড়ালুম। সে আমাকে অবাক করে ছটা অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট আমার হাতে গুঁজে দিল। বললুম,–অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট কী হবে?
হরি মুচকি হেসে বলল,–বাইরের মানুষ! হরির হোটেলে খেয়েছেন। যদি দৈবাৎ অম্বল হয়-টয়! আপনি আমার এ রাত্তিরের একমাত্র খদ্দের স্যার! আপনি আমার সার্টিফিকেটও বটে।
বলে সে হোটেলে ফিরে গেল। আমি এতক্ষণে একটু চিন্তায় পড়লুম। খেতে তো সবই সুস্বাদু মনে হচ্ছিল। তাই খেয়েছিও প্রচুর। প্যান্টের বেল্ট ঢিলে করতে হয়েছে। কিন্তু অ্যান্টাসিড কেন?
দুধারে মাঠ। নির্জন পিচরাস্তায় গুনগুন করে সত্যিই মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে হাঁটছিলুম। জ্যোত্সায় চারদিক বেশ স্পষ্ট। কিছুদূর চলার পর মনে হল পেট বেজায় ওজনদার হয়ে উঠছে। তখন দুটো অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট মুখে পুরে চুষতে থাকলুম।
আরও কিছুদূর হাঁটার পর পেটের ওজন কমেছে মনে হল। সেইসময় নেহাত খেয়ালবশে একবার পিছু ফিরে দেখি, আমার পিছনে কেউ হেঁটে আসছে। একজন সঙ্গী পাওয়া গেল ভেবে দাঁড়িয়ে গেলুম। অমনি সেই লোকটাও দাঁড়িয়ে গেল। বললুম,–কে?
কোনও সাড়া এল না। একটু ভয় পেলুম। ছিনতাইবাজ বা ডাকাত নয় তো? চলার গতি বাড়ালুম। তারপর এক অদ্ভুত ঘটনা লক্ষ করলুম। যতবার পিছনে তাকাচ্ছি, দেখছি জ্যোৎস্নায় কালো রঙের মূর্তির সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুপাশের মাঠ থেকে একজন-দুজন করে আরও নোক এসে সেই ছায়ামিছিলকে বাড়িয়ে তুলছে। অবশেষে ঘুরে দাঁড়িয়ে চ্যাঁচামেচি করে বললুম,–তোমরা যেই হও, আমার কাছে ডাকাতি করার মতো মালকড়ি নেই। বন্ধুর মেয়ের অন্নপ্রাশনে উপহার দিতে কিছু পুতুল আর জামা কিনেছি। নগদ টাকাকড়ি যা আছে, তা তোমরা কেড়ে নিয়ে ভাগাভাগি করলে প্রত্যেকে একটা আধুলির বেশি পাবে না। কাজেই তোমরা কেটে পড়ো।
আশ্চর্য ব্যাপার, কালো কালো মানুষের দল স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আবার কিছুটা হেঁটে গিয়ে ঘুরে দেখি, তারা সমান দূরত্বে আমাকে অনুসরণ করছে। এরা কারা? অজানা ত্রাসে শিউরে উঠলুম। সাহস দেখিয়ে খুব চেঁচিয়ে বললুম, সাবধান। আমার কাছে রিভলভার আছে। আমি কিন্তু পুলিশের লোক। গুলি করে মুন্ডু উড়িয়ে দেব।
কিন্তু এই হুমকিতেও কাজ হল না। আমি যত দ্রুত হাঁটছি, তারা একই দূরত্বে নিঃশব্দে হেঁটে আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালে তারাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
এই অদ্ভুত মায়াকালো মিছিল পিছনে নিয়ে হেঁটে চলা সহজ ছিল না। আমার গলা তৃষ্ণায় শুকিয়ে গেছে। সঙ্গে জলের বোতল নেই। এমনকী একটা টর্চও আনিনি। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আমি দৌড়তে শুরু করলুম। দৌড়তে-দৌড়তে যতবার পিছু ফিরে তাকাচ্ছি, সেই বিভীষিকার আমাকে অনুসরণ করছে।
কিছুক্ষণ পরে সামনে ঘন কালো গাছপালার ফাঁকে রাস্তার ধারে একটা মন্দির দেখতে পেলুম। মন্দিরের উঁচু খোলা চত্বরে কারা বসে কথা বলছিল। আমি দৌড়ে গিয়ে সেখানে দাঁড়াতেই লোকগুলো হইচই করে উঠল। –কে? কে?
হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম,–আমি।
কেউ ধমকে বলল, আমি কে?