রাগ করে লাভ নেই। কার ওপরই বা রাগ করব! নিমেষে প্ল্যাটফর্ম নির্জন নিঝুম হয়ে গেল। কাঁধের ব্যাগ আর পোশাক ঝেড়েঝুড়ে রুমালে মুখ মুছলুম। ট্রেনটা হুইসল বাজিয়ে আস্তেসুস্থে চলে গেল। সেই সময় হঠাৎ মাথায় এল, ট্রেনে ডাকাতি হচ্ছিল সম্ভবত। তাই অত সব যাত্রী প্রাণভয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে গেল!
এতক্ষণে ভয় পেলুম। রাত আটটা বাজে। প্ল্যাটফর্মে আর স্টেশনঘরে আলো জ্বলছে। গেটে মানুষজন নেই। সেখানে গিয়ে একটু দাঁড়ালুম। ডাকাতরা ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনঘরে ঢুকে হামলা করেছে কি না দেখবার জন্য উঁকি মারলুম।
নাঃ। স্টেশনঘরে উর্দিপরা এক ভদ্রলোক চেয়ারে বসে চোখ বুজে ঝিমোচ্ছেন। তাকে বললুম,–একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?
তিনি চোখ না খুলেই বললেন,–পারেন। তবে আপনার বরাতে হরির হোটেল আছে।
অবাক হয়ে বললুম, হরির হোটেল মানে?
–হুঁ। এ তল্লাটে নতুন এসেছেন। যাবেন কোথায়?
–কাঞ্চনপুর।
–সেখানে কার বাড়ি যাবেন?
একটু বিরক্ত হয়ে বললুম,–সেখানে আমার বন্ধুর বাড়ি।
রেলকোট পরা ভদ্রলোক এবার চোখ খুলে একটু হেসে বললেন, আপনার বন্ধু আপনাকে এখানকার হালহদিশ কিছুই জানাননি দেখছি। তা কী আর করবেন? হরির হোটেল এখন আপনার ভবিতব্য।
কথা না বাড়িয়ে বললুম,–গেটে টিকিট নেওয়ার লোক নেই। টিকিটটা নেবেন কি?
–টিকিট কেটেছেন? তা এ তল্লাটে নতুন প্যাসেঞ্জার। টিকিট কাটবেন বইকী। ইচ্ছে হলে দিন। না হলে দেবেন না।
বুঝলুম, এই ভদ্রলোকই স্টেশনমাস্টার। মাথায় হয়তো ছিট আছে। টিকিটটা ওঁর সামনে টেবিলে রেখে বললুম,–আচ্ছা, এবার বলুন তো, অতসব যাত্রী ট্রেন থেকে ওভাবে মরিয়া হয়ে নেমে দৌড়ে পালাল কেন?
–আজ যে শনিবার। তাতে ট্রেন চার ঘণ্টা লেট।
–বুঝলুম না।
–বুঝতে পারবেন। গেট পেরিয়ে নিচের চত্বরে যান।
গেট পেরিয়ে গিয়ে দেখি, কয়েক ধাপ সিঁড়ির নিচে একটা খোলামেলা জায়গা। একপ্রান্তে কিছু দোকানপাট। অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় লক্ষ করলুম, চত্বর একেবারে জনহীন। আমার সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু নির্মল বলেছিল, স্টেশন থেকে নামলেই বাস, সাইকেলরিকশা বা এক্কা ঘোড়ার গাড়ি একটা কিছু পেয়ে যাব। কিন্তু কোথায় তারা?
একটা চায়ের দোকানে আলো জুলছিল। সেখানে গিয়ে বেঞ্চে বসে বললুম, পরের বাস কটায় দাদা?
চা-ওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, বাবুমশাইয়ের আসা হচ্ছে কোত্থেকে?
–কলকাতা।
–ঠিক, ঠিক। তা যাওয়া হবে কোথায়?
–কাঞ্চনপুর। পরের বাস কখন আসবে?
–বাবুমশাই! এ রাত্তিরে আর বাস আসবে না। আসবে সেই ভোরবেলা। কেননা রাত্তিরে তো এই স্টেশনে আর কোনও ট্রেন থামে না।
–সাইকেলরিকশো বা একাগাড়ি?
চা-ওয়ালা হাসল। আজ্ঞে না। খামোকা কেন রাত্তিরবেলা ওরা আসবে? বাবুমশাই! আপনি বড় ভুল করেছেন। আসবার সময় দেখেননি সোনাগড় জংশনে হঠাৎ ট্রেনের কামরায় বেজায় ভিড় হয়েছিল?
মনে পড়ে গেল। বললুম,–তুমি ঠিক বলেছ। কামরা একেবারে ফাঁকা ছিল। হঠাৎ ওই জংশনে ভিড়ের চাপে কোণঠাসা হয়ে গিয়েছিলুম।
–ব্যাপারটা হল, এ তল্লাটের অসংখ্য লোক সোনাগড়ে কলকারখানায় চাকরি করে। তারা প্রতি শনিবারে বাড়ি ফেরে। রোববারটা কাটিয়ে আবার সোমবার সোনাগড় যায়। আপনি যদি ট্রেন থেকে নেমেই ওদের সঙ্গে দৌড়ে আসতেন, তা হলে হয়তো বাসে বা সাইকেলরিকশো, নয়তো এক্কাগাড়িতে ঢুকে যেতে পারতেন। হ্যাঁ–সহজে পারতেন না। একটু কসরত করতে হতো, এই যা!
এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারলুম। নির্মলের ওপর রাগ হল। এই ব্যাপারটা আমাকে তার খুলে বলা উচিত ছিল।
কিন্তু আর রাগ করে লাভ নেই। তাছাড়া নির্মলের মেয়ের অন্নপ্রাশন কাল রবিবার। আমি কবে যাব, নির্দিষ্ট করে তাকে তো বলিনি! শুধু বলেছিলুম,–নিশ্চয় যাব। শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করিস।
বললুম,–এক কাপ চায়ের ব্যবস্থা করা যায় না দাদা?
চা-ওয়ালা গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ল, না বাবুমশাই! উনুনে আমার রাতের রান্না শেষ করে জল ঢেলে দিয়েছি। আর চা করার কোনও উপায় নেই।
–আচ্ছা, এখানে হরির হোটেলটা কোথায়?
লোকটা যেন চমকে উঠল-হরির হোটেল। এর আগে কখনও হরির হোটেলে খেয়েছিলেন নাকি?
–না। আমি এই প্রথম এখানে আসছি। হরির হোটলের কথা স্টেশনমাস্টারের মুখে শুনলুম।
–ও। হরির হোটেলে যখন যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, চলে যান। তবে একটু দেখেশুনে যাবেন।
বলে চা-ওয়ালা আমার মুখের সামনেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিল। এখানে দেখছি সবই অদ্ভুত। লোকজনও অদ্ভুত! হরির হোটেলে যেতে দেখেশুনে যাব কেন? কিছু বোঝা গেল না।
এতক্ষণে চাঁদ আরও উজ্জ্বল হয়েছে। সব দোকানপাট বন্ধ। শুধু শেষদিকটায় আলো জ্বলছে। সেখানে গিয়ে দেখলুম, একটা ঘর খোলা আছে। দরজার কাছে টেবিলের সামনে একজন রোগাটে গড়নের কালো রঙের লোক বসে আছে। পরনে ধুতি আর হাতকাটা ফতুয়া। ভেতরে দুসারি লম্বা বেঞ্চের সঙ্গে উঁচু ডেস্ক আঁটা। দেখেই বোঝা যায় এটা একটা হোটেল।
এই তা হলে হরির হোটেল? লোকটি আমাকে দেখেই কেন যেন সবিনয়ে করজোড়ে নমস্কার করল। আমিও নমস্কার করে বললুম,–এটাই কি হরিবাবুর হোটেল?
সে জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে স্যার, দয়া করে আমাকে বাবু বলবেন না। আমি একজন সামান্য লোক। বাইরে টাঙানো সাইনবোর্ড দেখুন! লেখা আছে অন্নপূর্ণা হোটেল। কিন্তু এ তল্লাটে সবাই বলে হরির হোটেল।