ধুড়মুড় করে উঠে বসতেই কে হিন্দিতে বলল,–তবিয়ত ঠিক হ্যায় বেটা? শরীর ঠিক আছে তো?
একজন লেংটিপরা জটাজুটধারী সাধুকে দেখতে পেলাম, আমার পিছনে বসে আছেন। তাঁর এক হাতে একটা পিদিম, অন্যহাতে জলের লোটা। এবার লোটাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,–পিও বেটা। জল খাও!
ঢকঢক করে জল খেয়ে মাথা এবার পরিষ্কার হয়ে গেল। বললাম, আমি কোথায় আছি?
সাধু বললেন, আমার ডেরায় আছে বাবা। কোনও ভয় নেই।
–কেমন করে এলাম এখানে?
–আমি তুলে নিয়ে এসেছি। নদীর চড়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলে। ভাগ্যিস, আমি তখন যাচ্ছিলাম নদীর বালি খুঁড়ে জল আনতে। নয়তো খুব বিপদে পড়ে যেতে। এইসব পাহাড়ে খুব চিতাবাঘের উপদ্রব আছে। মড়া ভেবে তোমাকে খেয়ে ফেলত! ভগবানের দয়ার তুমি জোর বেঁচে গেছো বেটা। বলে সাধু হাসতে থাকলেন।
বললাম, তাহলে দেখছি চুরাইলটা আমাকে মেরে ফেলতে পারেনি। সাধু গম্ভীর হয়ে তাকালেন আমার দিকে। বললেন,–চুরাইল!
–হ্যাঁ সাধুবাবা। আমি একটা চুরাইলকে দেখে আর তার চিৎকার শুনে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম।
সাধু আবার হো-হো করে হেসে উঠলেন,–ও, বুঝেছি তুমি কাকে চুরাইল বলছ! বেটা, বোকা লোকেরা তাই রটিয়েছে বটে। ও চুরাইল নয়, তোমার-আমার মতোই মানুষ!
–মানুষ! অবাক হয়ে বললাম।
–হ্যাঁ বেটা। ও এক হতভাগিনী মেয়ে। পাগলি। এই পাহাড়ের একটা গুহায় থাকে। খিদে পেলে দূর-দূরান্তের গ্রামে রাতে গিয়ে খাবার চুরি করে এনে খায়। কারণ ও ভিক্ষে চাইলে কেউ দেয় না। ওর চেহারাটা আগুনে পুড়ে বীভৎস হয়ে গেছে।
–কে সাধুবাবা?
–ওর একমাত্র মেয়ে ঘুমঘুমি স্টেশনে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যায়। সেই শোকে ও পাগলিনী হয়ে কোথায় চলে গিয়েছিল। পরে ফিরে এল যদি, কে ওই নির্জন স্টেশনে ওকে খেতে-পরতে দেবে? পেটের জ্বালায় বেচারি গ্রামে ভিক্ষে করতে যেত আর ওর সেই মেয়ের বয়সি কোনও মেয়ে দেখলেই তার দিকে তাকিয়ে থাকত। একবার হল কী, বিহারের এইসব গাঁয়ের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন সব মানুষ ওকে ডাইনি ভেবে আগুনে পুড়িয়ে মারবার চেষ্টা করল। দৈবাৎ সে-গ্রামে পুলিশ এসেছিল সেদিন। পুলিশ এসে হতভাগিনীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর ঘা সেরে উঠলে সে পালিয়ে আসে আবার ঘুমঘুমিতে।
সাধুবাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের বললেন, ওর ওই এক বিদঘুঁটে স্বভাব বেটা। মানুষকে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। কিন্তু মাঝে-মাঝে শুনি অনেক রাতে মেয়ের নাম ধরে কাঁদছে। আমি সন্ন্যাসী মানুষ বেটা, কিন্তু সে কান্না শুনলে আমিও স্থির থাকতে পারিনে।
বললাম, কিন্তু ওঁর স্বামী তো বেঁচে আছেন শুনলাম। জংশনে না কোথায় যেন আছেন সেই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক!
সাধুজী বললেন,–সে খোঁজ আমি কি নিইনি? তিনি বছর পাঁচেক আগে চাকরি ছেড়ে সপরিবারে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। সে ঠিকানা যোগাড় করতে পারিনি। যাকগে, রাত অনেক হয়েছে। এখন এই সামান্য রুটিটুকু খেয়ে ভগবানের নাম করে শুয়ে পড়ো বেটা। বহুত তকলিফ হবে জানি। কিন্তু কী আর করবে? এ তো সাধু-সন্ন্যাসীর গুহা। এখন নির্ভয়ে ঘুমোও। সকালে তোমার পরিচয়, হালহদিশ শুনব। এখন তুমি অসুস্থ।-বলে সাধুজি একটা কম্বল পেতে দিলেন। কোণা থেকে শালপাতায় একটা রুটি এনে সামনে ধরলেন।
বললাম, বরং আমায় স্টেশনে পৌঁছে দিন সাধুবাবা। মামা খুব ভাবনায় পড়বেন আমি না ফিরলে।
সাধুজি অবাক হয়ে বললেন,–স্টেশন? কোন স্টেশন? আর তোমার মামাই বা কে?
–কেন? ঘুমঘুমি স্টেশন। আমার মামা সেখানকার স্টেশনমাস্টার।
সাধুজি সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কী বলছ তুমি? ঘুমঘুমি তো কবে থেকে পোড়ো হয়ে আছে! সাইনবোর্ডে আর ভাঙা স্টেশনঘরের গায়ে বড় বড় ইংরিজি হরফে লেখা আছে : অ্যাবান্ডানড।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, অসম্ভব। আজ তিন দিন ধরে সেখানে আছি। ঘুমঘুমির টিকিট কেটেই তো সেখানে পৌঁছেছিলাম।
সাধুজি হো-হো করে হেসে উঠলেন আবার,-এ ছেলেটার মাথা গড়বড় হয়ে গেছে। ঘুমঘুমি স্টেশনের নামে টিকিটই নেই। তুমি নিশ্চয় ভুল করছ। হা–ঘুমঘুমির টিকিট চাইলে আজিমাবাদ জংশনের বাবুরা আনাড়ি লোক ভেবে পরের স্টেশনের টিকিট দেন শুনেছি। পরের স্টেশনের নাম কী জানো? ঝুমঝুমি।
টিকিট তো আমার এই প্যান্টের পকেটেই ছিল। তক্ষুনি বের করে অবাক হয়ে দেখি, লেখা আছে ঝুমঝুমি। আবার অজ্ঞান হয়ে যাব মনে হল।
সাধুবাবার সঙ্গে পরদিন সকালে এক মাইল হেঁটে গিয়ে সত্যি দেখেছিলাম, ওটা একটা অ্যাবন্ডানড বা পরিত্যক্ত স্টেশন। যাত্রী ওঠানামা করে না বলে আজিমাবাদনওলগড় ব্রাঞ্চের এই স্টেশনটা কবে বাতিল হয়ে গেছে। আর কলকাতায় ফিরে গিয়ে শুনি, মা চলে গেছেন পাটনা। পাটনা রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে টেলিগ্রাম গিয়েছিল, ঝুমঝুমির স্টেশনমাস্টার অরুণ রায় করোনারি থ্রম্বসিসে মারা গেছেন! হ্যাঁ, ভাঙা স্টেশন কোয়ার্টারে কোনও জবা গাছও ছিল না।
হরির হোটেল
স্টেশনে ট্রেন থামতে-না-থামতেই যাত্রীদের মধ্যে হুলস্থুল বেধে গিয়েছিল। ভিড়ে ঠাসা কামরা। পিছন থেকে প্রচণ্ড চাপ আর তো টের পাচ্ছিলুম। তারপর দেখলুম, কেউ-কেউ আমার কাঁধের ওপর দিয়ে কসরত দেখিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে চ্যাঁচিমেচি চলেছে। অবশেষে ঠেলা খেতে-খেতে যখন প্ল্যাটফর্মে পড়লুম, তখন আমার ওপর দিয়ে অসংখ্য জুতো-পরা পা ছুটে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, অন্য সব কামরা থেকেও পিলপিল করে মানুষ বেরিয়ে স্টেশনের গেটের দিকে ছুটে চলেছে।