পরে কথাটা অরুণমামার কাছে তুললাম। উনি বললেন, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই ধরেছ সুকু। মঞ্জুর বাবা ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। মা বাঙালি মেয়ে। তাই মেয়ের নাম মঞ্জু রেখেছিলেন। ভদ্রমহিলা কিন্তু খ্রিস্টান হয়েও দেবী চণ্ডিকার ভক্ত ছিলেন শুনেছি। ওই জবা গাছটা তারই লাগানো। নিয়মিত পুজোর ফুল দিয়ে আসতেন। পাঁচ মাইল রাস্তা একা যেতেন, একা ফিরে আসতেন। খুব সাহসী মহিলা ছিলেন। মঞ্জু ওইভাবে ট্রেনের চাকায় মারা পড়ার পর উনি নাকি পাগল হয়ে যান। তারপর আর তাঁর পাত্তা পাওয়া যায়নি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্টেশনমাস্টার অনেক খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। পরে বদলি হয়ে যান আজিমাবাদ জংশনে। শুনেছি আবার বিয়ে করেছেন। ছেলেপুলেও হয়েছে।
এসব কথা শোনার পর মঞ্জুর মায়ের জন্যেও দুঃখ হল। মঞ্জু তো ইচ্ছে করলেই ওর মাকে খুঁজে বের করতে পারে। ভূতপ্রেত পারে না-ই বা কী? মাকে দেখা দিলে মায়ের প্রাণে শান্তি আসে। আচ্ছা, আবার যদি ফুল তুলতে আসে মঞ্জু, তাকে বলব তার মায়ের কথা।
কিন্তু আমার প্রতীক্ষা ব্যর্থ হয়। আর মঞ্জুকে দেখি না। জবাফুলও সুগন্ধ ছড়ায় না। এমনি করে দুটো দিন কেটে গেল।
এই দুদিনে আর কোনও অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ল না। তাই সাহস বেড়ে গেল। বিকেলে অনেকটা দূর অবধি রেললাইন ধরে একা বেরিয়ে এলাম। ফিরে এলে অরুণমামা একটু বকাবকি করলেন। তারপর বললেন বেড়াতে গেলে যেন ভজুয়াকে সঙ্গে নিয়ে যাই।
পরদিন বিকেলে মামার কথা মেনে ভজুয়াকে সঙ্গে নিয়েই বেরোলাম।
ভজুয়া চমৎকার বাংলা বলতে পারে। সে এই স্টেশনে দশ বছর ধরে আছে। অনেক ভুতুড়ে ব্যাপার দেখে-দেখে তার সয়ে গেছে। সেইসব গল্প শুনিয়ে কান ঝালাপালা করে দিল সারা পথ।
আধমাইল যাওয়ার পর দেখি একটা ছোট্ট নদী। জল শুকিয়ে বালির চড়া পড়ে আছে। এখানে-ওখানে ছোট ও বড় পাথর ছড়ানো আছে অজস্র। দূর থেকে মনে হবে, একপাল হাতি দাঁড়িয়ে বা বসে আছে চুপচাপ।
ব্রিজের ওপর দিয়ে লাইনটা চলে গেছে দূরের দিকে। আমরা নদীতে নেমে গেলাম। একটা পাথরে বসে সূর্যাস্ত দেখতে থাকলাম। ভজুয়া লোকটি দেখি মহা গল্পবাজ। অনবরত কথা বলছে। কান করছি না। একসময় সূর্যাস্তের পর সে হঠাৎ থেমে চাপাগলায় বলে উঠল, খোকাবাবু! আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা ঠিক নয়। উঠুন, এবার ফিরে যাই।
বললুম,–কেন বলো তো? ভূত আসবে?
ভজুয়া কেমন হাসল। হেসে বলল, না খোকাবাবু, ভূতের ভয় আর আমি করি না। আমার বউ তো করেই না। আপনার মামাবাবুও না। কেউ আমরা ভয় পাই না ভূত দেখে।
–তাহলে আর থাকা ঠিক নয় বলছ কেন?
ভজুয়া ভয়ার্তচোখে নদীর ধারে একটা টিলা দেখিয়ে বলল, ভূতের চেয়ে সাংঘাতিক একজন ওখানে থাকে খোকাবাবু। চুরাইল কাকে বলে জানেন?
–চুরাইল? সে আবার কী?
–শাঁকচুন্নি না কী যেন বলে আপনাদের বাংলা মুল্লুকে? কালো কুচকুচে গায়ের রং। মুখটা পেঁচার মতো। লম্বা শরীর। চোখদুটোর পাতা নেই। তাই পলক পড়ে না। মেয়েদের মতো সাদা কাপড় পরে থাকে। আর খোকাবাবু, তার পাদুটো পিঠের দিকে, মানে উল্টো দিকে ঘোরানো। উল্টো পায়ে হেঁটে থির তাকিয়ে সে আপনার দিকে এগিয়ে আসবে। আপনাকে সে মন্তর দিয়ে আটকে ফেললে, আপনি নড়তেও পারবেন না। তারপর এমন একটা বিচ্ছিরি চ্যাঁচিনি চেঁচিয়ে উঠবে–তা শুনলে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যাবে খোকাবাবু! তাই বলছি, এবার চলে আসুন।
হো-হো করে হেসে বললাম, ভজুয়া! তুমি ভেবো না। তোমাদের চুরাইল আমার একটুও ক্ষতি করতে পারবে না।
ভজুয়া পাথর থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল, খোকাবাবু, আপনার ভালোর জন্যে বলছি। এখন চুরাইলটার বেরুবার সময় হয়েছে।
জেদ ধরে বললাম, তুমি যাও ভজুয়া, আমি যাব না।
ভজুয়া আবার কী বলতে যাচ্ছে, আচমকা সেই টিলার দিকে তীব্র চেরা গলার চঁচানি শোনা গেল। কতকটা এই রকম—আঁ–ইঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ! ইঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁঃ।
ভজুয়া ঠিক বলেছিল। ওই চিৎকার কখনও মানুষের তো নয়ই, কোনও জন্তুরও নয়। পৃথিবীর কোনও শরীরী প্রাণী অমন অমানুষিক চিৎকার করতেই পারে না। ওই চিৎকার শুনলে সত্যি গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায়। হৃৎপিণ্ডে খিল ধরে। শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতেও মনে থাকে না।
ভজুয়াকে দেখলাম, চোখের পলকে ব্রিজের ওপর পৌঁছে গেছে। আমার পা দুটো আটকে গেছে নদীর বালিতে–পাথর থেকে নেমেছি, কিন্তু পা তোলার ক্ষমতা নেই। সেই অবস্থায় টিলাটার দিকে তাকিয়ে দেখি, হ্যাঁ–একটা আবছা মৃর্তি তরতর করে নেমে আসছে আমার দিকে!
ওই তাহলে চুরাইল এবং সত্যি আমি আটকে গেছি। নড়তেও পারছি নে।
কয়েক মুহূর্ত পরে নদীর কিনারায় পৌঁছে গেল চুরাইলটা। তারপর পাথর ডিঙিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। যে পাথরে বসেছিলাম একটু আগে, সেটার ওপর এসে দাঁড়াতেই তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
ভজুয়া ঠিকই বলেছিল। অমন কুৎসিত-ভয়ংকর চেহারা কখনও দেখিনি– কল্পনাও করিনি। এই আবছা অন্ধকারে তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে। নিষ্পলক চোখ। তারপর সে বিকট চিৎকার করে উঠল আগের মতো : আঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ! ইঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ! আমার কানে যেন ঠান্ডা বরফের সূচ ঢুকে গেল।
সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
যখন জ্ঞান হল, বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। একটু পরে যেন টের পেলাম, শক্ত মাটিতে শুয়ে আছি। এবং কে আমার মুখে জলের ঝাঁপটা দিল। তখন চোখ খুলে দেখি একটা পিদিম জ্বলছে। বদ্ধ এবং ছোট্ট একটা জায়গায় আমি নগ্ন পাথুরে মেঝেয় শুয়ে আছি।