অরুণমামাকে অবিশ্বাস করাও তো যায় না। আমার মায়ের দূর সম্পর্কের দাদা এই ভদ্রলোককে অবশ্য খুব কমই দেখেছি আমাদের বাসায়। দুবছর অন্তর একবার করে দেখা দিয়ে এসেছেন মাত্র। তারপর আর পাত্তা নেই! গত দুবছর এমনি বেমালুম নিপাত্ত থাকার পর পুজোর ঠিক আগে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। ঠিকানা দিয়ে আসতে লিখেছিলেন। আসার সময় পাইনি। হঠাৎ কদিন আগে মা একটা কী যেন দুঃস্বপ্ন দেখেন। খুলে বলেননি, কিন্তু তারপর থেকেই তাগিদ দিচ্ছিলেন ওই অরুণদার কাছে গিয়ে যেন খবর নিয়ে আসি, কেমন আছেন। তাই এমনি করে আসা।
কিন্তু ওই অল্পস্বল্প পরিচয়েই অরুণমামাকে যতটুকু জেনেছিলাম, মনে হয়েছিল উনি বেশ জেদি, গম্ভীরপ্রকৃতির এবং সাহসী মানুষ। যাকে বলে ডানপিটে। এখনও বিয়ে করেননি। কাছের আত্মীয়স্বজন কেউ কোথাও নেই। একা থাকেন বরাবর। ওঁর মতো মানুষের পক্ষে ঘুমঘুমি আদর্শ জায়গা হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এমন ভুতুড়ে ব্যাপারের মধ্যে উনি পড়ে আছেন জেনে বেশ অবাক হলাম।
ফের হেসে বললাম, তাহলে মঞ্জুকে আপনি অনেকবার দেখেছেন মামা? খুব জ্বালায় বুঝি?
অরুণমামা মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ। মেয়েটা পাজির পাড়া। সারাক্ষণ জ্বালায়। স্টেশনে আপন মনে কাজ করছি, হঠাৎ কাগজপত্র ছড়িয়ে দিয়ে পালায়। খিলখিল করে হাসতে-হাসতে মাঠের দিকে পালিয়ে যায়। ভজুয়াকে জিগ্যেস করে দেখিস না! ওকে কি কম জ্বালায়? ওর টিকি ধরে টানে। হাঁটুর পেছনে আচমকা সুড়সুড়ি দেয়, আর ভজুয়া আছাড় খায়। পাজি মেয়েটার জন্যে বড্ড ঝামেলায় পড়তে হয় মাঝে-মাঝে। একবার তো ট্রেন আসছে, লাইন ক্লিয়ারের……
বলতে-বলতে হঠাৎ থেমে অরুণমামা জানালার দিকে তাকিয়ে ধমক দিলেন, অ্যাই মঞ্জু! যাব নাকি? তবে রে পাজি মেয়ে।
উনি দরজা অবধি তাড়া করে গিয়ে ফিরলেন। কেরোসিন-কুকারের কাছে বসে কেটলির ফুটন্ত জলে চা-পাতা ফেলে বিড়বিড় করে কী যেন মন্ত্র পড়তে থাকলেন। ততক্ষণে আমি বিস্ময়ে ও আতঙ্কে ঘামতে শুরু করেছি। আগে জানলে কক্ষনও এমন জায়গায় আসতাম না। ওরে বাবা, এ যে সারাক্ষণ ভূত-প্রেত নিয়ে থাকা। ভয়ে ভয়ে জানলার বাইরে তাকাচ্ছিলাম। মঞ্জুকে দেখতে পেলে এবার নিশ্চয় ভিরমি খেতাম সন্দেহ নেই। জানলার বাইরে আকাশে দু-তিনটে নক্ষত্র সবে ফুটে উঠেছে। সেই নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নেই।
একটু পরে দুজনে বসে চা খাচ্ছি, অরুণমামা বললেন, তাঁ, আর যা বলছিলাম। এই স্টেশনে অনেক ট্রেন বা মালগাড়ি আসতে-যেতে দেখবে। কোনওটা থামবে, কোনও যাত্রীও নামবে। কিন্তু জেনে রাখো, কোনও-কোনও গাড়ি মিথ্যে গাড়ি। তার মানে রেলগাড়িই নয়। স্রেফ ভুতুড়ে ট্রেন কিংবা ভুতুড়ে মালগাড়ি। যার যাত্রী, চেকার, গার্ড, ড্রাইভার, ফায়ারম্যান–সবাই ভূত-প্রেত। যে যাত্রী নামবে, সেও জানবে ভূত ছাড়া মানুষ নয়। তাই তো তখন তোমাকে নামতে দেখে আমি মনে-মনে তৈরি হচ্ছিলামভূত হলে অ্যায়সা থাপ্পড় কষব!…
শুনে আমি আঁতকে উঠে বললাম, ওরে বাবা!
অরুণমামা সস্নেহে আমার পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন,–পাগল! তোকে থাপ্পড় মারতাম নাকি? তুই তো মানুষ। দেখলেই চেনা যায়।
এই প্রথম আমার মনে হল, অরুণমামা আমার পিঠে যে-হাতটা এইমাত্র রেখে তুলে নিলেন, সেটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা। জামার তলায় পিঠের সেই অংশটুকু যেন কতক্ষণ জমে নিঃসাড় হয়ে রইল। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে অরুণমামাকে দেখে নিলাম মাঝে মাঝে। তারপর খুব সাহসের সঙ্গে মনে-মনে তৈরি হতে থাকলাম। ঘুমঘুমিতে যখন এসেই পড়েছি, সহজে কাবু হব না। ভূতের সঙ্গে লড়াই করেই বীরের মতো প্রাণ বিসর্জন দেব।
কিন্তু অরুণমামা যে ভূত নন, তার প্রথম অকাট্য প্রমাণ, তিনি মারা তো যাননি। মারা গেলে খবর পেতাম। আত্মীয় বলতে তো যতদূর জানি, একমাত্র আমরাই আছি।
দ্বিতীয় অকাট্য প্রমাণ, ভূত কখনও এমন চমৎকার চা, কিংবা পাঁঠার মাংস রান্না করতে পারে না।
ভূতের রান্না খেয়ে হজম করাও সহজ কথা নয়। অথচ দিব্যি হজম হয়ে গেল। ভূতের পাশে শুয়ে রাত কাটিয়ে সকালে নিজেকে জ্যান্ত আবিষ্কার করাও কি যায়?
মোটেও না। সারারাত গভীর ঘুমে ঘুমিয়েছি। অরুণমামা ভূত হলে ঘাড় মটকাবার এমন সুযোগ কখনও ছাড়তেন না।
অতএব খুশি হলাম যত, সাহসও পেলাম তত। অরুণমামা যখন মানুষ, তখন ভজুয়া ও লছমিও মানুষ ছাড়া ভূত নয়। কিন্তু হায়…থাক। সে কথা পরে।
শুধু আগের স্টেশনমাস্টারের মেয়ে হতভাগিনী মঞ্জুর ব্যাপারটা ধাঁধা থেকে গেল। কতবার উঠোনের জবাফুলের গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম সারাটা সকাল। কিন্তু সে আর ফুল চাইতে এল না। ফ্ৰকপরা সুন্দর অতটুকু মেয়েটা-বয়স কত আর হবে? দশ-বারো বছরের বেশি নয়। তাকে আবার দেখতে পেলে জিগ্যেস করতাম, ভূত হওয়াটা সুখের, না দুঃখের? ভূতেরা থাকেই বা কোথায়?
একসময় হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, জবাফুলগুলো তো কালকের মতো আর সুগন্ধ ছড়াচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে গন্ধহীন হয়ে গেছে আবার।
তখন ভীষণ চমক জাগল। তাহলে কি মঞ্জুর আবির্ভাবের সঙ্গে সেই মিষ্টি গোলাপফুলের গন্ধের কোনও সম্পর্ক আছে?
নিশ্চয় আছে। মঞ্জু এসেছিল বলেই জবাফুলের মধুর গন্ধ ছড়াচ্ছিল। এই গন্ধ মঞ্জুই নিয়ে আসে।