একটা মোটে কোয়ার্টার। তার দরজার তালা খুলতে খুলতে অরুণমামা বললেন, আমার বন্ধু বল, দেখাশোনার লোক বল, এই ভজুয়া আর তার বউ লছমী। একজন খালাসি ছিল ঝাটুয়া নামে। সে ব্যাটা অনেক চেষ্টা করে বদলি নিয়েছে। আর নতুন লোক আজ অবধি এল না। কেউ এই ঘুমঘুমি স্টেশনে আসতে চায় না। বুঝলি?
বললাম, কেন মামা?
অরুণমামা ঘরে ঢুকে বললেন,–কেন তা বুঝতে পারছিস নে সুকু? এই পাণ্ডববর্জিত নির্জন জায়গায় কি কেউ থাকতে চায়? কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ এখানে হাঁফিয়ে উঠবে।
–আপনি আছেন যে? তাছাড়া ওই ভজুয়া আর তার বউও তো আছে?
অরুণমামা আমার প্রশ্ন শুনে একটু হেসে বললেন,–এর কোনও স্পষ্ট জবাব দেওয়া সত্যি কঠিন সুকু। শুধু এটুকু বলতে পারি, নির্জন জায়গায় থাকতে কোনও কোনও মানুষ হয়তো ভালোবাসে। যেমন আমি। প্রথমে কিছুদিন ভালো লেগেছিল। তারপর খারাপ লাগতে শুরু করল। তখন পড়াশুনায় মন দিলাম। রাজ্যের বইপত্তর কিনে আনি জংশন শহর থেকে, আর পড়ি। তারপর সয়ে গেল সব। এখন বরং এ জায়গা থেকে চলে যেতে হলে খুব কষ্ট পাব। যাক গে, তুই আটচল্লিশ ঘণ্টার জানিতে ক্লান্ত। বারান্দায় বালতিতে জল আছে। হাত-মুখ ধুয়ে নে। আমি চা জলখাবারের জোগাড় করি।
অরুণমামা চোখ নাচিয়ে ফের বললেন,–বুঝতেই তো পারছিস, স্বপাক খাই। কিন্তু আমার রান্নার স্বাদ পেলে আর কলকাতায় ফিরতে ইচ্ছেই করবে না তোর।
আজ রাতে কী রান্না করব জানিস? পাঁঠার মাংস।
অবাক হয়ে বললাম,–পাঁঠার মাংস এখানে কোথায় পেলেন মামা?
–মাইল পাঁচেক দূরে চণ্ডিকাঁদেবীর মন্দির আছে। কাল তোকে নিয়ে যাব সেখানে। মন্দিরের পুরোহিতের সঙ্গে আমার খুব খাতির আছে। বলি পড়লেই প্রসাদি মাংস পাঠিয়ে দেন।
বলে অরুণমামা কেরোসিন কুকার ধরাতে ব্যস্ত হলেন। আমি ভেতরের বারান্দায় গিয়ে বালতির ঠান্ডা জলে হাত-মুখ-পা রগড়ে ধুলাম। ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। উঠোনের কোণায় পাঁচিল ঘেঁষে একটা প্রকাণ্ড জবা গাছে বড়-বড় ফুল ফুটেছে। এই রুক্ষ নীরস শ্রীহীন তেপান্তরে ওই ফুলগুলো দেখে কী যে ভালো লাগল।
ফুলগুলো যে সত্যিকার ফুল বিশ্বাস করাই কঠিন। চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে তো বটেই, এমন গোলাপি পাপড়ি এবং হলুদ পরাগের জবা এর আগে কোথাও দেখিনি। তার চেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার, জবাফুলে গোলাপের মতো মিঠে আঁজালো গন্ধ কেন?
কাছে গিয়ে খুঁজছিলাম পাশে কোথাও গোলাপ গাছ আছে নাকি। কিন্তু না, আর কোনও ফুলগাছ নেই। শুধু ওই একটাই জবা গাছ–প্রকাণ্ড ঝাড়। তাজ্জব হয়ে ভাবছি, একটা নতুন ব্যাপার দেখলাম তাহলে। জবাফুলে গোলাপের গন্ধ!
ঠিক সেই সময় পাচিলের ওপর একটা বছর দশ-বারো বয়সের মেয়ের মাথা দেখা গেল। আমি একটু চমকে উঠেছিলাম। তারপর মেয়েটি পাঁচিলের ওপর ওঠে পা ঝুলিয়ে বসল। তখন সূর্য ডুবে গেছে ঘুমঘুমির মাঠে। ফিকে গোলাপি আলোটাও মুছে গেছে। মেয়েটি হাসিমুখে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। তার কেঁকড়ানো চুলগুলো ঈষৎ লালচে। চোখের তারা নীল। মেমসায়েবদের মতো। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা।
বললাম,–কোথায় থাকো খুকুমণি?
কপরা খুকুমণিটি হেসে বাইরের দিকে আঙুল তুলে দেখাল।
কিন্তু বাইরে তো কোনও বাড়ি দেখিনি কোথাও। হ্যাঁ–একটা ছোট্ট ঘর আছে বটে, সেখানে সম্ভবত ওই ভজুয়ারা থাকে তাহলে ভজুয়ারই মেয়ে। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে এবার ফিসফিস করে বলল,–একটা ফুল দাও না!
যেই ফুল ভাঙতে হাত বাড়িয়েছি, পিছনে অরুণমামা বলে উঠলেন,–ও কী করছিস সুকু? ফুল তুলছিস নাকি? উঁহু কক্ষনো ওই কাজটি করবি নে বাবা। ওই ফুলগুলো মানসিক করা। প্রতিদিন সেই চণ্ডিকার মন্দিরের লোক এসে নিয়ে যায়।
অপ্রস্তুত হেসে বললাম, মামা, ওই মেয়েটা ফুল চাইছিল কিনা, তাই…
অরুণমামা আমার কাছে দৌড়ে এসে বললেন,–মেয়েটা? কোন মেয়েটা?
ওই যে।–বলে আমি পাঁচিলের দিকে মুখ তুলে কিন্তু কাকেও দেখতে পেলাম না। তাহলে নির্ঘাত বেচারি লাফ দিয়ে নেমে পালিয়েছে অরুণমামার ভয়ে।
অরুণমামা পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে শুধু বললেন, হুঁ।
তারপর আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। ঘরে গিয়ে চাপাগলায় বললেন,-একটা কথা বলি, শোন সুকু। ঘুমঘুমি বড় অদ্ভুত জায়গা। এখানে অনেক কিছু দেখবি। কিন্তু সাবধান, মাথা ঠিক রাখবি।
অবাক হয়ে বললাম, অনেক কিছু দেখব মানে?
অরুণমামা গম্ভীরমুখে বললেন,–ওই মেয়েটা কে ছিল জানিস? আগেকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্টেশনমাস্টারের ছোট মেয়ে মঞ্জু। বছর দশেক আগে মঞ্জু ট্রেনে কাটা পড়েছিল। আনমনে লাইনের ওপর খেলা করছিল, ট্রেনের হুইসেল শুনতে পায়নি।
শিউরে উঠেছি সঙ্গে সঙ্গে। তাহলে কি আমি মঞ্জুর ভূত দেখলাম? অসম্ভব। আমি প্রত্যক্ষ দেখলাম। নিশ্চয় মামা আমার সঙ্গে তামাশা করছেন। মনের তলায় ভয় এসে চুপিচুপি দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু মুখের ভাবে সাহস রেখে হেসে বললাম, ভূতটুতে আমার বিশ্বাস নেই, মামা!
অরুণমামা হাসলেন না একটুও। আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি এখন সোমত্ত ছেলেটি হয়ে উঠেছ। ভূতপ্রেতে বিশ্বাস না থাকারই কথা। বিশেষ করে কলকাতায় থাকো তুমি। সেখানে আলোর দেশ। কিন্তু বাবা সুকু, এ হল অন্ধকারের দেশ। শহর তো দূরের কথা, গ্রাম বলতে ধারে কাছে কিছু নেই। সবচেয়ে কাছের গ্রামটির দূরত্ব সাত মাইল। অবশ্য দেবী চণ্ডিকার মন্দির আছে মাইল পাঁচেক দূরে। কিন্তু সেখানে থাকেন শুধু পূজারী আর তার একজন লোক। তাই বলছি, এই ঘুমঘুমি স্টেশনে অনেক বিচিত্র ব্যাপার তুমি দেখতে পাবে।