সে রাত্তিরে আমরা প্রায় জেগেই কাটালাম। এত আলো, এমন উজ্জ্বল আলো ছেড়ে কি ঘুমোতে ইচ্ছে করে?
শুধু ঠাকুমার মুখ গম্ভীর। কেন গম্ভীর, তা সকালবেলায় জানতে পারলাম। বাগানের কোণায় একটা বেলগাছ ছিল, সেই গাছে থাকত এক বেম্মদত্যি। সকালে দেখি, ঠাকমা বেলতলায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি ঝিলের দিকে।
ঠাকুমার কাছে গেছি, সেই সময় মোনা-ওঝা ঝিলের দিক থেকে হন্তদন্ত এসে ধপাস করে বসে পড়ল। ঠাকুমা বললেন,-খুঁজে পেলি?
মোনা-ওঝা ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল, নাহ। সব পালিয়েছে। কেউ নেই।
ঠাকুমা বেলগাছের ডগার দিকে মুখ তুলে বললেন, এ বুড়োও পালিয়ে গেছে। কাল রাত্তিরে স্পষ্ট দেখলাম, যেই ওই আলোটা জ্বলেছে, অমনি বুড়ো গাছ থেকে নেমে পালিয়ে গেল। ওই দ্যাখ, হাত থেকে হুঁকোটা পড়ে গেছে। কল্কেটাও পড়ে আছে দেখতে পাচ্ছিস?
মোনা উদাসচোখে হুঁকোটার দিকে তাকিয়ে বলল,–দিদিঠাকরুন যদি হুকুম দেন, বাবা বেম্মদত্যির কোকস্কে আমিই নিয়ে যাই।
নিয়ে যা।–ঠাকুমা করুণমুখে বললেন। তবে এঁটো করিসনে যেন। বামুনবুড়ো জানতে পারলে কষ্ট পাবে। রোজ রাত্তিরে বুড়ো হুঁকো খেত আর খকখক করে কাশত। আহা, কোথায় ভিটেছাড়া হয়ে চলে গেল সব?
মোনা-ওঝা হুঁকোকল্কে কুড়িয়ে নিয়ে বলল, আমার সবচেয়ে দুঃখুটা কী জানেন দিদিঠাকরুন? শাঁকচুন্নি আর কন্ধকাটার বিয়েটা ভন্ডুল হয়ে গেল। এ আলো কি যেমন-তেমন আলো? ইলেকটিরি বলে কথা। আমি যে মানুষ, আমারও চোখ জ্বালা করে। তবে দেখবেন দিদিঠাকরুন, এ পাপ সইবে না। আমি বরাবর বলে আসছি, কাউকে ভিটেছাড়া করার মতো পাপ আর নেই। এই মহাপাপ কি ভগবান সইবেন ভাবছেন? কক্ষনও না।…
ঠিক তা-ই।
মোনা-ওঝার কথা ফলেছে বলা চলে। এখন বড় হয়েছি। কলকাতায় থাকি। খবর পাই, আমাদের গাঁয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন বিদ্যুৎ থাকে না। মোনার ভগবান নাকি লোডশেডিং নামে এক সাংঘাতিক দানো পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে ভিটেছাড়া ভূতগুলোকে ফিরিয়ে এনেছে। তাছাড়া চোখে সইয়ে-সইয়ে বিদ্যুতের আলো দিয়ে ভূতগুলোকে সে চাঙ্গা করে তুলেছে। সেইসব ভূতই নাকি তার কাটে। ট্রান্সফরমার চুরি করে। কত উপদ্রব বাধায়। ঠাকুমা বেঁচে নেই। মোনাও বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে শাঁকচুন্নি আর কন্ধকাটার বিয়েটা লোডশেডিংয়ের দৌলতে ঘটা করেই ওঁরা দিতেন।
বললে তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না। গত পুজোয় গাঁয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাত্তিরে হঠাৎ লোডশেডিং অভ্যাসমতো ঠাকুমার সেই ঘরে শুয়েছিলাম। রাতদুপুরে বাগানে হঠাৎ খকখক করে কাশির শব্দ শুনে জানলায় উঁকি মেরে দেখি, সেই বেলগাছে হুঁকোর আগুন জ্বগজুগ করছে। খুব খুশি হলাম। মানুষের জীবনে ভূতটুত না থাকলে কি চলে? জীবনটাই যে নীরস হয়ে যাবে, যদি না থাকে ভূতপেতনি, যদি না থাকে অন্ধকার।…
স্টেশনের নাম ঘুমঘুমি
ভুল করে অন্য কোথাও নেমে পড়েছি নাকি? ট্রেন চলে গেলে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চারদিক দেখতে থাকলাম। মানুষ নেই জন নেই,
গাছ নেই পালা নেই, এ কেমন জায়গা?
নাঃ, ভুল হয়নি। ওই তো হলুদ বোর্ডে লেখা আছে ঘুমঘুমি। দেখে স্বস্তি পেলাম। তারপর চোখে পড়ল রেলের পোশাকপরা একটা লোক স্টেশনের উঁচু খোলামেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। কোনও যাত্রী নামেনি আমি ছাড়া। টিকিট নেওয়ার জন্যও কেউ নেই মনে হল।
স্টেশনের পিছনে কোয়ার্টারটাও চোখে পড়ল। তখন নিচু প্ল্যাটফর্মে আস্তে– আস্তে হেঁটে স্টেশনঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। বলা বাহুল্য, খুব হতাশ হয়ে গেছি। এমন একটা অখাদ্য নির্জন স্টেশনে অরুণমামা থাকেন, ভাবতেই পারিনি।
চারদিকে ধুধু রুক্ষ মাঠ। কদাচিৎ দূরে একটা গাছ। সেও একেবারে ন্যাড়া। আর এদিকে-ওদিকে ছোটখাট পাহাড় বা টিলা। রেললাইনটা এই মাঠ পেরিয়ে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। কেমন একটা শূন্যতা খাঁখাঁ করছে চারপাশে।
রেলের পোশাক পরা লোকটি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। মুখে গোঁফদাড়ি দেখে আমি সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারিনি অরুণমামাকে। বললাম, আচ্ছা, স্টেশনমাস্টার অরুণ রায় কি আছেন, না বদলি হয়ে গেছেন?
একথা জিগ্যেস করার কারণ, অরুণমামা আমাকে আসতে লিখেছিলেন সেই পুজোর পর। আর এখন বোশেখ মাস। তারপর এতদিন আর কোনও চিঠি লেখালেখি নেই।
তা আমার কথা শুনে ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে বললেন, বদলি হবেন মানে? তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন। তুমি কোত্থেকে আসছ?
–কলকাতা থেকে! অরুণবাবু আমার মামা হন।
অমনি ভদ্রলোক লাফিয়ে উঠে হাসতে-হাসতে বললেন,-সুকু, তুই? ওরে, তুই এত্তো বড়টি হয়েছিস রে! আঁ? তোকে যে আর চেনাই যাচ্ছে না রে!
আর আমিও দাড়িগোঁফের আড়ালে অনেকদিন আগে দেখা মুখখানা আবিষ্কার করে ফেলেছি তক্ষুনি। বললাম,–ও মামা! আপনাকেও যে চেনা যাচ্ছে না। দাড়িগোঁফ রেখে একেবারে সাধুসন্নেসী হয়ে গেছেন যে।
অরুণমামা আমাকে জাপটে ধরে এগিয়ে গেলেন। স্টেশন-ঘরের দরজায় পয়েন্টসম্যানকে ডেকে বললেন,–ভজুয়া! এ কে এসেছে দেখছিস। আমার ভাগ্নে সুকুমার!
ভজুয়া আমাকে সেলাম দিয়ে হাসল।
অরুণমামা বললেন,–বাবা ভজুয়া! আমি একে কোয়ার্টারে নিয়ে যাই। তুই থাকিস। সন্ধে ছটার ডাউন আসার সময় হয়ে গেল। সিগন্যাল দিয়ে রাখা।
ওকে আরও কিছু নির্দেশ দিয়ে অরুণমামা আমাকে নিয়ে চলতে থাকলেন। গেট পেরিয়ে একটা চটান মতো জায়গায় কুয়ো আছে দেখলাম। কুয়োর কাছে একটি দেহাতি মেয়ে বালতি করে জল তুলছিল। ঘোমটা টানল আমাদের দেখে। অরুণমামা বললেন, লছমীবউ, বল তো এ কে? বলতে পারলি নে তো? আমার ভাগ্নে রে, ভাগ্নে। কলকাতা থেকে আসছে। তুই জল তুলে একবারটি আসবি। বুঝলি?