এদিকে আবার ভূতের সাড়াশব্দ পাওয়া গেল সেদিন থেকেই। পণ্ডিতমশাই পাঠশালার ছুটির পর বাড়ি ফিরছেন। হঠাৎ গাছ থেকে টুপটাপ করে ঢিল পড়ল। পণ্ডিতমশাইয়ের বেলায় এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। বরং ঢিল পড়া বন্ধ হওয়াতে তার খারাপ লাগত। আবার ঢিল পড়ায় খুশি হয়েছিলেন। বললেন, কীরে তোরা সব কেমন আছিস?
গদাই মোড়ল সন্ধেবেলা মাঠ থেকে ফিরছেন। একটা কালো বেড়াল তাঁর সঙ্গ নিল। মোড়ল খুব খুশি হয়ে বললেন, ভালো আছিস তো বাবা? জলবন্দি হয়ে নাকি খুব কষ্টে ছিলিস?
এইসব ঘটনা সন্ধেবেলায় ছোটকাকা খুব জমিয়ে বর্ণনা করতেন। আমি কিন্তু তখনও ভূত দেখিনি বা সেরকম কোনও সাড়াশব্দও পাইনি। বড়রা বলতেন, ভূত আছে। আমরা ছোটরাও মেনে নিতাম, ভূত আছে। তাছাড়া বড়মামা এসে ভূতের স্বভাবচরিত্র, কীর্তিকলাপ শুনিয়ে ভূতের ব্যাপারটাকে আরও পাকাঁপোক্ত করে ফেলতেন।
তো অমন একটা ঘটনার কিছুদিন পরে ঠাকুমার মুখে ঝিলের ধারের শাঁকচুন্নি আর জঙ্গলের কন্ধকাটার ঝগড়ার কথা শুনেছিলাম। বলেছিলেন,–মোনা-ওঝাকে ডাকতে হবে। মোনা ছাড়া এর বিহিত হবে না।
মোনা-ওঝা পরদিন এসেছিল। ঠাকুমার মুখে সব শুনে সে বলল, বড় সমিস্যে দিদিঠাকরুন। ওদের ঝগড়াঝাটির কথা আমার অজানা নয়। অনেক চেষ্টা করেও মিটমাট করাতে পারিনি। আসলে শাঁকচুন্নিটা আলো ছাড়া এক পা হাঁটতে পারে না। মেয়েটা রাতকানা। ওদিকে কন্ধকাটার চোখে ঘা। আলো লাগলেই জ্বালা করে। কাকে দোষ দেব বলুন?
–তুই কন্ধকাটাকে বরং অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে বল মোনা!
–যাবে কোথায়? সব জায়গাই তো দখল হয়ে আছে।
–খুঁজলে নিশ্চয় কোথাও পাওয়া যাবে। তুই খুঁজে দ্যাখ না।
মোনা-ওঝা একটু ভেবে নিয়ে বলল,-মুসলমানপাড়ার গোরস্থানে একটা শ্যাওড়া গাছ আছে। গাছটাতে একটা মামদো থাকত দেখেছি। কাল রাত্তিরে গিয়ে তাকে ডাকলাম, চাচা আছে নাকি? কোনও সাড়া পেলাম না। আমার সন্দেহ হচ্ছে, মামদোচাচা ডেরা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। প্রায়ই বলত, গাছটা পছন্দ হচ্ছে রে। হাত-পা ছড়িয়ে বসা যায় না! বড্ড বেশি ডালপালা। হাওয়া বাতাস ঢোকে ।
ঠাকুমা খুব উৎসাহ দেখিয়ে বললেন, তাহলে তুই কন্ধকাটাকে গিয়ে কথাটা বল মোনা। ওদের ঝগড়ার জ্বালায় সারারাত্তির ঘুমোতে পারিনে।
মোনা-ওঝা কিন্তু কিন্তু করে বলল,–দেখি, বলেকয়ে। তবে গোরস্থানে কন্ধকাটা যেতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
–কেন? রাজি হবে বলে মনে হয় না?
–বুঝলেন না? কন্ধকাটা হল গিয়ে হিন্দু। মুসলমানদের গোরস্থানে যেতে চাইবে কি?
ঠাকুমা ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন, ধুর পাগল! ভূতের আবার হিন্দু মুসলমান কী রে? ভূত হল ভূত। মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান আছে। ভূতের মধ্যে নেই। তুই কন্ধকাটাকে একবার বলেই দ্যাখ গে না। বলবি, গোরস্থানের তল্লাটে একেবারে শুনশান অন্ধকার। আরামে থাকবে।…।
কদিন পরে মোনা-ওঝা এসে বলল,–কেলেঙ্কারি হয়ে গেছে দিদিঠাকরুন! কন্ধকাটাকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলাম। কাল সন্ধেবেলায় সে গোরস্থানের শ্যাওড়াগাছে ডেরা বাঁধতে গিয়েছিল। কিন্তু মামদোচাচা আবার ফিরে এসেছে। তাড়া খেয়ে কন্ধকাটা পালিয়ে এল।
ঠাকুমা নিরাশ হয়ে বললেন,–মুখপোড়া মামদোটা ফিরে এল কেন জানিস?
বলতে গেলে সে অনেক কথা! –মোনা-ওঝা শ্বাস ছেড়ে বলল।–বেঁচে থাকতে এক কাবুলিওয়ালার কাছে দেনা করেছিল। এদিকে কাবুলিওয়ালাও যে মরে ভূত হয়েছে আর মোদিপুরের গোরস্থানের কাছে বাজপড়া তালগাছের ডগায় ডেরা খুঁজে নিয়েছে, মামদোচাচা জানত না। ওকে দেখেই কাবুলিওয়ালা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল। তাড়া খেয়ে কঁহা কঁহা মুল্লুক ঘুরে মামদোচাচা বাড়ি ফিরেছে।
হ্যাঁরে মোনা, তাহলে এক কাজ কর না তুই।–ঠাকুমা মিটিমিটি হেসে বললেন,– ঘটকালিতে লেগে যা। শাঁকচুন্নির সঙ্গে কন্ধকাটার বিয়ে দিয়ে দে। তাহলেই মিটমাট হয়ে যাবে।
মোনা-ওঝা ফিক করে হাসল।–সেই চেষ্টাই তো করছি দিদিঠাকরুন। শুধু একটাই সমিস্যে! কন্ধকাটার চোখের ঘা সারিয়ে দেওয়া দরকার। তাহলে শাঁকচুন্নির পিদিমের আলো ওর চোখের ঘায়ে খোঁচা দেব না। দেখি, তেমন বদ্যি-কোবরেজ কোথাও পাই নাকি!
মোনা চলে গেলে বললাম, আচ্ছা ঠাকুমা, কন্ধকাটাদের তো মুন্ডু নেই শুনেছি। ছোটকাকা বলছিলেন। ওদের চোখ কোথায় থাকে তাহলে?
ঠাকুমা বললেন,–ধুর বোকা! চোখ থাকে ওদের বুকের ওপর।
কন্ধকাটার বুকে চোখের কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তারপর থেকে দিনদুপুরেও আর ঝিলের জঙ্গলের দিকে তাকাতে সাহস পেতাম না। বড়মামা বলতেন বটে, ভূতকে কক্ষনও ভয় পাবি না। কিন্তু কন্ধকাটার একে তো মুণ্ডু নেই, তার ওপর বুকে দুটো চোখ। মুখোমুখি দেখা তো দূরের কথা, কল্পনা করতেই যে রক্ত হিম হয়ে যায়!
তো শেষপর্যন্ত মোনা-ওঝা ভূতের কোবরেজ খুঁজে পেয়েছিল। সেই কোবরেজের মলমে নাকি কন্ধকাটার চোখের ঘা সেরে যাচ্ছিল। আগামী কালীপূজার অমাবস্যার রাত্তিরেই কন্ধকাটার সঙ্গে শাঁকচুন্নির বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছিল। মোনা নোজই এসব খবর দিয়ে যেত। বিয়েতে খরচাপাতির ব্যাপার আছে। ঠাকুমা সবই দিতে রাজি হয়েছিলেন।
কিন্তু হঠাৎ এক অঘটন ঘটে গেল।
হঠাই বলা চলে। কারণ ইতিমধ্যে আমাদের গায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিকল্পনা হয়েছে এবং খুটি পোঁতার কাজও শেষ, কিন্তু বিদ্যুতের পাত্ত ছিল না। লোকেরা হাল ছেড়ে দিয়েছিল। এতদিনে খবর পাওয়া গেল, সামনের দুর্গাপুজোয় বিদ্যুৎ আসছে। উদ্বোধন করতে আসছেন বিদ্যুৎমন্ত্রী। সাজো সাজো রব পড়ে গেল খবর শুনে। শহর থেকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আসার হিড়িক পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। ছোটকাকা আমাদের বাড়িতে মিস্ত্রি এনে বিপুল উৎসাহে কাজে নেমে পড়লেন। বাগানের দিকে আলোর ব্যবস্থা করা হল। তারপর ষষ্ঠীর দিন সন্ধেবেলায় খেলার মাঠে জনসভা হল, বিদ্যুত্মন্ত্রী এসে সুইচ টিপে উদ্বোধন করলেন। চারদিকে উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল।