হরিপদবাবু গর্জে উঠলেন এবার, কাকে চাই কী রে ব্যাটাচ্ছেলে? ভাঙ খেয়েছ সাতসকালে? তারপর হারুকে ঠেলে ঘরে ঢুকে গেলেন।
হারু হই-চই করে উঠল, আচ্ছা ভদ্রলোক তো মশাই আপনি! গায়ের জোরে পরের বাড়ি ঢুকে পড়লেন যে বড়? আরে! ও কী! কোথায় যাচ্ছেন?
হরিপদ সটান নিজের শোওয়ার ঘরে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড আঁতকে দেখলেন, রোজ পার্কের বকুলতলায় পাথরটার ওপর যে লোকটাকে বসে থাকতে দেখেছেন সেই লোকটাই বটে। হরিপদবাবু তার শরীটা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু তার নিজের শরীরটা কোথায় গেল, সেটাই সমস্যা। আর ছ্যা ছ্যা, এমন বিচ্ছিরি নাক থাকতে আছে মানুষের।
হরু ততক্ষণে পাড়া মাথায় করে চেঁচাচ্ছে,–ডাকাত ডাকাত পড়েছে! এমন জোর করে শোওয়ার ঘরে ঢোকে যে, সে নিশ্চয় ডাকাত। হরিপদবাবু আয়নার সামনে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না। পার্কে বেড়াতে গেলেন হরিপদবাবু হয়ে, ফিরে এলেন কোন হতচ্ছাড়া ডোম্বলবাবুটি হয়ে যিনি নাকি একসময় থিয়েটারে অ্যাকটিং করতেন এবং যাঁর জামাই লোকটা চোর না হয়ে যায় না! এ কী সর্বনেশে কাণ্ড রে বাবা!
কিন্তু তার চেয়ে সর্বনেশে কাণ্ড যে ঘটতে চলেছে, ঠাহর হল পাড়ায় লোকের হট্টগোলে। বাড়ির দরজায় ওরা চেষ্টাচ্ছে, কই ডাকাত? কোথায় ডাকাত? ধর ব্যাটাকে! মারমার! কেউ বলছে,-যাসনে, যাসনে! ভোজালি আছে। পুলিশ ডাক! তার মধ্যে হরু এন্তার চেঁচাচ্ছে, সব লুঠ হয়ে গেল যে! ওরে বাবা! এতক্ষণে সব লুঠ করে ফেললে রে!
সাহসী ছেলেরা লাঠিসোটা নিয়ে বাড়ি ঢুকছে টের পেয়েই হরিপদবাবুর বুদ্ধি খুলে গেল। দড়াম করে দরজায় খিল এঁটে দিলেন। দরজার বাইরে ছেলেগুলো হল্লা করছে। কেউ ধাক্কা দিচ্ছে দরজায়। হরিপদবাবু ভেতর থেকে শাসিয়ে বললেন, সাবধান! আমার কাছে বোমা আছে। উড়িয়ে দেব!
ছেলেগুলো ভয় পেয়ে গেল। বয়স্করা বললেন,–ওরে! সরে আয়! সরে আয়! পুলিশে খবর গেছে।
পুলিশের কথা শুনে হরিপদবাবুর বুকের ভেতর কাঁপুনি বেড়ে গেল। তখন ঘরের ভেতর থেকে করুণ স্বরে ডাকলেন, হরু! ওরে বাবা হারাধন! আমি তোর মনিব হরিপদ তালুকদার। সত্যি বলছি!
হরু বলল,–চালাকি হচ্ছে? আমার মনিবকে আমি চিনিনে? ওইরকম চেহারা নাকি ওনার? ওইরকম হেঁড়ে গলা নাকি? ছা-ছ্যা, যেন নিমতলার আস্ত পিচেশ!
গণ্ডগোল একটু থেমেছে। সবাই পুলিশের প্রতীক্ষা করছে। হরিপদবাবুর গলা আবার শোনা গেল ভেতর থেকে,–সত্যি বলছি আমি হরিপদ তালুকদার। দোহাই তোমাদের, এখন পুলিশ-টুলিশ ডেকো না! ও বাবা হারাধন! ওদের বুঝিয়ে বল না একটু। আমিই তোর কর্তাবাবু রে!
হারু তেড়েমেড়ে বলল, বলবটা কী মশাই! হরিপদবাবুর বাড়ি সেই এতটুকুন বাচ্চা বয়েস থেকে কাজ করছি। আমি কর্তাবাবুকে চিনিনে? থামুন, দারোগাবাবুকে আসতে দিন।
বলতে বলতে এসে গেলেন দারোগাবাবু। পেল্লায় গোঁফের ডগায় পাক খাইয়ে বললেন, কই? কোথায় ডাকাত?
সবাই একগলায় বলে উঠল,–ওই ঘরের ভেতর স্যার!
দাবোগাবাবু হাঁক মেরে বললেন,-গিরধর সিং! দরওয়াজা তোড়ো! জলদি তোড়!
শুনেই হরিপদবাবু হামাগুড়ি দিয়ে খাটের তলায় ঢুকতে যাচ্ছেন, টাকে খাটের একটা ধার জোরে লাগল। উঃ করে ককিয়ে উঠলেন।
তারপর দেখলেন, প্রচণ্ড অবাক হয়েই দেখলেন, পড়ে গেছেন শিশিরভেজা ঘাসে এবং বকুলতলার সেই পাথরটাতে ঠোক্কর লেগেছে মাথায়। বেশ জোরেই লেগেছে।
এই সময় কেউ বলে উঠল, আহা! লাগল নাকি।
তাকিয়ে দেখে অবাক হরিপদ তালুকদার। সেই টাকওয়ালা লোকটা, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল–রোজ যে এই পাথরের আসনটা দখল করে বসে থাকে এবং যে কিছুক্ষণ আগে তাকে সর্বনাশের মুখে ফেলে দিয়েছিল।
লোকটা হাসতে-হাসতে বলল,–ওখানে বসলেই কিন্তু ঘুম পায়। বুঝলেন?
হরিপদবাবু মনে-মনে বললেন, বুঝেছি। তার মানে পাথরটা দখল করার জন্য রাত চারটেয় শেষ ঘুম বরবাদ করার শাস্তিটা ভালোই পেয়েছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–মশায়ের নাম কি ডোম্বলবাবু?
–আজ্ঞে না। আমার নাম হরিপদ চাকলাদার।
শুনেই হরিপদবাবু হনহন করে কেটে পড়লেন। আর কক্ষনো এ ভুতুড়ে পার্কে এত ভোরে বেড়াতে আসবেন না। বাড়ির কাছাকাছি হতে হঠাৎ মনে হল, নামটা কী হরিপদ চাকলাদার বলল, না তালুকদার বলল? চাকলাদার না তালুকদার? তালুকদার না চাকলাদার?
তালুকদার হলে বেটাচ্ছেলে আমার মতোই বিপদে পড়তে পারে। এই ভেবে হরিপদ শেষে খিকখিক করে হেসে উঠলেন।
অদ্ভুত যত ভূত
ছোটমামার সঙ্গে ছিপে মাছ ধরতে যাচ্ছিলুম। ছোটমামার ছিপটা বড় মাছধরা হুইল। আর আমারটা নেহাত পুঁটিধরা কঞ্চির ছিপ। বঁড়শিও খুদে।
ভাদ্র মাসের দুপুরবেলা। কদিন বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার হয়েছে। ঝলমলে রোদে গাছপালা-ঝোঁপঝাড়ে সবুজ রঙের জেল্লা বেড়েছে। আমার মনও খুশিতে চঞ্চল। ছোটমামা বলেছেন, বুঝলি পুঁটু? আজ থেকে তোর ট্রেনিং শুরু। তোর ডাকনাম পুঁটু। তাই দেখবি, পুঁটিমাছেরা তোর বঁড়শির সঙ্গে ভাব জমাতে ভিড় করবে। ওরা কিন্তু বড় চালাক। ফাতনা নড়লেই ছিপে খ্যাচ মারবি।
–খ্যাঁচ কী মামা?
–ধুর বোকা! এ্যাচ বুঝিস না? ঠিক আছে। তোকে হাতেকলমে শিখিয়ে দেব।
গ্রামের শেষদিকটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। সেখানে আদ্যিকালের ভাঙা শিবমন্দির ঘিরে প্রকাণ্ড বটগাছ এবং ঝোঁপজঙ্গল গজিয়েছে। সেখানেই দেখা হয়ে গেল মোনা-ওঝার সঙ্গে।