আর কৌতূহল সম্বরণ করা দুঃসাধ্য হল। পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলাম। জগনমামা কিচেনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে টেবিলে তরকারি কুটছেন এবং কথা বলছেন। কিচেনের দরজা সামনাসামনি। ভেতরে কেরোসিন কুকার জ্বলছে। রান্না হচ্ছে। কিন্তু নতুন মামিকে দেখা যাচ্ছে না।
মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেলাম। আমার সাড়া পেয়ে জগনমামা হেসে বললেন, এসো বাবাজি! তোমার মামিমাকে বলছিলাম, ঝন্টু তো পাড়াগাঁয়ের ছেলে, বিশুদ্ধ জলবায়ু আর নির্ভেজাল খাদ্য খেয়ে মানুষ হয়েছে। এ ভূতের জায়গায় অখাদ্য কি ওর রুচবে?
বলেই ভেতরের সেই ঘরের দিকে তাকালেন।…তোমার অত কেন লজ্জা বলল তো? ঝন্টু বলতে গেলে আমার আপন ভাগনে। এসো। কই? বেশ, এসো না। ফিরে গিয়ে তোমারই বদনাম করবে! অচেনা তো নয়। সেই ছোট্ট বয়সে কতবার দেখেছ। বড় হয়েছে বলে লজ্জা! আশ্চর্য!
আপন মনে ফের গজগজ করতে থাকলেন।…তোমার এই একরোখামিই যত সর্বনাশের গোড়া।
আমি হকচকিয়ে গেছি ততক্ষণে। ছোট্ট বয়সে কতবার দেখেছে–এর মানে কী? তাহলে কি নতুন মামিমা আমার চেনাজানা কোনও মহিলা? জগনমামার হাবভাব দেখে কোনও কথা জিগ্যেস করতে সাহস হল না! বুঝলাম, আমার খুব পরিচিত মহিলাকেই বিয়ে করেছেন জগনমামা। এত পরিচিত যে মুখোমুখি হলে নিশ্চয়ই দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তাই উনি দেখা দিচ্ছেন না। খুব ভাবনায় পড়ে গেলাম। খুঁজেই পেলাম না, তেমন কে হতে পারেন নতুন মামিমা।
দুপুরে খাওয়ার সময়ও উনি এলেন না। জগনমামার মুখ গম্ভীর। সেটা খুবই স্বাভাবিক। টেবিলে সবই সাজানো ছিল! দুজনে চুপচাপ খেলাম। খাওয়া হলে জগনমামা বললেন,–ওপরে গিয়ে ঘুমিয়ে নাও। সাড়ে পাঁচটার আগে উঠো না। গরম কমলে বরং ঘুরে এসো গঙ্গার ধারে।
লম্বা হয়ে গেল ঘুমটা। উঠে দেখি টেবিলে চা ঢাকা আছে। নতুন মামিমা এসে দিয়ে গেছেন কি? বোধহয় জগনমামাই। বাড়ির ভেতর চুপচাপ। চা জুড়িয়ে গিয়েছিল। কল্পনা করলাম, নতুন মামিমা চা রেখে গেছেন, এবং আশ্চর্য, সেই মিষ্টি মেয়েলি গন্ধটা অবিকল টের পেলাম।
দরজা ভেজিয়ে গলিরাস্তায় গঙ্গার ধারে ঘুরতে গেলাম। ঘণ্টা দুই পরে যখন ফিরে এলাম, তখন এদিকটা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। লোডশেডিং। দরজা বন্ধ থাকবে ভেবেছিলাম। কিন্তু কড়া নেড়ে সাড়া না পেয়ে ঠেলতেই দেখি, তেমনি খোলা। ভেতরে ঢুকে ডাকলাম, জগনমামা।
সাড়া এল,–আয় ঝন্টু। এখানে আয়। উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন জগনমামা কালো মূর্তিটি হয়ে। আলো নেই বাড়িতে। বললাম, আলো জ্বালেননি যে!
জগনমামা বললেন, অন্ধকার ভালো লাগে। আয় এখানে আয়। কী গো! এখন তো ঝন্টু তোমাকে দেখতে পাচ্ছে না, এবার কথা বলবে না কী? অ ঝন্টু, মামিমার সঙ্গে কথা বল।
ডাকলাম,–মামিমা। তারপর টের পেলাম অন্ধকার উঠোনে আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি শুধু আমি আর জগনমামা। হঠাৎ কেমন গা ছমছম করে উঠল। বললাম, জগনমামা, মামিমা কই?
এই তো! দেখতে পাচ্ছিস না? জগনমামা অস্বাভাবিক গলায় বললেন, কই গো, ঝন্টুকে ছুঁয়ে দাও তো! আহা দাও না বাবা! বলতে গেলে আপন ভাগ্নে ছোটবেলায় কত আদর করেছ!
অদ্ভুত হাসি হেসে জগনমামা আমার একটা হাত টেনে অন্য হাতে অন্ধকারে অদৃশ্য মামিমার হাত টানার ভঙ্গি করতেই আমার মাথা ঘুরে গেল এবং আচমকা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক লাফে বারান্দা থেকে বাইরের ঘরে–তারপর ব্যাগট্যাগের কথা ভুলে দড়াম করে দরজা খুলে গলিতে গিয়ে পড়লাম। জগনমামা যে একজন বিদেহিনী স্ত্রীলোক নিয়ে ঘর করছেন, এতে আর সন্দেহ ছিল না।
.
মাস দুয়েক পরে একদিন শহরে গেছি। ব্যাগটা নিয়ে আসতে তো বটেই। জগনমামার অবস্থা দেখতেও তীব্র কৌতূহল হল। নিরিবিলি জায়গায় পুরোনো জরাজীর্ণ বাড়িটা দেখে একটু গা ছমছম করছিল। কিন্তু দিনদুপুরে আশা করি আর ভূতের ভয়টা পাব না।
দরজায় কড়া নাড়ার পর খুলল। খুলতেই আমার বুকের ভেতর রক্ত চড়াৎ করে উঠল। হাসিখুশি মিষ্টি চেহারার এক সুন্দরী মহিলা দরজার পাল্লায় হাত রেখে দাঁড়িয়েছেন। যেই হাসিখুশি মুখে বলছেন,-কাকে চাই, অমনি আমি পিছিয়ে এসেছি। আর লাফ দিয়েই–
ইনিই যে সেই নিরাকার মামিমা, যাঁর সঙ্গে জগনমামা অনর্গল কথা বলতেন এবং যিনি আত্মহত্যা করে মারা যান, তিনি ছাড়া আর কে হতে পারেন? ভুল হয়েছে বলে আমি হনহন করে চলে এলাম, পা টলছিল। একবারও পিছু ফেরার সাহস হল না। নিরাকার আকার ধরেই সমস্যা।
কিন্তু ব্যাপারটা আগাগোড়া রহস্যময়। তবে এটুকু মনে পড়ছে, পেছনে জগনমামার যেন চিৎকার শুনছিলাম ঝন্টু ও ঝন্টু! চলে যাচ্ছিস কেন? তোর নতুন মামিমার সঙ্গে আলাপ করে যা! কানের ভুল হতেও তো পারে। নতুন শব্দটা কি সত্যি শুনেছিলাম…?
আম কুড়োতে সাবধান
ফুটবলম্যাচ দেখতে যাব বলে সেজেগুজে তৈরি হচ্ছিলুম। হঠাৎ কোত্থেকে এসে বাধা দিল প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। মুহুর্মুহু বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের গর্জন অবস্থাটা আরও সাংঘাতিক করে ফেলল। মনমরা হয়ে বসে রইলুম।
সন্ধ্যার দিকে ঝড়বৃষ্টির দাপট যখন কমে গেল, তখন দেখলুম ছোটমামা কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরছেন। একটু পরে পোশাক বদলে একটা লণ্ঠন জ্বেলে ছোটমামা ঘরে ঢুকলেন। আমাকে দেখে বললেন,–এ কী রে পুঁটু? তুই অন্ধকারে ভূতের মতো বসে আছিস যে?