বুঝতে পারছিলাম, জগনমামা আবার বিয়ে করেছেন। তবে অবাক হচ্ছিলাম নতুন মামিমা একবারও ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না দেখে। ভেতরের বারান্দার একটা চেয়ারে আমি বসে আছি। জগনমামা ওপাশের কিচেন থেকে চা এনেছেন। চায়ের খালি কাপ প্লেট-উনি রেখে এসেছেন। মামিমার পাত্তা নেই। জগনমামা ওঁর উদ্দেশে কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু কোনও সাড়া আসছে না।
তাই ভাবছিলুম, একটা দাম্পত্য কলহ-গোছের কিছু ঘটে থাকবে। নাকি মামিমা ঠাকুরঘরে পুজোয় বসে আছেন?
জগনমামা ছাতি চাইলেন। তবু মামিমার সাড়া এল না। তখন জগনমামা মুখে একটু বিরক্তি ফুটিয়ে উঠোন থেকে বারান্দায় উঠলেন। তারপর তির খোঁজে ঘরে ঢুকলেন। ঘর থেকে ওঁর চাপা গলা শুনতে পেলাম। একটু পরে বেরিয়ে এলেন ছাতি হাতে। মুখে অশান্ত কথাবার্তা-হাসি। বললেন, তাহলে গল্পসল্প করো তোমরা। আমি ঝটপট ফিরব।
উনি খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ওদিকটায় আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে শর্টকাট পায়ে চলার পথ আছে। গিয়ে উঠেছে বাজারের চওড়া রাস্তায়। এদিকটা একেবারে নিরিবিলি নিঃঝুম জায়গা। আশেপাশে বাড়ি বিশেষ নেই। গঙ্গার ধারে শহরের একপ্রান্তে এই বাড়িটার বয়স প্রাচীন। একটু তফাতে হাসপাতাল এলাকা, অন্য দিকটায় গঙ্গার পাড়ে বনজঙ্গলের সঙ্গে সাজানো ঘন বন। ভাঙন আটকাতেই ওই নিরামিষ জঙ্গল, জগনমামার ভাষায় নৈমিষারণ্য।
বাড়ি একেবারে চুপচাপ। গ্রীষ্মের এই সাতসকালে গঙ্গার দিক থেকে একটা হাওয়া এল শনশনিয়ে। হাওয়াটা খিড়কির দরজা ঠেলে উঠোনে ঢুকে বই-বাই করে ঘুরতে থাকল। তারপর পাঁচিলের ধারে জবা ও শিউলির ঝোপে হুলুস্থুল করে পটাপট কিছু হলুদ পাতা ছিঁড়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে গেল। এই সময় আমার মনে পড়ল যেদিকে হাওয়াটা গেল সেদিকটায় শ্মশানঘাট এবং একটু পরে সেই উঁচু বটগাছের মাথায় ঝাঁকুনি লাগল!
কিছু করার না থাকলে আমার উদ্ভট সব অনুভূতি জাগে। হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেবেলায় দেখা মামির অর্থাৎ জগনবাবুর প্রথম স্ত্রীর কথা। আত্মহত্যা করলে মানুষ নাকি ভূত হয়। এমন নিরিবিলি বাড়িতে ভূতের পক্ষে হামলা করা ভারি সহজ। পুরোনো মামিমার ভূত নতুন মামিকে জ্বালায় না?
কে জানে কেন, এ বাড়িতে রাতে থাকতে হবে ভাবতেই এবার অস্বস্তি জাগল। ভূতে আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু ভূতের ভয় আমার বেজায় রকমের।
একটু কাশলাম। ভেতরের ঘর একেবারে চুপচাপ। সিগারেট টানতে থাকলাম। জগনমামা বলছিলেন, সব সময় খালি তোদের গল্প করি। তোর মায়ের মতো মহীয়সী মেয়ে তো আর হয় না। আর এই টুকুন ছিলি জানিস বাবা ঝন্টু? এই অ্যাটুকুন। আর কী ভীতু কী ভীতু।
এত সব যদি শুনে থাকেন ভদ্রমহিলা, তাহলে আমাকে দেখার জন্যে বেরুলেন না কেন কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না।
সিগারেট শেষ করে বাড়ি ঢুকে চমকে উঠলাম। কোথা থেকে একটা নেড়ি কুকুর ঢুকে পড়েছে যে। বারান্দায় গিয়ে ভেতরের ঘরের পর্দার ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠলাম, মামিমা! কুকুর ঢুকছে। কুকুর!
তবু সাড়া নেই দেখে দৌড়ে এলাম। কুকুরটা ঘরে ঢুকে পড়েছিল। লাথি খেয়ে কেঁউ-কেঁউ করে উঠল এবং ডিগবাজি খেতে-খেতে উঠোনে গিয়ে পড়ল। তারপর লেজ গুটিয়ে পালাল।
পর্দা তুলে উঁকি মেরে ডাকলাম, মামিমা! কিন্তু ঘর ফাঁকা। কেউ নেই। সেকেলে পালঙ্কের ওপর জগনমামার লুঙ্গি পড়ে আছে। ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকালাম। এক গুচ্ছের স্নো-পাউডার ইত্যাদি যথারীতি সাজানো। ওপাশে আলনায় কয়েকটা শাড়ি ও সায়া পর্যন্ত। সেগুলো অত ময়লা কেন ভেবে পেলাম না।
কিন্তু ঘরে একটা মেয়েলি গন্ধ টের পাচ্ছিলুম। আবছা মনে হল, মামিমার বয়স নিশ্চয় জগনমামার তুলনায় ঢের কম। মেয়েলি গন্ধটা কি চুলের? স্নানের পর মেয়েদের চুলের এমন গন্ধ হয়। একটু লজ্জা পেলাম! এ ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। ভদ্রমহিলা ওপাশে কোথাও আছেন। এসে গেলে অপ্রস্তুতের একশেষ হবে।
বেরিয়ে আসার আগে ড্রেসিং টেবিলে রাখা ছবিটার দিকে চোখ পড়ল। পুরুষ ও মহিলার ছবি পাশাপাশি। কিন্তু চিনতে পারলাম না। শুধু দেখলাম, যুবতী মহিলাটি কেমন চোখে তাকিয়ে হাসছেন।
ঠিক এইসময় বাইরে জগনমামার সাড়া পেলাম।…বহু ভাগ্যে দুটো গলদা পেলাম, বুঝলে? মোট দুটো। থাকগে। এতেই হবে। আর ইয়ে, শানোর ছাই! ভুলে গেলাম যে!
ঝটপট বেরিয়ে শুনলাম, মামিমার গলা,–এ অসময়ে ওদের বাড়ি না গেলে চলত না? ঝটপট ফিরে এসো তাহলে। অবিশ্যি আজ রোববার। বেলা করেই খাওয়া যাবে।
নতুন মামিমা তাহলে কিচেনে ছিলেন।
ঘুরে জগনমামা একগাল হেসে বললেন,–এই যে ঝন্টু। আলাপ হল মামিমার সঙ্গে? গল্পের রাজা! থুড়ি রাণি! রাণি আর তুমি তো বরাবর ভূতের গল্প শুনতে ভালোবাসতে! এখন অবিশ্যি বড় হয়েছ। তাহলে মন্দ লাগবে না। কী বলো।
বলে চোখ নাচালেন,–রাত্তিরে শুনবেখণ…
বাইরের ঘরে জগনমামার ওকালতির আপিস। আজ ছুটির দিন বলে বুঝি ওঁর মুহুরিবাবু আসেননি। সেই ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। বাইরে রোদ বেড়েছে। এখনই লু হাওয়া বইতে শুরু করেছে। চারপাশে শুধু গাছপালার শনশন আর গঙ্গায় নাইতে যাওয়ার সরু গলিপথে আবর্জনার ঝড় বইছে শোঁশো করে। ভেতর থেকে জগনমামার কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে। নতুন মামিমার সঙ্গে অনর্গল কথা বলছেন। ভদ্রমহিলাকে ভারি অদ্ভুত বলব। সম্ভবত শুনেই যাচ্ছেন মুখ বুজে।