–কিন্তু সুখরবটা কী?
কাক্কু গুণ্ডাকে কে বা কারা রাত্রে মেরে কেল্লাবাড়ির ভেতরে লাশ ফেলে এসেছে। পাগলা ফকির খুব ভোরে সেই লাশ দেখে থানায় খবর দিয়েছিল। আশ্চর্য ঘটনা স্যার, তার পিস্তল আর টর্চটা সেখানেই পড়ে ছিল।
–আচ্ছা আসলাম! কাল্লু কি বাঙালি ছিল?
–না স্যার। তবে সে উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, বাংলা সব ভাষাতেই কথা বলতে পারত। কলকাতাতে নাকি তার ছোটবেলা কেটেছিল। স্কুলেও পড়েছিল। তাই বাংলাও বলতে পারত। আজমগড়ে বাঙালি আছে। তারা তো কাল্লুকে বাঙালি বলেই মনে করত। কাম্পু কখন কোন রূপ ধরত, চেনা কঠিন হতো।
–কাল্লুর লাশ কি পুলিশ নিয়ে গেছে?
–শুনলুম একটু আগে মর্গে নিয়ে গেছে। কাল্পর সারা শরীর নাকি রক্তে লাল।
ব্রেকফাস্টের পর সাড়ে নটায় আমি এবার সাহস করে কেল্লাবাড়িতে গেলুম। আমার মনে হচ্ছিল, কাল বিকেলে যে অশরীরীর জুতোর ছাপ আমার সামনে রাঙা ধুলোয় ফুটতে উঠতে দেখেছি, সেই ছদ্মবেশী অশোক রায় নামধারী দুবৃত্ত কাল্পর হাত থেকে আমাকে বাঁচিয়েছে। মনে-মনে তার উদ্দেশে কৃতজ্ঞতা জানালুম।
এবার নির্ভয়ে সেই কালো পাথরের পাশ দিয়ে সংকীর্ণ লাল ধুলোভরা রাস্তায় পৌঁছলুম। চড়াই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আর সেই জুতোর ছাপ সামনে ফুটে উঠল না। কিছুটা যাওয়ার পর রাস্তাটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে। নিচে নেমেই ঘন গাছপালার ভেতর সারসার কয়েকটা কবর দেখলুম। তারপর লাল পাথরের একটা কবর দেখে এগিয়ে গেলুম। সেই কবরের শিয়রে একটা রক্তকরবীর গাছ। কবরে লাল ফুল ঝরে পড়েছে। আমি বহুকাল আরবি লিপির ফলক দেখে-দেখে লিপি বিষয়ে সামান্য জ্ঞান অর্জন করেছিলুম। আরবিতে তিনটি হরফ চেনামাত্র বুঝতে পারলুম এটাই সেই সিপাহিবিদ্রাহীদের নেত্রী শাহজাদি রেশমা বেগমের কবর, যাঁর ডাকে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।
হঠাৎ আমার মাথায় কথাটা এসে গেল। তা হলে কি রেশমা বেগমের অতৃপ্ত আত্মাই আমাকে কাল বিকেলে পথ দেখিয়ে তার কবরের কাছে আনতে চেষ্টা করেছিল? সেই রেশমা বেগমের আত্মাই কি দুবৃত কাল্লুকে চাবুক মেরে রক্তাক্ত করেছিল?
শ্রদ্ধায় আমার মাথা নুয়ে পড়ল। পাশের একটা লাল ফুলের গুচ্ছ ডাল থেকে ভেঙে বিদ্রোহিনীর কবরে রেখে মাথা ঠেকালুম। সেই মুহূর্তে স্নিগ্ধ একটা হাওয়া ভেসে এল। সেই হাওয়ায় যেন পুরোনো ইতিহাসের সুঘ্রাণ টের পেলুম। মনে-মনে বললুম, প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়িকা বীরাঙ্গনা তুমি! তোমার জীবনকাহিনি আমাকে লিখতেই হবে।
এই সময় পাগলা ফকির এসে গেল। অট্টহাসি হেসে সে বলল,–বাবুজি! আপকা উপ্লর রেশমা বেটি বহত খুশ যায়। তো আব আপ তুরন্ত হিয়াসে চলা যাইয়ে। রেশমা বেটিকো একেলা রহনে দিজিয়ে। বেটি জিন্দেগিমে বহত দুখ পায়ি। বহত দুখসে মর গেয়ি বেটিয়া!
তখনই নিঝুম কবরখানা থেকে চলে এলুম। ইতিহাসে এইসব আশ্চর্য ঘটনা লেখা যাবে না। সেগুলো আমার ব্যক্তিগত জীবনেই থেকে যাক।
হ্যাঁ–সেই অদ্ভুত ঘটনা এতদিন কাকেও বলিনি। এখন আমি বৃদ্ধ। মৃত্যুর আগে ঘটনাগুলি লিখে যাওয়া উচিত মনে করেই লিখে ফেললুম। এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুললে আমি নিরুত্তর থাকব।…
আধি ভৌতিক
জগনমামা বললেন, তাহলে বাবা ঝন্টু ততক্ষণ তুমি মামিমার সঙ্গে গল্পসল্প ( করো। আমি ঝটপট বাজারটা সেরে আসি।
বলে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে ডাকলেন, কই গো। ছাতিটা দাও বরং! এই সাতসকালেই রোদ্দুরটা বড় চড়ে গেছে।
জগনমামার মাথায় এমন প্রকাণ্ড টাক আমি আশা করিনি। এতকাল পরে ওঁকে দেখে খুব হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। চেহারায় কী দারুণ অদলবদল না ঘটে গেছে। রোগা খটমটে চেহারার মানুষ ছিলেন। এখন বিশাল পিপে হয়ে উঠেছেন। মুখে এমন অশান্ত হাসিও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এই মফস্বল শহরে এখন ওঁর উকিল হিসেবে বেজায় নামডাকও হয়েছে এবং তার কারণ সম্ভবত ওঁর চেহারার এই ভোলবদল। আগে ওই শুটকো চেহারা আর খিটখিটে মেজাজের জন্যে মক্কেল যেমন জুটত না, তেমনি হাকিমরাও নাকি ওঁকে এজলাসে দেখলে চটে যেতেন। অবিশ্যি, সবই শোনা কথা।
এও শোনা কথা যে জগনমামার স্ত্রী আত্মহত্যাই করেছিলেন। কৌশলে কলেরায় মৃত্যু বলে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। উকিল-মানুষদের তো পেটে-পেটে
বুদ্ধি।
বলে রাখা ভালো, জগনমামা কস্মিনকালে আমার মামাকুলের কেউ নন। ছেলেবেলায় আমার বাবা-মারা যান। পাড়াগাঁয়ে সম্পত্তি রাখার নানা ঝামেলা। মামলা মোকদ্দমার দায় সামলাতে হতো তাই মাকেই। সেই সুবাদে এই উকিল ভদ্রলোক মায়ের দাদা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু আমি ভেবে পেলাম না জগনমামার মতো উকিল কেন ধরেছিলেন মা! তখন আরও কত জাঁদরেল উকিল এ শহরে তো ছিল। মামলায় হেরে গেলেও দেখতাম ফের এই ভদ্রলোকের কাছে এসে পড়েছেন।
হয়তো এটাই মানুষের অভ্যাস। চেনা-জানা ডাক্তারের হাতে মরতেও রাজি যেমন, তেমনি উকিল-মোক্তারের বেলাও তাই।
এখন মা নেই। আমি বিষয়সম্পত্তির হাল ধরেছি। আমি সেই একই অভ্যাসে এসে জুটেছি জগন-উকিলের দরজায়। মামলায় হার-জিত-ভবিষ্যতের কথা–ছোটবেলা থেকে যাঁকে মামা বলে জানি, তাঁর কাছে এসে দাঁড়ালে মনের জোর ভীষণ বেড়ে যায়।
তবে তার চেয়ে বড় কথা, জগনমামার এখন নাকি নামডাক হয়েছে। কাজেই আমার মনের জোর অনেক বেশি করেই বেড়েছে। আজ রোববার। আগের দিন ও রাত্তিরটা জগনমামার বাড়ি কুটুম্বিতা এবং শলাপরামর্শ করা যাবে বলেই আসা। আগামীকাল ফার্স্ট আওয়ারে কেস ঠোকা যাবে।