কেল্লাবাড়ি এলাকায় ঢুকে গঙ্গার ধারে একটা পাথরের ওপর পাশাপাশি দুজনে বসলুম। অশোকবাবু কলকাতার সাম্প্রতিক খবরাখবর জেনে নিচ্ছিলেন। বহুবছর তার কলকাতা যাওয়া হয়নি।
কিছুক্ষণ পরেই চাঁদ উঠল। জ্যোত্সায় গাছপালা, ঝোঁপঝাড় আর ধ্বংসস্তূপ রহস্যময় মনে হচ্ছিল। অশোকবাবু বললেন, আপনি যে লাল রাস্তাটা দেখেছিলেন, ওর পাশেই নাকি ইংরেজরা বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়েছিল। তবে আপনি যে অশরীরী জুতোর ছাপ দেখার কথা বললেন, ওটা চোখের ভুল। ওই রাস্তা দিয়ে পাগলা ফকির যাতায়াত করে। আপনাকে আড়াল থেকে ভয় দেখানোর জন্য ব্যাটা নিশ্চয় কোনও কারচুপি করেছিল। এও হতে পারে পুরু ধুলোর তলায় লম্বা কোনও জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল। তার ওপর আপনি পা ফেললেই সামনের দিকটা উঁচু হয়ে ধুলো ঠেলে তুলবে। স্রেফ ম্যাজিক! চলুন। পরীক্ষা করা যাক।
অশোকবাবু আমার হাত ধরে ওঠালেন। একটু দ্বিধার সঙ্গে বললুম, কিন্তু আমি সত্যি জুতোর ছাপ দেখেছিলুম।
আরে মশাই! আমি তো সঙ্গে আছি আসুন না। বলে অশোকবাবু হাঁটতে শুরু করলেন। আমার কাঁধে তার হাত চেপে বসল।
জ্যোৎস্নার জন্য ধ্বংসস্তূপের চকরাবকরা ছায়ার ভেতর দিয়ে আমাকে তিনি নিয়ে চললেন। একটু পরে দেখলুম, সেই আরবি লিপি খোদাই করা কালো পাথরটার কাছে এসে গেছি! অশোকবাবু টর্চের আলো ফেলে বললেন,–চলে আসুন। দেখা যাক কী হয়।
সংকীর্ণ চড়াই রাস্তায় কিছুটা উঠে টর্চের আলো ফেলে অশোকবাবু বললেন, কই? কোনও ভুতুড়ে জুতোর ছাপ দেখতে পাচ্ছেন?
বললুম,–এখন পাচ্ছি না। কিন্তু–আমার কথা থেমে গেল। এরপর যা ঘটল তা কল্পনাও করিনি। হঠাৎ টর্চ নিভিয়ে অশোকবাবু আমার কানের নিচে শক্ত এবং ঠান্ডা কী একটা জিনিস ঠেকিয়ে চাপা গর্জন করে বললেন,–টুঁ শব্দটি নয়। ট্রিগারে আঙুল আছে। একটু চাপ দিলেই তোমার মুন্ডু উড়ে যাবে। আগে ক্যামেরাটা দাও। হ্যাঁ–তারপর রিস্টওয়াচ। আর মানিব্যাগটা বের করো।
মুহূর্তে আমি টের পেয়ে গেছি, এক ভদ্রবেশী গুণ্ডার পাল্লায় পড়েছি। হোটেলের ম্যানজার মিঃ ঠাকুর আমাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন কেন, এতক্ষণে তার মর্ম বুঝতে পারলুম। সেই ফকিরও হয়তো আমাকে সাবধান করে দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এখন আর কোনও উপায় নেই। ক্যামেরাটা গলা থেকে ঝুলছিল। সেটা হাতে ধরে কাঁপতে কাঁপতে বললুম, দয়া করে এটা নেবেন না। মানিব্যাগে হাজারখানেক টাকা আছে। তা নিন। ঘড়িটাও নিন। কিন্তু ক্যামেরায় লোড করা ফিল্মে অনেক ছবি আছে। দয়া করে অন্তত ফিল্মের রোলটা বের করে নিতে দিন আগে।
অশোকবাবুরূপী দুবৃত্ত আগ্নেয়াস্ত্রের নল আমার কানের নিচে আরও চেপে হিসহিস করে বলে উঠল, চুপ! শিগগির! আর একটা কথা বললে তোমার লাশ পড়বে। আর সেই লাশের কথা কেউ জানতেও পারবে না। কারণ তোমার লাশ আমি চোরাবালিতে ফেলে দিয়ে আসব। চোরাবালিতে তোমার মতো কত লাশ আমি ফেলে দিয়ে এসেছি। সব তলিয়ে গেছে।
বলেই সে ধমক দিল,–আবে জলদি কর!
এতক্ষণে মনে হল, লোকটার মাতৃভাষা বাংলা নয়। তার বাংলা কথাবার্তায় কেমন যেন একটু হিন্দির টান ছিল। কিন্তু এবার ডান কানের নিচে ব্যথা পেয়ে যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠেছিলুম। তারপরই আবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল। আচমকা শপাং করে একটা প্রচণ্ড শব্দ হল। তারপর দেখলুম, দুবৃত্তটার হাতের অস্ত্র ছিটকে পড়ল এবং সে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
তারপর আবার শপাং করে প্রচণ্ড শব্দ হল। গুণ্ডাটা লাল ধুলোয় গড়াতে শুরু করল। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। কোনও অশরীরী অদৃশ্য চাবুক মেরে চলেছে তাকে। সে একবার কাত হচ্ছে। একবার উপুড় হচ্ছে। হাঁটু মুড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। তারপরই সেই প্রচণ্ড শব্দ এবং তার মুহুর্মুহু আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট দেখছি, লোকটার গায়ের টি শার্ট ফালাফালা হয়ে কালো কালো ক্ষতরেখা ফুটে উঠছে।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। লাল ধুলোভরা রাস্তায় নোকটা ক্রমাগত গড়াচ্ছে এবং তার গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরুচ্ছে শুধু। অশরীরীর চাবুকের শব্দ ক্রমশ প্রচণ্ডতর হয়ে উঠছে।
লাল ধুলোর ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবার। তার আড়ালে চাবুকের ক্রমাগত শব্দ আর গোঙানি শুনতে-শুনতে একসময় আমার চেতনা ফিরে এল। তখনই দৌড়ে নেমে এসে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরোলাম। তারপর ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে ভোলা জায়গায় ছুটে চললুম।
কেল্লাবাড়ির ভাঙা ফটকের কাছে গিয়ে প্যান্ট-শার্ট থেকে ধুলো ঝেড়ে হোটেলে ফিরে চললুম। না, কাউকে এসব অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলা উচিত হবে না…
রাতে ডিনার খাইনি। ম্যানেজার খবর নিতে এসেছিলেন আমার রুমে। বলেছিলুম,–ঘুরে-ঘুরে খুব ক্লান্ত। খিদে নেই।
সারারাত যতবার ঘুম এসেছে, চমকে উঠেছি। আবার বুঝি কোনও অদ্ভুত ঘটনা ঘটবে। ভোর ছটায় আসলাম খান বেড-টি আনল। তারপর গম্ভীরমুখে বলল, খবর আছে স্যার! সুখবর। তাই বলা উচিত মনে হল।
বললুম, কী সুখবর আসলাম?
সে বলল,–আজমগড়ে একজন সাংঘাতিক গুণ্ডা ছিল। তার নাম কাল্প। সে আমাদের হোটেলে এসেও ম্যানেজারসায়েবের কাছে টাকা দাবি করত। কাল সন্ধ্যার আগে সে নাকি আপনার সঙ্গে কথা বলছিল। ওয়েটার রমেশ দেখেছে। কিন্তু আপনাকে সাবধান করার সুযোগ পায়নি।