তারপর পাথরের একপাশ দিয়ে এগিয়ে লাল রাস্তায় পৌঁছলুম। কিন্তু সংকীর্ণ রাস্তাটার লাল ধুলোয় জুতো প্রায় ডুবে যাচ্ছিল। প্যান্ট একটু গুটিয়ে নিতে হল। সাবধানে পা ফেলে একটুখানি এগিয়েছি, হঠাৎ চমকে উঠলুম। আমার প্রায় ফুটছয়েক দূরে চোখের সামনে এইমাত্র কার জুতোর ছাপ ফুটে উঠেছে। প্রথমে ভাবলুম চোখের ভুল। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, আমি আবার পা ফেলে এগোতেই আমার সামনে একই দূরত্বে বারবার আগে-পিছে জুতোর ছাপ ফুটে উঠছে। বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হিম হয়ে গেল।
কোনও এক অশরীরী আমার সামনে হেঁটে চলেছে, এতে কোনও ভুল নেই। তার জুতোর ছাপগুলি আমার জুতোর ছাপের তুলনায় ছোট। কিন্তু কে সে?
চোখের ভুল কি না জানার জন্য দুঃসাহসী হয়ে আবার কয়েক পা এগিয়ে গেলুম। আবার আমার সামনে একই দূরত্বে সেই অশরীরীর জুতোর স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠল।
এবার আমার সব সাহস উবে গেল। শেষবেলার রোদে এই অবিশ্বাস্য ঘটনা দেখে আমার বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গেল। আমি দ্রুত পিছু ফিরে লাল ধুলোয় টলতে টলতে কালো পাথরটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে এলুম। তারপর বিভ্রান্তভাবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে দৌডুতে থাকলুম। একটু পরে গঙ্গার ধারে খোলা জায়গায় পৌঁছে পিছু ফিরে দেখে নিলুম কেউ আমাকে অনুসরণ করছে কি না।
এরপর কী করে যে হোটেলে ফিরেছিলুম, মনে পড়ে না।…
জীবনে বহু ঐতিহাসিক ধ্বংসস্তূপ এবং দুর্গম স্থানে গেছি। কিন্তু এমন অদ্ভুত ঘটনা কোথাও ঘটতে দেখিনি। হোটেলের লাউঞ্জে বসে ইশারায় একজন ওয়েটারকে ডেকে কফি আনতে বললুম।
সে কফি এনে দিল। কফি খেতে-খেতে ঘটনাটা ঠান্ডা মাথায় বোঝবার চেষ্টা করছিলুম। এমন সময় দেখি, লাউঞ্জের অন্যপ্রান্তে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে জিনস এবং টি-শার্ট। মুখে গোঁফ। বেশ বলিষ্ঠ গড়ন। গায়ের রং শ্যামবর্ণ হয়েও নয়, ভদ্রলোকের মুখে যেন একটা একটা বিরক্তির ছাপ এবং চোখদুটোও কুতকুতে। এরকম চেহারার মানুষ দেখলে অস্বস্তি জাগে।
ভদ্রলোক সম্ভবত প্যালেস হোটেলের লাউঞ্জে এসে কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তাকে না পেয়ে হয়তো বিরক্ত এবং অধৈর্য হয়ে উঠেছেন।
আমার চোখে চোখ পড়লে তিনি এগিয়ে এলেন। তারপর বাংলায় বলে উঠলেন, আপনি কি বাঙালি?
বললুম, হ্যাঁ।
ভদ্রলোক অমায়িক হেসে আমার মুখোমুখি বসে পড়লেন। বললেন,–মশাই! বাঙালির চেহারা দেখলেই চেনা যায়। আমার ঠাকুরদা ওকালতি করতে আজমগড়ে এসেছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি। বাবাও ওকালতি করতেন। আমি কিন্তু ব্যবসা করি। আমার নাম অশোক রায়। আপনার পরিচয় পেলে খুশি হব।
অশোকবাবুকে প্রথমে দেখে যা ভেবেছিলুম, তাঁর অমায়িক হাবভাব এবং কথাবার্তা শুনে সেই ধারণা কেটে গেল। আমার পরিচয় পেয়ে তিনি খুব উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। বললেন,–কেল্লাবাড়ির ধ্বংস্কৃপের মধ্যে কোথায় কী ছিল, তা আমার নখদর্পণে। আমার ছেলেবেলায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়নি।
ওয়েটারকে আবার ডেকে ওঁর জন্য কফি আনতে বললুম। তারপর অশোকবাবু আজ গড়ের পুরনো ঐতিহাসিক কাহিনি বলতে শুরু করলেন। ম্যানেজারের কাছে এসব গল্প শুনেছি। ওয়েটার কফি দিয়ে গিয়েছিল। কফি খেতে-খেতে অশোকবাবু বললেন, আজ বিকেলে কলকাতা থেকে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর আসার কথা। তার জন্য অপেক্ষা করে অস্থির। ছটা বেজে এল। সে এল না। কাজেই ধরে নিচ্ছি, আর সে আসবে না। না আসুক। আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে কী যে আনন্দ পেলুম, বোঝাতে পারব না। তা আপনি হোটেলে থাকবেন কে? খামোকা একগাদা টাকা খরচ! বরং আমার অতিথি হোন। আপনাকে দেখলে আমার স্ত্রী-ছেলেমেয়েরাও খুব খুশি হবে।
এত অন্তরঙ্গতার পর বিকেলে কেল্লাবাড়ির ভেতরে সংকীর্ণ লাল রাস্তায় যে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখেছি, তা অশোকবাবুকে না বলে থাকতে পারলুম না।
অশোকবাবু ঘটনাটা হেসে উড়িয়ে দিলেন। বললেন, আপনি ঐতিহাসিক পণ্ডিত। ইতিহাসের ভেতর ডুবে থাকেন। বাস্তব জগতে ভুলভাল দেখা আপনার পক্ষে স্বাভাবিক। দেখুন মশাই! আমি কত রাতদুপুরে ওই এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কখনও কিচ্ছু দেখিনি। হ্যাঁ–ওখানে এক পাগলা ফকির থাকে। আমাকে দেখলেই সে লেজ তুলে পালিয়ে যায়। তাকে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছেন?
বললুম,–হ্যাঁ। দুপুরে ফকিরকে গঙ্গায় স্নান করতে দেখেছি। আমাকে সে ভয় দেখাচ্ছিল।
অশোকবাবু হেসে উঠলেন। বললেন,–পরশু দোলপূর্ণিমা গেছে। আজ কিছুক্ষণ পরে সঁদ উঠবে। কোনও ভয়ের কারণ নেই। আমার সঙ্গে কেল্লাবাড়িতে চলুন। দেখবেন, কোনও অলৌকিক ব্যাপার ঘটছে না। আর পাগলা ফকিরের ডেরাতেও আপনাকে নিয়ে যাব। দেখবেন, আমাকে দেখে ব্যাটাচ্ছেলে কী করে।
এতক্ষণে সায়েব-মেমদের দলটি এসে পড়ল। অন্যান্য বোর্ডাররাও ততক্ষণে এসে গেছে। কেউ লাউঞ্জে, কেউ ডাইনিং হলে ঢুকে চা-কফি খাচ্ছে। অশোকবাবু বললেন, চলুন! জ্যোৎস্নারাতে আজমগড়ের গঙ্গার ধারে বসে গল্প করা যাবে। তারপর সেই লাল রাস্তায় যাব। আমার কাছে টর্চ আছে। আপনাকে আমি রেশমা বেগমের কবরও দেখিয়ে দেব। উঠে পড়ুন।
একটু অনিচ্ছা-অনিচ্ছা করে অশোকবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে গেলুম। তারপর মনে হল, ইনি বাঙালি এবং এখানেই বড় হয়েছেন। তা ছাড়া, তাঁর বলিষ্ঠ গড়ন দেখেও শেষপর্যন্ত ভয়টুকু ঘুচে গেল…