- বইয়ের নামঃ অন্যান্য ছড়াসমূহ
- লেখকের নামঃ সুকুমার রায়
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
অন্ধ মেয়ে
গভীর কালো মেঘের পরে রঙিন ধনু বাঁকা,
রঙের তুলি বুলিয়ে মেঘে খিলান যেন আঁকা!
গবুজ ঘাসে রোদের পাশে আলোর কেরামতি
রঙিন্ বেশে রঙিন্ ফুলে রঙিন্ প্রজাপতি!
অন্ধ মেয়ে দেখ্ছে না তা – নাইবা যদি দেখে-
শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে!
শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরয কোলাকুলি
মিষ্ট ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি!
দুঃখ সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,
তারও আধার জগৎখানি মধুর তারি কাছে।।
আকাশের গায়ে
আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে,
দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে;
তাই দেখে খুঁৎ-ধরা বুড়ো কয় চটে,
দেখছ কি, এই রং পাকা নয় মোটে।।
আদুরে পুতুল
যাদুরে আমার আদুরে গোপাল, নাকটি নাদুস থোপ্না গাল,
ঝিকিমিকি চোখ মিটমিটি চায় ঠোঁট দুটি তায় টাট্কা লাল।
মোমের পুতুল ঘুমিয়ে থাকুক দাঁত মেলে আর চুল খুলে-
টিনের পুতুল চীনের পুতুল কেউ কি এমন তুলতুলে?
গোব্দা গড়ন এম্নি ধরন আব্দারে কেউ ঠোট ফুলোয়?
মখমলি রং মিষ্টি নরম – দেখছ কেমন হাত বুলোয়!
বলবি কি বল হাব্লা পাগল আবোল তাবোল কান ঘেঁষে,
ফোক্লা গদাই যা বল্বি তাই ছাপিয়ে পাঠাই “সন্দেশে”।
আনন্দ
যে আনন্দ ফুলের বাসে,
যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়,
যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দ বাতাস বহে,
যে আনন্দ সাগরজলে,
যে আনন্দ ধুলির কণায়,
যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দ আকাশ ভরা ,
যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে,
যে আনন্দ রক্তধারায়
সে আনন্দ মধুর হয়ে
তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত
থাকুক তব জীবন ভরি।
আলোছায়া
হোক্না কেন যতই কালো
এমন ছায়া নাইরে নাই –
লাগ্লে পরে রোদের আলো
পালায় না যে আপনি ভাই!
শুষ্কমুখে আঁধার ধোঁয়া
কঠিন হেন কোথায় বল্,
পাগল যাতে হাসির ছোঁয়া
আপনি গলে হয় না জল।।
আয়রে আলো আয়
পুব গগনে রাত পোহাল,
ভোরের কোণে লাজুক আলো
নয়ন মেলে চায়।
আকাশতলে ঝলক জ্বলে,
মেঘের শিশু খোলার ছলে
আলোক মাখে গায়।।
সোনার আলো, রঙিন্ আলো,
স্বপ্নে আঁকা নবীন আলো –
আয়রে আলো আয়।
আয়রে নেমে আঁধার পরে,
পাষাণ কালো ধৌত করে
আলোর ঝরণায়।।
ঘুম ভাঙান পাখির তানে
জাগ্রে আলো আকুল গানে
অকুল নীলিমায়।
আলসভরা আখিঁর কোণে,
দুঃখ ভয়ে আঁধার মনে,
আয়রে আলো আয়।।
ও বাবা !
পড়তে বসে মুখের পরে কাগজ খানি থুয়ে
রমেশ ভায়া ঘুমোয় পড়ে আরাম ক’রে শুয়ে।
শুনছ নাকি ঘড়র্ ঘড়র্ নাক ডাকার ধুম?
সখ যে বড় বেজায় দেখি- দিনের বেলায় ঘুম!
বাতাস পোরা এই যে থলি দেখ্ছ আমার হাতে,
দুড়ম করে পিট্লে পরে শব্দ হবে তাতে।
রমেশ ভায়া আঁতকে উঠে পড়বে কুপোকাৎ
লাগাও তবে -ধুম ধাড়াক্কা! ক্যাবাৎ! ক্যাবাৎ!
ও বাবারে! এ কেরে ভাই! মারবে নাকি চাটি?
আমি ভাবছি রমেশ বুঝি! সব করেছে মাটি!
আবার দেখ চোখ পাকিয়ে আস্ছে আমায় তেড়ে,
আর কেন ভাই? দৌড়ে পালাই, প্রানের আশা ছেড়ে!
কত বড়
ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।
যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে-
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি-
“ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?”
কলিকাতা কোথা রে
গিরিধি আরামপুরী, দেহ মন চিৎপাত,
খেয়ে শুয়ে হু হু করে কেটে যায় দিনরাত;
হৈ চৈ হাঙ্গামা হুড়োতাড়া হেথা নাই;
মাস বার তারিখের কোন কিছু ল্যাঠা নেই;
খিদে পেলে তেড়ে খাও, ঘুম পেলে ঘুমিও-
মোট কথা, কি আরাম, বুঝলে না তুমিও !
ভুলেই গেছিনু কোথা এই ধরা মাঝেতে
আছে যে শহর এক কলকাতা নামেতে-
হেন কালে চেয়ে দেখি চিঠি এক সমুখে,
চায়েতে অমুক দিন ভোজ দেয় অমুকে ।
‘কোথায়? কোথায়?’ বলে মন ওঠে লাফিয়ে
তাড়াতাড়ি চিঠিখানা তেড়ে ধরি চাপিয়ে,
ঠিকানাটা চেয়ে দেখি নীচু পানে ওধারে
লেখা আছে ‘কলিকাতা’ – সে আবার কোথারে !
স্মৃতি কয় ‘কলিকাতা ‘ রোস দেখি; তাই ত ,
কোথায় শুনেছি যেন , মনে ঠিক নাই ত,
বেগতিক শুধালেম সাধুরাম ধোপারে ;
সে কহিল, হলে হবে উশ্রীর ওপারে।
ওপারের জেলেবুড়ো মাথা নেড়ে কয় সে ,
‘হেন নাম শুনি নাই আমার এ বয়সে ।’
তারপরে পুছিলাম সরকারী মজুরে
তামাম মুলুক সে ত বাৎলায় ‘হুজুরে’
বেঙাবাদ বরাকর , ইদিকে পচম্বা ,
উদিকে পরেশনাথ ,পাড়ি দাও লম্বা ;
সব তার সড়গড় নেই কোন ভুল তায় –
‘কুলিকাতা কাঁহা’ বলি সেও মাথা চুলকায় !
অবশেষে নিরুপায় মাথা যায় ঘুলিয়ে ‘
‘টাইম টেবিল’ খুলি দেখি চোখ বুলয়ে ।
সেথায় পাটনা পুরী গয়া গোমো মাল্দ
বজবজ দমদম হাওড়া ও শ্যালদ –
ইত্যাদি কত নাম চেয়ে দেখি সামনেই
তার মাঝে কোন খানে কলিকাতা নাম নেই !!
-সব ফাঁকি বুজ্রুকী রসিকতা -চেষ্টা !
উদ্দেশে ‘শালা ‘ বলি গাল দিনু শেষটা।-
সহসা স্মৃতিতে যেন লাগিল কি ফুৎকার
উদিল কুমড়া হেন চাঁদপানা মুখ কার!
আশে পাশে ঢিপি ঢুপি পাহাড়ে পুঞ্জ,
মুখ চাঁচা ময়দান, মাঝে কিবা কুঞ্জ !
সে শোভা স্মরণে ঝরে নয়নের ঝরনা ;
গৃহিনীরে কহি ‘প্রিয়ে !মারা যাই ধর না ।
তার পরে দেখি ঘরে অতি ঘোর অনাচার –
রাখে না কো কেউ কোন তারিখের সমাচার !
তখনি আনিয়া পাঁজি দেখা গেল গণিয়া,
চায়ের সময় এল একেবারে ঘনিয়া !
হায়রে সময় নেই, মন কাদে হতাশে-
কোথায় চায়ের মেলা! মুখশশী কোথা সে !
স্বপন শূকায়ে যায় আধারিয়া নয়নে ,
কবিতায় গলি তাই গাহি শোক শয়নে।
কহ ভাই কহ রে
কহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকা চোরা শহরে,
বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।
কানা-খোঁড়া সংবাদ
পুরাতন কালে ছিল দুই রাজা,
নাম ধাম নাহি জানা,
একজন তার খোড়া অতিশয়,
অপর ভূপতি কানা।
মন ছিল খোলা, অতি আলো ভোলা
ধরমেতে ছিল মতি,
পর ধনে সদা ছিল দোঁহাকার
বিরাগ বিকট অতি।
প্রতাপের কিছু নাহি ছিল ত্রুটি
মেজাজ রাজারি মত,
শুনেছি কেবল, বুদ্ধিটা নাকি
নাহি ছিল সরু তত,
ভাই ভাই মত ছিল দুই রাজা,
না ছিল ঝগড়াঝাঁটি,
হেনকালে আসি তিন হাত জমি
সকল করিল মাটি।
তিন হাত জমি হেন ছিল, তাহা
কেহ নাহি জানে কার,
কহে খোঁড়া রায় “এক চক্ষু যার
এ জমি হইবে তার”।’
শুনি কানা রাজা ক্রোধ করি কয়
“আরে অভাগার পুত্র,
এ জমি তোমারি- দেখ না এখনি
খুলিয়া কাগজ পত্র”।
নক্সা রেখেছে এক বছর
বাক্সে বাঁধিয়া আঁটি,
কীট কুটমতি কাটিয়া কাটিয়া
করিয়াছে তারে মাটি ;
কাজেই তর্ক না মিটিল হায়
বিরোধ বাধিল ভারি,
হইল য্দ্দু হদ্দ মতন
চৌদ্দ বছর ধরি।
মরিল সৈন্য, ভাঙিল অস্ত্র,
রক্ত চলিল বহি,
তিন হাত জমি তেমনি রহিল,
কারও হার জিত নাহি
তবে খোঁড়া রাজা কহে, হায় হায়,
তর্ক নাহিক মিটে,
ঘোরতর রণে অতি অকারণে
মরণ সবার ঘটে”
বলিতে বলিতে চঁটাৎ করিয়া
হঠাৎ মাথায় তার
অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসিল
অতীব চমৎকার।
কহিল তখন খোঁড়া মহারাজ,
শুন মোর কানা ভাই,
তুচ্ছ কারণে রক্ত ঢালিয়া
কখনও সুযশ নাই।
তার চেয়ে জমি দান করে ফেল
আপদ শান্তি হবে।”
কানা রাজা কহে, খাসা কথা ভাই,
কারে দিই কহ তবে।”
কহেন খঞ্জ, ” আমার রাজ্যে
আছে তিন মহাবীর-
একটি পেটুক, অপর অলস,
তৃতীয় কুস্তিগীর।
তোমার মুলুক কে আছে এমন
এদের হারাতে পারে?-
সবার সমুখে তিন হাত জমি
বকশিস দিব তারে।
কানা রাজা কহে ভীমের দোসর
আছে ত মল্ল মম,
ফালাহারে পটু, পঁচাশি পেটুক
অলস কুমড়া সম।
দেখা যাবে কার বাহাদুরি বেশি
আসুক তোমার লোক;
যে জিতিবে সেই পাবে এই জমি-
খোড়া বলে, তাই হোক।
পড়িল নোটিস ময়দান মাঝে
আলিশান সভা হবে,
তামাসা দেখিতে চারিদিক হতে
ছুটিয়া আসিল সবে।
ভয়ানক ভিড়ে ভরে পথঘাট,
লোকে হল লোকাকার,
মহা কোলাহল দাড়াবার ঠাই
কোনোখানে নাহি আর।
তারপর ক্রমে রাজার হুকুমে
গোলমাল গেল থেমে,
দুইদিক হতে দুই পালোয়ান
আসরে আসিল নেমে।
লম্ফে ঝম্ফে যুঝিল মল্ল
গজ-কচ্ছপ হেন,
রুষিয়া মুষ্টি হানিল দোহায়-
বজ্র পড়িল যেন!
গুঁতাইল কত ভোঁতাইল নাসা
উপাড়িল গোফ দাড়ি,
যতেক দন্ত করিল অন্ত
ভীষণ চাপটি মারি
তারপরে দোঁহে দোঁহারে ধরিয়া
ছুঁড়িল এমনি জোরে,
গোলার মতন গেল গো উড়িয়া
দুই বীর বেগভরে।
কিহল তাদের কেহ নাহি জানে
নানা কথা কয় লোকে,
আজও কেহ তার পায়নি খবর,
কেহই দেখেনি চোখে।
যাহোক এদিকে, কুস্তির শেষে
এল পেটুকের পালা,
যেন অতিকায় ফুটবল দুটি,
অথবা ঢাকাই জালা।
ওজনেতে তারা কেহ নহে কম,
ভোজনেতে ততোধিক,
বপু সুবিপুল, ভুড়ি বিভীষন-
ভারি সাতমন ঠিক।
অবাক দেখিছে সভার সকলে
আজব কান্ড ভারি-
ধামা ধামা লুচি নিমেষে ফুরায়
দই ওঠে হাঁড়ি হাঁড়ি!
দাড়ি পাল্লায় মাপিয়া সকলে
দেখে আহারের পরে ,
দুজনেই ঠিক বেড়েছে ওজনে
সাড়ে তিন মন করে।
কানা রাজা বলে একি হল জ্বালা,
আক্কেল নাই কারো ,
কেহ কি বোঝেনা সোজা কথা এই,
হয় জেতো নয় হারো।”
তার পর এল কুঁড়ে দুই জন
ঝাকার উপর চড়ে,
সভামাঝে দোহে শুয়ে চিৎপাত
চুপ চাপ রহে পড়ে।
হাত নাহি নাড়ে, চোখ নাহি মেলে,
কথা নাই কারো মুখে,
দিন দুই তিন রহিল পড়িয়া,
নাসা গীত গাহি সুখে।
জঠরে যখন জ্বলিল আগুন,
পরান কণ্ঠাগত,
তখন কেবল মেলিয়া আনন
থাকিল মড়ার মত।
দয়া করে তবে সহৃদয় কেহ
নিকটে আসিয়া ছুটি
মুখের নিকটে ধরিল তাদের
চাটিম কদলি দুটি।
খঞ্জের লোকে কহিল কষ্টে,
“ছাড়িয়া দে নারে ভাই”
কানার ভৃত্য রহিল হা করে
মুখে তার কথা নাই ।
তখন সকলে কাষ্ঠ আনিয়া
তায় কেরোসিন ঢালি,
কুড়েদের গায়ে চাপাইয়া রোষে
দেশলাই দিল জ্বালি।
খোঁড়ার প্রজাটি বাপরে বলিয়া
লাফ দিয়া তাড়াতাড়ি
কম্পিত পদে চম্পট দিল
একেবারে সভা ছাড়ি।
দুয়ো বলি সবে দেয় করতালি
পিছু পিছু ডাকে “ফেউ”?
কানার অলস বলে কি আপদ
ঘুমুতে দিবিনা কেঊ?
শুনে সবে বলে “ধন্য ধন্য
কুঁড়ে-কুল চুড়ামণি!”
ছুটিয়া তাহারে বাহির করিল
আগুন হইতে টানি।
কানার লোকের গুণপনা দেখে
কানা রাজা খুসী ভারি,
জমিতে দিলেই আরও দিল কত,
টাকাকড়ি ঘরবাড়ি।
কানে খাটো বংশীধর
কানে ঘাটো বংশীধর যায় মামাবাড়ি,
গুনগুনে গান গায় আর নাড়ে দাড়ি।।
চলেছে সে একমনে ভাবে ভরপুর,
সহসা বাজিল কানে সুমধুর সুর।।
বংশীধর বলে, “আহা, না জানি কি পাখি
সুদূরে মধুর গায় আড়ালেতে থাকি।।
দেখ, দেখ সুরে তার কত বাহাদুরি,
কালোয়াতি গলা যেন খেলে কারিকুরি ।।
এদিকে বেড়াল ভাবে, “এযে বড় দায়,
প্রাণ যদি থাকে তবে ল্যাজখানি যায়।।
গলা ছেড়ে চেচামেচি এত করি হায়,
তবু যে ছাড়ে না বেটা, কি করি উপায়।।
আর তো চলে না সহা এত বাড়াবাড়ি,
যা থাকে কপালে দেই এক থাবা মারি ।।
বংশীধর ভাবে, “একি বেসুরা যে করে,
গলা গেছে ভেঙে তাই ‘ফ্যাঁস’ সুর ধরে ।।”
হেনকালে বেরসিক বেড়ালের চাঁটি,
একেবারে সব গান করে দিল মাটি।।
কিছু চাই?
কারোর কিছু চাই গো চাই?
এই যে খোকা, কি নেবে ভাই?
জলছবি আর লাটু লাটাই
কেক বিস্কুট লাল দেশলাই
খেলনা বাঁশি কিংবা ঘুড়ি
লেড্ পেনসিল রবার ছুরি
এসব আমার বাক্সে নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?