- বইয়ের নামঃ হরতাল
- লেখকের নামঃ সুকান্ত ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
দেবতাদের ভয়
[পাত্ৰ-পাত্রী : ইন্দ্ৰ, ব্ৰহ্মা, নারদ, অগ্নি, বরুণ ও পবন।]
ইন্দ্ৰ : কি ব্যাপার?
ব্ৰহ্মা : আমার এত কষ্টের ব্ৰহ্মাণ্ডটা বোধহয় ছারখার হয়ে গেল। হায়—হায়—হায়!
নারদ : মানুষের হাত থেকে স্বর্গের আর নিস্তার নেই মহারাজ, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
ইন্দ্র : আঃ বাজে বকবক না করে আসল ব্যাপারটা খুলে বলুন না, কি হয়েছে?
ব্ৰহ্মা : আর কী হয়েছে। অ্যাটম বোমা!–বুঝলে? অ্যাটম বোমা।
ইন্দ্র : কই, অ্যাটম বোমার সম্বন্ধে কাগজে তো কিছু লেখে নি?
নারদ : ও আপনার পাঁচ বছরের পুরনো মফঃস্বল সংস্করণ কাগজ। ওতে কি ছাই কিছু আছে নাকি?
ইন্দ্ৰ : অ্যাটম বোমাটা তবে কি জিনিস?
ব্ৰহ্মা : মহাশক্তিশালী অস্ত্ৰ। পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারে।
ইন্দ্র : আমার বজ্রের চেয়েও শক্তিশালী?
নারদ : আপনার বজ্রে তো শুধু একটা তালগাছ মরে, এতে পৃথিবীটাই লোপাট হয়ে যাবে।
ইন্দ্ৰ : তইতো, বড় চিন্তার কথা। এই রকম অস্ত্র আমরা তৈরী করতে পারি না? বিশ্বকৰ্মা কি বলে?
নারদ : বিশ্বকৰ্মা বলছে তাঁর সেকেলে মালমশলা আর যন্ত্রপাতি দিয়ে ওসব করা যায় না। তা ছাড়া সে যা মাইনে পায় তাতে অতি খাটুনি পোষায়ও না।
ইন্দ্র : তবে তো মুস্কিল! ওরা আমার পুষ্পকরথের নকল করে এরোপ্লেন করেছে, আর বজ্রের নকল করে অ্যাটম বোমাও করল। এবার যদি হানা দেয় তা হলেই সেরেছে। আচ্ছা অগ্নি, তুমি পৃথিবীটাকে পুড়িয়ে দিতে পার না?
অগ্নি : আগে হলে পারতুম। আজকাল দমকলের ঠেলায় দম আটকে মারা যাই যাই অবস্থা।
ইন্দ্ৰ : বরুণ! তুমি ওদের জলে ড়ুবিয়ে মারতে পার না?
বরুণ : পরাধীন দেশ হলে পারি। এই তো সেদিন চট্টগ্রামকে ড়ুবিয়ে দিলুম। কিন্তু স্বাধীন দেশে আর মাথাটি তোলবার জো নেই। কেবল ওরা বাঁধ দিচ্ছে।
ইন্দ্ৰ : পবন?
পবন : পরাধীন দেশের গরিবদের কুঁড়েগুলোই শুধু উড়িয়ে দিতে পারি। কিন্তু তাতে লাভ কি?
ইন্দ্ৰ : আমাদের তৈরী মানুষগুলোর এত আস্পর্ধা? দাও সব স্বর্গের মজুরদের পাঁচিল তোলার কাজে লাগিয়ে—
নারদ : কিন্তু তারা যে ধর্মঘট করেছে।
ইন্দ্র : ধর্মঘট কেন? কি তাদের দাবি?
নারদ : আপনি যেভাবে থাকেন তারাও সেইভাবে থাকতে চায়।
ইন্দ্ৰ : (ঠোঁট কামড়িয়ে) বটে? মহাদেব আর বিষ্ণু কি করছেন?
ব্ৰহ্মা : মহাদেব গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছেন। আর বিষ্ণু অনন্ত শয়নে নাক ডাকাচ্ছেন।
ইন্দ্ৰ : এঁদের দ্বারা কিছু হবে না। আচ্ছা, মানুষগুলোকে ডেকে বুঝিয়ে দিতে পার যে এতই যখন করছে তখন ওরা একটা আলাদা স্বৰ্গ বানিয়ে নিক না কেন?
নারদ : তা তো করেছে। সোভিয়েট রাশিয়া নাকি ওদের কাছে স্বৰ্গ, খাওয়া-পরার কষ্ট নাকি কারুর সেখানে নেই। সবাই সেখানে নাকি সুখী।
ইন্দ্র : কিন্তু সেখানে কেউ তো অমর নয়।
ব্ৰহ্মা : নয়। কিন্তু মরা মানুষ বাঁচানোর কৌশলও সেখানে আবিষ্কার হয়েছে। অমর হতে আর বাকি কী?
ইন্দ্ৰ : তা হলে উপায়?
ব্ৰহ্মা : উপায় একটা আছে। ওদের মধ্যে মারামারি, কাটাকাটিটা যদি বজায় রাখা যায় তা হলেই ওরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করে মারা পড়বে, আমরাও নিশ্চিন্ত হব।
ইন্দ্র : তা হলে নারদ, তুমিই একমাত্র ভরসা। তুমি চলে যাও সটান পৃথিবীতে। সেখানে লোকদের বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের বিষ ঢুকিয়ে দাও। তা হলেই তা হলেই আমাদের স্বৰ্গ মানুষের হাত থেকে বেঁচে যাবে।
নারদ : তথাস্তু। আমার ঢেঁকিও তৈরী আছে!
[নারদের প্রস্থান]
রাখাল ছেলে
সূৰ্য যখন লাল টুকটুকে হয়ে দেখা দেয় ভোরবেলায়, রাখাল ছেলে তখন গরু নিয়ে যায় মাঠে। সাঁঝের বেলায় যখন সূৰ্য ড়ুবে যায় বনের পিছনে, তখন তাকে দেখা যায় ফেরার পথে। একই পথে তার নিত্য যাওয়া-আসা। বনের পথ দিয়ে সে যায় নদীর ধারের সবুজ মাঠে। গরুগুলো সেখানেই চ’রে বেড়ায়। আর সে বসে থাকে গাছের ছায়ায় বাঁশিটি হাতে নিয়ে, চুপ করে চেয়ে থাকে নদীর দিকে, আপন মনে ঢেউ গুনতে গুনতে কখন যেন বাঁশিটি তুলে নিয়ে তাতে ফুঁ দেয়। আর সেই সুর শুনে নদীর ঢেউ নাচতে থাকে, গাছের পাতা দুলতে থাকে। আর পাখিরা কিচির-মিচির করে তাদের আনন্দ জানায়!
একদিন দোয়েল পাখি তাকে ডেকে বলে :
।। গান।।
ও ভাই, রাখাল ছেলে!
এমন সুরের সোনা বলে কোথায় পেলে।
আমি যে রোজ সাঁঝা-সকালে,
বসে থাকি গাছের ডালে,
তোমার বাঁশির সুরেতে প্ৰাণ দিই ঢেলে।।
তোমার বাঁশির সুর যেন গো নির্ঝরিণী
তাই শোনে রোজ পিছন হতে বনহরিণী।
চুপি চুপি আড়াল থেকে
সে যায় গো তোমায় দেখে
অবাক হয়ে দেখে তোমায় নয়ন মেলে।।
রাখাল ছেলে অবাক হয়ে দেখে সত্যিই এক দুষ্ট হরিণী লতাগুলোর আড়াল থেকে মুখ বার করে অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছে তার দিকে। সে তাকে বললে :
ওগো বনের হরিণী!
তুমি রইলে কেন দূরে দূরে,
বিভোর হয়ে বাঁশির সুরে,
আমি তো কাছে এসে বসতে তোমায়
নিষেধ করি নি।
হরিণীর ভয় ভেঙে গেল, সে ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এল রাখাল ছেলের কাছে। সে তার পাশটিতে এসে চোখে চোখ মিলিয়ে শুনতে লাগল তার বাঁশি। অবোধ বনের পশু মুগ্ধ হল বাঁশির তানে। তারপর প্ৰতিদিন সে এসে বাঁশি শুনত, যতক্ষণ না তার রেশটুকু মিলিয়ে যেত বনান্তরে।
হরিণীর মা-র কিন্তু পছন্দ হল না তার মেয়ের এই বাঁশি-শোনা। তাই সে মেয়েকে বলল :