- বইয়ের নামঃ খাই খাই
- লেখকের নামঃ সুকুমার রায়
- প্রকাশনাঃ প্রান্ত প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ ছড়াসমগ্র
অবুঝ
চুপ করে থাক্, তর্ক করার বদভ্যাসটি ভাল না,
এক্কেবারেই হয় না ওতে বুদ্ধিশক্তির চালনা।
দেখ্ ত দেখি আজও আমার মনের তেজটি নেভেনি-
এইবার শোন বলছি এখন- কি বলছিলাম ভেবেনি!
বলছিলাম কি, আমি একটা বই লিখেছি কবিতার,
উচু রকম পদ্যে লেখা আগাগোড়াই সবি তার ।
তাইতে আছে “দশমুখে চায়,হ জম করে দশোদর,
শ্মশানঘাটে শষপানি খায় শশব্যস্ত শশধর।”
এই কথাটার অর্থ যে কি ,ভাবছে না কেউ মোটেও-
বুঝছে না কেউ লাভ হবে কি, অর্থ যদি জোটেও।
এরই মধ্যে হাই তুলিস যে? পুতে ফেলব এখনি,
ঘুঘু দেখেই নাচতে শুরু, ফাঁদ ত বাবা দেখনি!
কি বললি তুই? সাতান্নবার শুনেছিস্ ঐ কথাটা?
এমন মিথ্যা কইতে পারিস্ লক্ষ্মীছাড়া বখাটা!
আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধ্যি নেই কো পেরোবার
হিসেব দেব বলেছি এই চোদ্দবার কি তেরোবার।
সাতান্ন তুই গুনতে পারিস? মিথ্যেবাদী! গুনে যা-
ও শ্যামাদাস! পালাস্ কেন? রাগ করিনি, শুনে যা।
অসম্ভব নয়!
এক যে ছিল সাহেব, তাহার
গুণের মধ্যে নাকের বাহার।
তার যে গাধা বাহন, সেটা
যেমন পেটুক তেমনি ঢ্যাঁটা।
ডাইনে বল্লে যায় সে বামে
তিন পা যেতে দুবার থামে ।
চল্তে চল্তে থেকে থেকে
খানায় খন্দে পড়ে বেঁকে।
ব্যাপার দেখে এম্নিতরো
সাহেব বললে “সবুর করো-
মাম্দোবাজি আমার কাছে?
এ রোগেরও ওষুধ আছে।”
এই না বলে ভীষন ক্ষেপে
গাধার পিঠে বস্ল চেপে
মুলোর ঝুটি ঝুলিয়ে নাকে
আর কি গাধা ঝিমিয়ে থাকে?
মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে
দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে –
যতই ছোটে “ধরব” ব’লে
ততই মুলো এগিয়ে চলে !
খাবার লোভে উদাস প্রাণে
কেবল ছোটে মুলোর টানে –
ডাইনে বাঁয়ে মুলোর তালে
ফেরেন গাধা নাকের চালে।
আশ্চর্য !
নিরীহ কলম, নিরীহ কালি,
নিরীহ কাগজে লিখিল গালি –
“বাঁদর বেকুব আজব হাঁদা
বকাট্ ফাজিল অকাট্ গাধা।”
আবার লিখিল কলম ধরি
বচন মিষ্টি, যতন করি –
“শান্ত মানিক শিষ্ট সাধু
বাছারে, ধনরে, লক্ষ্মী যাদু।”
মনের কথাটি ছিল যে মনে,
রটিয়া উঠিল খাতার কোণে,
আঁচড়ে আঁকিতে আখর ক’টি
কেহ খুশী, কেহ উঠিল চটি!
রকম রকম কালির টানে
কারো হাসি কারো অশ্রু আনে,
মারে না, ধরে না, হাঁকে না বুলি
লোক হাসে কাঁদে কি দেখি ভুলি?
সাদায় কালোয়া কি খেলা জানে?
ভাবিয়া ভাবিয়া না পাই মানে।
আড়ি
কিসে কিসে ভাব নেই? ভক্ষক ও ভক্ষ্যে-
বাঘে ছাগে মিল হলে আর নেই রক্ষে।
শেয়ালের সাড়া পেলে কুকুরেরা তৈরি,
সাপে আর নেউলে ত চিরকাল বৈরী!
আদা আর কাঁচকলা মেলে কোনোদিন্ সে?
কোকিলের ডাক শুনে কাক জ্বলে হিংসেয়।
তেলে দেওয়া বেগুনের ঝগড়াটা দেখিনি?
ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ রাগ যেন খেতে আসে এখনি।
তার চেয়ে বেশি আড়ি আমি পারি কহিতে-
তোমাদের কারো কারো, কেতাবের সহিতে।
কাজের লোক
প্রথম।
বাঃ – আমার নাম ‘বাঃ’,
বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা!
লেখাপড়ার ধার ধারিনে , বছর ভরে ছুটি,
হেসে খেলে আরাম ক’রে দুশো মজা লুটি।
কারে কবে কেয়ার করি , কিসের করি ডর?
কাজের নামে কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর।
গাধার মতন খাটিস্ তোরা মুখটা করে চুন-
আহাম্মুকি কান্ড দেখে হেসেই আমি খুন।
সকলে।
আস্ত একটি গাধা তুমি স্পষ্ট গেল দেখা,
হাস্ছ যত, কান্না তত কপালেতে লেখা।
দ্বিতীয়।
‘যদি’ বলে ডাকে আমায় নামটি আমার যদি –
আশায় আশায় বসে থাকি হেলনা দিয়ে গদি।
সব কাজেতে থাকতে যদি খেলার মত মজা,
লেখাপড়া হত যদি জলের মত সোজা –
স্যান্ডো সমান ষন্ডা হতাম যদি গায়ের জোরে,
প্রশংসাতে আকাশ পাতাল যদি যেত ভরে –
উঠে পড়ে গেলে যেতাম বাজে তর্ক ফেলে।
করতে পারি সবি – যদি সহজ উপায় মেলে।
সকলে।
হাতের কাছে সুযোগ, তবু যদির আশায় বসে
নিজের মাথা খাচ্ছ বাপু নিজের বুদ্ধি দোষে
তৃতীয়।
আমার নাম ‘বটে’ আমি সদাই আছি চটে-
কট্মটিয়ে তাকাই যখন, সবাই পালায় ছুটে।
চশমা পরে বিচার ক’রে চিরে দেখাই চুল-
উঠ্তে বস্তে কচ্ছে সবাই হাজার গন্ডা ভুল।
আমার চোখে ধুলো দেবে সাধ্যি আছে কার?
ধমক শুনে ভূতের বাবা হচ্ছে পগার পার।
হাসছ? বটে ভাবছ বুঝি মস্ত তুমি লোক,
একটি আমার ভেংচি খেলে উল্টে যাবে চোখ।
সকলে।
দিচ্ছ গালি, লোকের তাতে কিবা এল গেল?
আকাশেতে থুতু ছুঁড়ে – নিজেই গায়েই ফেল।
চতুর্থ।
আমার নাম ‘কিন্তু’ আমায় ‘কিন্তু’ বলে ডাকে,
সকল কাজে একটা কিছু গলদ লেগে থাকে।
দমটা কাজে লাগি কিন্তু আটটা করি মাটি,
ষোল আনা কথায় কিন্তু সিকি মাত্র খাঁটি।
লম্ফ ঝম্ফবহুৎ কিন্তু কাজের নাইকো ছিরি-
ফোস করে যাই তেড়ে – আবার ল্যাজ গুটিয়ে ফিরি।
পাঁচটা জিনিস গড়তে গেলে দশটা ভেঙে চুর –
বল্ দেখি ভাই কেমন আমি সাবাস বাহাদুর!
সকলে।
উচিত তোমায় বেধে রাখা নাকে দিয়ে দড়ি,
বেগারখাটা পশুকাজের মূল্য কানাকড়ি।
পঞ্চম।
আমার নাম ‘তবু’ তোমার কেউ কি আময়ি চেনো?
দেখতে ছোট তবু আমার সাহস আছে জেনো।
এতটুকু মানুষ তবু দ্বিধা নাইকো মনে,
যে কাজেতেই লাগি আমি খাটি প্রাণপণে।
এম্নি আমার জেদ, যখন অঙ্ক নিয়ে বসি,
একুশ বারে না হয় যদি বাইশ বারে কষি।
হাজার আসুক বাধা তবু উৎসাহ না কমে,
হাজার লোকে চোখ রাঙালে তবু না যাই দ’মে।
সকালে।
নিস্কম্মারা গেল কোথা,পালাল কোন দেশে?
কাজের মানুষ কারে বলে দেখুন এখন এসে।
হেসে খেলে, শুয়ে বসে কত সময় যায়,
সময়টা যে কাজে লাগায়,চালাক বলে তায়।