মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের স্মৃতি অনুযায়ী নরেন্দ্রনাথ বরাহনগর থেকে সোজা নিমতলা ঘাটে চলে আসেন। শ্মশানের মিউনিসিপ্যাল ডেথ রেজিস্টারে নরেন্দ্রনাথ তার পুরো নাম ইংরিজিতে লেখেন।
পৈত্রিক দিক থেকে দীর্ঘজীবী হওয়ার তেমন কোনো প্রমাণ স্বামীজির বংশতালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না। দশভাইবোনের সংসারেও অনেকেই অকালে দেহরক্ষা করেছেন। তবে তাঁর দিদি স্বর্ণলতা, মেজভাই মহেন্দ্রনাথ এবং ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবনের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। জননী ভুবনেশ্বরী শোকতাপে জর্জরিত হয়েও বাহাত্তর বছর বেঁচেছিলেন, তার মৃত্যুর কারণ যে মেনিনজাইটিস তা আমাদের অজানা নয়। ভুবনেশ্বরী-জননী রঘুমণি দেবী বেঁচেছিলেন ৯০ বছর, তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটির খাতায় লেখা আছে ‘বার্ধক্যজনিত দৌর্বল্য’। জীবিতকালে তাঁর শেষ আশ্রয় নিমতলা গঙ্গাযাত্রীনিবাস।
স্বামীজির স্বল্পায়ুকে চেষ্টা করে পুরোপুরি বংশধারার সঙ্গে যুক্ত করাও সুবিবেচনার কাজ হবে না, কারণ দিদি স্বর্ণময়ী বেঁচেছিলেন ৭২ বছর। কর্পোরেশন মৃত্যু-রেজিস্টার অনুযায়ী স্বর্ণময়ীর দেহাবসান ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, আনুমানিক বয়স ৭০। মেজভাই মহিম বেঁচেছিলেন ৮৮ বছর এবং ছোট ভূপেন্দ্রনাথ ৮১ বছর। তবু পারিবারিক ব্যাধি ডায়াবিটিস ও হার্ট অ্যাটাকের কথা মনে রেখেই স্বামীজির শরীর ও রোগের মানচিত্র আমাদের আঁকতে হবে।
সেই সঙ্গে সকলকে জানানো দরকার কী-ধরনের শারীরিক জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যে তিনি কী সব কাজ এই পৃথিবীতে করে গেলেন। অসম্ভব যেভাবে তার জীবনে সম্ভব হয়েছে তা পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে।
নরেন্দ্রনাথের শৈশবকাল থেকে ৪ জুলাই ১৯০২ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে শরীর সংক্রান্ত যেসব খবরাখবর ছড়িয়ে রয়েছে তা এবার সাজিয়ে না ফেললে অনেক মূল্যবান ছোটখাট বিবরণ চিরদিনের মতন অনুসন্ধিৎসুদের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে পারে।
ব্যাধির প্রসঙ্গে ঢোকবার আগে স্বামীজির অবয়ব সম্বন্ধে কিছু জানবার আগ্রহ সর্বস্তরেই রয়েছে। কেমন দেখতে ছিলেন মানুষটি? কত ছিল তার উচ্চতা? ওজন কত? গায়ের রঙ কী রকম? পায়ের জুতোর সাইজ কত? এসব বিষয়েও সম্পূর্ণ তথ্য সবসময় আমাদের হাতের গোড়ায় নেই।
সমকালের ভারতীয়দের মস্ত দোষ, তারা একজন স্মরণীয় মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে নানাবিধ মন্তব্য করেন, কেমন দেখতে তাও বলেন, কিন্তু তথ্যভিত্তিক বিবরণ দেন না।
প্রমথনাথ বসু তাঁর বইতে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলেছেন, সুগঠিত অবয়ব, তার মধ্যে সিংহাবয়বের সৌন্দর্য। কিন্তু স্বামীজির শরীরের মাপজোখের জন্য আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে রোমাঁ রোলাঁর। সাবধানী ইউরোপীয় ও আমেরিকান লেখকরা যথা সময়ে কলম না ধরলে আমরা অনেক বিবরণ জানতে পারতাম না।
রোলাঁ তার বিখ্যাত বইয়ের শুরুতেই লিখছেন : “বিবেকানন্দের দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মত সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণদেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে অবনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চক্ষু।”
ভারতীয় অপেক্ষা তাতারদের সঙ্গেই তার চোয়ালের সাদৃশ্য ছিল বেশি। বিবেকানন্দর কণ্ঠস্বর ছিল ভায়লিনচেলো বাদ্যযন্ত্রের মতো। তাতে উত্থানপতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তার ঝঙ্কার সমগ্র সভাকক্ষে সকল শ্রোতার হৃদয়ে। ফরাসি গায়িকা এমা কালভে বলেন, তিনি ছিলেন চমৎকার ব্যারিটোন, গলার সুর ছিল চীনা গঙের আওয়াজের মতো। রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বিবেকানন্দর ওজন ১৭০ পাউন্ড।
এই ওজন কি মাঝে-মাঝেই ওঠা-নামা করতো? কারণ অন্য এক পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক মার্কিনী সাংবাদিক আন্দাজ করেছেন, স্বামীজির ওজন ২২৫ পাউন্ড। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে, স্বামীজি নিজেই ওজন কমাবার জন্য কৃতসংকল্প হয়ে উঠেছেন। মনে হয়, ঝপ করেই তার ওজন বাড়তো আবার একটু চেষ্টাতেই আয়ত্তে এসে যেত।
প্রথমবার মার্কিন প্রবাসকালে নিউইয়র্ক থেকেডায়েটিংসম্বন্ধেবিবেকানন্দ লিখেছেন, “আজকাল দুধ, ফল, বাদাম–এই সব আমার আহার। ভাল লাগে, আছিও বেশ। এই গ্রীষ্মের মধ্যেই মনে হয় শরীরের ওজন ৩০৪০ পাউন্ড কমবে, শরীরের আকার অনুসারে ওজন ঠিকই হবে।”
প্রথমবার যখন স্বামীজি আমেরিকায় যান তখন “ফ্রেনলজিক্যাল জার্নাল অব নিউ ইয়র্কে” তাঁর শরীরের মাপ প্রকাশিত হয়।
নিজের ওজন নিয়ে স্বামীজির রসরসিকতার অন্ত ছিল না। আমেরিকায় একবার বক্তৃতার পর জনৈক মুগ্ধ ভক্ত তাঁকে প্রশ্ন করলেন,”স্বামীজি, আপনি কি ভগবানকে দেখেছেন?” স্বামীজির তাৎক্ষণিক উত্তর : “বলেন কি? আমাকে আমার মতন একজন মোটা লোককে দেখে কি তাই মনে হয়?”
কারও শারীরিক ওজনের উত্থান-পতনের গ্রাফের দিকে সাবধানী নজর রাখা দেহান্তের এতোদিন পরে সহজ কাজ নয়। আমাদের কাছে উপাদানের মধ্যে তখনকার মানুষের কিছু স্মৃতিকথা, ইংরিজি, বাংলা, সংস্কৃত ও ফরাসিতে লেখা তাঁর চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন সময়ে তোলা কিছু ফটো, যা দেখলে সহজেই বোঝা যায় কোনো অজ্ঞাত কারণে তার ওজন সব সময় স্থির থাকছে না। এর পিছনে অদৃশ্য ডায়াবিটিস এবং কিডনির ব্যাধি কতটুকু কাজ করেছে তা নিয়ে ডাক্তারি অনুধ্যান করলে মন্দ হয় না।