- বইয়ের নামঃ হলদে পাখির পালক
- লেখকের নামঃ লীলা মজুমদার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
০১. কত দেরি হয়ে গেল
কত দেরি হয়ে গেল ভুলো তবু বাড়ি এল না, সন্ধ্যে হয়ে গেল, রাত হয়ে গেল। দাদু তাস খেলতে যাবার আগে বললেন, খুঁজতে যাবার কিছু দরকার নেই, কেউ তোদের নেড়িকুত্তো চুরি করবে না, খিদে পেলে সুড়সুড় করে নিজেই বাড়ি ফিরবে দেখিস।
রুমুর গলার কাছটা কীরকম ব্যথা ব্যথা করছিল; কখন ভুলোর খাবার সময় হয়ে গেছে, বারান্দার কোনায় ভুলোর থালায় দুধরুটিগুলোকে নীলমতো দেখাচ্ছে, পিঁপড়েরা এসেছে।
জানলার শিকের সঙ্গে ভুলোর চেনের আগায় কলারটা আটকানো ছিল। খুব মজার দেখাচ্ছিল। ভারি দুষ্টু ভুলো। কলার আঁটবার সময় কান খাড়া করে গলা ফুলিয়ে রাখে; তারপরে যেই-না সবাই চলে যায়, কান চ্যাপটা করে, গলা সরু করে, কলারের মধ্যে থেকে সুড়ুত করে বেরিয়ে পড়ে দে ছুট।
কেন ভুলো পালিয়ে যায়?
দাদা চেন কলার আর একটা বেঁটে লাঠি হাতে নিয়ে গেটের কাছে দূরে রেলের লাইনের ওপারের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রুমুকে দেখেই রেগে গেল।
যা, ঘরে যা, এখানে কেন এসেছিস? যা ভাগ।
দাদা, বোধ হয় সে সাঁওতাল গ্রামে গেছে। ওরা যদি মারে?
বেশ হবে, ঠিক হবে, আমি খুব খুশি হব, পালানো বেরুবে, আসুক-না বাড়ি, পিটিয়ে মজা বের কচ্ছি। যা, পালা, ছিঁচকাঁদুনে!
রুমু আবার পিছনের বারান্দায় গেল।
এমনি সময় ভুলো বাড়ি এল। অন্যদিনের মতো সামনের গেট দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে নয়। রান্নাঘরের পেছন দিয়ে, দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে ল্যাজ নামিয়ে, কান ঝুলিয়ে, আড়চোখে তাকাতে তাকাতে, স্রেফ একটা চোরের মতো এসেই রুমুর পায়ে মুখ রেখে ল্যাজ নাড়তে লাগল। রুমুর মুখে কথাটি নেই, গা শিরশির করতে লাগল। জানলা দিয়ে খাবার ঘর থেকে আলো এসে ভুলোর গায়ে পড়েছে, সেই আলোতে রুমু দেখতে পেল ভুলোর ঠোঁটের কোণে ছোট্ট একটা হলদে পালক গুঁজে রয়েছে। সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে।
রুমুর বুকটা ধড়াস করে উঠল, এক দৌড়ে দাদার কাছে গেল।
দাদা, ভুলোর ঠোঁটের কোনায় সেইরকম হলদে পালক।
যাঃ, দূর, হলদে পাখি ঝগড়ুর বানানো।
না, দাদা, তুমি দেখবে এসো।
ভুলো মাটির ভাঁড় থেকে জল খাচ্ছিল। হলদে পালকটা ভাঁড়ের জলে ভাসছিল। ভিজে একটু চুপসে গিয়েছে, কিন্তু তখনও সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে। বোগি পালকটা তুলে, মুছে, পকেটে রেখে দিল।
কারো মুখে কথা সরে না। কোথাও একটু আওয়াজ নেই, শুধু মাথার উপর একটা রাতের পাখির ডানা নাড়ার ঝটপটি, আর দূরে কুসিদিদিদের পোড়ো জমির ঝাউ গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে শোঁ শোঁ করে বাতাস বইছে, আর রুমু বোগির বুকের ধুকপুকি। এবার তবে তো ঝগডু মিথ্যা কথা বলেনি। দারুণ গাঁজাখুরি গল্প বলে ঝগড়ু। দুমকায় ওদের গাঁয়ে নাকি হয় না এমন আশ্চর্য জিনিস নেই। সেখানে সীতাহার গাছের পিছনে সূর্য ডুবে গিয়ে যেই তার লাল আলোগুলোকে গুটিয়ে নেয়, অমনি নাকি আকাশ থেকে সোনালি রঙের অবাক পাখিরা বটফল খেতে নেমে আসে। তারা ডাকে না, কারণ তাদের গলায় স্বর নেই। তারা মাটিতে বা গাছের ডালে বসতে পারে না, কারণ তাদের পা নেই। এমনি উড়ে ফল খেয়ে আবার আকাশে চলে যায়। কিন্তু দৈবাৎ যদি একটা পাখির ডানা জখম হয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, আর ঠিক সেই সময় যদি তাকে শেয়ালে কি কুকুরে খেয়ে ফেলে, তাহলে সেই শেয়াল কি কুকুর মানুষ হয়ে যায়। তাই শুনে বোগি বলেছিল, যাঃ, ঝগড়ু যত রাজ্যের বাজে কথা! জানোয়ার কখনো মানুষ হয়?
বিশ্বাস না করতে পার, বোগিদাদা, কীই-বা জান তুমি? জানলে কী আর রোজ রোজ মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেতে। কিন্তু আমাদের দুমকাতে ওইরকম অনেক মানুষ আছে। তাদের দেখলেই চিনতে পারা যায়। কারণ সবটা মানুষের মতো হলেও, চোখটা হয় পাটকিলে রঙের, আর কানের উপরদিকটা হয় একটু ছুঁচলো। নেই ও-রকম মানুষ তোমাদের এখানেও? কেউ চোখে দেখে না ও পাখি, কিন্তু ওই মানুষদের দেখলেই সব বোঝা যায়।
পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নি রোজ সন্ধে বেলায় দাদুর বাড়ির পাঁচিলের তলা থেকে আমরুল পাতা তুলতে আসেন। মাঝে মাঝে আমরুল তুলতে তুলতে চোখ উঠিয়ে রুমুকে বলেন, আয় তুলে দে, আমার গেঁটে বাত, এসব তোদের কচি হাড়ের কাজ। ততক্ষণে সূর্য তাল গাছের গুঁড়ির কাছে নেমে গেছে, ছায়াগুলো লম্বা হয়ে গেছে। পণ্ডিতমশাইয়ের গিন্নির চোখে আলো পড়ে, চকমকি পাথরের মতো ঝকঝক করে; পাটকিলে রঙের চোখের মণি, তার মধ্যে সোনালি রঙের সবুজ রঙের ডুরি ডুরি কাটা মনে হয়; মাথার কাপড় খসে যায়, ঝিনুকের মতো পাতলা কান, উপর-দিকটা গোল না হয়ে খোঁচামতন।
ও-রকম লোক এখানেও আছে।
দিদিমা এসে বলেন, ওঃ, চাঁদের তাহলে বাড়ি ফেরার মর্জি হয়েছে! কে জানে হয়তো এবার এ বাড়ির অন্য লোকদেরও পড়াশুনো খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি হবে। মেজো মামা সরভাজা এনেছে, জানিস তোরা?
ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ সরভাজা। রুমু তখুনি চলে গেল। বোগি অনেকক্ষণ ভুলোর নাক, মুখ, চোখ পরীক্ষা করে দেখল। কই, কিছু তো হয়নি। তারপর খুব আঁটো করে কলার লাগিয়ে সরভাজা দেখতে গেল।
রাতে শোবার সময় মশারি টানাতে টানাতে ঝগড়ু বলল, বোগিদাদা, ভুলো কিছু খেল না, চটের উপর শুয়ে খালি ঘুমুচ্ছে।