• বইয়ের নামঃ অচেনা অজানা বিবেকানন্দ
  • লেখকের নামঃ শংকর
  • প্রকাশনাঃ পোদ্দার বুকস্ ইন্টারন্যাশনাল (ভারত)
  • বিভাগসমূহঃ ধর্মীয় বই

 ১. সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী

সেই ১৮৯৩ সাল থেকে এদেশের চিত্তগগনে মধ্যাহ্নসূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়ে আছে স্বামী বিবেকানন্দ! উনিশ, বিশ এবং একুশ শতকের দেশী-বিদেশী গবেষকরা বিপুল নিষ্ঠায় নিরন্তর অনুসন্ধান চালিয়ে এখনও পরিপূর্ণ বিবেকানন্দকে এঁকে ফেলতে সক্ষম হননি। অজানা ও অচেনা বিবেকানন্দের অনুসন্ধান তাই চলছে এবং চলবে।

সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের সঙ্গে শংকর-এর প্রথম পরিচয় নিতান্ত বাল্যবয়সে ১৯৪২ সালে, যার চল্লিশ বছর আগে বেলুড়ে মহাসমাধি লাভ করেছেন বিদ্রোহী, বিপ্লবী ও জনগণমন বিবেকানন্দ। হাওড়ায় তারই নামাঙ্কিত বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে অতি অল্পবয়সে শংকর-এর বিবেকানন্দ-অনুসন্ধানের শুরু।

কেমন ছিলেন মানুষটি? সন্ন্যাসীর কর্তব্য ও সন্তানের কর্তব্যের সমন্বয় ঘটাতে গিয়ে তিনি কি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন? তার বোন কোথায় আত্মঘাতিনী হলেন? বিলেত থেকে ফেরার পথে উদাসী মেজভাই কোন অভিমানে পাঁচবছর বাড়িতে একটা চিঠি লিখলেন না? কোথা থেকে যোগাড় হল দত্ত পরিবারের শরিকী মামলার টাকাকড়ি? সমস্ত পরিবার কীভাবে সর্বস্বান্ত হলেন?

সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কেমনভাবে বিদেশে বেদান্তের সঙ্গে বিরিয়ানি রান্নার প্রচার-অভিযানে নেমেছিলেন? কলকাতা শহর থেকে আরম্ভ করে কোথায়-কোথায় কতদিন তাকে অনাহারে থাকতে হয়েছিল? তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার কোনটি? কোন ফলটি তিনি একেবারেই অপছন্দ করতেন?

স্বামীজির দৈহিক উচ্চতা ও ওজন কত ছিল? তার প্রথম ও দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক কোথায় হয়েছিল? বিশ্ববিজয় করে ফেরবার পরেও কলকাতার বিখ্যাত ডাক্তাররা তাদের চেম্বারে ভিক্ষুক সন্ন্যাসীর কাছ থেকে নির্দ্বিধায় কত টাকা ফি গ্রহণ করেছিলেন? চিকিৎসার খরচ সামলাতে হিমশিম খেয়ে কাদের কাছে স্বামীজি হাত পেতেছিলেন? আসন্ন বিদায়ের কথা ভেবেই কি তিনি পারিবারিক বিবাদের ফয়সালা করার জন্য মহাপ্রয়াণের মাত্র কয়েকদিন আগে অমন তৎপর হয়ে উঠেছিলেন? এমনই সব হাজারো প্রশ্নের ছোট ছোট এবং বড় বড় উত্তর সংগ্রহ করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় লেগে গিয়েছে লেখকের।

শংকর-এর স্বপ্নময় রচনায় অচেনা অজানা বিবেকানন্দই জানিয়ে দেন, কেন তিনি পুরুষোত্তম? সমকালের সমস্ত তাচ্ছিল্য ও যন্ত্রণা অবহেলা করে কেমন করে তিনি মহত্ত্বের হিমালয়শিখরে আরোহণ করেছিলেন? কেন প্রতিটি বড় কাজ করার সময় তিনি মৃত্যুর উপত্যকা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন?

উৎসর্গ – শ্রীসত্যপ্রসাদ রায়বর্মণ শ্রদ্ধাস্পদেষু

যাঁর নিরন্তর উৎসাহ, অশেষ কৌতূহল, ধারাবাহিক অনুপ্রেরণা ও সহমর্মিতা ছাড়া এই বই লিখতে আমার আরও অনেক দেরি হয়ে যেতো।

শংকর
৩০ নভেম্বর ২০০৩

.

“কতবার আমি অনাহারে, বিক্ষতচরণে, ক্লান্তদেহে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি। কতবার দিনের পর দিন এক মুষ্টি অন্ন না পেয়ে পথচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন অবসন্ন শরীর বৃক্ষচ্ছায়ায় লুটিয়ে পড়ত, তখন মনে হতো প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে পারতাম না, চিন্তাও অসম্ভব হয়ে পড়ত; আর অমনি মনে এই ভাব উঠত, আমার কোন ভয় নেই, মৃত্যুও নেই; আমার জন্ম কখনো হয়নি, মৃত্যুও হবে না; আমার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, সোহ হম, সোহ হম। সারা প্রকৃতির ক্ষমতা নেই যে আমায় পিষে মারে। প্রকৃতি তো আমার দাসী! হে দেবাদিদেব, হে পরমেশ্বর, নিজ মহিমা প্রকাশ কর, স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হও! উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত! বিরত হয়ো না। অমনি আমি পুনর্বল লাভ করে উঠে দাঁড়াতাম; তাই আমি আজও বেঁচে আছি।”

লস এঞ্জেলিসে বক্তৃতা
‘দ্য ওপেন সিক্রেট’
৫ জানুয়ারি ১৯০০

.

“না খেতে পেয়ে মরে গেলে দেশের লোক একমুঠো অন্ন দেয় না, ভিক্ষে-শিক্ষে করে বাইরে থেকে এনে দুর্ভিক্ষগ্রস্ত অনাথকে যদি খাওয়াই তো তার ভাগ নেবার জন্য দেশের লোকের বিশেষ চেষ্টা; যদি না পায় তো গালাগালির চোটে অস্থির!! হে স্বদেশীয় পণ্ডিতমণ্ডলী! এই আমাদের দেশের লোক, তাদের আবার কি খোসামোদ? তবে তারা উন্মাদ হয়েছে, উন্মাদকে যে ঔষধ খাওয়াতে থাকে, তার হাতে দু-দশটা কামড় অবশ্যই উন্মাদ দেবে; তা সয়ে যে ঔষধ খাওয়াতে যায়, সেই যথার্থ বন্ধু।”

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
উদ্বোধন পত্রিকা
১৩০৬-০৮

.

“আমাদের এত বুদ্ধি মেধা কেন জানিস? আমরা যে সুইসাইডের বংশ, আমাদের বংশে অনেকগুলো আত্মহত্যা করেছে।…আমাদের পাগলাটে মাথা, হিসেব-ফিসেবের ধার ধারে না, যা করবার তা একটা করে দিলুম, লাগে তাক, না লাগে তুক।”

বলরাম বসুর বাড়িতে
যোগেন মহারাজকে
স্বামী বিবেকানন্দ

.

লেখকের নিবেদন

এতো চেনা-জানা হয়েও বিবেকানন্দকে অনেকসময় বড়ই অচেনা এবং অজানা মনে হয়েছে। প্রথমেই স্মরণ করি হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে আমার পূজ্যপাদ হেডমাস্টারমশাই সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্যের কথা। বয়সের এবং জ্ঞানের দুস্তর পার্থক্যের কথা মনে না রেখে তিনি কমবয়সী ছাত্রদেরও বিবেকানন্দ বিষয়ে নানা সংবাদ সরবরাহ করতেন। পরবর্তীকালে, ইস্কুলে সিনিয়র এবং আমার সাহিত্যগুরু শঙ্করীপ্রসাদ বসুর স্নেহপ্রশ্রয় ও নিবিড় সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য লাভ করি। তার কালজয়ী রচনা বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনেই মহীরুহের আকার ধারণ করে। শঙ্করীপ্রসাদের গবেষণা থেকে প্রত্যাশার বেশি লাভ করেও কিন্তু আমার কৌতূহলের অবসান হলো না। বরং পিপাসা আরও বেড়ে গেল।

এই পিপাসানিবৃত্তির প্রচেষ্টায় সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিবেকানন্দ সম্পর্কে কয়েকটা ছোট আকারের প্রবন্ধ লেখা হয়। সেই লেখাগুলি বেশ কয়েকজন পাঠকের নজরে আসে। প্রধানত তাদেরই প্ররোচনায় খোঁজ করতে হল কিছু পুরনো কাগজপত্রের। দেখলাম, দীর্ঘদিন ধরে আমার অজান্তেই কিছু কিছু উপাদান হাতের গোড়াতে সংগৃহীত হয়ে রয়েছে। অতএব সাহস করে আসরে নেমে পড়া গেল।

অচেনা অজানা বিবেকানন্দ সত্যিই বহুমুখীতার স্বল্পপরিসর বিচিত্র জীবনের কয়েকটা মাত্র দিক এবারের এই অনুসন্ধানের আওতায় আনা গেল।

যাঁদের জন্য এই লেখা, তারা চাইলে ভিক্ষালব্ধ সংগ্রহের ঝুলি থেকে আরও কিছু তথ্য আর একটি বইতে সাজিয়ে দেবার ইচ্ছা রইল।

শংকর

.

ত্রয়োদশ সংস্করণের নিবেদন

সুদূর সেন্ট লুইস, আমেরিকা থেকে সন্ন্যাসী, গবেষক ও লেখক স্বামী চেতনানন্দ সস্নেহে কিছু মন্তব্য পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আশীর্বাদে এই সংস্করণে নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু সংশোধন ও সম্পাদনা করা গেল! স্বামী চেতনানন্দকে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

ভূতপূর্ব পাঠক এবং বর্তমানে বন্ধু শ্ৰীঅরুণকুমার দে এবারও সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। তাঁকেও নমস্কার।

শংকর

.

প্রচ্ছদচিত্র

স্বামীজির এই অবিস্মরণীয় ছবিটি কে তুলেছিলেন এবং কোথায় তুলেছিলেন তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। এতোদিন বলা হয়েছে, এইটাই বেলগাঁও ছবি, তোলা আমেরিকযাত্রার আগে অক্টোবর ১৮৯২। কেউ কেউ বলেন, ছবিটি হায়দ্রাবাদে তোলা ১৮৯৩ সালের। গোড়ার দিকে। আবার একদলের দাবি, ছবি নেওয়া হয় চেন্নাইতে। নতুন মত, ১৮৯১ এপ্রিলের গোড়ায় জয়পুরে তোলা।

স্বামীজির ভক্ত ও শিষ্য হরিপদ মিত্র বেলগাঁওতে যে ছবি তুলিয়েছিলেন তা রক্ষা পেয়েছে। হরিপদ মিত্র নিজেই জানিয়েছেন, স্বামীজি ছবি তোলাতে খুব অনিচ্ছুক ছিলেন। সেক্ষেত্রে, এই ছবিটি বেলগাঁওয়ে তোলার সম্ভাবনা খুব কম। বেলগাঁওয়ের ছবিটি সম্ভবত তুলেছিলেন এস মহাদেব অ্যান্ড সন স্টুডিওতে গোবিন্দ শ্রীনিবাস ওয়েলিং।

ওপরের ছবিটি সম্পর্কে স্বামীজির সহাস্য মন্তব্য : ঠিক যেন। ডাকাতদলের সর্দার!

এই সময়ে তার সম্বলের মধ্যে একখানি গেরুয়া বস্ত্র, দণ্ড,কমণ্ডলু ও কম্বলে জড়ানো দু’চারখানি বই। এছাড়া সঙ্গে আর কিছুই থাকতো না। তার কাছে কোন পয়সাও থাকতো না।

রাজপুতানা ভ্রমণকালে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “মহারাজ, আপনি কেন গেরুয়া পরেন?” স্বামীজির উত্তর, “কারণ এটাই ভিখিরির বেশ। শাদা কাপড়ে ঘুরলে লোকে আমার কাছে ভিক্ষে চাইবে। আমি নিজেই ভিখিরি, বেশীরভাগ সময়ে আমার নিজের কাছেই একটা পয়সা থাকে না। অথচ কেউ ভিক্ষে চাইলে না দিতে পারলে আমার বেজায় কষ্ট হয়। আমার এই গেরুয়া কাপড় দেখলে ওরা বুঝতে পারে আমিও ভিখিরি। কেউ ভিখিরির কাছে ভিক্ষে চায় না।”

.

০১. সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী

“আমার ছেলে চব্বিশ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হয়েছিল,” এই কথা তার জীবনসায়াহ্নে বেশ গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন এক গর্ভধারিণী। যাঁদের কাছে তিনি একথা বলেছিলেন তাঁরা তরুণ সংসারত্যাগী, কিংবদন্তি সন্ন্যাসীর জননীকে দেখতে তারা এসেছিলেন উত্তর কলকাতার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে বিবেকানন্দর জন্মভিটায়। তখন অবশ্য তিনি ইহলোকে নেই।

বৈরাগ্যের এই দেশে স্মরণাতীত কাল থেকে মুক্তিসন্ধানী মানুষ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন, সংসারের মায়াবন্ধনকে তাঁরা ভাল চোখে দেখেননি, কিন্তু তবু প্রশ্ন জেগে থাকে, যার জঠর থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া যায়, যার স্তন্যপানে অসহায় শিশু জীবনরক্ষা করে, তাকে কি কোনো অবস্থাতেই পরিপূর্ণ ত্যাগ করা সম্ভব? অভিজ্ঞরা জানেন, এইসব প্রশ্নকে চিরতরে ভস্মীভূত করার জন্যই সন্ন্যাসপথের পথিককে নিজের শ্রাদ্ধ নিজে করতে হয়। পূর্বাশ্রমের সঙ্গে সকল সম্পর্ক সন্দেহাতীতভাবে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করার জন্যই তো এই আত্মশ্রাদ্ধ।

কিন্তু সন্ন্যাসীও তো মানুষ। গর্ভধারিণী জননীর ঋণ এবং মোক্ষের আহ্বান যতই ভিন্নমুখী হোক, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবসন্তানরাও কোনো যুগে এই দ্বন্দ্বের সম্পূর্ণ অবসান ঘটাতে সফল হননি। একালের সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন, “সন্ন্যাস অর্থ, সংক্ষেপে মৃত্যুকে ভালবাসা। আত্মহত্যা নয়–মরণ অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজেকে সর্বতোভাবে তিলে তিলে অপরের মঙ্গলের জন্য উৎসর্গ করা।” এরই পাশাপাশি উত্তর কলকাতায় তারই প্রতিবেশী মহাকবির ঘোষণা, বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়। অসংখ্য বন্ধন মাঝে মুক্তির স্বাদ গ্রহণের জন্য সত্যসন্ধানীর বার বার জীবনসমুদ্রে অবগাহন।

চব্বিশ বছর বয়সে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের যে প্রতিবেশী বৈরাগী হয়ে সব বন্ধন ছিন্ন করলেন, বিশ্ববাসীকে শোনালেন অনন্তকালের মুক্তিবাণী, তিনি বোধহয় উল্টোপথের যাত্রী। সমস্ত বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত হয়েও এবং অতীত বন্ধনকে অস্বীকার করার যথেষ্ট সুযোগ পেয়েও তা করতে রাজি হলেন না, যদিও সমকালের দৃষ্টিতে কারও কারও মনে হলো, তিনি ঘর ও ঘাটের বিচিত্র দোটানায় পড়ে থাকলেন।

আত্মশ্রাদ্ধের পর সর্ববন্ধন মুক্ত হয়েও যে মানবসন্তান অতীতবন্ধনকে অস্বীকার করে না, সে কি বিপথগামী? না নরোত্তম?

যেহেতু আমাদের সন্ধানের বিষয়বস্তু মহামানব বিবেকানন্দ, মানবতার সর্বোচ্চ শিখরে যাঁর রোমাঞ্চকর বিজয় অভিযান, সেহেতু আমরা অবাক বিস্ময়ে এমন এক মানুষের সন্ধান করি যিনি সংসারের কঠিনতম প্রশ্নকেও এড়িয়ে না গিয়ে বৈরাগ্য ও প্রেমকে আপন বিবেকের মধ্যে সহ-অবস্থানের অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। জনৈক প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে গাজীপুরে রোদন করতে দেখে একজন মন্তব্য করলেন, “সন্ন্যাসীর পক্ষে শোকপ্রকাশ অনুচিত।” বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, “বলেন কি, সন্ন্যাসী হইয়াছি বলিয়া হৃদয়টা বিসর্জন দিব? প্রকৃত সন্ন্যাসীর হৃদয় সাধারণ লোকের হৃদয় অপেক্ষা আরও অধিক কোমল হওয়া উচিত। হাজার হোক, আমরা মানুষ তো বটে।” তারপর সেই অচিন্তনীয় অগ্ন্যুৎপাত–”যে সন্ন্যাসে হৃদয় পাষাণ করতে উপদেশ দেয় আমি সে সন্ন্যাস গ্রাহ্য করি না।” এদেশের শতসহস্র বছরের ইতিহাসে মনুষ্যত্বের সারসত্যটুকু এমন অকুতোভয়ে আর কেউ ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।

কিন্তু সাধারণ মানুষ আমরা, যে কোনো কঠিন তত্ত্বকে গলাধঃকরণ করতে গেলে আমরা কিছু নজির খুঁজিনজির ছাড়া এই বিশ্বে সাধারণ মানুষের কাছে কিছুই গ্রহণীয় নয়। তাই বাধ্য হয়ে বিবেকানন্দও জনমতের আদালতে নজির উপস্থিত করেছেন অষ্টম শতকের শঙ্করাচার্যের–এই শঙ্করাচার্যও নিতান্ত তরুণবয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন, বেঁচেছিলেনও অত্যন্ত কম সময় (বিবেকানন্দ ৩৯, শঙ্কর ৩২), কিন্তু গর্ভধারিণী জননীর প্রতি দু’জনেরই প্রবল আনুগত্য।

জগদ্গুরু শঙ্কর মাকে ভালবাসতেন ভীষণ, তার জন্য তাকে যে কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল, তার বিবরণ যথাসময়ে এই লেখায় এসে পড়বে। সেই সঙ্গে শ্রীচৈতন্যও। এখন শুধু আমরা স্মরণ করি, সত্যসন্ধানী বিবেকানন্দ দুর্জয় সাহস নিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন, “যে মাকে সত্য সত্য পূজা না করতে পারে, সে কখনও বড় হতে পারে না।” মাতৃপূজার এই দেশে নিতান্ত সাধারণ সত্যের প্রকাশ্য স্বীকৃতি, কিন্তু এযুগের সংসারে তার সরল পুনর্ঘোষণা তেমন মেলেনি। মাতৃপ্রেমী, মাতৃপূজারী, পূতচরিত্র বৈরাগীকে তাই শতাব্দীর দূরত্বে দাঁড়িয়েও প্রণাম জানাতে হয়।

বিবেকানন্দর এই দুঃসাহসিক উক্তি থেকেই আমার এবারের অনুসন্ধানের শুরু-সন্ন্যাসী ও গর্ভধারিণী। আত্মশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করেও সন্ন্যাসী কেমনভাবে মাতৃপ্রেমকে অস্বীকার করতে রাজি হলেন না? মাতৃপ্রেমীদের ইতিহাসে এ বোধহয় দুর্গমতম তীর্থযাত্রা–সাধারণ মানুষের স্বপ্নেরও বাইরে। কিন্তু এ সংসারের বিবেকানন্দরা এখনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে সক্ষম হন এবং সেই জন্যেই তারা আমাদের হৃদয়-সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং হয়ে ওঠেন আমাদের পরম পূজনীয়।

.

সন্ন্যাসী হয়ে কেউ এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হন না। বিবেকানন্দ ২৪ বছর বয়সে এবং শঙ্করাচার্য ১৬ বছর বয়সে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন, তার আগে সংসারেই তারা পরম আদরে লালিত পালিত হয়েছেন, সুতরাং আবহমান কাল থেকে সংসারই সমাজকে সন্ন্যাসী উপহার দেয় বলাটা অত্যুক্তি হবেনা।

বিবেকানন্দ যখন বিলু বা বীরেশ্বর বা নরেন্দ্রনাথ তখনকার ছবিটা একটু চেনা না থাকলে পরবর্তী জীবনে মায়ের প্রতি, ভাইদের প্রতি, বোনদের প্রতি তার প্রবল টান এবং কর্তব্য করতে না পারার জন্য বিবেকদংশনকে ঠিক বুঝতে পারা কঠিন হতে পারে। এই বিবেকদংশন আমৃত্যু কতখানি তীব্র হয়ে উঠেছিল এবং মাতৃসেবায় আপাত ব্যর্থতাকে হৃদয়বান বিবেকানন্দর কেন পাপ মনে হয়েছে তাও আমরা ভোলামনে অনুসন্ধান করবো।

যে সংসারে বিলে অথবা নরেন্দ্রনাথের জন্ম তাকে সোনার সংসার। বলাটা অত্যুক্তি হবে না। বিলে নামটায় আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে আমরা প্রমাণ পেয়েছি, একবার বিবেকানন্দ-গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী দাসী বেলুড়মঠে এসে একতলা থেকে উঁচুগলায় বিশ্ববিজয়ী ছেলেকে ডাকলেন বিলু-উ-উ। মায়ের গলা শুনে ছেলে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন এবং নীচু গলায় মায়ের সঙ্গে কথাবার্তায় ডুবে গেলেন। এই সেই মা যিনি শৈশবে ছেলের দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে বলেছিলেন, “চেয়েছিলাম শিবকে, পেলাম এক ভূতকে!” এসব কথা সব দেশের সব মায়েরাই তাদের ছেলেকে বলে থাকেন।

বিবেকানন্দর বিদেশি ভক্তদের মনে তাদের প্রিয় স্বামীজির গর্ভধারিণী জননী সম্বন্ধে প্রবল আগ্রহ ছিল। ইংরিজিতে আমরা বিভিন্ন রচনায় তার ইঙ্গিত পেয়েছি, তাদেরই একজন জননী ভুবনেশ্বরীর মুখে শুনেছিলেন, ছোটবেলায় এই বম্বেটে শিশুটিকে সামলানোর জন্যে একজন নয় দু’জন পরিচারিকা হিমশিম খেতো!

মায়ের কাছে চিরদিন বিলু থাকলেও, বিলে অথবা বীরেশ্বর ঠিক কবে থেকে নরেন হলেন তা আমাদের জানা নেই। তবে বীরেশ্বর নামটা যে অনেকদিন প্রচলিত ছিল তা পরবর্তীকালে সিস্টার নিবেদিতার চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি। একজন পশ্চিমী ভক্তিমতাঁকে নিবেদিতা কিছুটা উত্তেজনার সঙ্গে ‘গোপন’ খবর জানাচ্ছেন, “হৃদয়বান বিবেকানন্দর আসল নাম ‘বীরেশ্বর’ব্যাপারটা কিন্তু খুব কম লোকেই জানে।”

কথা যখন উঠলোই তখন বলে রাখা ভাল, বিলু ভুবনেশ্বরীর জ্যেষ্ঠপুত্র ছিলেন না, যদিও পরবর্তীকালে তাকেই বড়ছেলের সমস্ত দায়িত্ব মাথায় পেতে নিতে হয়েছিল, সংসারত্যাগী হয়েও সেই বিরাট মানসিক দায়িত্বকে তিনি কোনোদিন স্বার্থপরের মতন দূরে সরিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতে পারেননি। এই পৃথিবীতে সন্ন্যাসী অনেকেই হয়েছেন, কিন্তু পরিবার ও বৈরাগ্যের উভয়-সঙ্কট এবং তার বিস্ময়কর সমাধানই বিবেকানন্দকে বিবেকানন্দ করে তুলেছে। বিলুর আরেকটি ডাক নাম ছিল। যে মানুষটি দীর্ঘদেহী এবং পৌনে ছ’ফুট লম্বা ছিলেন তাকে তাঁর ন’ঠাকুরদাদা গোপাল দত্ত ‘বেঁটে শালা’ বলে ডাকতেন। দত্তবাড়ির পূর্বপুরুষরা আয়তনে কেমন ছিলেন তার একটা আন্দাজ করা গেল!

সর্বসাকুল্যে বিবেকানন্দরা যে দশ ভাই-বোন সেকথা অনেকের খেয়াল থাকে না। আরেক মহামানব, জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্রনাথরাও পনেরো ভাই বোন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নটি পুত্র ও ছ’টি কন্যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর চতুর্দশ সন্তান। ভুবনেশ্বরীর প্রথম সন্তানটি পুত্র, অকালে মৃত্যু হওয়ায় তার সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। যদিও বহুকাল পরেও জননী এই সন্তানটির অভাবনীয় সৌন্দর্যের প্রশংসা করতেন–দেখতে ছিল পিতামহের মতন। দত্তবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন একজন অজ্ঞাতনামা লেখিকার মতে প্রথম সন্তানটি আটমাস বয়সে মারা যান। এবিষয়ে অবশ্য অন্য কোন প্রমাণ সংগ্রহ সম্ভব হয়নি।

ভুবনেশ্বরীর পরের সন্তানটি কন্যা, তারও শৈশবে মৃত্যু, নাম পর্যন্ত জানা যায় না। অজ্ঞাতনামা লেখিকার মতে, এই কন্যাটি আড়াই বছর বেঁচে ছিলেন। তৃতীয় সন্তান হারামণি মাত্র ২২ বছর বেঁচে ছিলেন, এঁর সম্বন্ধেও তেমন কিছু খবর পাওয়া যায় না। চতুর্থ সন্তান স্বর্ণময়ী দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন, এক সময় স্বামীজির ভিটেতেই বসবাস করতেন। তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলেছেন, স্বামীজির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর দিদি স্বর্ণময়ী বেলুড়মঠে দশটাকা পাঠিয়ে দিতেন। রামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ শিষ্যগণ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন এই চাঁদা দেওয়া হয়েছে। এই চাঁদা দেওয়া অবশ্য শুরু করেন বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী। হয় স্বামী ব্রহ্মানন্দ, না হয় স্বামী প্রেমানন্দ বাড়ি থেকে এই টাকা নিয়ে যেতেন। ভুবনেশ্বরীর পঞ্চম সন্তানটিও কন্যা–মৃত্যু ছ’বছর বয়সে। নরেন্দ্রনাথ তাঁর ষষ্ঠ সন্তান, বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯ বছর (১৮৬৩ ১৯০২)। সপ্তম সন্তান কিরণবালা (আনুমানিক ১৮/১৯ বছর। বেঁচেছিলেন), অষ্টম যোগীন্দ্ৰবালা (বেঁচেছিলেন আনুমানিক ২৫ বছর), নবম মহেন্দ্র ও দশম ভূপেন্দ্রনাথ। শেষ দু’জন যথাক্রমে ৮৮ বছর (১৮৬৮ ১৯৫৬) এবং ৮১ বছর (১৮৮০-১৯৬১) জীবিত ছিলেন। মহেন্দ্রনাথের জন্ম-তারিখ নিয়ে অন্য মতও আছে। কর্পোরেশন জন্ম-রেজিস্টার অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১ আগস্ট ১৮৬৯। রেজিস্টারির তারিখ ৭ আগস্ট।

ভুবনেশ্বরীর মেয়েদের পরিবারের কিছু কিছু সংবাদ বিক্ষিপ্তভাবে পাওয়া গেলেও, বিস্তারিত বিবরণ কোথাও নেই। বিবেকানন্দ ভিটার পুনরুদ্ধারের প্রাণান্তকর দায়িত্ব মঠ-মিশনের পক্ষ থেকে যিনি নিঃশব্দে গ্রহণ করেছেন সেই পার্থ মহারাজের (স্বামী বিশোকানন্দ) সূত্রে জানা যায়, যে গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের ভিটা অধিগ্রহণের সময় বেশ কয়েকজনকে পুনর্বাসিত করা হয়, তাদের দেওয়া হয় নতুন ফ্ল্যাট–এঁরা বিবেকানন্দের বোনের দিক থেকে বংশধর, কারণ ভুবনেশ্বরীর তিন পুত্রসন্তানের কেউই বিবাহ করেননি। বিশ্বস্ত সূত্রে আরও জানা যায়, যে বোন (যোগীন্দ্ৰবালা) বিবেকানন্দের পরিব্রাজককালে সিমলা পাহাড়ে শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করে নিজের জ্বালা জুড়িয়েছিলেন, তার দুটি নাবালিকা কন্যার দায়িত্বও একসময়ে নিঃসম্বল ভুবনেশ্বরীকে ঘাড়ে নিতে হয়। অন্য আর এক সূত্রে জানা যায়, ভুবনেশ্বরীর এই জামাতা আবার বিবাহ করলে, শোকতপ্তা মাতা ভুবনেশ্বরী নতুন বউকে এবং জামাইকে নিজের বাড়িতে এনে আদরযত্ন করেছিলেন। বাঙালি সংসারে এই ধরনের ঘটনা বিরল না হলেও, বড়ই বেদনাদায়ক। এই অভাগা দেশের অভাগিনী মায়েরাই এমন কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করেও নিজের কর্তব্য পালন করতে পারেন।

স্বামীজির বোনদের কবে কীভাবে বিয়ে হলো, পিতৃদেব বিশ্বনাথ বেঁচে থাকতে থাকতে কতটুকু দায়িত্বপালন করতে পেরেছিলেন, তাঁর আকস্মিক অকালমৃত্যুর পরে বোনদের বিবাহব্যবস্থায় দাদা নরেন্দ্রনাথের কোনো ভূমিকা ছিল কি না, এইসব ব্যাপারে বিবেকানন্দ-বিষয়ক বিপুল তথ্যসমুদ্রে তেমন কিছু খুঁটিনাটি অভিজ্ঞমহলের নজরে পড়েনি। আমরা শুধু জানি, তার বড় দুই দিদি ইংরেজি শিক্ষার আলোকলাভ করে বেথুনে পড়াশোনা করেছিলেন এবং ছোটদুই বোনওমিশনারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদুষীহয়েছিলেন। আমরা জানি, পিতৃদেবের মৃত্যুর সময়ে বিবেকানন্দর বয়স ছিল ২১ বছর, মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রর তখন ১৫ এবং ভূপেন্দ্রনাথ নিতান্তই নাবালক, বয়স তিন।

কিরণবালা ও যোগীন্দ্ৰবালার তেমন খোঁজখবর বিবেকানন্দর বিস্তারিত জীবনকাহিনীগুলিতে আজও নেই এবং পরিবার সম্বন্ধে সর্বপ্রকার সংবাদের তুলনাহীন রসার মহেন্দ্রনাথ তাঁর প্রায় নব্বইখানি বইয়ের কোথাও এই বিষয়ে তেমনভাবে মুখ খোলেননি। কিন্তু স্বামীজির নিজের লেখা চিঠিতে মাঝে-মধ্যে কিছু উল্লেখ আছে। ১৯০০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লস্ এঞ্জেলিস থেকে মিসেস সারা বুলকে বিবেকানন্দ লিখছেন: “আমার বোনের একখানি পত্রে জানলাম যে, তার পালিতা কন্যাটি মারা গেছে। ভারতের ভাগ্যে যেন একমাত্র দুঃখই আছে। তাই হোক! সুখদুঃখে আমি যেন বোধশূন্য হয়ে গেছি!”

পরিবারের সভ্য এবং সভ্যাদের সম্পর্কে একটু বিবরণ এই জন্যে দেওয়া প্রয়োজন হলো যে মা, বোন, ভাইদের সম্পর্কে স্বামীজির কেন উদ্বেগ এবং পরিবারের পুত্র হিসেবে দায়িত্বপালনে ব্যর্থতা সম্পর্কে তাঁর মনে অন্যায়বোধ কেন তা চোখের সামনে থাকা প্রয়োজন। দশ সন্তানের জননী ভুবনেশ্বরী অকালবৈধব্যে জর্জরিত হয়েও কী বিপুল দুঃখের বোঝা আমৃত্যু নিঃশব্দে বহন করেছিলেন তা জেনে রাখাও মন্দ নয়।

সেই সঙ্গে মহাবৈরাগ্য অবস্থায় স্বামীজির চিঠি, “আমি অতি অকৃতী সন্তান, মাতার কিছু করিতে পারিলাম না, কোথায় তাদের ভাসিয়ে দিয়ে চলিয়া আসিলাম।” করুণ স্বরে তিনি যেন মায়ের কাছে ক্ষমা চাইছেন।

অবশ্য সবটাই অন্যায়বোধ নয়, অন্য এক জায়গায় সংসারত্যাগ সম্বন্ধে স্বামীজি বলছেন, যখন সংসার ছাড়লাম তখন আমার একচোখে শোকা, মা, দিদিমা, ভাই বোনদের ছেড়ে চলে যেতে ভীষণ খারাপ লাগছিল, কিন্তু দ্বিতীয় চোখে আমার আদর্শের জন্যে আনন্দাশ্রু।

.

সিমলার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের দত্তবাড়ি যাঁরা নিজের চোখে দেখেছেন তারা অবশ্যই জানেন দরিয়াটনার দত্তরা কলকাতা শহরে আদি যুগ থেকে বেশ জাঁকিয়ে বসেছিলেন। দক্ষিণরাঢ়ি কাশ্যপগোত্রীয় দত্তদের বিপুল বৈভবের পিছনে ছিল বংশানুক্রমে আইনব্যবসায় সাফল্য। কৌতূহলীরা ভূপেন্দ্রনাথ দত্তর পারিবারিক বর্ণনা পড়ে দেখতে পারেন এবং কিছুটা আন্দাজ করতে পারেন কেন বিবেকানন্দ আইন পড়েছিলেন, কেন এটর্নি অফিসে শিক্ষানবিশী করেছিলেন, অথচ মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বিলেতে আইন পড়তে হাজির হয়েছে শুনে কেন তিনি বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন।

উকিল ও এটর্নির গুষ্টি বলতে যা বোঝায় তা এই সিমলের দত্তরা। এই যৌথ পরিবারের সমৃদ্ধি অবশ্যই ওকালতি থেকে, আবার পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমায় সর্বস্ব হারানোর দুর্ভাগ্যও জুটেছে এঁদের। জ্ঞাতিদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমায় কলকাতার ধনবানরা একসময় কীভাবে নিঃস্ব হতেন তার অনেক ইতিহাস হাইকোর্টের এটর্নিপাড়ার কাগজপত্তরের মধ্যে চাপা পড়ে আছে। এক্ষেত্রে আমাদের দুঃখ এই কারণে যে অনাবশ্যক শরিকী লড়াই সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর স্বল্পপরিসর জীবনকে সবদিক থেকে বিষময় করে তুলেছিল। এই দুর্বিষহ যন্ত্রণা না থাকলে হয়তো তিনি আরও কিছুদিন বাঁচতেন। এ-বিষয়ে যথাসময়ে একটা স্পষ্ট অথচ অস্বস্তিকর ছবি এই লেখায় হাজির করবার প্রয়োজন হবে।

দত্তদের আদি নিবাস বর্ধমান জেলার কালনা মহকুমার দত্ত-দরিয়াটনা বা দেরেটনা গ্রাম। দক্ষিণরাঢ়ী কাশ্যপ গোত্রীয় রামনিধি দত্ত তার পুত্র রামজীবন এবং পৌত্র রামসুন্দরকে নিয়ে গড়-গোবিন্দপুরে (কলকাতা) চলে আসেন। দেওয়ান রামসুন্দরের পাঁচ ছেলে, জ্যেষ্ঠ রামমোহন। ইনিই নরেন্দ্রনাথের প্রপিতামহ। দেখা যাচ্ছে বিলুর প্রপিতামহ রামমোহন দত্ত সুপ্রীম কোর্টের ফার্সী আইনজীবী ছিলেন। অভিজাত জীবনযাপন করেও তিনি প্রভূত অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন করেছিলেন সালকিয়ায় তার দুটো বাগানবাড়ি এবং খিদিরপুরে প্রচুর জমিজমা ছিল। অতি অল্পবয়সে (৩৬) কলেরায় রামমোহনের মৃত্যু হয়। সে সময় গ্রীষ্মকালে কলেরা হতো এবং উত্তর কলকাতায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় প্রত্যেক পরিবার থেকে প্রত্যেক বছর এক-আধজন মারা যেতেন।

রামমোহন মৃত্যুর সময়ে বাড়িতে এক বিধবা কন্যা ও দুটি শিশুপুত্রসন্তান রেখে যান। রামমোহন দত্তর বড় ছেলে দুর্গাপ্রসাদ, বিবেকানন্দর পিতামহ। তিনিও এটর্নি অফিসে যুক্ত ছিলেন এবং কোনো এক দুর্ঘটনায় তার জীবনের গতি পরিবর্তনের কথা আমরা ভূপেন্দ্রনাথের তথ্যপূর্ণ রচনা থেকে সংগ্রহ করেছি।

শরিকী টেনশন তখনও ছিল, কারণ যৌথ পরিবারে তাঁর স্ত্রী অপমানিত হয়েছেন এই দুঃখে দুর্গাপ্রসাদ একবার বসতবাটি ত্যাগ করেছিলেন। পরে তিনি যে সন্ন্যাসী হয়ে যান তা অনেকেরই জানা। সন্ন্যাসী হয়ে যাবার পরও দুর্গাপ্রসাদ মাঝে মাঝে টার্টু ঘোড়ায় চড়ে উত্তর ভারত থেকে কলকাতায় আসতেন এবং তাঁর এক ভিক্ষাপুত্রের সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে বাস করতেন। একবার তাকে আটকাবার জন্যে দরজায় তালা লাগানো হয়, তিনদিন পরে তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে দেখা যায়, তখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গৃহত্যাগী দুর্গাপ্রসাদ আর কখনও ফেরেননি।

নরেন্দ্রপিতাবিশ্বনাথদত্ততারকাকারকরুণায় প্রায় অনাথরূপেপ্রতিপালিত হন। স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কয়েকবার ব্যবসায় নামতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তেমন সফলনা হতে পেরে একসময় (১১ এপ্রিল ১৮৫৯)এটর্নি চার্লস এফ পিটারের অধীনে আর্টিকেল ক্লার্ক হন এবং পরে (২৯ জানুয়ারি ১৮৬১) এটর্নি হেনরি জর্জ টেম্পলের অফিসে আর্টিকেল ক্লার্ক হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানে ১০ অক্টোবর ১৮৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১৪ মার্চ ১৮৬৬ প্রধান বিচারপতি স্যার বার্নের্স পিকক-এর এজলাসে ‘এটর্নি’ ও ‘প্রক্টর’ রূপে নাম লেখাবার জন্য বিশ্বনাথ দরখাস্ত করেন। আবেদনের সঙ্গে বিশ্বনাথ দত্ত দুখানি সার্টিফিকেট দাখিল করেন–দুটি সার্টিফিকেটের তারিখ ৭ জানুয়ারি ১৮৬৫, দাতাদের নাম শ্রী গ্রীস’ চন্দ্র বনার্জি ও শ্রী ‘দিগাম্বের’ মিটার। একই দিনে এই আবেদনে সম্মতি দেন মিস্টার জাস্টিস ওয়ালটার মরগ্যান। বিচারপতি মরগ্যান পরে উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রধান বিচারপতি হন। আইনপাড়ায় বিশ্বনাথের কোম্পানির নাম ছিল ধর অ্যান্ড দত্ত। তার পার্টনার আশুতোষ ধর।

ভূপেন দত্ত জানিয়েছেন, তাঁর সাহিত্যপ্রেমী পিতৃদেব একখানি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং অর্থাভাব থাকায় বইটি পিতামহর খুড়তুতো ভাই, ডাকবিভাগের পদস্থ কর্মচারী গোপালচন্দ্র দত্তর নামে প্রকাশিত হয়। অপরের নামে নিজের রচিত গ্রন্থ প্রকাশের একই দুর্ভাগ্য পুত্র বিবেকানন্দর ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। পূর্বাশ্রমে অপরের নামে এমনকি প্রকাশকের নামে তিনি বছর বেঁচেছিলেন, একমাত্র মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহ, যৌথপরিবার থেকে বিতাড়ন, অনেকগুলি ছেলেমেয়ে নিয়ে অকাল-বৈধব্য, অভাবনীয় ভাগ্যবিপর্যয়, এমনকি প্রাণাধিক নাতি বিলুর অকালমৃত্যুর অসহায় সাক্ষী এই রঘুমণি দেবী। বিডন স্ট্রিটের ঘোষপরিবারের মেয়ে, পিতা গোপালচন্দ্র ঘোষ, জন্ম ১৮২৫। রঘুমণি ছিলেন পরম বৈষ্ণব।

সুবিশাল যৌথপরিবারে বিবাহিতা হয়েও বিপদের সময় সহায়সম্বলহীন মেয়ের পাশে কেউ নেই, স্বামী প্রয়াত, উপার্জনের পথ নেই, জ্যেষ্ঠপুত্ৰ সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী, মধ্যমটি নিজের খেয়ালে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ায় এবং ছোটটি সাবালক হয়েই স্বদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে জড়িত হয়ে প্রথমে জেলে গিয়ে ঘানি টানা এবং মুক্তি পেয়ে আবার গ্রেপ্তার হবার আশঙ্কায় চুপিচুপি বেনামে দেশছেড়ে পালিয়ে দীর্ঘকাল স্বেচ্ছানির্বাসিত। এই কঠিনসময়ে আদরের ভুবনেশ্বরীর পাশে যিনি সবসময় ছিলেন এবং প্রয়োজনে কন্যাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। বিবেকানন্দ-মাতামহী রঘুমণি। পরম বৈষ্ণব এই মহিলা তার কন্যার দেহাবসান পর্যন্ত বেঁচেছিলেন এবং ১৯১১ সালে ভুবনেশ্বরীকে মরণসাগরের ওপারে পার করে দিয়ে, ঠিক একদিনের ব্যবধানে দেহরক্ষা করেন। মেনিনজাইটিস রোগে ভুবনেশ্বরীর মৃত্যু ২৫ জুলাই ১৯১১, আর রঘুমণির শেষ বিদায় ২৭ জুলাই। তার মৃত্যুকালীন বাসস্থান নিমতলা গঙ্গাযাত্রী নিবাস। আপনজন বলতে মহেন্দ্রনাথ, ঘাটের রেজিস্টারে নাতির সই আছে। ভূপেন্দ্রনাথের বইতে দিনগুলি সম্পর্কে একটু পার্থক্য আছে। আমরা কর্পোরেশন রেকর্ডের উল্লেখ করলাম।

মামা নেই, কিন্তু বিলুর মামাবাড়ি আছে। মাতৃ-আলয়েই অসহায়া ভুবনেশ্বরীকে সপরিবারে বারবার আশ্রয় নিতে হয়েছে। এই মামার বাড়িতেই ছিল ভুবনেশ্বরীর প্রাণবন্ত জ্যেষ্ঠপুত্রের নিত্য আনাগোনা। অনেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার সাক্ষী রামতনু বসু লেনের এই মাতুলালয়। প্রথম পর্বে এই বাড়ির আরেকজন বসবাসকারিণী বিবেকানন্দর ঝিমা (প্রমাতামহী) রাইমণি দেবী, স্বামী মারা যাওয়ার পরে তিনি নিজ কন্যা রঘুমণির কাছেই বাস করতেন।

পিতৃদেব বিশ্বনাথের জীবনযাত্রার ওপর সামান্য আলোকপাত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে বিফল হয়ে তিনি আইনব্যবসায়ে মনোনিবেশ করেন এবং সেই সঙ্গে নীলামে সম্পত্তি কিনে সময়মতো তা বেচে দিয়ে তিনি অর্থবান হতেন। এই কেনাবেচায় তিনি স্ত্রী ভুবনেশ্বরীর নাম ব্যবহার করতেন।

বিশ্বনাথের কাকা কালীপ্রসাদের দুই ছেলে–একজনের নাম কেদারনাথ এবং অপরজন তারকনাথ। তারকনাথ কলকাতা হাইকোর্টে নামী উকিল হয়েছিলেন, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারী সেরেস্তার অনেক মামলা-মোকদ্দমা তিনি করতেন এবং সেই সুবাদে রবীন্দ্রনাথের পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বিশেষ পরিচয় ছিল। তারকনাথের ছয় কন্যা এবং তাদেরই কারও বিয়েতে ঠাকুরপরিবারের বিশিষ্ট সদস্যরা (রবীন্দ্রনাথ সহ) গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নেমন্তন্ন খেতে এসেছিলেন। বিশিষ্ট অতিথিদের বসাবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছিল। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের তখনও নাম হয়নি।

তারকনাথের বিধবা, অর্থাৎ ভুবনেশ্বরী-পুত্রদের খুড়িমাকে কেন্দ্র করেই বিরাট মামলার সূত্রপাত। মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে খুড়িমা জ্ঞানদাসুন্দরী সর্বস্বহারা হয়ে শেষজীবনে বিবেকানন্দর সাহায্যপ্রার্থিনী হন। এমনই ভবিতব্যের রসিকতা, যাঁর খামখেয়ালিপনায় ভুবনেশ্বরীর সোনার সংসার দুঃস্থ হলো, তিনিই আবার আশ্রয় চাইলেন ভুবনেশ্বরীর সংসারত্যাগী সন্তানের কাছে। স্বামীজির দেহাবসানের পর খুড়িমা যে বেলুড়ে নরেনকে দেখতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন তার বিবরণও আমাদের হস্তগত হয়েছে।

শরিকদের সঙ্গে মামলার সময় বিবেকানন্দর পিতার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে নানা ইঙ্গিত ওঠে। কারও অভিযোগ তিনি বিশাল দেনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং পাওনাদারদের এড়াবার জন্যে কিছুদিনের জন্য কলকাতা ছেড়ে রায়পুরে প্র্যাকটিস করেন। জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথের রায়পুরের পথে মাংস রান্না করা এবং বৈষ্ণবী দিদিমার প্রভাবে নিরামিষাশী মধ্যমভ্রাতাকে জোর করে মাংস খাওয়ানোর চেষ্টার চমৎকার একটা দৃশ্য মহেন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় আমাদের উপহার দিয়ে গিয়েছেন।

রায়পুর থেকে উত্তর ভারতের কয়েকটি জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিশ্বনাথের ওকালতির যে ছবি আমরা পাই তাতে তিনি যে ব্রীফলেস উকিল ছিলেন তা মোটেই মনে হয় না। নরেন্দ্রনাথের বয়স যখন চোদ্দ (১৮৭৭) তখন বিশ্বনাথ রায়পুরে ছিলেন এবং কয়েকমাস পরে নিজের পরিবারের সবাইকে তিনি রায়পুরে নিয়ে যান। মেট্রোপলিটান ইস্কুলে পড়াশোনা ছেড়ে দেড় বছর নরেন্দ্রনাথ রায়পুরে ছিলেন এবং ১৮৭৯ সালে কলকাতায় এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেন। পরের বছর ১৮৮০ সালের ২৭ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথ দশ টাকা ভর্তি ফি দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই বেতনের রসিদেরছবি ভূপেন্দ্রনাথের বইতে মুদ্রিত হয়েছে।

প্রচুর উপার্জনের সঙ্গে প্রচুর বেহিসেবী ব্যয়ের ব্যাপারে অনেক উকিল এবং ডাক্তার এদেশে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গিয়েছে। বিশ্বনাথ দত্ত বেশি রোজগার না কম রোজগার করেছেন তা নিয়ে মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকতো না যদি না তার মৃত্যুর পরে শরিকী মামলায় তাঁর খুড়তুতো ভাইয়ের বউ আদালতে অভিযোগ করতেন যে ভুবনেশ্বরীর ভূসম্পত্তি সবই তার স্বামী তারকনাথের উপার্জিত অর্থে বেনামে যৌথপরিবারের ভ্রাতৃবধূ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা হয়েছিল। এসব সম্পত্তি কেনার কোনো আর্থিক সঙ্গতিইনাকি ছিল না ভুবনেশ্বরীর স্বামীর। এমনকি বিশ্বনাথের অনুপস্থিতিতে কলকাতায় স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের ভরণপোষণ হয়েছে খুডোর পয়সায়।

শরিকী মামলায় হাজার রকম অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগ ওঠে, সে নিয়ে কেউ তেমন উদ্বিগ্নও হন না, কিন্তু এক্ষেত্রে এইসব অভিযোগের আইনী মোকাবিলার জন্যে বৈরাগী বিবেকানন্দকে যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

কিন্তু বিশ্বনাথ পরিবার যে লক্ষ্মীর কৃপাধন্য ছিলেন তার অনেক নমুনা আমরা ভ্রাতৃস্মৃতি থেকে পাচ্ছি। যেমন ধরুন খাওয়া-দাওয়ার কথা। শুনুন বড় ও মেজ দুইভাইয়ের জলখাবারের কথা। তখন কলকাতার পাঁঠার দোকানে পাঁঠার মুড়ি বিক্রি হতো না। দুইভাই নরেন্দ্র ও মহেন্দ্র পাঠাওয়ালার সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। দুই চার আনায় দশ বারোটা পাঁঠার মাথা যোগাড় হতো। দশ বারোটা মুড়ি ও সের দুই আড়াই কড়াইশুটি–একসঙ্গে ফুটিয়ে তরকারি। মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিকেলে আমি ও স্বামীজি স্কুল থেকে এসে ওই তরকারি ও খান-ষোল করে রুটি জলখাবার খেতাম।”

আর একদিনের কথা। “বড়দা একবার নিলামে ফিরিঙ্গিপাড়া থেকে পাঁচ আনা দিয়ে কেটলি কিনে আনলো। ওপরটা কালিঝুলি মাখা–ওমা, ভুসোগুলো উঁচতে চাচতে দেখি, ভিতরটা খাঁটি রুপো!”

এইসব ঘটনা সংসারে অর্থকষ্টের ইঙ্গিত দেয় না, বরং প্রাচুর্যের কথাই বলে। ১৮৮০-৮৪ সাল সস্তাগণ্ডার সময়, তখন শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্তদের অফিসে মাস মাইনে ছিল পনেরো টাকার মতন। সেই সময় ভুবনেশ্বরী দেবীর পারিবারিক সংসার খরচ ছিল মাসে হাজার টাকা!

.

মায়ের কথায় আবার আসা যাক। বিবেকানন্দ তাঁর বন্ধুদের বলতেন, “আমি কি অমনি হয়েছি, আমার জন্যে আমার মা কত তপস্যা করেছেন।” অন্যত্র তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, “আমার জ্ঞানের বিকাশের জন্য আমি মায়ের কাছে ঋণী।”

ভুবনেশ্বরীর গায়ের রঙ ছিল ফর্সা, কণ্ঠ সুমধুর, প্রতি পদক্ষেপে আভিজাত্য, বুদ্ধিমতী, কার্যকুশলা, মিতভাষিণী, গম্ভীর প্রকৃতি, আলাপে মিষ্টস্বভাব, কিন্তু তেজস্বিনী। ছেলেকে তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন, “আজীবন পবিত্র থাকিও, নিজের মর্যাদা রক্ষা করিও, কখনও অপরের মর্যাদা লঙ্ঘন করিও না। খুব শান্ত হইবে, কিন্তু আবশ্যক হইলে হৃদয় দৃঢ় করিবে।”

এমন মায়ের ছেলে বলেই, জোরগলায় বিবেকানন্দ বলতে পেরেছেন, “যে মাকে সত্য সত্য পূজা করতে না পারে, সে কখনও বড় হতে পারে না।”

বড় কঠিন কথা, কিন্তু আমাদের এই দেশে নিতান্ত ফেলে দেবার মতন আদর্শ নয়। একজন বিদেশিনী অনুরাগিনী একবার রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীদের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখেছিলেন, এঁদের প্রায় সবার ওপর গর্ভধারিণী জননীর প্রভাব খুব বেশি, সে তুলনায় বাবার প্রভাব উল্লেখযোগ্য নয়।

নরেনের সমীক্ষা ভুবনেশ্বরী দেবী নিজেই ভালভাবে করেছে। তিনি বলতেন, “ছেলেবেলা থেকে নরেনের একটা মস্ত দোষ ছিল, কোন কারণে রাগ হলে আর জ্ঞান থাকতো না, বাড়ির আসবাবপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করতো।”

তার দুই দিদি (হারামণি ও স্বর্ণময়ী) ভাইয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হতেন। কখনও তাড়া করে তাকে ধরতে গেলে বিলু দৌড়ে গিয়ে আঁস্তাকুড়ে আশ্রয় নিতেন এবং সেখানে মনের সাধে ভেঙচাতে ভেঙচাতে মৃদুহাস্য সহকারে বলতেন, “ধর না, ধরনা।” শিষ্যদের কাছে পরবর্তীসময়ে স্বামীজির সপ্রসন্ন স্বীকারোক্তি, “ছেলেবেলায় আমি বড় ডানপিটে ছিলাম, তা না হলে কি আর একটা কানাকড়ি সঙ্গে না নিয়ে দুনিয়াটা ঘুরে আসতে পারতুম রে।”

মায়ের চরিত্রের আর একদিক বিবেকানন্দকে মুগ্ধ করেছিল। ভুবনেশ্বরীর। সংযমশক্তি। “মা একবার সুদীর্ঘ চোদ্দ দিন উপবাসে কাটিয়েছিলেন।” এই শক্তির প্রতিফলন আমরা বিবেকানন্দর জীবনের শেষপর্যন্ত দেখেছি, তিরোধানের কিছুদিন আগে কবিরাজের উপদেশ অনুযায়ী একুশ দিন তিনি জল না খেয়েই সবার বিস্ময়ের উদ্রেক করেছিলেন।

সুখী সোনার সংসারের শত শত কাহিনী বিভিন্ন স্মৃতিকথায় ছড়িয়ে আছে। এই আনন্দময় বিবেকানন্দকে আমার ভীষণ ভাল লাগে। যেমন ধরুন, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয়ভক্ত গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র দত্তের কথা। এই আত্মীয়ের বিয়েতে নরেন মহানন্দে নিতবর হয়েছিলেন।

ছোটবেলায় দত্ত পরিবারের স্বর্ণযুগ প্রসঙ্গে প্রবীণ মহেন্দ্রনাথ একবার একটা দামী কথা বলেছিলেন, “মানুষের শেষজীবনে সমস্ত ছেলেবেলাকার ভাব, বংশের ধারা ফিরে আসে। এই দ্যাখ, ছেলেবেলায় যেসব খেতুম, যেসব শখ ছিল, এখন সেইসব মনে হচ্ছে–সেই কড়াইয়ের ডালের বড়া, ধোঁকা, এইসব। এইরকম হয়। স্বামীজি শেষটায় তখন মঠে আছেন। একদিন বললেন–”আমায় সব যোগাড় করে দে। আমি ফুলুরি করব। তেল, কড়া, বেসন সব দেওয়া হল, মায় খুরো দেওয়া সিঁড়ি পর্যন্ত স্বামীজি ঠিক ফুলুরিওয়ালার মতন করে বসলেন, হাঁটু থেকে কাপড় গুটোলেন, ফুলুরি ভাজতে ভাজতে ছেলে মানুষের মতো খদ্দের ডাকতে লাগলেন, আয় খদ্দের আয়।”

.

বিশ্বনাথ দত্তের শারীরিক অসুস্থতা এবং আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভুবনেশ্বরী ও তার জ্যেষ্ঠপুত্রের অন্তহীন অগ্নিপরীক্ষার শুরু। তবে তার কিছু আগেই শরিকী সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। এই বিরোধ কী ধরনের তার বিস্তারিত বিবরণ আমাদের হাতে নেই, কিন্তু আমরা জানি যৌথপরিবারের বিষাক্ত পরিবেশে তিতিবিরক্ত ভুবনেশ্বরী ও পুত্রকন্যাদের নিয়ে বিশ্বনাথ তাঁর মৃত্যুর আগের বছরে ছাতুবাবু বাজারের কাছে ৭ ভৈরব বিশ্বাস লেনে একটা বাড়িভাড়া করে উঠে যান। কিন্তু পরে তিনি সপরিবারে আবার গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে আসেন। বিশ্বনাথ পরিবারের এই ফিরে আসায় উকিল খুড়ো তারকনাথ তেমন খুশি হননি বলে শোনা যায়।

বাবামায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে ভুবনেশ্বরী কিছু পৈত্রিক সম্পত্তির অধিকারিণী হয়েছিলেন। পিতার বসতবাটি এবং চারকাঠা সম্পত্তি তার ছেলেরা ভোগদখলের অধিকারী। বিশ্বনাথ নিজেও তাঁর মাতামহের কাছ থেকে একটা বাগানবাড়ি উপহার পেয়েছিলেন।

এবার শুনুন বিবেকানন্দর ছোটভাইয়ের মুখে : “অকস্মাৎ আবির্ভূত হলেন বিশ্বনাথের মেজমামা। তিনি এসে ভাগ্নের কানে কি পরামর্শ দিলেন। বিশ্বনাথ সে সম্পত্তি মামার নামে লিখে দিলেন। আমার মায়ের কাছে এ কাহিনী শুনেছি। তিনি একার্যের সমর্থন করতেন। তিনি বলতেন, ঐ সম্পত্তি লিখে না দিলে মাতামহের কাছ থেকে পাওয়া সম্পত্তি কাকাই আত্মসাৎ করে নিতেন। সে সময়ে পরিবারের সমস্ত অংশীদাররা মধু রায় লেনের বাড়ি বিক্রয়ের চেষ্টা করছিলেন। বিশ্বনাথ তাঁর নিজের অংশ কাকার নামে লিখে দেন।”

বিশ্বনাথের মৃত্যু তারিখ কলকাতা কর্পোরেশনের খাতায় লেখা ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, কিন্তু হাইকোর্টে ভুবনেশ্বরীর আবেদনপত্র অনুযায়ী ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪, তবে তাঁর মৃত্যুকালীন বাসস্থান যে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিট তার প্রমাণ কর্পোরেশনের খাতায় রয়েছে। রাত্রে তার বুকে ব্যথা ও হার্ট অ্যাটাক হয়, যদিও ডেথ রেজিস্টারে কেবল ডায়াবিটিসের উল্লেখ আছে। শ্মশানে সংবাদদাতা হিসেবে ইংরিজিতে পুরো স্বাক্ষর করেছেন পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত। আকস্মিক মৃত্যুকালে নরেন্দ্রনাথ এক বন্ধুর বাড়িতে রাত্রিযাপন করতে গিয়েছিলেন, গভীর রাতে তিনি খবর পান এবং বোধহয় সোজা শ্মশানে চলে আসেন। ভূপেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “পরদিন সকালবেলায় তাঁর বড় ছেলের জন্যে কনে দেখতে যাবার কথা ছিল।”

নরেন্দ্রনাথের বিবাহ প্রস্তাব সম্পর্কে বেশ কিছু বিবরণ ভূপেন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায়। পিতার মৃত্যুর পরেও পিতৃবন্ধু কলকাতার হাইকোর্টের এক এটর্নি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যদি তার নাতনীর সঙ্গে বিয়ে হয় তাহলে তিনি পারিবারিক মামলার সব ব্যয়ভার বহন করবেন।

পিতা-পুত্রের মৃত্যুর আকস্মিকতার মধ্যেও যথেষ্ট মিল আছে। সঙ্কট আসে রাত ন’টা নাগাদ। সন্ন্যাসী পুত্রের মৃত্যুসংবাদ বেলুড় থেকে এক সকালে কলকাতায় এল। মা জানতে চাইলেন হঠাৎকী হলো? ভূপেন্দ্রনাথ বললেন, “বাবার যা হয়েছিল।” মা ও দিদিমা শোকে বিহ্বল হয়ে পড়লেন।

ভুবনেশ্বরীর জন্ম ১৮৪১ সালে, স্বামীর যখন ১৬ বছর বয়স তখন বিয়ে, পরের পর দশটি সন্তানকে গর্ভে ধারণ। একের পর এক সন্তানশোক পেয়েছেন। তেতাল্লিশ বছর বয়সে কপর্দকশূন্য অবস্থায় নাবালক ছেলেমেয়ে নিয়ে বৈধব্য, প্রায় একই সময় প্রাণান্তকর মামলায় ভিটেমাটি ছাড়া হওয়ার অবস্থা, যে ছেলে রোজগেরে হয়ে সংসারের হাল ধরতে পারতো তার সন্ন্যাস গ্রহণ, কন্যার আত্মহনন এবং একষট্টি বছর বয়সে সন্ন্যাসীপুত্রের মৃতদেহের সামনে বসে থাকা। সংসারে একজন মায়ের জন্য আর কত যন্ত্রণাই বা থাকতে পারে?

সময়সীমার অনেক আগেই মৃত্যু উপস্থিত হয়ে বিবেকবান সন্ন্যাসীর সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছিল কেমনভাবে তা কারও অজানা নয়। কিন্তু জীবনযাত্রার মধ্যপথে কণ্টকাকীর্ণ পথ ধরে নগ্নপদে বিচরণ করতে গিয়ে তিনি কেমনভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন এবং রক্তমাখা চরণতলে পথের কাটাকে তিনি কেমন নির্ভীকভাবে দলনের চেষ্টা করেছিলেন তার সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা থাকলে, এদেশের সংখ্যাহীন হতদরিদ্র এবং ভাগ্যহত মানুষ জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার ভরসা খুঁজে পাবেন। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, জীবন কী তার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে তার অনুগত শিষ্য এবং দুঃখ দিনের পরম বন্ধু খেতড়ির রাজা অজিত সিংকে স্বামীজি বলেছিলেন, সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ এবং আত্মবিকাশের চেষ্টার নামই জীবন।

*

সুখের সংসারে আগুন লেগে রাতারাতি বাঙালি পরিবার কীভাবে বিপর্যস্ত হয় তার ছবি আঁকার আগে সুখী গৃহকোণের আরও দু’একটা খবর সংগ্রহ করা যাক।

দাদা নরেন যে কমবয়স থেকে নস্যি নিতেন এবং মশারিতে তার গন্ধ পাওয়া যেতো একথা মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সবিনয়ে আমাদের জানিয়েছেন। পায়রা ওড়াবার পারিবারিক শখ ছিল, আঙুলের কায়দায় দেওয়ালে ছায়াছবি দেখিয়ে নরেন্দ্রনাথ ভাইদের তাক লাগাতেন, খেলতেন একধরনের ক্রিকেট যার তদানীন্তন বাংলা নাম ব্যাটম্বল। এক মাস্টারমশাই তার মেজভাইয়ের মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন বলে স্কুল সুপার ব্রজেন্দ্রনাথ দে-কেনরেন্দ্রনাথ এমন চিঠি লিখেছিলেন যে মাস্টারমশায়ের যোগ্য শাস্তি হয়েছিল।

গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী একবার স্বামী অখণ্ডানন্দকে বলেছিলেন, বালককালে এবং বড় হয়েও আমার বড় ছেলে কখনও বেলা অবধি ঘুমোয়নি। যত দেরিতেই শোওয়া হোক, বিলু উঠতো খুব ভোরে।

সেকালে প্রতিষ্ঠিত পরিবারে নাপিতদের গৃহ আগমনে ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন হতো। বিবেকানন্দকে কিন্তু বেলুড়ে আমরা ঝটপট ক্ষুর চালাতে দেখেছি। আয়না সামনে না রেখেই এই কাজ তিনি নিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারতেন এবং রসিকতা করে বলতেন আমেরিকায় তার দুর্ভোগের কথা। এক সেলুনে তাঁর দাড়ি কামানো হলো না, কারণ একজন কালা আদমিকে কামালে সায়েবরা আর এই দোকানের দিকে পা বাড়াবেন না।

সোনার সংসার পর্বের আর একটি টিপিক্যাল বাংলা দৃশ্য: দুটো তক্তপোষ জুড়ে ঢালা বিছানা, সেখানে শুয়ে আছেন প্রথমে বিলু, পরে মহেন্দ্র, ছোটবোন, দিদিমা ও মা। এই সময়ে পিতৃদেব বিশ্বনাথ বিদেশে এবং ছোটভাইয়ের জন্ম হয়নি।

মাতৃকুল বৈষ্ণব আর পিতৃকুল শাক্ত, তাই দুটো ভাবই বিশ্বনাথ পরিবারে প্রবাহিত হত। দিদিমার মা রাইমণি যখন বেঁচেছিলেন তখন শেষরাতে ঘুম ভাঙিয়ে তিনি কৃষ্ণকথা শোনাতেন। এঁদের পাল্লায় পড়ে, তুলসীগাছে জল না দিয়ে মহেন্দ্রনাথ কিছু খেতেন না। মুগের ডাল, পুঁইশাক, পেঁয়াজ হাঁড়িতে ছোঁয়ানো যেতো না। গোবর পর্যন্ত খেতে হতো। ভুবনেশ্বরীর পরিবারে এসময় বিদেশি ফুলকপিও অচল ছিল। এহেন ভাই, দাদা ও মা সেবার বাবার সঙ্গে রায়পুরে যাচ্ছে। মহেন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন, “ঘোড়াতালাতে মাংস রান্না হল। আমি খাব না। দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল খা। তারপর আর কি! বাঘ রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”– মায়ের দেওয়া শিক্ষাতেই বিবেকানন্দ চরিত্রের বুনিয়াদ গড়ে উঠেছিল। একবার ভুবনেশ্বরী তার বড় ছেলেকে বলেছিলেন, “ফল যা হোক না কেন, সর্বদা যা সত্য বলে মনে করবে তাই করে যাবে। অনেক সময় হয়তো। এর জন্য অন্যায় অপ্রীতিকর ফল সহ্য করতে হবে, তবু সত্য কখনো ছাড়বে না।” জননী নিজেই দুঃসাহসের পথে নিজের ছেলেকে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন বলে আমরা যথাসময়ে বীরসন্ন্যাসীকে পেয়েছিলাম, সত্যের ব্যাপারে দর-কষাকষি করেননি বলেই যুগপুরুষের মর্যাদা লাভ করতে পেরেছিলেন ঘরছাড়া বিবেকানন্দ।

বিদেশে এক বক্তৃতায় বিবেকানন্দ বলেন, “জননীর নিঃস্বার্থপ্রেম ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি জীবনে যা কিছু সৎকার্য করিয়াছেন, সমস্তই সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে।” আর একবার মায়ের অদ্ভুত আত্মসংযমের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আর কোন রমণীকে তিনি কখনও তার মায়ের মতন দীর্ঘকাল উপবাস করতে দেখেননি। তিনি নাকি একবার উপর্যুপরি চোদ্দ দিন উপবাস করেছিলেন।

সুখী সংসারের সভ্য হিসেবেই বিলু বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটে পরীক্ষা দিয়েছিল–এনট্রান্স, এফ এ এবং বি এ। পরীক্ষায় ফলাফল কিন্তু তেমন চিত্তাকর্ষক হয়নি। ইংরিজি ভাষায় যিনি আমেরিকা এবং ইংলন্ড জয় করবেন, তার ইংরিজিতে নম্বর এন্ট্রান্সে ৪৭, এফ এ তে ৪৬ এবং বি এতে ৫৬। এফ এ এবং বি এ তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ। অনেক চেষ্টায় বিবেকানন্দর মার্কশিট যাঁরা উদ্ধার করেছেন তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে কৌতূহলীদের জন্য সোনার সংসারের সোনার ছেলের নম্বরগুলো লিপিবদ্ধ করা হল :

এনট্রান্স

ইংরিজি – ৪৭

দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৭৬

ইতিহাস – ৪৫

অঙ্ক – ৩৮

মোট – ২০৬

.

এফ এ

ইংরিজি – ৪৬

দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৩৬

ইতিহাস – ৫৬

অঙ্ক – ৪০

লজিক (৫০ নম্বর) – ১৭

সাইকোলজি (৫০ নম্বর) – ৩৪

মোট – ২২৯

.

বি এ

ইংরিজি – ৫৬

দ্বিতীয় ল্যাংগোয়েজ – ৪৩

অঙ্ক – ৬১

ইতিহাস – ৫৬

ফিলসফি – ৪৫

মোট – ২৬১

একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক এবং তুলনাহীন বাংলা ও ইংরিজির লেখকের নম্বরের হাল দেখে আশাকরি আজকের কম নম্বর-পাওয়া ছাত্ররা কিছুটা ভরসা পাবেন। যা মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভাল বা খারাপ নম্বরের সঙ্গে জীবনের পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের প্রায়ই কোনো সঙ্গতি থাকে না। আরও যা ভাববার বিষয়, আজও কেন আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি মানুষের যথার্থ গুণাবলীর মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয় না?

*

সোনার সংসারের সোনার ছেলে নরেন্দ্রনাথ প্রায়ই একই সময়ে দুটি প্রবল ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়েছিলেন। এক, আধ্যাত্মিক জগতের বিপুল আলোড়ন–দক্ষিণেশ্বরের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, দ্বিতীয়, পিতা বিশ্বনাথের আকস্মিক মৃত্যুতে পারিবারিক বিপর্যয়, এমন এক পরিস্থিতিতে যখন একুশ বছর বয়সের ওকালতি-পড়া জ্যেষ্ঠপুত্র ছাড়া কাছাকাছি আর কেউ উপার্জনক্ষম নেই।

বিরাট সংসারের বিরাট খরচ, কিন্তু উপার্জনের কোনো রকম পথ নেই; এবং সুযোগ বুঝে শরিকদের মামলা-মোকদ্দমা, যাতে বিধবা ভুবনেশ্বরী অসহায় ছেলেমেয়েদের হাত ধরে ভিটেমাটি ছাড়া হন।

একান্নবর্তী পরিবারের অভিশাপ যে কত নিষ্করুণ তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামীজির ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ জীবনসায়াহ্নে দুঃখ করেছেন, যাঁরা এই একান্নবর্তী পরিবার-প্রথার পবিত্রতা সম্বন্ধে গলাবাজি করে থাকেন তারা বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত নন। পারিবারিক কলহবিবাদ ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলী তারা উপেক্ষা করে থাকেন। ভূপেন্দ্রনাথের মতে, “বর্তমান সমাজে এই প্রথা চালু রাখার স্বপক্ষে কোনো কারণই থাকতে পারে না।”

বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর কেউ তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে একটি কপদক দিয়েও সাহায্য করবার জন্যে এগিয়ে আসেননি। এই অপ্রিয় সত্যটুকু ভুবনেশ্বরীর কনিষ্ঠ সন্তান লিখিতভাবে জানিয়েছেন। “অথচ কলকাতাতেই আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা ছিলেন। কিন্তু বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর সকলেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সমাজ, আত্মীয়-স্বজন আমাদের কথা বিস্মৃত হলো…জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্রে আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লাম”, দুঃখ করেছেন ভূপেন্দ্রনাথ।

শেষ দিকে বিশ্বনাথবাবু তাঁর এটর্নি অফিসের ওপর তেমন নজর রাখতেন না। যে বন্ধুর ওপর তিনি কোম্পানির ভার অর্পণ করেন তিনি সুযোগ বুঝে বিশ্বনাথের নামে ঋণ করে সেইসব অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকেন।

বাবার শ্রাদ্ধশান্তির পরেই দাদা নরেন্দ্রনাথ বুঝলেন, আর্থিক অবস্থা ভয়াবহ। তখন ছোটভাই নিতান্তই শিশু। জ্যেষ্ঠভ্রাতা স্বয়ং এসময়কার বৃত্তান্ত আমাদের জন্যে মর্মস্পর্শী ভাষায় বর্ণনা করে গিয়েছেন :

“মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে ছিন্নবস্ত্রে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে অফিস হইতে অফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম … কিন্তু সর্বত্রই বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত সেই প্রথম পরিচয়েই বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুইদিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া কখনো কখনো সংসারটা দানবের রচনা বলিয়া মনে হইত। মনে হয়, এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল, অথবা ঘটনাক্রমে ঐস্থানে আমার সহিত মিলিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে একজন বোধ হয় আমাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গাহিয়াছিল—’বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে।’

“শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় যেন কে গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাগণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হওয়ায় ক্ষোভে নিরাশায় ও অভিমানে বলিয়া উঠিয়াছিলাম, ‘নে নে চুপ কর! ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের তাড়া যাহাদিগকে কখনো সহ্য করতে হয় নাই, টানাপাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকট ঐরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে; আমারও একদিন লাগিত। কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।”

অন্য পরিস্থিতিতে নরেন্দ্রনাথ একদিন মাস্টারমশাই মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে যা বলেছিলেন তাও কথাসূত্রে লিপিবদ্ধ আছে : “অনেক দুঃখ কষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে, মাস্টারমশাই, আপনি দুঃখকষ্ট পান নাই তাই; জানি দুঃখকষ্ট না পেলে ঈশ্বরের হস্তে সমর্পণ হয় না।”

পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে বিলুর নিজের মুখেই আরও কথা : “প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার্য নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে, বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে ঘরে বাহিরে কাহারও নিকটে ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।”

ধনী বন্ধু কিছু ছিল, কিন্তু তারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এবিষয়ে জানতে চেষ্টা করেনি। তাদের মধ্যে বিরল দুই-একজন কখনও কখনও বলতো, “তোকে আজ এত বিষণ্ণ ও দুর্বল দেখছি, কেন বল দেখি? একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্ৰমধ্যে মাতাকে সময়ে সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।”

তখনকার অবস্থা স্বামীজির মুখেই শুনুন। “যৌবনে পদার্পণপূর্বক যে সকল বাল্যবন্ধু চরিত্রহীন হইয়া অসদুপায়ে যৎসামান্য উপার্জন করিতেছিল, তাহাদিগের কেহ কেহ আমার দারিদ্র্যের কথা জানিতে পারিয়া সময় বুঝিয়া দলে টানিতে সচেষ্ট হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা ইতঃপূর্বে অবস্থার পরিবর্তনে সহসা পতিত হইয়া একরূপ বাধ্য হইয়াই জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য হীনপথ অবলম্বন করিয়াছিল, দেখিতাম তাহারা সত্যসত্যই আমার জন্য ব্যথিত হইয়াছে। সময় বুঝিয়া অবিদ্যারূপিনী মহামায়াও এইকালে পশ্চাতে লাগিতে ছাড়েন নাই। এক সঙ্গতিসম্পন্না রমণীর পূর্ব হইতেই আমার উপর নজর পড়িয়াছিল। অবসর বুঝিয়া সে এখন প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল, তাহার সহিত তাহার সম্পত্তি গ্রহণ করিয়া দারিদ্র-দুঃখের অবসান করিতে পারি! বিষম অবজ্ঞা ও কঠোরতা প্রদর্শনে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে হইয়াছিল। অন্য এক রমণী ঐরূপ প্রলোভিত করিতে আসিলে তাহাকে বলিয়াছিলাম, বাছা এই ছাই-ভস্ম শরীরটার জন্যে এতদিন কত কি তো করিলে! মৃত্যু সম্মুখে–তখনকার সম্বল কিছু করিয়াছ কি? হীনবুদ্ধি ছাড়িয়া ভগবানকে ডাক।”

ঘটনাস্রোতে আর একবার কয়েকজন বন্ধু নরেন্দ্রনাথকে সুরাপানের পরামর্শ দেয় এবং সুচতুরভাবে এক বারাঙ্গনার কাছে জর্জরিত নরেনকে নিয়ে যায়। তাকে বিদায় করে দিয়ে নরেন্দ্রনাথ সবাইকে বলতে লাগলেন, “আমি আজ মদ ও মেয়েমানুষ নিয়ে আমোদ করেছি।” বাড়িতে গিয়ে নিজের মাকেও ওই কথা তিনি প্রকাশ করেন। খবরটা দিয়েছেন জীবনীকার প্রমথনাথ বসু।

“এক সন্ধ্যায় তাহার জনকয়েক বন্ধু তাহাকে গাড়ি করিয়া তাহাদের কলিকাতার উপকণ্ঠস্থিত এক উদ্যানবাটীতে লইয়া যাইতে চাহিলেন… গানবাজনা খুব হইল, নরেন্দ্রও যথারীতি যোগ দিলেন, কিছুপরে তিনি ক্লান্ত বোধ করিলে বন্ধুরা পার্শ্ববর্তী একখানি ঘর দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, তিনি সেখানে গিয়া বিশ্রাম করিতে পারেন। তিনি একাকী শুইয়া আছেন এমন সময় বন্ধুদের দ্বারা প্রেরিত একটি যুবতী সেই কক্ষে উপস্থিত হইল…সে ক্রমে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করিল এবং ঐ গৃহে আসার অভিপ্রায়ও খুলিয়া বলিল।…নরেন্দ্র বাহিরে যাইবার জন্য পা বাড়াইয়া বলিলেন, “মাপ করবেন; আমায় এখন যেতে হবে।…আপনার মঙ্গল হোক এই আমি চাই। আপনি যদি বুঝে থাকেন যে, এভাবে জীবনযাপন করা পাপ, তবে একদিন না একদিন আপনি এ থেকে উদ্ধার পাবেন নিশ্চয়।”

.

ঘটনাস্রোত থমকে দাঁড়ায়নি। নরেন্দ্রর আত্মজীবনবর্ণনা আমাদের কাছেই রয়েছে, “এত দুঃখ কষ্টেও এতোদিন আস্তিক্যবুদ্ধির বিলোপ কিংবা ঈশ্বর মঙ্গলময়–একথায় সন্দিহান হই নাই। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গে তাহাকে স্মরণ-মনন পূর্বক তাহার নাম করিতে করিতে শয্যাত্যাগ করিতাম। একদিন ঐরূপ শয্যাত্যাগ করিতেছি, এমন সময় পার্শ্বের ঘর হইতে মাতা শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘চুপ কর ছোঁড়া! ছেলেবেলা থেকে কেবল ভগবান ভগবান। ভগবান সব তো কল্লেন!’ কথাগুলিতে মনে ভীষণ আঘাত পাইলাম। স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ভগবান কি বাস্তবিক আছেন এবং থাকিলেও আমাদের সকরুণ প্রার্থনা কি শুনিয়া থাকেন? তবে এত যে প্রার্থনা করি, তাহার কোন উত্তর পাই না কেন? শিবের সংসারে এত অশিব কোথা হইতে আসিল? মঙ্গলময়ের রাজত্বে। এত প্রকার অমঙ্গল কেন?”

আরও বিস্ফোরণ আছে। “গোপনে কোন কার্যের অনুষ্ঠান করা আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল।…সুতরাং ঈশ্বর নাই। অথবা যদি থাকেন তো তাহাকে ডাকিবার জন্য কোন সফলতা বা প্রয়োজন নাই, একথা হাঁকিয়া ডাকিয়া লোকের নিকট সপ্রমাণ করিতে এখন অগ্রসর হইব, ইহাতে বিচিত্র কি? ফলে স্বল্পদিনেই রব উঠিল, আমি নাস্তিক হইয়াছি এবং দুশ্চরিত্র লোকের সহিত মিলিত হইয়া মদ্যপানে ও বেশ্যালয়ে গমনে পর্যন্ত কুণ্ঠিত নই।”

এই সময়ে পাড়ার রিপোর্টও ভাল নয়। এক প্রতিবেশী তার বন্ধু শরৎচন্দ্রকে (পরে স্বামী সারদানন্দ) বলেন, “এই বাটিতে একটা ছেলে আছে, তাহার মতো ত্রিপণ্ড ছেলে কখনও দেখিনি; বি এ পাশ করেছে বলে যেন ধরাকে সরা দেখে। বাপখুডোর সামনেই তবলায় চাটি দিয়ে গান ধরলে, পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে দিয়েই চুরুট খেতে খেতে চললো–এইরূপ সকল বিষয়ে।”

বি এ পাস করেও কলকাতার অফিসপাড়ায় মাসিক ১৫ টাকা মাইনের চাকরি জোগাড় করতে ভবিষ্যতের বিবেকানন্দ যে অসমর্থ হয়েছিলেন তা মার্কিন দেশের ভক্তদের তিনি সুযোগ পেলেই শুনিয়েছেন। এখনকার যুগে যাঁদের ধারণা সকালে কলকাতার চাকরিবাজার খুব লোভনীয় ছিল তারা আশা করি প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারছেন।

সম্বলহীন, অন্নহীন নরেন্দ্রনাথ দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কথামৃতের রচনাকার শ্রীমর স্নেহনজরে পড়লেন। তিনি তখন বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক। তার চেষ্টায় নরেন্দ্রনাথ সুকিয়া স্ট্রিটে ইস্কুলের প্রধান শাখায় তিনমাস পড়ান। তারপর সিদ্ধেশ্বর লেন, চাপাতলায় মেট্রোপলিটানের একটা শাখা খোলা হল, ঐখানে হেডমাস্টারের কাজ পেলেন নরেন্দ্রনাথ।

ঐ স্কুলের সেক্রেটারি ছিলেন বিদ্যাসাগরের জামাই–তার বিষনজরে পড়ে গেলেন হতভাগ্য নরেন্দ্রনাথ। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা কলকাঠি এমনভাবে নাড়লেন যে ক্লাস নাইন ও টেনের ছেলেরা যৌথভাবে পিটিশন করলো, নতুন হেডমাস্টার পড়াতে পারে না। জগৎকে নতুন শিক্ষা দেবার জন্যে যাঁর আবির্ভাব, দলবাজির জোরে তার ছাত্ররাই কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করছে, লোকটা পড়াতে পারে না।

বিদ্যাসাগরমশায় পিটিশন দেখেই খোঁজখবর না নিয়েই নির্দেশ দিলেন, তা হলে নরেন্দ্রকে বলো–আর না আসে।নতমস্তকে এই নির্দেশ মেনে নেওয়া ছাড়া নরেন্দ্রর আর কোনো পথ ছিল না। আশ্চর্য এই,নরেন্দ্রনাথের মনে পরবর্তীকালেও কোনো তিক্ততা ছিল না। তাকে সবসময় বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করতে দেখেছি আমরা।

মেট্রোপলিটন ইস্কুলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের নমস্য সন্ন্যাসী স্বামী বোধানন্দ। পড়তেন নিচু ক্লাসে, কিন্তু তার বেশ মনে ছিল, আলখাল্লা, চাপকান ও ট্রাউজার পরে নরেন্দ্রনাথ ইস্কুলে আসতেন। সেইসঙ্গে গলায় থাকতো ৬ ফুট লম্বা চাদর, এক হাতে ছাতা এবং অন্যহাতে এনট্রান্স ক্লাসের পাঠ্যপুস্তক।

বিদ্যাসাগরের চাকরি হারিয়ে সিটি স্কুলে একটা মাস্টারির চাকরির জন্য শিবনাথ শাস্ত্রীমশাইকে ধরাধরি করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। বলাবাহুল্য, শাস্ত্রীমশায় দায়টা এড়িয়ে যান। আরও বলে রাখা ভাল, প্রায় এই পর্বে রামকৃষ্ণ ভক্ত শ্ৰীম নিজেই বিদ্যাসাগরের রোষানলে পড়েন। অসুস্থ রামকৃষ্ণের ওখানে ঘন ঘন যাতায়াতের জন্য ছেলেদের পরীক্ষার ফল আশানুরূপ হয়নি, এমন ইঙ্গিত পাওয়ায় মানসম্মান রক্ষার জন্য ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই মাস্টারমশাই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। ঠাকুরকে যখন তিনি খবরটা দিলেন তখন অসুস্থ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ তিনবার বললেন, “ঠিক করেছ, ঠিক করেছ, ঠিক করেছ।” চাকরি-বাকরির ব্যাপারে ঠাকুরকে এতো সাফসুফ কথা বলতে আর কখনও শোনা যায়নি।

সৌভাগ্যবশত শ্ৰীমকে অন্নচিন্তায় কাতর হতে হয়নি, কারণ স্যর সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি মহাশয় তাঁর নবপ্রতিষ্ঠিত রিপন স্কুলে সাদরে ডেকে নিয়ে যান বহুগুণের অধিকারী মহেন্দ্রনাথ গুপ্তকে।

কিন্তু ভবিষ্যতের বিবেকানন্দ? শোনা যায়, তিনি গয়ার কাছে কোনো জমিদারি সেরেস্তায় সামান্য একটা কাজ জুটিয়েছিলেন, যদিও শেষপর্যন্ত সেখানে যাওয়া হয়নি। কারণ বাবার মৃত্যুর একবছর পরে ১৮৮৫ সালের মার্চ মাসে নরেন্দ্রনাথ গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বলে আমরা আন্দাজ করতে পারি। এইসব বর্ণনা পাঠ করেই নিন্দুকরা সময় বুঝে বাঁকা প্রশ্ন তুলেছেন, ইনি কি ‘অভাব-সন্ন্যাসী’ না ‘স্বভাব-সন্ন্যাসী’?

মেট্রোপলিটান স্কুল থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর নরেন্দ্রনাথ আরও কিছু করেছিলেন এমন ইঙ্গিত অন্য কোথাও না থাকলেও, উচ্চতম আদালতের নথিপত্রে তার একটি বক্তব্য ইদানীং আমাদের নজর পড়ে যায়। কলকাতা হাইকোর্টের একটি কাগজে লেখা : মেট্রোপলিটান ছাড়বার পরে “অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ও তার অধীনে একটি কলেজে আমি কিছুদিন অধ্যাপনা করি।” তখন নরেন্দ্রনাথ আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। উকিলের প্রশ্নের মুখে তিনি স্বীকার করছেন : “আমি বেকার।”

.

পারিবারিক সংকটকালে অভাবের সংসারের কয়েকটি টুকরো টুকরো ছবি বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে আমরা একটা বড় ছবি নিজেরাই সাজিয়ে নিতে পারি। দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসের ইচ্ছা, প্রিয় শিষ্য শরৎ (পরে স্বামী সারদানন্দ) একবার নরেনের সঙ্গে দেখা করে।

“নরেন কায়েতের ছেলে, বাপ উকিল, বাড়ি সিমলে।” এইটুকু ইঙ্গিত পেয়ে ১৮৮৫ সালে জ্যৈষ্ঠ মাসে কলেজফেরত শরৎ নরেনের গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে হাজির। “কেবল একখানি ভাঙ্গা তক্তপোষের ওপর তুলা বের করা একটা গদি, দু’একটা ছেঁড়া বালিশ আর পশ্চিমদিকে একটা কালো মশারি পেরেকের উপর গুটানো; কড়িকাঠ হইতে একটা টানা পাখার ছেঁড়া ঝালর ঝুলিতেছে।” নরেনের শিরঃপীড়া হয়েছে, নাকে কর্পূরের ন্যাস নিতে হতো। শরৎ তখন গুরুভ্রাতাকে ডাকতেন, নরেনবাবু বলে।

পারিবারিক মামলা-মোকদ্দমা এই পর্বে ক্রমশই তাল পাকিয়ে উঠছে। পরমহংস মহাশয়ের কাছ থেকে উপদেশ এসেছিল, “মোকদ্দমা জোর চালাবে। ফোঁস করবে, কিন্তু কামড়াবে না।”

উকিলবাড়ির ছেলের মন কিন্তু তখন অন্যত্র। অসহায়া ভুবনেশ্বরী শেষ চেষ্টা করেছিলেন।

ছোটছেলেকে নিয়ে ভুবনেশ্বরী কাশীপুরের অন্তিমপর্বে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথের বয়স তখন ছয়। “আমাকে মা নিয়ে গেলেন রামকৃষ্ণের ঘরে। দ্বিতলের একটি প্রশস্ত ঘরের মাঝখানে শয্যায় অর্ধ-শায়িত অবস্থায় রামকৃষ্ণ তাকিয়ায় হেলান দিয়ে রয়েছেন। ঘরে ঢুকতে তিনি আমাদের উভয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ডাক্তার আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমাকে কথা বলতেই হবে। আপনি এসেছে ভালই হয়েছে। নরেনকে আপনার সঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যান। গিরিশ ওরা সকলে মিলে ওকে সন্ন্যাসীর পোশাক পরিয়েছিল, কিন্তু আমি তখনই বাধা দিয়ে বলেছিলাম–তা কেমন করে হয় নরেন, তোমার বিধবা মা এবং একটি শিশু ভাই রয়েছে দেখবার। তোমার তো সন্ন্যাসী হওয়া সাজে না।’ একথা বলার পরে নরেন্দ্রনাথ মা ও আমার সঙ্গে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। আসবার সময় ঘোড়ার গাড়িতে বসে মা নরেন্দ্রনাথকে রামকৃষ্ণের কথাগুলো বললেন। নরেন্দ্রনাথ উত্তরে বললেন, ‘তিনি চোরকে বলেন চুরি করতে, আর গৃহস্থকে বলেন সজাগ থাকতে।”

*

বিশ্বনাথের মৃত্যুর পর ভুবনেশ্বরী যে দশপ্রহরণধারিণী দুর্গতিনাশিনীর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তা সংসারী বাঙালির মনে চিরদিন বিস্ময়ের সৃষ্টি করবে। আমার মতন ভুক্তভোগীরা বুঝবেন, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। যে সংসারে প্রতি মাসে হাজার টাকা খরচ হতো তা নামিয়ে আনলেন তিরিশ টাকায়। শুরু করলেন গহনাপত্র বিক্রি করা।

এ বিষয়ে স্বামী সারদানন্দর সশ্রদ্ধ প্রতিবেদন : “স্বামীর মৃত্যুর পর দারিদ্র্যে পতিত হইয়া ভুবনেশ্বরীর ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও তেজস্বিতা প্রভৃতি গুণরাজী বিশেষ বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। …তাকে একদিনের জন্য বিষণ্ণ দেখা যাইত না।…তাহার অশেষ সদ্গুণসম্পন্ন জ্যেষ্ঠপুত্র নরেন্দ্রনাথ নানা প্রকার চেষ্টা করিয়াও অর্থকর কোনরূপ কাজকর্মের সন্ধান পাইতেছেন না এবং সংসারের উপর বীতরাগ হইয়া চিরকালের নিমিত্ত উহা ত্যাগের দিকে অগ্রসর হইতেছেন–এইরূপ ভীষণ অবস্থায় পতিত হইয়াও শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী যেরূপ ধীরস্থির ভাবে নিজ কর্তব্য পালন করিয়াছিলেন, তাহা ভাবিয়া তাহার উপর ভক্তি-শ্রদ্ধার স্বতই উদয় হয়।”

বাবার মৃত্যুর পরে বিব্রত নরেনের প্রায়ই মাথার প্রবল যন্ত্রণা হতো। আমরা আগেই দেখেছি, মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য তিনি কর্পূরের ন্যাস নিতেন। মা একখানি চেলীর কাপড় পরতেন। কাপড়টা ছিঁড়ে যাওয়ায় নরেনকে বলেন, একখানা কাপড় হলে আহ্নিকের সুবিধে হয়। কাপড় দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নরেন মাথা হেঁট করে চলে গেল। এই সময় পরমহংসদেব এক ভক্তের কাছ থেকে একটা কাপড় পেয়ে নরেনকে বললেন, “তুই গরখানা নে, তোর মা পরে আহ্নিক করবেন।” নরেন নিল, কিন্তু পরমহংসদেব নিজেই অন্য লোকের মাধ্যমে কাপড়খানা শ্রীমতী ভুবনেশ্বরীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

পরমহংসদেবের অন্ত্যলীলা শুরু হওয়া থেকে পরিব্রাজক রূপে বিবেকানন্দর বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে নরেন্দ্রকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। কথামৃতে আছে, কেউ তাকে একশ টাকা ধার দিয়েছিলেন, তার নাম বলা হয়নি, কিন্তু এখন আমরা ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের শেষ বয়সের উক্তি থেকে জানি, স্বয়ং মাস্টারমশায় টাকাটা দান করেছিলেন। তাতে নরেনের পরিবারের তিনমাসের সংসারখরচের ব্যবস্থা হয়েছিল।

কাশীপুরের প্রথম দিকের একটি বর্ণনা মনে দাগ কাটে। নরেন্দ্রনাথ শ্ৰীমকে বললেন, “আজ সকালে বাড়ি গেলাম। সকলে বকতে লাগল। আর বললেন–”কি হো হো করে বেড়াচ্ছিস? আইন এগজামিন এত নিকটে, পড়াশুনা নাই, হো হো করে বেড়াচ্ছিস!

মাস্টারমশায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা কিছু বললেন?” নরেন্দ্র উত্তর দিলেন, “না তিনি খাওয়াবার জন্য ব্যস্ত। হরিণের মাংস ছিল, খেলুম, কিন্তু খেতে ইচ্ছে ছিল না!”… “দিদিমার বাড়িতে সেই পড়বার ঘরে পড়তে গেলাম। পড়তে গিয়ে পড়াতে একটা ভয়ানক, আতঙ্ক এল–পড়াটা যেন কী ভয়ের জিনিস! বুক আটু বাটু করতে লাগল। অমন কান্না যা কখনো কাঁদি নাই। তারপর বই-টই ফেলে দিয়ে দৌড়। রাস্তা দিয়ে ছুট। জুতো-টুতো রাস্তায় কোথায় একদিকে পড়ে রইল।..আমি দৌড়াচ্ছি কাশীপুরের রাস্তায়! ‘বিবেক-চূড়ামণি’ শুনে আরও মন খারাপ হয়েছে। শঙ্করাচার্য বলেন, এই তিনটি জিনিস অনেক তপস্যায়, অনেক ভাগ্যে মেলে–”মনুষ্যত্বং, মুমুক্ষ্যত্বং, মহাপুরুষসংশয়ঃ।‘ ভাবলাম, আমার তিনটিই হয়েছে অনেক তপস্যার ফলে মানুষজন্ম হয়েছে, অনেক তপস্যার ফলে মুক্তির ইচ্ছা হয়েছে, আর অনেক তপস্যার ফলে এরূপ মহাপুরুষের সঙ্গলাভ হয়েছে।”

বরানগর পর্বে ঠাকুরের ত্যাগী-সন্তানদের কঠিন সাধনার কথা আমরা জানি। নরেন্দ্রর পক্ষে তখন উভয় সমস্যা। পারিবারিক মোকদ্দমা চালাতে হবে, আবার ঘোর বৈরাগ্যসাধন করতে হবে।” তেজস্বী বীরপুরুষ না হলে দুটি বিপরীতভাব একত্র রাখিয়া নিজেকে নিরাপদ রাখিতে পারে না। মোকদ্দমা চালাইবার টাকার এতো অনটন যে শশী (রামকৃষ্ণানন্দ) ও শরৎ (সারদানন্দ) নরেন্দ্রকে বলিলেন, “দেখ ভাই নরেন, তোমার টাকার অনটন। মকদ্দমার খরচ বেশি, আমরা বেশ দু’জনে গিয়ে বালির ইস্কুলে মাস্টারি করি না? কিছু কিছু রোজগার করি আর মঠে আসিয়া থাকি, তাহা হইলে সেই টাকা হইতে তোমার কিছু উপকার হইতে পারে।”

যাঁরা গুরুভাইয়ের পরিবারের দুঃখমোচনের জন্য এতো ভাবতে পারেন বরানগরে তাঁদের নিজেদের আর্থিক অবস্থা কত শোচনীয় ছিল তা শুনুন। রাত্রে শোবার কোনো বিছানা ছিল না। খান দুই তিন মোটা হোগলার চাটাই ঘরে পাতা ছিল, আর একখানা ছেঁড়া সতরঞ্চি ছিল। সকলে হাত মাথায় দিয়া রাত্রে নিদ্রা যাইত, বালিশের অভাব হইলে চাটাইয়ের নিচে একখানা ইট দিত তাহা হইতেই বালিশের অভাব পূরণ হইত..গেরুয়া কাপড় পরার প্রথা ছিল না…জুতাও ছিল না, জামাও ছিল না।”

কিন্তু তীব্র অভাবের মধ্যেও ভালবাসার তীব্র প্রকাশ। বরানগরপর্বে নরেনের মোকদ্দমা চলাকালীন সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন কেদারনাথ দাস। বাগবাজারের খড়ের ব্যবসা করতেন বলে এঁর নাম হয়েছিল খড়ো কেদার। তিনি স্বেচ্ছায় নরেনকে একশ টাকা দিয়েছিলেন।

এই সময়েই নরেনকে টাকা ধার নিতে হয় বলরামবাবুর কাছ থেকে। এই ৫০০ টাকা ঠাকুরের গৃহী ভক্ত সুরেশবাবু মঠ স্থাপনের জন্য বলরামবাবুর কাছে রেখে যান। মোকদ্দমা যখন তুমুলভাবে চলছে তখন নরেন্দ্রনাথ এই টাকা ধার করেন। দেড় বছর পরে টাকা পাওয়া গেলে এই টাকা শোধ করে দেওয়া হয়। টাকাটা কোম্পানির কাগজে ছিল এবং উকিল অতুল ঘোষের কাছ থেকে চিঠি নিয়ে মহিমবাবু ও শরৎ মহারাজ বড়বাজারে প্রসাদদাস বড়ালের অফিসে গিয়ে, কাগজ ভাঙিয়ে টাকা শোধ করেন। শোনা যায়, পরে এই টাকায় বেলুড় মঠে ঠাকুরঘরের মার্বেল পাথর কেনা হয়।

*

স্বামীজীর পারিবারিক বিপর্যয়কালে তার দু’জন গুরুভাইয়ের নিঃশব্দ সেবা ও সমর্থন অবিস্মরণীয় রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ও শরৎ মহারাজ (সারদানন্দ)। স্বামীজীর পিতৃবিয়োগের পর আত্মীয়রা এই পরিবারকে ভিটেমাটিছাড়া করার চেষ্টা চালিয়েছিল, সেই দুর্দিনে জমিদার-পরিবারের সন্তান রাখাল লোকজন সঙ্গে নিয়ে বাড়ির দখল রক্ষা করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই পর্বের অনেক বর্ণনা শোনা যেত অনঙ্গ মহারাজ ওরফে স্বামী ওঙ্কারানন্দের মুখে। অনঙ্গ মহারাজের প্রিয়পাত্র ছিলেন গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু।

স্বামীজির দেহত্যাগের পর জননী ও ভ্রাতাদের অভিভাবকের দায়িত্বও রাখাল মহারাজ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।

জীবনের শেষপর্বেও স্বামীজি তার গুরুভাইকে অনুরোধ করেছিলেন, “রাখাল, আমার শরীর ভাল নয়। আমি শীগগির দেহত্যাগ করবো, তুই আমার মার ও বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিস, তাকে তীর্থ দর্শন করাস, তোর ওপর এইটি ভার রইল।”

পারিবারিক বিরোধ একবার শুরু হলে শেষ হতে চায় না, আমাদের অষ্টাদশ পর্ব মহাভারতই তার প্রমাণ। এই বিরোধ যেমন মৃতদেরও ছাড়তে চায় না, তেমন সন্ন্যাসীকেও তার মুক্তিপথ থেকে হিড়হিড় করে আদালতে টেনে আনতে দ্বিধা করে না।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব একবার আদালতে গেলে যে দুটো খরচের কোনো নাগাল পাওয়া যায় না তা হলো সময় ও অর্থ। ভুবনেশ্বরী দেবীর ক্ষেত্রেও আমরা দেখবো, এই মামলা শাখাপ্রশাখা বিস্তারিত করে স্বামীজির ৩৯ বছর জীবনকালের দ্বিতীয়ার্ধটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবার প্রবল চেষ্টা করেছিল।

স্বামীজির কনিষ্ঠভ্রাতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, জ্যেষ্ঠভ্রাতা সংসার ত্যাগ করায়, এই সংকটকালে ভুবনেশ্বরীর পাশে কেউ ছিল না। কথাটা কতটুকু সত্য তা পরিমাপ করতে হলে দত্তদের পারিবারিক মামলার বিস্তৃত বিবরণ ইতিহাসের অবগুণ্ঠন সরিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করা প্রয়োজন।

স্বামীজির সব জীবনীগ্রন্থে এই মামলার উল্লেখ থাকলেও সব তথ্য এখনও যাচাই করা হয়নি। কিন্তু ভূপেন্দ্রনাথ স্বামীজির জীবনীকারদের কিছু মন্তব্যকে ভালভাবে নিতে পারেননি। এইসময় স্বদেশ এবং বিদেশ থেকে মেমসায়েবদের এবং অবাঙালিদের কাছে লেখা বিবেকানন্দর কিছু চিঠির পূর্ণবয়ান তখন ভূপেন্দ্রনাথের হাতে ছিল না। গত কয়েকবছরে পরিস্থিতির অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটেছে। মেরি লুইস বার্ক তার অতুলনীয় গবেষণাগ্রন্থে কিছু চিঠির পূর্ণ বয়ান সংগ্রহ করে অনেক বিক্ষিপ্ত অংশ এমনভাবে জুড়ে দিয়েছেন যে তাঁর ছয়খণ্ডের বইটার কয়েক হাজার পাতা মন দিয়ে না পড়লে নানা সমস্যায় জর্জরিত এবং অকারণে বারংবার বিপন্ন বিবেকানন্দকে পুরো জানা যায় না।

এই বিড়ম্বনার হিসেবখাতা দেখলে বোঝা যায়, বিবেকানন্দ একই সঙ্গে দেবী দুর্গার মতন দশ হাতে যুদ্ধ করছেন। রণক্ষেত্রে দেবী চণ্ডীকার যত অসুবিধাই থাক তার স্বাস্থ্যের কোনো সমস্যা ছিল না, বিবেকানন্দ সেই সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। এক একবার মনে হয় আমাদের এই দুর্ভাগা দেশে জন্মগ্রহণ করে বড় কোনো স্বপ্ন দেখলে তার জন্যে মানুষকে অনেক বাড়তি মাশুল দিতে হয়। সংগ্রামী বিবেকানন্দকে ভালভাবে জানলেই এখন যাঁরা দারিদ্রের বিরুদ্ধে পারিবারিক সংগ্রাম করছেন এবং অনাগতকালে যাঁরা সংগ্রাম করবেন তাদের একাকিত্বের কিছুটা অবসান ঘটবে, তাদের মনে বিশেষ কোনো দুঃখ থাকবে না।

*

একজন প্রবীণ আইনজ্ঞ (চিত্রগুপ্ত) ছদ্মনামের আড়ালে থেকে কিছুদিন আগে দত্তপরিবারের কিছু আইনি তথ্য আমাদের উপহার দিয়েছেন, যার থেকে আমরা জানতে পারি ভিটেমাটি নিয়ে কবে কোন মামলা হয়েছিল এবং কোন আদালতে নরেন্দ্রনাথ কী সাক্ষ্য দিয়েছিলেন।

মামলার সময় ভুবনেশ্বরী পালকি করে কলকাতার হাইকোর্ট পাড়ায় আসতেন। বিলু যেতেন পায়ে হেঁটে, কিন্তু তিনি মায়ের আগেই পৌঁছে যেতেন। মামলার কাগজপত্র থেকে আমাদের সব চেয়ে মূল্যবান প্রাপ্তি ভুবনেশ্বরী দেবীর বাংলা স্বাক্ষর–এমন সুন্দর হস্তলিপি কদাচ দেখা যায়।

বিবেকানন্দের পিতা বিশ্বনাথের ওকালতি তথ্য সম্বন্ধে একসময় হাইকোর্টে খোঁজখবর করেন ব্যারিস্টার সুধীরচন্দ্র মিত্র। তার অনুরোধে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন চিফ জাস্টিস ফণিভূষণ চক্রবর্তী ১৯৫২ সালে সুধীরচন্দ্রকে কিছু বিবরণ পাঠিয়ে দেন।

ভিটেবাড়ি নিয়ে বিড়ম্বনা যখন সারাজীবনই ঘটেছে, তখন জেনে রাখা ভাল যে আমরা একনজরে একটা নয়, একগুচ্ছ মামলার উপস্থিতি লক্ষ্য করছি। এই মামলার বিবরণ মাথায় নিতে হলে যেসব বংশলিপি সেই সময় আদালতে পেশ করা হয়েছিল তাও পড়ে নেওয়া দরকার–কোন্ প্রজন্মে কার কতখানি অংশ, কোন শরিক বিবাহ করেননি, কে নিঃসন্তান, কে অপুত্রক, বা কে ছয় বা সাত কন্যার জনক তা জানা প্রয়োজন।

সিমলাপর্বের শুরুতে রামসুন্দর দত্ত, যাঁর পাঁচটি সন্তানের নাম আমাদের জানা।

জ্যেষ্ঠপুত্র রামমোহনের দুইপুত্র ও সাত কন্যা। এঁরই জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্গাপ্রসাদ সন্ন্যাসী হয়েছিলেন এবং তিনিই বিবেকানন্দর পিতামহ। রামমোহনের দ্বিতীয় পুত্রের পুত্র তারকনাথ ছিলেন বিবেকানন্দর খুড়ো, তাঁর স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরীর সঙ্গেই আদালতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ যা সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর জীবনকে মেঘাচ্ছন্ন করে রেখেছিল।

বলে রাখা ভাল এই খুড়ির ছয় কন্যা এবং পরবর্তীকালে যথাসর্বস্ব হারিয়ে তিনি ভুবনেশ্বরী-পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেন!

ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “মোকদ্দমা বিশ্বনাথ দত্তের স্ত্রী বনাম তারকনাথ দত্তের স্ত্রীর মোকদ্দমা, তখন স্বামী বিবেকানন্দ বলে কেহ ছিলেন না।” মোকদ্দমার দায়ে খুড়ি জ্ঞানদাসুন্দরীর বাস্তুভিটা নিলাম হয়। “পরে স্বামীজির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে, তিনি একটা মোটা অঙ্কের টাকা এককালীন দান করেন।”

আমরা দেখবো, উদার হস্তে দান করেও সমস্যা মেটেনি, বরং স্বামীজি কিছুটা ঠকেছিলেন। ফলে মামলা আরও শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে, যদিও শেষ বয়সে এই খুড়ি নাকি দুঃখ করতেন, কয়েকজনের প্ররোচনায় তিনি এই মামলা করেন। বাড়ির সরকারও সুযোগ বুঝে হাজার পাঁচেক টাকা বাড়তি উপার্জন করেন। কিন্তু আমরা জানি, যৌথপরিবারে খুড়োখুড়ির অত্যাচার ছিল তুঙ্গে এবং এমন সময় গেছে যখন ভুবনেশ্বরীকে ‘একটি শাড়ি পরে কাটাতে হয়েছে।‘ বিশ্বনাথ দত্ত নিজেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, “আমি এত টাকা রোজগার করি, আর আমার স্ত্রী পেটভরে খেতে পায় না।”

আজকের প্রজন্মের অনেকের কাছে যৌথপরিবারের লাইফস্টাইলটা অবোধ্য এবং রহস্যময় মনে হওয়া আশ্চর্য নয়। আমি রোজগার করছি, আর আমার বউ এক কাপড়ে প্রায় না খেয়ে কী করে থাকবে? বাড়ি যখন আমার তখন আদালতে ছোটাছুটি কেন?

উনিশ ও বিশ শতকের মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের এ এক দুঃখময় দিক। ব্যাপারটা এই রকম : সম্পন্নলোকরা সেকালে যৌথ পরিবারে থাকতেন। রোজগারের পরিমাণ যার যতই হোক, হেঁসেল অথবা হাঁড়ি এক। দুই, আইনের চোখে সভ্যদের মালিকানার অংশ থাকলেও সম্পত্তিটা অবিভক্ত। একসময় এই অবিভক্ত সম্পত্তি ভাগ করে দেবার জন্যে পার্টিশন স্যুট চলতো চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে কলকাতার ধনপতি আইনজ্ঞদের বিশাল উপার্জনের একটা বড় অংশ আসতো এই ধরনের মামলা থেকে। এক প্রস্থে এইসব মামলার শেষ হতো না। একবার হারলে উচ্চ আদালতে আপিল হতো। বলে রাখা ভাল, দুর্বল নিঃসন্তান বিধবারা অনেক সময় টাকার প্রয়োজন হলে অবিভক্ত ভিটের নিজের অংশ আর একজন শরিককে বেচে দিতেন।

ভুবনেশ্বরী মামলার একটি সংক্ষিপ্তসার ভূপেন্দ্রনাথ দিয়েছেন, সেটি প্রথমে দিই। তারপর একটু-আধটু বাড়তি আলোকপাত করা যাবে। “আমরা যখন কালিপ্রসাদের বংশের সঙ্গে এজমালিতে থাকতাম সেসময়ে আমার মাতাঠাকুরানী দত্তদের অবিভক্ত পৈতৃক বাড়ির একাংশ, যা এক বালবিধবার বখরায় পড়ে, ক্রয় করেছিলেন। কিন্তু আমাদের খুল্লতাতের মৃত্যুর পর খুড়ি তা দখল করে আমাদের ভিটাচ্যুত করেন। তারপরে আদালতে মকদ্দমা রুজু করেন।”

অতিসুন্দর সংক্ষিপ্তসার, কিন্তু বিবেকানন্দের বিড়ম্বনা বুঝতে গেলে আর একটু খবর সংগ্রহের প্রয়োজন। প্রথমেই বলে রাখা যাক, আমরা একাধিক মামলায় দত্তপরিবারকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখছি। সময় অনুযায়ী সাজালে ব্যাপারটা সহজ হয়। যার শুরু নরেন্দ্রনাথের চোদ্দবছর বয়স থেকে।

১লা সেপ্টেম্বর ১৮৭৭ : মাধব দত্তর স্ত্রী বিন্দুবাসিনীর ভাগ কিনলেন ভুবনেশ্বরী। এই সম্পত্তি স্বামীর টাকায় কিনলেন, না খুড়ো তারকনাথ বেনামে ভাইপোর স্ত্রীর নামে কিনলেন, এই নিয়ে আদালতে মহারণ হয়েছিল পরে।

১৮৮০: আর এক শরিক শচীমণি দাসী (গৌরমোহন দত্তের দৌহিত্রী) সম্পত্তি বিভাজনের মামলা আনলেন, যাতে বিবেকানন্দ জননীও ছিলেন প্রতিপক্ষ। এই মামলায় বিখ্যাত এটর্নি রবার্ট বেচেম্বার্স সম্পত্তি বিভাজনের কমিশনার নিযুক্ত হলেন। যথাসময়ে তিনি ভাগ ঠিক করে দেন, কিন্তু তাতে এই মামলার শেষ হয় না।

আগস্ট ১৮৮৫ : পিতা বিশ্বনাথের মৃত্যু ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪ সালে, তারপরেই উকিল তারকনাথ ভুবনেশ্বরীর নামে কেনা সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করতে লাগলেন।

বড়দিন ১৮৮৫ : যৌথসম্পত্তির একটা অংশে শৌচাগার মেরামতের জন্য পুরনো দেওয়াল ভাঙা নিয়ে ভুবনেশ্বরী পরিবারের সঙ্গে তারকনাথ কথাকাটাকাটিতে পড়লেন। এই কথাকাটাকাটিতে মাতৃনির্দেশে নরেন্দ্রনাথকে অংশ নিতে হয়েছিল।

২৫শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৬ : তারকনাথ দেহ রক্ষা করলেন।

জুলাই ১৮৮৬ : তারকনাথের বিধবা জ্ঞানদাসুন্দরী হাইকোর্টে মামলা করলেন ভুবনেশ্বরী দেবীর বিরুদ্ধে।

১১ই আগস্ট ১৮৮৬ : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পাঁচদিন আগে ভুবনেশ্বরী দাসী স্বামীর সম্পত্তির জন্য হাইকোর্টে লেটার অফ অ্যাডমিনিসট্রেশনের আবেদন করলেন কারণ বিশ্বনাথের কোনো উইল ছিল না। তখনকার উচ্চ আদালত কীরকম দ্রুত কাজ করতে পারতেন তার প্রমাণ, পরের দিনই (১২ আগস্ট) ছাড়পত্র পাওয়া গেল। সমস্ত কাগজপত্রে মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের সই আছে।

১৬ আগস্ট ১৮৮৬ : শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধি।

১৮৮৭ গোড়ার দিক : খুড়ি জ্ঞানদাসুন্দরীর মামলা আদালতে শুরু হলো। তার পক্ষে বিখ্যাত ইংরেজ ব্যারিস্টার পিউ।

৮ মার্চ ১৮৮৭ : নরেন্দ্রনাথ তখন বরাহনগর মঠ নিবাসী। সাক্ষ্য দিতে এসে অপরপক্ষের ব্যারিস্টারের জেরার মুখে পড়লেন, বললেন আমি বেকার।

১৪ মার্চ ১৮৮৭ : হাইকোর্টের রায়–হেরে গেলেন খুড়ি, কিন্তু আবার হাইকোর্টে আপিল।

১০নভেম্বর ১৮৮৭ : তিন বিচারকের আপিল আদালতের রায়। খুড়ির আবার পরাজয়।

১৮৮৮ : শচীমণি দাসী ১৮৮০ সালে যে পার্টিশন চেয়েছিলেন এবং রবার্ট বেলচেম্বার্স যে বাঁটোয়ারা করেছিলেন সেই অনুযায়ী সম্পত্তি বিভাজন চাইলেন শ্রীমতী ভুবনেশ্বরী।

২৩ নভেম্বর ১৮৮৮ : ভুবনেশ্বরী তার আইনগত অধিকার পেলেন।

২৮ জুন ১৯০২: প্রায় চোদ্দ বছর অতিক্রান্ত। তবু মামলার শেষ নেই।

৪ঠা জুলাই স্বামীজির দেহত্যাগ। তার কয়েকদিন আগে তার জীবনের শেষ শনিবারে (২৮ জুন) কলকাতায় এসে অনেক চেষ্টা করে স্বামীজি মামলার অবসান ঘটালেন, শান্তি ফেরাবার জন্য শরিকদের বেশ কিছু টাকা দিতে হল।

৪ জুলাই ১৮৮৯ বাগবাজার থেকে স্বামীজি বারাণসীতে প্রমাদাস মিত্রকে যে চিঠি লেখেন তাতে মামলার কিছু আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। “আমার মাতা ও দুই ভ্রাতা কলিকাতায় থাকে। আমি জ্যেষ্ঠ, মধ্যমটি এইবার ফার্স্ট আর্টস পড়িতেছে, আর একটি ছোট। ইহাদের অবস্থা পূর্বে অনেক ভাল ছিল, কিন্তু আমার পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বড়ই দুঃস্থ, এমনকি কখন কখন উপবাসে দিন যায়। তাহার উপর জ্ঞাতিরা দুর্বল দেখিয়া পৈতৃক বাসভূমি হইতে তাড়াইয়া দিয়াছিল; হাইকোর্টে মকদ্দমা করিয়া যদিও সেই পৈতৃক বাটীর অংশ পাইয়াছেন, কিন্তু সর্বস্বান্ত হইয়াছেন–যে প্রকার মকদ্দমার দস্তুর।…এবার তাহাদের মকদ্দমা শেষ হইয়াছে। কিছুদিন কলকাতায় থাকিয়া, তাহাদের সমস্ত মিটাইয়া এদেশ হইতে চিরদিনের মত বিদায় হইতে পারি, আপনি আশীর্বাদ করুন।”

দশদিন পরে প্রমদাবাবুকে স্বামীজির আর একটি চিঠি। “…আমার এস্থানের গোযোগ প্রায় সমস্ত মিটিয়াছে, কেবল একটি জমি বিক্রয় করিবার জন্য দালাল লাগাইয়াছি, অতি শীঘ্রই বিক্রয় হইবার আশা আছে। তাহা হইলেই নিশ্চিন্ত হইয়া একেবারে কাশীধামে মহাশয়ের সন্নিকট যাইতেছি।”

জটিল পারিবারিক মামলা সম্পর্কে কনিষ্ঠ ভ্রাতা ভূপেন্দ্রনাথের বক্তব্য: “স্বামীজীর জীবন বলে যেসব পুস্তক বাজারে চলছে তাতে একটা মিথ্যা সংবাদ আছে। এই মোকদ্দমায় ব্যারিস্টার ও উকিল পাই-পয়সাটি পর্যন্ত আদায় করেছিল, ব্যারিস্টারদের নগদ বিদায় দিতে হয়, আর উকিলের পাওনা, তা শেষ দেবার সময় লেখক হাজির ছিলেন এবং তার রসিদ আছে।”

*

মায়ের প্রতি দায়িত্বপালন করতে গিয়ে নিঃসম্বল সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে কি কঠিন সমস্যামালার মধ্যে পড়তে হয়েছিল এবং আমৃত্যু তিনি কীভাবে একের পর এক সেইসব আর্থিক বাধার মোকাবিলা করেছেন, এমনকি অপরের কাছে তার চিরউন্নত শির নত করতে বাধ্য হয়েছিলেন তার ইতিহাস অপ্রকাশিত না হলেও তেমন প্রচারিত নয়।

এই অংশটুকু না জানলে বোঝা শক্ত কত বড় হৃদয় ছিল তার, দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার পথ গ্রহণ করতে সারাজীবন ধরে তার কেন আপত্তি। মোক্ষসন্ধানী বিবেকানন্দই আমাদের মতন সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে গিয়েছেন ভবিতব্যের কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ না করেও কী করে মানবত্বের হিমালয়শিখরে আরোহণ করা যায়। দরিদ্র বিশ্ববাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, দরিদ্র বাঙালির পূজ্য দেবতা হবার জন্য যা যা অবশ্য প্রয়োজন তার সব কিছুই আমরা স্বামীজির অবিশ্বাস্য জীবনসংগ্রাম থেকে খুঁজে পেতে পারি।

শচীমণির মামলার সময় ভুবনেশ্বরী তার স্বামীর সঙ্গে আদালতে গিয়েছিলেন। ঘোড়ার গাড়িতে ওঠার সময় তিনি নরেনকে সঙ্গে যেতে বলেছিলেন, সে রাজি হয়নি। ভুবনেশ্বরী আদালতকে বলেন, রামসুন্দরের দ্বিতীয় ছেলের বংশধর ভোলানাথ ও মাধবচন্দ্রের প্রত্যেকের অংশ ওঁদের বিধবা বামাসুন্দরী ও বিন্দুবাসিনীর কাছ থেকে প্রত্যেককে ৫০০ টাকার বিনিময়ে তিনি কিনে নেন। বিক্রি কোবলার তারিখ ১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৭।

বাঁটোয়ারা কমিশনার রবার্ট বেল চেম্বার্সের রিপোর্টের ভিত্তিতে বিচারপতি আর্থার উইলসন রায় দিলেন, যৌথসম্পত্তিতে শচীমণির অংশ চার আনা। এই মামলায় সমস্ত পরিবারদের অংশ এবং বাসগৃহের সীমানা নির্ধারিত হয়েছিল। চিত্রগুপ্ত’ আমাদের জানিয়েছেন, দেওয়াল তুলে ভাগাভাগি না হলেও, বাঁটোয়ারার ব্যাপারে খরচ হয়েছিল ২৮৯২ টাকা, এবং নিজ নিজ অংশের আনুপাতিক হারে শরিকরা সেই অর্থ মিটিয়ে দেন। পরবর্তী মামলায় প্রমাণিত হয়, এই টাকা দেওয়ার কথা ওঠে বিশ্বনাথের মৃত্যুর পরে এবং ভুবনেশ্বরীর দেওয়ার একটা অংশ মিটিয়েছিলেন খুড়ো তারকনাথ।

তখনকার ভুবনেশ্বরী সংসারজ্বালায় বড়ই জর্জরিত। একই সময়ে চলেছে ঠাকুরের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথের লীলাখেলা। বিরক্ত ভুবনেশ্বরী নাকি একদিন বলেছিলেন, “এসব কি হচ্ছে বিলু? সংসারটা কি করে চলবে সেদিকে হুঁশ নেই, দিনরাত টোটো করে ঘুরছিস।”

নরেন নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, “সংসার চালাবার আমি কে মা? যিনি চালাবার তিনি চালিয়ে দেবেন।”

ঠাকুরের পরম ভক্ত রামচন্দ্র দত্ত ভুবনেশ্বরীর নিকট-আত্মীয়, শিশুকালে মাতৃহারা হওয়ায় তিনি ভুবনেশ্বরীর স্তন্যদুগ্ধে লালিত হয়েছিলেন। তাকে ভুবনেশ্বরী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বিলু কি আর সংসারে ফিরে আসবে না?” গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র ভরসা দিয়েছিলেন, “আপনাকে ছেড়ে ও যাবে কোথায়?”

খুড়ির সুবৃহৎ মামলার খবর নরেন্দ্রনাথ পান বরানগর মঠে থাকার সময়, যদিও মামলা দায়ের হয়েছে ঠাকুরের মহাসমাধির একমাস আগে। খুড়ির আর্জিতে আছে, ভুবনেশ্বরী যে সম্পত্তি কিনেছিলেন তা তার স্বামীর অর্থে বেনামীতে নেওয়া। সেইসময় খুড়ির প্রধান পরামর্শদাতা তার এক জামাই।

এটর্নি নিমাই বসু ভুবনেশ্বরীর জবাব দাখিল করলেন যথাসময় আমার স্বামী তার পোষ্যদের যাবতীয় খরচ প্রবাস থেকে নিয়মিত পাঠাতেন। এই সম্পত্তি আমার স্ত্রীধন। এই মামলায় মায়ের দেওয়া বাংলা স্বাক্ষর নরেন্দ্রনাথ শনাক্ত করেন।

.

মামলার শুনানির দেরি হতে পারে জেনে নরেন্দ্রনাথ তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। শুনানি শুরু হবার আগেই তিনি ফিরে আসেন। এই মামলায় সাক্ষীসাবুদ অনেক। নরেন্দ্রনাথ নিজেই সাক্ষ্য দিলেন ৮ মার্চ ১৮৮৭।

স্বামী গম্ভীরানন্দের মতে এই মামলায় ব্যারিস্টার ডবলু সি বনার্জি ভুবনেশ্বরীকে সাহায্য করেন। ব্যারিস্টার পিউ সায়েব নরেন্দ্রনাথকে বেকায়দায় ফেলবার জন্য আদালতে নানাভাবে জেরা করেন।

তোমার বয়স কত?

–তেইশ-চব্বিশ হবে।

তোমার পেশা কী?

–আমি বেকার। বর্তমানে আমি কিছুই করছি না। প্রায় দু’বছর আগে ১৮৮৫ সালে মেট্রোপলিটান ইনটিটিউশনে হেডমাস্টার পদে নিযুক্ত হই। কিন্তু মাসতিনেক পরে আমি সে কাজ ছেড়ে দিই। তারপর ডঃ আঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়ের আনুকূল্যে ও তার অধীনে একটি কলেজে আমি কিছুদিন অধ্যাপনা করি।

পৈত্রিক বাড়িতে তিনি বহুদিন বসবাস করেন না, একথা ঠিক কিনা জানতে চাইলেন পিউ সায়েব।

–বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মায়ের কাছেই থাকতাম। সব সময় যে থাকতাম একথা বলতে পারি না। আমার কাকা তারকনাথের মৃত্যুর সময়ে আমি বাড়িতে ছিলাম।

মিস্টার পিউ–তুমি কি কারও চেলা হয়েছ?

–চেলা কাকে বলে তা আমি জানি, কিন্তু আপনার ইঙ্গিতটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। আমি কখনও কোনো ভিক্ষাজীবী সাধুর চেলাগিরি করিনি।

মিস্টার পিউ জানতে চাইলেন, ধর্মীয় ব্যাপারে কোনোরকম চাঁদা তোলায় যুক্ত ছিলে?

–নরেন উত্তর দিলেন, রামকৃষ্ণদেবের জন্য তিনি কোনো চাদা গ্রহণ করেননি।

মিস্টার পিউকে প্রত্যাঘাত করার জন্য নরেন জিজ্ঞেস করলেন, মহাশয় আপনি চেলা শব্দটির অর্থ জানেন কি? ব্যারিস্টার সায়েব এবার একটু বেকায়দায় পড়ে গেলেন।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নরেন্দ্রনাথ জানালেন, কাকা তারকবাবুর সঙ্গে তাঁর দু’বার বচসা হয়। কথাকাটাকাটির পরে তারকবাবুর সঙ্গে আর সাক্ষাৎ হয়নি। কাকার মৃত্যুর আগে তিনি বাড়িতে এসেছিলেন। মাও ফিরে বাড়িতে এসেছিলেন। মায়ের ঘরটি অক্ষত ছিল। নরেন ও পরের ভাই অন্য একটি ঘরে ছিলেন। অপর একটি ঘর তারকনাথ ভেঙে দিয়েছিলেন।

স্বামী গম্ভীরানন্দর অনবদ্য জীবনকথায় আমরা জানতে পারি, ইংরেজ জজ বলেন, “যুবক তুমি একজন ভাল উকিল হইবে।” বিপক্ষের এটর্নিও তাঁর হাত ধরে বলেন, “আমি জজসায়েবের সঙ্গে সহমত।”

দীর্ঘ শুনানির পরে হাইকোর্টের বিচারপতি ম্যাকফারসনের রায় প্রকাশিত হলো : বিশ্বনাথ প্রবাস থেকে স্ত্রীকে নিয়মিত টাকা পাঠাতেন। সুতরাং তারকনাথ বেনামীতে সম্পত্তি কিনেছিলেন তা প্রমাণ করবার পূর্ণ দায়িত্ব তার স্ত্রীর। জ্ঞানদাসুন্দরী তার স্বামীর কোন হিসেব খাতা আদালতে দাখিল করেননি। বিপদ সাধলো তারকনাথের একটি পুরনো চিঠি, যেখানে এক আত্মীয়কে তিনি লিখছেন, সম্পত্তির প্রকৃত ক্রেতা তিনি নন, ভুবনেশ্বরী। এছাড়া এই সম্পত্তি কলকাতা কালেকটরেটে নথিভুক্ত করার জন্য ভুবনেশ্বরী একবার দেবর তারকনাথকে ওকালতনামা দিয়েছিলেন এবং সে দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।

আপিল মামলার রায়ও যথাসময়ে বেরিয়েছিল ১৮৮৭ সালে চীফ জাস্টিস, জাস্টিস আর্থার উইলসন এবং জাস্টিস রিচার্ড টটেনহ্যাম-এর আপীল কোর্ট ভুবনেশ্বরীর পক্ষে রায় দিলেন। খুড়ির শোচনীয় পরাজয় ১০ নভেম্বর ১৮৮৭।

কিন্তু মামলা কি আর অত সহজে শেষ হয়! আমরা দেখবো এর রেশ গড়ায় বিবেকানন্দর দেহাবসানের মুহূর্ত পর্যন্ত।

*

এর পরের রিপোর্ট স্পষ্টভাবে আঁকার জন্য শঙ্করীপ্রসাদ বসুর রচনা থেকে কিছু ভিক্ষা নেওয়া যাক। স্বামীজি ৬ হাজার টাকা দিয়ে নিজের খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কিনে নেন। মঠ-তহবিল থেকে এর জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার করতে হয়।

কিন্তু স্বামীজি এই ব্যাপারে দারুণভাবে ঠকেন, জানাচ্ছেন শ্রদ্ধেয় গবেষক। ৬ই আগস্ট ১৮৯৯, মিসেস ওলি বুলকে স্বামীজি লেখেন, “দুশ্চিন্তা? সম্প্রতি তা যথেষ্ট। আমার খুড়িকে আপনি দেখেছেন তিনি আমাকে ঠকাবার জন্য তলেতলে চক্রান্ত করেন। তিনি ও তাঁর পক্ষের লাকজন আমাকে বলেন, ৬০০০ টাকায় বাড়ির অংশ বিক্রি করবেন–সেটা আমি সরল বিশ্বাসে ৬০০০ টাকা দিয়ে কিনি। তারপর তারা বাড়ির অধিকার দেবেন না–এই বিশ্বাসে যে আমি সন্ন্যাসী হয়ে, জোর করে বাড়ি দখল নেবার জন্য আদালতে যাব না।”

“এর ফলে মামলা হয়। এবং কয়েক বছর গড়ায়। মামলাতে যথেষ্ট খরচ হয়। স্বামীজির সে খরচের টাকাও মঠ তহবিল থেকে নিতে হয়। পূর্বোক্ত পাঁচ হাজার টাকা এবং এই মামলা খরচের টাকার দুশ্চিন্তা স্বামীজিকে একেবারে অস্থির করে ফেলেছিল। তাঁর ব্যক্তিগত টাকা বলতে সেইসব টাকা, যা তাঁর অনুরাগীরা তাঁর নিজস্ব খরচের জন্য দিতেন, কাজের জন্য নয়; এই সঙ্গে ছিল বই বা প্রবন্ধসূত্রে, কিছুটা লেকচার সূত্রে উপার্জিত অর্থ।” শঙ্করীপ্রসাদ সবাইকে নিশ্চিন্ত করেছেন, “স্বামীজি শেষ পর্যন্ত ধার নেওয়া সব টাকা শোধ করতে পেরেছিলেন।”

বিবেকানন্দ পরিবারের কেউ কেউ লেখার সময় স্মরণে রাখেননি যে বিদেশ থেকে ফেরবার পরে স্বামীজি তার মাকে পৈতৃকবাড়ির অংশ কিনে দিয়েছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ সঙ্গত কারণেই অস্বস্তি বোধ করেছেন। “আমার মনে হয়। স্বামীজি তারকনাথ দত্তর বিধবা বধূকে অর্থসাহায্য করেছিলেন। (যা ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন)–তার শর্ত ছিল, তিনি ভুবনেশ্বরীর প্রাপ্য যে অংশ অন্যায়ভাবে অধিকার করে আছেন, সেটি ফিরিয়ে দেবেন।” সেখানেও তাকে চক্রান্তের শিকার হতে হয়।

সন্ন্যাসীর সাধনা ও যন্ত্রণাকে এক্স-রে করতে গিয়ে মামলা-মোকদ্দমার সাতকাহন গাইতে হলো। কিন্তু এই যন্ত্রণা মানুষের চোখের সামনে থেকে লুকিয়ে রাখলে বিবেকানন্দের বিবেক পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত হয় না।

এর আগে শঙ্করীপ্রসাদ যে সম্পত্তি কেনাবেচার কথা উল্লেখ করেছেন তার বিবরণ স্বামী গম্ভীরানন্দ বিরচিত যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থের ছোট্ট ফুটনোটে ধরা আছে। “অন্য সূত্রে জানা যায়, স্বামীজি ২/১২/১৮৯৮ তারিখে অমৃতলাল দত্ত প্রভৃতির নিকট হইতে ২ গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের এক-চতুর্থাংশ এবং ২৯/১/১৮৯৯ তারিখে গৃহাদি সহ ৩নং-এর জমি বাড়ি বিশ্বেশ্বরী দেবীর নিকট ক্রয় করেন। ২৭/৫/১৮৯৯ তারিখে তিনি উভয় সম্পত্তি স্বীয় জননীকে দান করেন।”

মামলার ছায়া প্রলম্বিত হয়েছে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে (মার্চ ১৯০২) বেনারস থেকে সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখছেন, “ইউরোপ থেকে সামান্য যে টাকা এনেছিলাম তা মায়ের দেনা শোধ এবং সংসার খরচে লেগে গেল। সামান্য যা রয়ে গিয়েছে তাতেও হাত দেবার উপায় নেই, ঝুলে-থাকা মামলার জন্য লাগবে।”

বিরোধের শেষ মীমাংসার একটা সুন্দর ছবি স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপিতে আছে।

স্বামীজি ২৮শে জুন শনিবার ১৯০২ (তাঁর তিরোধানের এক সপ্তাহ বাকি নেই) পারিবারিক মামলাস্থান কলকাতায় গিয়েছিলেন। কয়েকজনকে নিয়ে বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণও খেয়েছিলেন। দেখা করতে শরিক হাবুল (দত্ত) এলো। স্বেচ্ছায় মিটিয়ে নেবার কথা বলল। যদি মীমাংসা হয় তা হলে স্বামীজি আরও হাজার টাকা দেবেন বললেন। তারা রাজি হলো। হাবুলের সঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ পন্টুবাবুর (এটর্নি) অফিসে গেলেন। শর্তাদি জানিয়ে ওঁদের এটর্নি এন সি বসুর কাছে চিঠি পাঠানো হলো। তারা উত্তরে ওঁদের শর্ত স্বীকার করে চিঠি দিলেন।

এতো তীব্রগতিতে একদিনে এইভাবে আইনপাড়ার সাধারণত কাজ হয় না। স্পষ্টই মনে হয়, স্বামীজি আন্দাজ করেছিলেন, অপেক্ষা করবার মতন সময় তার হাতে আর নেই।

মৃত্যুর দুদিন আগে (২রা জুলাই) পন্টুকে শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে চারশো টাকা দেওয়া হলো–হাবুল দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী। সবই পারিবারিক চুক্তি অনুযায়ী করা হয়।

শুধু অর্থ নিয়েই মাতাপুত্রের সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। আমরা শেষ দেখেছি কাশীপুর থেকে মায়ের সঙ্গে নরেন্দ্রনাথ গাড়িতে ফিরছেন, পাশে ছোটভাই এবং মা কাশীপুরে ঠাকুরের কাছে যা শুনেছেন তা বলছেন।

আরও একটি দৃশ্য আছে, ১৬ আগস্ট ১৮৮৬ ঠাকুরের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে কাশীপুর শ্মশান থেকে নরেন বাড়ি ফিরে এলেন এবং জামাকাপড় ধুতে দিলেন। কাপড়ের খুঁটে ঠাকুরের অস্থি বাঁধা ছিল। পরের দিন তিনি মাকে জিজ্ঞেস করলেন, চাঁদরে অস্থি পেয়েছেন কি না। মা বললেন, চাঁদরের কোণে কতকগুলো কয়লার ছাই দেখে ফেলে দিয়েছি। ছেলে বললেন, “হায়! হায়! ওগুলোই তো রামকৃষ্ণের অস্থি।”

মামলা-মোকদ্দমার প্রথম ধাক্কা সামলে দিয়েই নরেন বিরলদৃশ্য হয়েছিলেন এবং সন্ন্যাসী হয়ে ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাড়ির সঙ্গে বিশেষ কোন সম্পর্ক রইলো না, যদিও কলকাতায় থাকলে মাঝে-মাঝে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ১৮৯৭ সালে ইউরোপ থেকে ফেরবার আগে পর্যন্ত বাড়িতে কেউ তাকে গেরুয়া বসনে দেখেন নি।”

*

সত্যিই দুর্ভাগা জননী। তিন পুত্রই ভুবনেশ্বরীকে আমৃত্যু অশেষ বেদনা দিয়েছেন।

বরানগর মঠে ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে জ্যেষ্ঠ পুত্র গুরুতর অসুস্থ বলে অসহায় বিধবা সেখানে ছুটেছিলেন দ্বিতীয় পুত্রকে নিয়ে, কিন্তু নরেনই তখন নিয়ম করে দিয়েছে মঠে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। মাকে আচমকা ঢুকতে দেখে তার কথা, “আমিই নিয়ম করলুম, আর আমার বেলায়ই নিয়ম রদ হল?”

পরিব্রাজক বিবেকানন্দের কোনো খবরাখবর প্রায়ই থাকত না। মাকে লেখা স্বামীজির কোন চিঠি কারও সংগ্রহে নেই।

১৮৯১ সালে বৈশাখ মাসে রবিবারের এক সকালে ভুবনেশ্বরীর কাছে চিঠি এলো যে কন্যা যোগীন্দ্ৰবালা সিমলা পাহাড়ে আত্মহত্যা করেছে। তখন তার বয়স পঁচিশ। শোকাৰ্তমনে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ চললেন বরানগর মঠে খবর দিতে।

যোগেন মহারাজ, বাবুরাম মহারাজ ও গিরিশচন্দ্র ঘোষ সিদ্ধান্ত করলেন স্বামী সারদানন্দের কাছে টেলিগ্রাম করবেন তিনি যাতে নরেনকে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারেন, কারণ ভুবনেশ্বরী তখন অত্যন্ত শোকার্ত। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে শরৎ মহারাজের নামে টেলিগ্রাম করা হল।

রামতনু বসু লেনে ভুবনেশ্বরী তখন অত্যন্ত শোকার্ত হয়ে কাঁদছেন। বাবুরাম মহারাজ নিজেও শোকার্ত হয়ে বসে রইলেন, আর যোগেন মহারাজ জননীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। রাত ৯টায় সময় সন্ন্যাসীরা বাগবাজারে ফিরে গেলেন। যোগীন্দ্রবালার আত্মহত্যা সংবাদ সারদানন্দ মারফত বিবেকানন্দর কাছে আলমোড়ায় পৌঁছেছিল, তিনি প্রবল দুঃখও পেয়েছিলেন।

কিন্তু সংসারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর সে কী বেদনাময় সংগ্রাম।

মহেন্দ্রনাথের বর্ণনায় : টেলিগ্রামের মর্মার্থ শুনে শুরু হলো বুকের মধ্যে দড়ি টানাটানি। শেষে সন্ন্যাসীর জয় হলো। সারদানন্দকে ক্রন্দনরত সন্ন্যাসী বললেন, “তোরাই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে, চিঠি দিয়ে এত গোলমাল বাধাস।.. আমাকে সব সময় তুই বিরক্ত করিস। আমি জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না, তুই কেবল সকলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবি।”

আত্মহত্যার বংশ? বলরামবাবুর বাড়িতে যোগেন মহারাজকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “আমাদের এত বুদ্ধি মেধা কেন জানিস? আমরা যে সুইসাইডের বংশ। আমাদের বংশে অনেকগুলো আত্মহত্যা করেছে… আমাদের পাগলাটে ধাত, হিসেব-নিকেশের ধার ধারে না। যা করবার তা একটা করে দিলুম, লাগে তাক, না লাগে তুক।”

দত্তদের মেধা প্রসঙ্গে আরও একটি সরস ব্যাখ্যা আছে। মেজভাই মহেন্দ্রনাথকে নিরঞ্জন মহারাজ একবার বলেন, “নরেনের এতো বুদ্ধি কেন জানিস?নরেন খুব গুড়ুক যুঁকতে পারে। আরে গুড়ুক না টানলে কি বুদ্ধি বেরোয়…তামাক খেতে শেখ। নরেনের মতন মাথা খুলে যাবে।”

বোনের আত্মহননের শোক সামলে নিয়ে, আবার সব যোগাযোগ ছিন্ন করে অধিকতর দুর্গম গিরিগহ্বরে আশ্রয় নেবার জন্যে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ আচমকা পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

বরানগরে মাঝে মাঝে নরেন্দ্রনাথ ফিরতেন, কিন্তু বলে যেতেন, এই শেষ, আর ফিরছি না। ১৮৯১ থেকে তার একাকী ভ্রমণ। গুরুভ্রাতাদের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক ত্যাগ করেন।

কিন্তু বিবেকবান বিবেকানন্দ কি সত্যই গর্ভধারিণীকে নিষ্ঠুরভাবে মন থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন? না পেরেছিলেন?

সব চেয়ে আশ্চর্য, বিবেকানন্দর সাড়ে পাঁচশোর বেশি চিঠি আমাদের সামনে রয়েছে, কিন্তু একখানা চিঠিও নেই মাকে লেখা। মাও কি কোনোদিন বিলুকে একখানা চিঠি লেখেননি? বিশ্বাস হয় না, ভাবতেও ইচ্ছা করে না। সেসব চিঠি যদি লেখা হয়ে থাকে এবং সেইসব চিঠি খুঁটিয়ে দেখার সৌভাগ্য হলে গর্ভধারিণী ও সন্ন্যাসী সম্বন্ধে গবেষকরা নিশ্চয় আরও অনেক কিছু জানতে পারতেন।

কিন্তু বিবেকানন্দর মানসিকতার নিদর্শন তার অন্য কয়েকটি চিঠিতে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। দেওয়ান হরিদাস দেশাইকে তিনি লিখেছিলেন, “আপনি আমার দুঃখিনী মা ও ছোটভাইদের দেখিতে গিয়াছিলেন জানিয়া সুখী হইয়াছি, কিন্তু আপনি আমার অন্তরের একমাত্র কোমলস্থানটি স্পর্শ করিয়াছেন। আপনার জানা উচিত যে আমি নিষ্ঠুর পশু নই। এই বিপুল সংসারে আমার ভালবাসার পাত্র যদি কেহ থাকেন তবে তিনি আমার মা।.. একদিকে ভারতবর্ষ… লক্ষ লক্ষ নরনারীর দুঃখ.. আর অন্যদিকে আমার যত নিকট আত্মীয়-স্বজন আছে তাহাদিগের দুঃখ দুর্দশার হেতু হওয়া–এই দুইয়ের মধ্যে প্রথমটিকেই আমি ব্রতরূপে গ্রহণ করিয়াছি, বাকি যাহা কিছু প্রভুই সম্পন্ন করিবেন।”

আরেক জায়গায় সন্ন্যাসীর স্বীকারোক্তি : “জননীর নিঃস্বার্থ স্নেহ ও পূতচরিত্র উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হওয়াতেই তিনি সন্ন্যাসজীবনের অধিকারী হইয়াছেন এবং তিনি জীবনে যা কিছু সকার্য করিয়াছেন, সমস্তই সেই জননীর কৃপাপ্রভাবে।”

আমরা আরও দেখেছি, ভুবনেশ্বরী শুধু ছেলেমেয়েদের প্রাথমিক ইংরিজি শিক্ষা দেননি–কেবল লৌকিক শিক্ষা নয়, নৈতিক শিক্ষাও দিয়েছেন। গর্ভধারিণীর মতে, “সংসার সমুদ্রের নানা আবর্তে পড়ে নৈতিক জীবনকে অবহেলা করা অত্যন্ত দূষণীয়।”

পরিব্রাজক জীবনে মায়ের চিন্তা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারেননি স্বামীজি। “মাদ্রাজে যখন মন্মথবাবুর বাড়িতে ছিলুম, তখন একদিন স্বপ্ন দেখলুম, মা মারা গেছেন! মনটা ভারি খারাপ হয়ে গেল। তখন মঠেও বড় একটা চিঠিপত্র লিখতুম না–তা বাড়িতে লেখা তো দূরের কথা। মন্মথবাবুকে স্বপ্নের কথা বলায় তিনি তখনই ঐ বিষয়ের সংবাদের জন্য কলকাতায় তার করলেন।…মাদ্রাজের বন্ধুগণ তখন আমার আমেরিকায় যাবার যোগাড় করে তাড়া লাগাচ্ছিল; কিন্তু মায়ের কুশল সংবাদটা না পেয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমার ভাব বুঝে মন্মথবাবু বললেন, শহরের কিছু দূরে একজন পিশাচসিদ্ধ লোক বসবাস করে, সে জীবের শুভাশুভ ভূত-ভবিষ্যৎ সব খবর দিতে পারে…’পিশাচসিদ্ধ’ মায়ের মঙ্গল সমাচার বললে। ধর্মপ্রচার করতে আমাকে যে বহুদূরে অতি শীঘ্র যেতে হবে তাও বলে দিলে!”

পরিব্রাজকপর্বে স্বামীজি একবার সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেছিলেন। মীরাট থেকে গুরুভাইদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পরে অনেকদিন তার খবর নেই।

শেষে একখানা চিঠি এল বরানগরে, কিন্তু নাম লেখা নেই। বরানগরের হাতকাটা হাবুর বাড়িতে একটা ওষুধ পাওয়া যেত–ওইটা পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। ওই চিঠি মধ্যমভ্রাতা মহিমকে দেখানো হলো। তিনি বললেন, নাম না থাকলেও দাদার চিঠি সন্দেহ নেই।

কয়েক বছর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের কোনো খবরই ছিল না। কেবলমাত্র জয়পুর থেকে একখানা চিঠি এসেছিল–তাতেও নাম লেখা নেই। পরে খেতড়ির রাজা অজিত সিং চিঠি দিতে লাগলেন। চিঠি বন্ধের আগে যে কয়েকখানি চিঠি এসেছিল তাতে স্বামীজির মনের ভাব যে অতি বিষণ্ণ তার প্রকাশ ছিল।

মহিমবাবু উল্লিখিত স্বামীজির একটি চিঠি বড়ই হৃদয়গ্রাহী : “ভগবান তো পেলাম না, অনেক চেষ্টা করলাম, তাতেও কিছু বুঝতে পারলাম না, এতে বুকের ভালবাসাটা বেড়ে গেছে, সকলের উপর একটা ভালবাসা এসেছে।”

*

মায়ের প্রতি, সংসারের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে স্বামীজি তার কর্তব্য পালন কীভাবে করেছিলেন, অথবা আদৌ করতে সক্ষম হননি তা এখনও ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গিয়েছে।

নতুন অধ্যায়ের শুরু হলো ১৮৯১ সালে। ওই বছর ৪ জুন বৃহস্পতিবার খেতড়ি নরেশ অজিত সিংজী ৬-৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠলেন, সন্ধ্যায় যোধপুরের মহারাজ প্রতাপ সিং-এর সঙ্গে আধঘণ্টা কাটালেন, তারপর এক সন্ন্যাসী এলেন তিনি বাংলা, ইংরিজি ও সংস্কৃত : ভাষায় পারঙ্গম।নানা বিষয়ে আলাপ করে রাত এগারোটায় স্বামীজি বিদায় নিলেন। সন্ন্যাসীকে আহারও দেওয়া হয়েছিল।…

এই হচ্ছে পরিচয়ের প্রথম পর্ব। বলাবাহুল্য স্বামীজি খেতড়ি মহারাজের হৃদয় জয় করলেন। নিঃসন্দেহে বলা যায়, মহারাজও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর হৃদয়স্পর্শ করলেন। স্বামীজি প্রথমবারে খেতড়িতে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত ছিলেন–পরিব্রাজক জীবনের দীর্ঘতম অবস্থান–প্রায় পাঁচ মাস। মনে রাখা প্রয়োজন, স্বামী প্রভানন্দের হিসাব অনুযায়ী স্বামীজি তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠে মাত্র ১৭৮ দিন অবস্থান করেছিলেন।

এরপরেও তিনি দুবার খেতড়িতে এসেছেন, একবার আমেরিকা যাবার আগে এবং আরেকবার পাশ্চাত্যদেশ থেকে ফিরে।

খেতড়িতে থাকার কোনো একসময়ে মহারাজ অজিত সিং শ্রদ্ধেয় স্বামীজির পারিবারিক দায়িত্বর কথা শুনে তাঁকে চিন্তামুক্ত করতে মনস্থ করেন।

মহেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন : “খেতড়ির মহারাজা, শরৎ মহারাজের, যোগেন মহারাজের, সান্ডেলমশায়ের মারফৎ স্বামীজির মাতাঠাকুরাণীকে মাসে একশত টাকা পাঠাইয়া দিতেন এবং বিশেষ করিয়া বলিয়া দিয়াছিলেন যে, এসকল কথা যেন অপরে না জানিতে পারে।”

খেতড়ির মহাফেজখানায় ইদানীং যেসব চিঠির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, অন্তত ১৮৯২ থেকে স্বামীজির পরিবারের সঙ্গে মহারাজের পত্রালাপ চলছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ তারিখে ৭ রামতনু বোস লেন থেকে মহেন্দ্রনাথের চিঠি : “বহুদিন পত্র না পাইয়া বিশেষ চিন্তিত আছি।… প্রায় পনেরো দিন পূর্বে দাদার খবর পাইয়াছি। তিনি এখন মাদ্রাজে।”

২২ মার্চ ১৮৯৩-এর চিঠিতে মহেন্দ্রনাথ খেতড়ি মহারাজকে তার সম্প্রতিপঠিত পুস্তকের তালিকা দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সম্বন্ধে জানাচ্ছেন, “কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে শহরের অন্যতম বিদ্যালয় মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনে পাঠাইয়াছি। সে ভালই লেখাপড়া করিতেছে।…দাদার খবর পাইলাম। তিনি এখন মাদ্রাজে এসিসট্যান্ট কট্রোলার অফ মাদরাজ শ্ৰীমন্মথনাথ ভট্টাচার্যের গৃহে আছে।”

যাঁদের ধারণা, স্বামীজির দ্বিতীয়বার খেতড়ি ভ্রমণের সময় (এপ্রিল ১৮৯৩) পারিবারিক সাহায্যের কথা হয়, তা ঠিক নাও হতে পারে। ২১শে এপ্রিল থেকে ১০ মে স্বামীজি তিন সপ্তাহকাল খেতড়িতে ছিলেন।

বিদেশযাত্রার ব্যাপারে খেতড়ির অসামান্য অবদানের কথা এখন আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমরা কেবল সন্ধান করছি মায়ের দুঃখ অপনোদনে স্বামীজির প্রচেষ্টার বিবরণ।

বেণীশঙ্কর শর্মা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “যাহা কিছু পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাহাই নিন্দনীয় বা বর্জনীয় এমন মনোভাব তাঁহার ছিল না। মাতৃভক্তিকে তিনি সন্ন্যাসের বেদীমূলে বলি দেন নাই। বরং দেখি, মাতার জন্য তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নেতৃত্ব, যশ, সব কিছুই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।”

বেণীশঙ্কর শর্মার মতে, “স্বামীজিকে আমেরিকা পাঠাইবার যে ব্যয়বহুল সংকল্প মহারাজা গ্রহণ করেন, তাহার মধ্যে স্বামীজির মাতা ও ভ্রাতাদের জন্য মাসিক একশত টাকা ব্যয় বরাদ্দ অন্তর্ভুক্ত ছিল বলিয়া মনে হয়। মহারাজ মনে ভাবিয়া থাকিতে পারেন, স্বামীজিকে মাতা ও ভ্রাতা সম্পর্কিত দুশ্চিন্তা হইতে মুক্ত রাখিয়া বিদেশে পাঠানোই তাহার কর্তব্য।”

আমেরিকা যাত্রার দুদিন পর, ২ জুন ১৮৯৩, মহেন্দ্রনাথ মাতুলালয় থেকে লেখেন : “গত ৩১ মে তারিখে আপনার অনুগ্রহপত্র ও পঞ্চাশ টাকা পাইয়া কৃতার্থ হইয়াছি। আপনার পত্রের মর্ম স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে, আমার মাতা ও মাতামহীকে পাঠ করিয়া শুনাইয়াছি..আমার মাতা ও মাতামহী দাদার পৃথিবী পরিভ্রমণে সম্মতি জানাইতেছেন।…”

১৩ জুন ১৮৯৩ খেতড়িনরেশকে মহেন্দ্রনাথের আবার পত্রাঘাত। “অবগত হইলাম যে দাদা বর্মা গিয়াছেন। তথা হইতে চীন বা অন্যত্র কোথাও যাইবেন।…আমার মাতা ও মাতামহী আপনার ন্যায় মহানুভবের পরিবারবর্গকে আন্তরিক আশীর্বাদ জানাইতেছেন।”

একই দিনে খেতড়ির মহারাজাকে রামকৃষ্ণানন্দের চিঠি–”মহেন্দ্রনাথ আপনার প্রেরিত একশত টাকা পাইয়াছে।”

২০শে জুলাই ১৮৯৩ স্বামী শিবানন্দ এক চিঠিতে স্বামীজির পরিবারকে সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে মহারাজকে প্রশ্ন করেছেন, “কানাঘুষা শুনিতেছি, বিবেকানন্দ ইংলন্ড অভিমুখে যাত্রা করিয়াছে। যদি তাই হয়, আপনি কি তাহার ইংলন্ডের ঠিকানা জানেন?”

পারিবারিক সাহায্যের ব্যাপারটা এতই গোপন রাখা হয়েছিল যে প্রথম পর্বে মুন্সী জগমোহনলালও ব্যাপারটা জানতেন না। তখনকার দিনে রাজস্থান থেকে বাংলায় টাকা পাঠাবার পদ্ধতি সম্বন্ধে একটা মজার ধারণা পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথকে লেখা জগমোহনলালের ৬ জুলাই ১৮৯৩-এর চিঠি থেকে। “আমি মহামহিমান্বিত খেতড়ি মহারাজের অধীনস্থ কর্মচারি এবং আপনাদের পরিবারের যাবতীয় বিষয় তিনি বিশ্বাসযোগ্য বিবেচনায় আমাকে গোপনে জানাইয়াছেন..মহারাজের ইচ্ছানুযায়ী v/41 62743 নম্বর সম্বলিত একশত টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ আপনাদের সংসার খরচের জন্য পাঠাইলাম। আপনার প্রাপ্তিপত্র পাইলে দ্বিতীয়াংশ পাঠাইব।”

৩১শে জুলাই ১৮৯৩ কলকাতা থেকে জগমোহনলালজীকে মহেন্দ্রনাথের উত্তর : “প্রীত হইলাম যে আপনি দাদাকে খেতড়ি হইতে মাদ্রাজ এবং তথা হইতে বোম্বাইয়ে স্টীমার পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। কলিকাতায় তাঁহার সম্বন্ধে কোন সংবাদ পাওয়া যাইতেছেনা।…গত তিন মাস দাদা বাংলাদেশের কোন বন্ধুকেই কোন পত্ৰই দেন নাই।…আপনি আমার পাঠসংক্রান্ত খবর লইয়াছেন। আমি আপনাকে সানন্দে জানাইতেছি যে এযাবৎ আমি ভালভাবে লেখাপড়া করিয়াছি, ক্লাসের সহিত সমান তালে চলিতেছি এবং আমার অধ্যাপকগণ প্রীত আছেন।..”

“পুনশ্চ : একশত টাকার কারেন্সি নোটের অর্ধাংশ পাইয়াছি। ভবিষ্যতে এইরূপ কারেন্সি নোট পাঠাইলে দয়া করিয়া রেজেস্ট্রি যোগে পাঠাইবেন। কেননা পোস্টাপিসের লোকেরা সন্দেহক্ৰমে চোখ রাখিয়াছে এবং হয়তো খাম খুলিয়া নিজেরাই আত্মসাৎ করিবে, এইরূপ ইঙ্গিতও তাহারা দিয়াছে।”

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ খেতড়িকে চিঠি লিখতেন বৈকুণ্ঠনাথ সান্যালের সরকারি অফিসের ঠিকানা থেকে। ১০ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪ তিনি খেতড়ির জগমোহনলালজীকে জানাচ্ছেন, “অনেকদিন পর আমাদের শ্রদ্ধেয় ভাই বিবেকানন্দর পত্র পাইয়াছি। তিনি এখন চিকাগোয় আছেন এবং ভাল আছেন।… কয়েকদিন পূর্বে মহেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিয়াছি। সে, তাহার মাতা, ছোট ভাই সকলে কুশলে আছে। সে এখন লেখাপড়া লইয়া বিশেষ ব্যস্ত, প্রতিদিন একটি করিয়া পাঠ্য পুনর্পাঠ করিতেছে। আগামী মাসের ২৬ তারিখে তাহার পরীক্ষা। স্বামীজির আত্মীয়বর্গের অভাব মোচনের ভার যখন মহারাজ লইয়াছেন তখন আমার আর উক্ত বিষয়ে কোনরূপ চিন্তা করা সাজে না; কি কর্তব্য তিনিই ভাল জানেন।”

সম্প্রতি বিভিন্ন পরীক্ষায় মহেন্দ্রনাথের ফলাফল ও সার্টিফিকেট দেখার সৌভাগ্য হয়। এনট্রান্সে (১৮৮৮-৮৯) প্রথম শ্রেণী পেলেও, এফ এ এবং বি এতে তিনি থার্ড ডিভিশন। বি এতে তৃতীয় শ্রেণী পেয়ে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যেতে সেযুগেও দুঃসাহসের প্রয়োজন হতো।

উনিশ শতকের শেষ দশকে মাসিক একশ টাকার নিয়মিত ব্যবস্থা নিতান্ত ছোট ব্যাপার নয়। তখন কলকাতায় শিক্ষিত কেরানির মাইনে তো ১৫ টাকা। যাঁরা মাসে পঞ্চাশ টাকা পান তারা দোলদুর্গোৎসব করতেন। কেউ কেউ বলেন, এই একশ টাকা আজকের দশহাজার টাকা, কেউ বলেন কুড়ি হাজার টাকা। গুরুর পরিবারের প্রতি একজন ভক্তের এই বদান্যতা সত্যিই স্মরণে রাখার মতন। কারণ বাঙালিরা পরবর্তীকালেও রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের ভক্ত হলেও কখনও তারা উদারহস্ত হননি। মনে রাখা প্রয়োজন, টাইটেল মহারাজা হলেও, খেতড়ি এমন কিছু বড় আকারের রাজ্য ছিল না। আরও মনে রাখা দরকার, মামলামোকদ্দমার রাহু সারাক্ষণ পিছনে লেগে থাকলে সেই সন্তাগণ্ডার যুগেও একশ টাকার মাসিক ব্যবস্থা কোনো সমস্যার অবসান ঘটায় না।

আরও একটি লক্ষ্য করবার বিষয় রয়েছে–দানের গোপনীয়তা। মহারাজ অজিত সিং চাননি তাঁর সাহায্যর কথা প্রকাশিত হোক। এই সাহায্যপর্বের শুরু ১৮৯১ সালে, কিন্তু খবরটা প্রকাশিত হল আরও আটদশক পরে যখন দত্ত পরিবারের নায়ক-নায়িকাদের কেউ ইহজগতে নেই। ভুবনেশ্বরীর জীবনাবসান ১৯১১, দিদি স্বর্ণবালার ১৯৩২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি, মহেন্দ্রনাথের ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ এবং কনিষ্ঠ ভূপেন্দ্রনাথের ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬১। যদিও স্বামীজি প্রকাশ্যে খেতড়ির ঋণ স্বীকার করে বিদেশ থেকে ফিরে (১৭ ডিসেম্বর ১৮৯৭) বলেছিলেন, “ভারতের উন্নতির জন্য সামান্য যা কিছু আমি করতে পেরেছি খেতড়ি রাজের সঙ্গে পরিচয় না হলে তা আমার পক্ষে সম্ভব হত না।”

খেতড়ি রাজের ওপর স্বামীজির নির্ভরতার আরও কিছু কথা এখনও বাকি আছে। স্বামীজির জীবনসায়াহ্নের সেই মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলি গর্ভধারিণী প্রসঙ্গে যথা সময়ে এসে পড়বে।

কিন্তু তার আগে আমেরিকা ও ইউরোপে গিয়েও স্বামীজির মাতৃচিন্তার কিছু খবর নেওয়া মন্দ হবে না।

*

মার্কিনমুলুকের প্রথম পর্বে মাতৃপ্রেমী বিবেকানন্দ অবাক হলেন, ছেলেরা তাদের মাকে নাম ধরে ডাকছে। আরও অবাক হলেন যখন দেখলেন, মা সম্বোধন করলে মার্কিন মহিলারা আঁতকে ওঠেন। প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে ব্যাপারটা মাথায় ঢুকলো, মা ডাকটা মেনে নেওয়া মানেই তো স্বীকার করে নেওয়া যে যথেষ্ট বয়স হয়েছে!

আমেরিকায় সুযোগ পেলেই পরিচিত মহলে তিনি গর্ভধারিণী মায়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন। ছোটবেলায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের কাছে যেসব গল্প-কবিতা শুনেছেন তা হড়হড় করে বলে যেতেন। তাঁর স্মৃতিশক্তির উল্লেখ হলেই বলতেন, “হ্যাঁ, আমার মায়েরও ঐ ধরনের স্মৃতিশক্তি আছে। একবার রামায়ণ শুনলে তিনি গড়গড় করে বলে যেতে পারেন।”

স্বামীজির স্মরণে ছিল, তার মায়ের কণ্ঠস্বর খুব মিষ্টি। কৃষ্ণযাত্রার গান তিনি আপনমনে গাইতেন। দুপুরে কয়েক ঘণ্টা এবং রাত্রে কয়েক ঘণ্টা সেই বিদ্যুৎবিহীন যুগে নিত্যপাঠ করতেন।

আর জননীর শেষবয়সের দেহবর্ণনাও তত রয়েছে। তার শরীরের গঠন ছিল বলিষ্ঠ, চোখ দুটি বৃহৎ ও আয়ত–চলতিভাষায় পটলচেরা চোখ। তার মধ্যে সবল, দৃঢ়চিত্ত ও তেজস্বিতার ভাব যেন ঠিকরে বের হতো।” দেখে মনে হতো এমন মায়েরই স্বামীজির মত ছেলে হওয়া সম্ভব। তিনভায়েই কতকটা মায়ের মুখাকৃতি পেয়েছিলেন।

মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “স্বামীজির চোখদুটি মায়েরই অনুরূপ–তবে তার চোখে যে কি ছিল তা মুখে বলা যায় না।”

মায়ের ছিল আত্মশক্তি। চরম বিপদেও এই আত্মশক্তির আগুন তিনি নিভতে দেননি। এবিষয়ে বিবেকানন্দর উক্তি অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে রাখা ভাল। “জগতের ইতিহাস হচ্ছে কতকগুলি আত্মশক্তিতে বিশ্বাসবান লোকের ইতিহাস।… যে মুহূর্তে একটা মানুষ বা একটা জাত নিজের উপর বিশ্বাস হারায় সেই মুহূর্তে সে মরে।”

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের কারাবাসের সময় (স্বামীজির মৃত্যুর পরে) কলকাতার কয়েকজন বিশিষ্ট মহিলা স্যর নীলরতন সরকারের বাড়িতে বীরজননীকে ডেকে একটি মানপত্র দেন। স্থান ৬১ হ্যারিসন রোড, তারিখ ২৪ শ্রাবণ ১৩১৪।

মুক্তিলাভের পর ভূপেন্দ্র মাকে বলেছিলেন, “বিবেকানন্দর মা হয়ে তুমি কোন স্বীকৃতি পেলে না, কিন্তু আমার মা হয়ে তুমি জন-সম্বর্ধনা লাভ করেছ।”

ভূপেন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করছেন, হাসতে হাসতে বলেছিলাম। কারণ বিদেশে স্বামীজির মুখে মুখে মায়ের কথা প্রচারিত হয়েছিল। ১৮৯৪ খ্রষ্টাব্দে বোস্টনে স্বামীজি ‘মাই মাদার’ নামে এক উদ্দীপনাময়ী বক্তৃতা দেন। ডিভাইন মাদার। হিউম্যান মাদার কি করে আসছে, সেটি তিনি সেদিন বলছিলেন। বক্তৃতা শুনে বিদুষী শ্রোতৃবৃন্দ এতদূর মোহিত হয়েছিলেন যে বড়দিনের সময় তারা স্বামীজির অজ্ঞাতসারে মেরী-অঙ্ক সুশোভিত বালক খ্রীস্টের একটি সুন্দর চিত্রের সহিত একখানি পত্র দিয়া স্বামীজির জননীর নিকট প্রেরণ করেন। সেই পত্রে স্বামীজি ভগবান যীশুখ্রীস্টের সদৃশ এই ভাবটি প্রকাশিত হইয়াছিল।”

“আজ মেরীপুত্র ভগবান যীশুর জন্মদিন।…এই শুভক্ষণে আমরা আপনাকে অভিনন্দিত করিতেছি, কারণ আপনার পুত্র এক্ষণে আমাদিগের মধ্যে অবস্থান করিতেছেন। কয়েকদিন পূর্বে তিনি বলেন যে ওখানকার আবালবৃদ্ধবনিতার কল্যাণার্থ তিনি যাহা কিছু করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহা কেবল আপনার শ্রীচরণাশীর্বাদে।…হে পুণ্যচরিতে, আপনার জীবনের কার্যসমূহ আপনার সন্তানের চরিত্রে প্রতিফলিত। সেই মহৎ কার্যের মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করিয়া আমরা আপনার প্রতি আমাদের হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করিতেছি।”

কিন্তু শুধু মাতৃস্তুতি নয়, মায়ের মতামতের ওপর স্বামীজির কতখানি নির্ভরতা ছিল তা স্পষ্ট হয় যখন প্রতাপ মজুমদার মার্কিন দেশে তার চারিত্রিক নিন্দে শুরু করেন–”ও কেউ নয়, ঠগ, জোচ্চোর, ও তোমাদের দেশে এসে বলে–আমি ফকীর।”

এই সময়ে স্বামীজির একটি করুণ চিঠি: “আমার বুড়ী-মা এখনও বেঁচে আছেন, সারাজীবন তিনি অসীম কষ্ট পেয়েছেন, সেসব সত্ত্বেও মানুষ আর ভগবানের সেবায় আমাকে উৎসর্গ করার বেদনা তিনি সহ্য করেছেন। কিন্তু তার সবচেয়ে ভালবাসা যে ছেলেটিকে তিনি দান করেছে, সে দূরদেশে গিয়ে কলকাতার মজুমদার যেমন রটাচ্ছে–জঘন্য নোংরা জীবনযাপন করছে, এ সংবাদ তাকে একেবারে শেষ করে দেবে।”

সৌভাগ্যের বিষয় একই সময়ে মার্কিনী মহিলারা আমেরিকা থেকে ভুবনেশ্বরী দেবীকে স্বামীজির অজান্তে জানান : “এখানকার আবাল-বৃদ্ধ বনিতার কল্যাণার্থে তিনি যাহা কিছু করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহা কেবল আপনার শ্রীচরণাশীর্বাদে”।

আরও কয়েকবছর পরে বিদেশের মাটিতে স্বামীজি সমস্ত হৃদয় ঢেলে দিয়ে অপূর্ব ও স্বার্থশূন্য, সর্বংসহা, নিত্য ক্ষমাশীলা জননী’র প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।”ধন্য আমাদের জননী! যদি মায়ের পূর্বে আমাদের মৃত্যু হয়, তাহা হইলে মায়ের কোলেই মাথা রাখিয়া আমরা মরিতে চাই।..আমাকে পৃথিবীতে আনিবার জন্য তিনি তপস্বিনী হইয়াছিলেন। আমি জন্মাইব বলিয়া তিনি বৎসরের পর বৎসর তাহার শরীর-মন, আহার পরিচ্ছদ, চিন্তা কল্পনা পবিত্র রাখিয়াছিলেন। এই জন্যই তিনি পূজনীয়া।”

মার্কিন দেশে প্রথম পর্বে মায়ের সঙ্গে স্বামীজির কী ধরনের ভাবের আদান-প্রদান ছিল তা আজও খুব স্পষ্ট নয়।

ইংলন্ডে ১৮৯৬ সালে আমরা আবার স্বামীজির অনেক পারিবারিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। পূর্বপর্বে আমরা জানি, তার প্রাণাধিক প্রিয় গুরুভাইরা স্বামীজির অনুরোধের ওপর গভীর গুরুত্ব দিয়ে তার পরিবারের সবরকম সমস্যা সামলাচ্ছেন। একমাত্র বিবেকানন্দর মতন মহামানবের পক্ষেই পূর্বাশ্রম ও সন্ন্যাসপর্বের দায়দায়িত্ব এমনভাবে পালন করা সম্ভব।

*

এবার কেন্দ্র লন্ডন। লন্ডন থেকে মিসেস ওলি বুলকে স্বামী বিবেকানন্দ ৫ জুন ১৮৯৬ জানাচ্ছেন, “আমার ভাই মহিন গত দু’মাস ধরে লন্ডনে রয়েছে, সে ব্যারিস্টার হতে চায়।”

মহেন্দ্রনাথের রচনা থেকে আমরা জানি, “শরত্মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসে কলকাতা থেকে জাহাজে লন্ডনে যান। শরৎ মহারাজ কলিকাতা পরিত্যাগ করিবার এক সপ্তাহ পরে বর্তমান লেখক আইন অধ্যয়ন করবার জন্য লন্ডনে গমন করেন।”

এই বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে স্বামীজির সাহায্য বা সমর্থন কতখানি ছিল তা আজও অস্পষ্ট। যদিও মহিমবাবু লিখেছেন, “স্বামীজি বাচস্পত্য অভিধান চাহিয়া পাঠাইয়াছিলেন, সেইজন্য সকলে মিলিয়া ১০০ টাকা দিয়া অভিধানটি ক্রয় করিয়া বর্তমান লেখকের সহিত পাঠাইয়া দিয়াছিলেন।”

লন্ডনে স্বামীজি তখন নিজের জীবনযুদ্ধ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। তার ওপর বিদেশে পদে পদে ভাইয়ের উপস্থিতি যে নানা অপ্রীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছিল তা এখন আমাদের জানা হয়ে গিয়েছে। আমাদের একমাত্র আনন্দ, মহেন্দ্রনাথ এইভাবে লন্ডনে হাজির হয়ে বিবেকানন্দর সমস্যা বাড়ালেও, তিনি না গেলে আমরা ‘লন্ডনে বিবেকানন্দ’ নামে তিন খণ্ডের অসামান্য গ্রন্থ থেকে বঞ্চিত হতাম।

আমরা জানি, বহুবৎসর পরে স্বামীজিকে দেখে মেজভাই মহিমের ভাইকে চিনতে একটু বিলম্ব হয়েছিল।

‘বিবেকানন্দ ইন দ্য ওয়েস্ট’ গ্রন্থের নমস্যা লেখিকা মেরি লুইস বার্ক স্বামীজির কয়েকটি চিঠির সবকটি লাইন পুনরুদ্ধার করে প্রবাসী সন্ন্যাসীর তখনকার ছবিটি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এর আগে আমেরিকা থেকে স্বামীজি একবার ইংলন্ডে গিয়েছিলেন। এটি দ্বিতীয়বার। স্বামীজি তাঁর ভাইকে দেখে আহ্লাদ করে একটি সোনার কলম দিয়েছিলেন। এই কলম মহেন্দ্রনাথ আবার ছোটভাইকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু ডাকওয়ালাদের হাত থেকে তা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছয়নি। প্রথম সাক্ষাতের পর, পকেট থেকে পাঁচপাউন্ড দিয়ে ভক্ত কৃষ্ণ মেননের সঙ্গে নিজের ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন।

আরেকদিন দুপুরবেলায় ভাইয়ের ঘরে ঢুকে স্বামীজি পরামর্শ দিলেন, আঙুলগুলো সবসময় পরিচ্ছন্ন রাখবে, নখে যেন ময়লা না থাকে। বড় নখ হলে কেটে ফেলবে। আমার জামার পকেটে নখ কাটবার অনেকরকম যন্ত্র আছে। সর্বদা ফিটফাট থাকবে, নইলে লোকে ঘৃণা করবে।

মিসেস বুলকে স্বামীজি তার ভাই সম্বন্ধে লিখলেন, “আমি চাই সে ইলেকট্রিসিয়ান হোক। আমার ইচ্ছে সে আমেরিকায় গিয়ে কোনো ভাল ইলেকট্রিসিয়ানের অধীনে কাজ করে। খেতড়ির রাজা তাকে কিছু টাকা পাঠাবেন। আমার কাছে যে ৩০০ পাউন্ড আছে তার পুরোটাই আমি তাকে দিতে পারি। আপনি আমাকে বছরে যে ১০০ ডলার দিতে চেয়েছেন সেটা আমি নেব না।” এরপরেই ভাইয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন!”প্রত্যেক পনেরোদিন অন্তর তার জঙ্গল জ্বর’ হচ্ছে। ছেলেটি খুব ভাল।”

খ্যাতনামা শিল্পী নন্দলাল বসুর সঙ্গে পরবর্তীকালে মহিমবাবুর আন্তরিক যোগাযোগ হয়েছিল। তার স্মৃতিচারণ : “মহিমের বিলেত যাওয়ায় স্বামীজি খুশি হননি। সম্ভবত পয়সাকড়ির অভাবের জন্য। মহিমবাবু লন্ডনে বছর দেড়-দুই ছিলেন…খানিকটা অভিমান করে আর হাতে বেশি পয়সা না থাকার জন্যে মহিমবাবু বিলেত থেকে সোজা হেঁটে এদেশে ফিরে আসার মনস্থ করলেন।..সব রাস্তাটাই পায়ে হেঁটে হেঁটে…য়ুরোপের নানান দেশের ভেতর দিয়ে গিয়ে উত্তর আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়া, গ্রীস, ইরান, সিরিয়া, রাশিয়া, বুলগেরিয়া হয়ে…পাঁচ বছর ধরে দেশ পর্যটন করে ১৯০২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরলেন।” . মনে রাখা প্রয়োজন, বিলেতে যখন দুই ভাইয়ের দেখা হয় তখন স্বামীজির বয়স ৩৩, মহিমের ২৬, সারদানন্দের ৩০, দ্রুতলেখক গুডইনের ২৫ এবং অপর সঙ্গী জন ফক্সের ২৩। মহিম অকস্মাৎ উধাও হয়ে বিশ্বপরিভ্রমণে বেরুবার পরেও এই ফক্সের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। জেনে রাখা ভাল, উদাসী পথিক হয়ে বেরিয়ে পড়বার পরে প্রায় ছ’বছর মহিম তার মাকে একখানাও চিঠি লেখেননি।

পরের বছর মিস্ ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে বিবেকানন্দ অনুরাগী মিস্টার স্টার্ডি জানাচ্ছেন, “মহিমের ব্যাপার জানি না, সে একেবারে উধাও হয়েছে, কোনো ঠিকানা রেখে যায়নি। আমি তার চিঠিপত্তর পোস্টাপিসে ফেরত দিয়েছি।”

শোনা যায় লন্ডনে ভাইকে নিয়ে স্বামীজির বেশ কিছু অসুবিধা হয়েছিল। মহিম ইলেকট্রিসিয়ান হতে আগ্রহী নন। বিবেকানন্দর খুবই ক্ষোভ মিস মুলার তার ভাইকে জ্বর অবস্থায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৮৯৬ সালের শরৎকালে লন্ডনে মহিম একের পর এক লজিং হাউস পাল্টাচ্ছেন এবং তেমন কিছুই করছে না।

স্বামীজির ক্ষিপ্রলিপিকার জে জে গুডউইন সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মহেন্দ্রনাথ নিজেই পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, সারদানন্দ ও গুডউইনের সঙ্গে ভাইকেও স্বামীজি একই সঙ্গে আমেরিকায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। “লন্ডন অপেক্ষা নিউ ইয়র্কে অনেক কিছু শিক্ষা করিবার বিষয় আছে।” আমেরিকাতে ইলেকট্রিসিটির কলকজা ও নানা প্রক্রিয়া লক্ষ্য করিয়া তিনি আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলেন।মহেন্দ্রনাথের ভাষায় “গুডউইনবর্তমান লেখককে আমেরিকাতে সাথী করিবার জন্য কয়েকদিন বিস্তর চেষ্টা করিয়াছিলেন। কখনও মিষ্টি কথায়, কখনও গালাগালি দিয়ে, কখনও বা হাস্যকৌতুকে নানাভাব উহার মত বদল করাইতে চেষ্টা করিলেন। স্বামীজির বাচনভঙ্গী অনুকরণ করে গুডউইন কথা বলেছিলেন।”গুডউইন তখন সিংহের সরব গর্জন করিয়া, ঘুসি পাকাইয়া বর্তমান লেখককে বলিতে লাগিলেন, মারব ঘুসি, দাঁত ভেঙে দেব, নাক ভেঙে দেব, চ আমেরিকায়।” অভিমানী মহিম দাদার কাছ থেকে কলকাতায় ফেরত আসবার জাহাজভাড়া না চেয়ে পরিব্রাজক হিসেবে বেরিয়ে পড়েন এবং বহু দেশ ঘুরতে ঘুরতে দেশে ফেরেন।

খেতড়ির কাছে লন্ডন থেকে লেখা চিঠিতে (১৩.১.১৮৯৯) এক সাহায্যপ্রার্থী বাঙালি (অক্ষয়কুমার ঘোষ) জানান, “আপনি মহিনের জন্য যে ত্রিশ পাউন্ড পাঠাইয়াছিলেন তাহা মিঃ স্টার্ডির কাছে রাখা আছে। গত উনিশ মাস মহিনের কোন খবর নাই।”

কলকাতা থেকে ৭ই জুলাই ১৮৯৮ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত খেতড়ির জগমোহনলালকে জানাচ্ছেন, “বহুদিন আপনার সহিত পত্রালাপ করি নাই। আমি সংবাদ পাইয়াছি আমাদের অগ্রজ এখন তুর্কীতে, তথা হইতে তিনি পারস্য, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া হইয়া চীনের প্রাচীর পর্যন্ত যাবেন। এই খবর তিনি মিঃ ট নামক এক আমেরিকানকে এবং তাহার মারফত আমরা পাই।”

সন্ন্যাসী হয়েও সংসারের নানাবিধ সমস্যা থেকে মুক্তি ছিল না বিবেকানন্দর। কিছুদিন পরে ফক্সকে স্বামীজি জানাচ্ছেন: “দয়া করে মহিনকে লিখবেন, সে যা করছে তাতে আমার আশীর্বাদ থাকবে। আমি অ্যাডভেঞ্চার ভালবাসি। একমাত্র কথা, আমার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে, বেশিদিন বাঁচবো বলে আশা করি না, মহিনকে যে করেই হোক মায়ের এবং পরিবারের হাল ধরতে হবে। আমার যে কোন সময়ে মৃত্যু হতে পারে। আমি এখন তাকে খুব পছন্দ করি।”

এই চিঠিতে লন্ডনপর্বের কিছু অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতার ইঙ্গিত আছে, যদিও মহেন্দ্রনাথের সারাজীবনের সমস্ত রচনায় দাদার প্রতি গভীর ভালবাসা ও শ্রদ্ধার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু যে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রবাসে অপরের দয়ার ওপর নির্ভরশীল বিবেকানন্দ তার ভাইকে স্নেহপ্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা, ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

পরবর্তী একসময়ে বিরক্তিতে ফেটে পড়ে বিবেকানন্দ ইংলন্ডের স্টার্ডিকে তীব্র পত্রাঘাত করেছিলেন। মিস মুলারের অভিযোগ ছিল, সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ পারিবারিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েন। স্টার্ডিকে বিবেকানন্দ লেখেন : “সেন্ট জর্জেস রোডের বাড়ির দায়িত্বে ছিলে তুমি এবং মিস মুলার। আমার ভাই অসুস্থ মিস্ মুলার তাকে বাড়ি থেকে বার করে দিলেন।…তুমি আমাকে কাজের জন্যে যে পয়সা দিয়েছে তার প্রতিটি কড়ি ঠিক জায়গায় রয়েছে। তোমাদের চোখের সামনে আমি আমার ভাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি–বোধহয় তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি, আমি তাকে একটা আধলা দিইনি যা আমার নিজের সম্পত্তি নয়।”

*

১৬ ডিসেম্বর ১৮৯৬ ইংলন্ড ত্যাগ করে ভারতের পথে যাত্রা শুরু করেন। বিবেকানন্দ। কলম্বো ঘুরে কলকাতায় ফেরেন ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭।

তারপর বেশ কিছুদিন ঝড়ের বেগে মঠ মিশন প্রতিষ্ঠা এবং আসমুদ্র ভারত ঘুরে বেড়ানো।

নিঃশ্বাস ফেলবার সময় নেই স্বামীজির। পরের বছর সেপ্টেম্বরে তিনি কাশ্মীরে, ঠিকানা কেয়ার অব ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, প্রধান জজ। সেখানে দু’সপ্তাহ অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে আবার খেতড়ির মহারাজকে চিঠি (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮): “আমার অর্থের প্রয়োজন। যদিও আমার আমেরিকান বন্ধুগণ আমায় যথাসাধ্য সাহায্য করছেন তবু সব সময় হাত পাততে লজ্জা হয়, বিশেষত এই কারণে যে রোগ হওয়া মানেই একটানা অর্থব্যয়। পৃথিবীতে একটিমাত্র লোকের কাছে ভিক্ষা চাইতে আমার লজ্জা বা সংকোচ হয় না, সে লোক আপনি! আপনি দেন বা না দেন, আমার কাছে দুই-ই সমান। যদি সম্ভব হয়, দয়া করে আমাকে কিছু টাকা পাঠাবেন।”

মহারাজ তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা নেন। কৃতজ্ঞ স্বামীজির উত্তর আসে বেলুড় থেকে। কলকাতার পোদ্দার শেঠ দুলিচাঁদ কাকরাণির কাছে ৫০০ টাকার যে অর্ডার কেটে পাঠিয়েছেন তার প্রাপ্তিস্বীকার এবং সেই সঙ্গে, “আমি এখন একটু ভাল আছি। জানিনা এই উন্নতি চলতে থাকবে কিনা।”

শরীর খারাপ থাকায় সংসার-সমস্যা মেটাবার জন্যে স্বামীজি ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। নভেম্বর মাসে তিনি খেতড়িকে লেখেন, “বংশলোপ নিবারণের জন্য কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিবাহ দিতে চাই।”

এব্যাপারে মায়ের ইচ্ছা যে প্রবলভাবে উপস্থিত তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। স্বামীজি নিজে কিন্তু একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, যদি মহেন্দ্রনাথ বিয়ে করতে চান, তাঁকে দূর করে দেবেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর সিদ্ধান্ত, মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথের মধ্যে ছোটকেই তিনি অধিক বিবাহযোগ্য মনে করেছিলেন। কিন্তু মনে রাখা ভাল, এই চিঠি লেখার সময় ভূপর্যটক মহেন্দ্রনাথের কোনো পাত্তা নেই।

পরের সপ্তাহে ২২ নভেম্বর ১৮৯৮ বেলুড় থেকে স্বামীজি খেতড়িকে সেই দুঃখময় গোপন চিঠি লেখেন যা পড়লে শতবর্ষ পরেও হৃদয়বান পাঠকের চোখ সজল হয়ে ওঠে। “মাননীয় মহারাজা,…আপনি জানেন বিদেশ থেকে ফেরার পর থেকেই আমি ভুগছি।… এই অসুস্থতা সারবার নয়।… এই দুবছর বিভিন্ন জায়গায় বায়ু পরিবর্তন করেও প্রতিদিন অবস্থা খারাপ হচ্ছে, আমি এখন প্রায় মৃত্যুর দ্বারে। আজ আমি মহারাজের প্রদত্ত আশ্বাস, মহানুভবতা ও বন্ধুত্বের কাছে একটা আবেদন জানাচ্ছি। আমার বুকের মধ্যে একটা পাপ সারাক্ষণ পীড়া দেয়–আমার মায়ের প্রতি বড় অবিচার করেছি। আমার মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ বাইরে চলে যাওয়ায় মা শোকে একেবারে মুহ্যমান, এখন আমার শেষ ইচ্ছা, অন্তত কিছুকালের জন্য মায়ের সেবা করে পাপস্খলন করি। এখন আমি মায়ের কাছে থাকতে চাই, আমাদের বংশটি যাতে লোপ না পায় সেজন্য ছোটভাইয়ের বিয়ে দিতে চাই। এতে আমার ও আমার মায়ের শেষ কটা দিন যে শান্তিতে কাটবেতাতে সন্দেহ নেই। মা এখন এক জঘন্য বাসায় থাকেন। তার জন্যে ছোট একটা ভাল বাড়ি করে দিতে চাই। ছোটভাইটির উপার্জন ক্ষমতা সম্পর্কে আশা কম, তার জন্যেও কিছু করে যাওয়া দরকার। আপনি রামচন্দ্রের বংশোদ্ভব, যাকে ভালবাসেন, যাঁকে বন্ধু মনে করেন তার জন্য এই সাহায্য আপনার পক্ষে কি খুব কষ্টকর হবে? আমি জানিনা, আর কার কাছে এই আবেদন পেশ করতে পারি। ইউরোপ থেকে যে টাকা পেয়েছি তার সবই কাজ’ এর জন্যে–এবং তার শেষ পাইপয়সা পর্যন্ত দিয়ে দেওয়া হয়েছে।…”

“পুনশ্চ :–এই চিঠি নিতান্ত ব্যক্তিগত ও গোপনীয়।”

এই চিঠির প্রথম উত্তর আসে টেলিগ্রামে। ১লা ডিসেম্বর ১৮৯৮ বেলুড়ে বসে মহানুভব খেতড়িকে উত্তর দিতে বসেন রোগাক্রান্ত বিবেকানন্দ।

“আমি কি চাই তা বিশদভাবে লিখলাম। কলকাতায় একটা ছোট বাড়ি তৈরির খরচ দশহাজার টাকা। ঐ টাকায় চারপাঁচজনের বাসযোগ্য একটা ছোট বাড়ি কোনমতে কেনা বা তৈরি করা যায়। সংসার খরচের জন্য যে মাসিক একশ টাকা আপনি আমার মাকে পাঠিয়ে থাকেন তা তার পক্ষে যথেষ্ট। যদি আমার জীবদ্দশা পর্যন্ত আমার খরচ নির্বাহের জন্য আরও মাসিক একশ টাকা পাঠাতে পারেন তাহলে বড়ই খুশি হব। অসুস্থতার জন্য আমার খরচ ভয়ানক বেড়েছে; কিন্তু এই বাড়তি বোঝা আপনাকে খুব বেশিদিন বইতে হবে বলে মনে হয় না, কেননা আমি বড়জোর আর দু’এক বছর বাঁচবো। আমি আর একটি ভিক্ষা চাইব–মায়ের জন্য একশত টাকার সাহায্যটি সম্ভব হলে আপনি স্থায়ী রাখবেন। আমার মৃত্যুর পরেও যেন সে সাহায্য নিয়মিত পৌঁছয়। যদি কোন কারণে আমার প্রতি ভালবাসায় ও দাক্ষিণ্যে ছেদ টানতে হয়, এক তুচ্ছ সাধুর প্রতি একদা যে প্রেম-ভালবাসা ছিল তারই কথা স্মরণ করে মহারাজ যেন সাধুর দুঃখীমাতার প্রতি এই করুণা বর্ষণ করেন।”

যতদুর মনে হয়, বাড়ির জন্য ১০,০০০ টাকা দেওয়া খেতড়ির পক্ষে সম্ভব হয়নি। স্বামীজিও আলাদা বাড়ির পরিবর্তে ৬,০০০ টাকা দিয়ে খুড়ির কাছ থেকে পৈতৃক বাড়ির একটা অংশ কেনেন। শঙ্করীপ্রসাদ জানিয়েছেন মঠ-তহবিল থেকে এর জন্য স্বামীজিকে ৫,০০০ টাকা ধার করতে হয়।

*

এবার আমাদের নজর পরিব্রাজক বিবেকানন্দর ওপর–২০ জুন ১৮৯৯ কলকাতা থেকে জাহাজে চড়ে তিনি দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো চলেছেন পশ্চিমে। তার যাত্রাসঙ্গী স্বামী তূরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতা। বিদেশে যাত্রার আগের দিন (১৯ জুন ১৮৯৯) গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী ও পূর্বাশ্রমের কয়েকজন আত্মীয়কে স্বামীজি বেলুড় মঠে আনিয়েছিলেন। একসময় সকলে স্বামীজির গান শোনার জন্য ঠাকুরঘরের বারান্দায় গিয়ে বসেন। মায়ের অনুরোধে তাঁর প্রিয়পুত্র শিব ও কালী বিষয়ক বেশ কয়েকটি গান গাইলেন। সন্ধ্যার সময় ঘোড়ার গাড়িতে মাকে সিমলায় পৌঁছে দিয়ে স্বামীজি বাগবাজারে বলরাম বসুর ভবনে চলে যান।

জাহাজ থেকে নিবেদিতা নিয়মিত চিঠি লিখতেন মিস ম্যাকলাউড ও মিসেস বুলকে।

কলকাতা ছেড়ে জাহাজ যখন সিংহলদ্বীপের কূলে উপস্থিত হচ্ছে তখন নিবেদিতা চিঠি লিখছেন…। মঙ্গলবার সকাল, ২৮ জুন। “তিনি কীভাবে নিজের গর্ভধারিণীর কথা বললেন; মাকে কত কষ্ট দিয়েছেন তিনি, সেই সঙ্গে তাঁর প্রবল ইচ্ছা ফিরে এসে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি মায়ের কাছে নিবেদন করার।দেখছো না, এবার মধ্যে রয়েছে প্রকৃত বৈরাগ্য। সম্ভব হলে অতীতকে আমি খণ্ডন করতাম-দশ বছর কম বয়সী হলে আমি বিয়ে করতাম, কেবল আমার মাকে খুশি করবার জন্য, আর কোনো কারণে নয়। আহা! কীসের ঘোরে এই ক’বছর আচ্ছন্ন ছিলাম? উচ্চাশার পাগলামি–এরপর হঠাৎ যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বললেন–আমি কখনই উচ্চাভিলাষী ছিলাম না। খ্যাতির বোঝা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”

নিবেদিতা বললেন, “খ্যাতির ক্ষুদ্রতা আপনার মধ্যে কখনও ছিল না। তবে আমি ভীষণ খুশি যে আপনার বয়স দশ বছর কম নয়!”

মানসকন্যা নিবেদিতার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বামীজি খুব জোরে হাসতে লাগলেন।

.

১৬ আগস্ট ১৮৯৯ স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছলেন। ডিসেম্বরে তিনি প্রবল উদ্দীপনায় লস এঞ্জেলিসে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন।

বড়দিনের দুদিন পরে আমরা দেখছি বিদেশের মাটিতেও মামলা মোকদ্দমার চিন্তা থেকে স্বামীজির মুক্তি মেলেনি। শ্রীমতী সারা বুলকে তিনি লিখছেন, “আমার শরীর এখন অনেক ভাল। আমি কাজ শুরু করেছি। মামলার খরচের জন্য ইতিমধ্যেই ১,৩০০ টাকা পাঠিয়েছি, যদি ওদের প্রয়োজন হয় তাহলে আরও পাঠাব।”

আরও খবর : “রাজযোগ-এর গ্রন্থস্বত্ব থেকে এবং খেতড়ির পাঠানো মোট ৫০০ পাউন্ড মিস্টার লেগেটের কাছে আছে, ওঁর কাছে আমার মোট গচ্ছিত একহাজার পাউন্ড। যদি আমি মরে যাই তাহলে দয়া করে ওই টাকা আমার মাকে পাঠিয়ে দিও।”

মায়ের জন্যে প্রবাসে রোগজর্জরিত সন্তানের চিন্তার শেষ নেই।কয়েকদিন পরেইনতুন বছরের নতুন মাসে (১৭ জানুয়ারি ১৯০০) লস এঞ্জেলিস থেকে মিসেসবুলকেবিবেকানন্দ জানাচ্ছেন: ”মিসম্যাকলাউডওমিসেস লেগেটের দাক্ষিণ্যে আমি সারদানন্দকে ২,০০০ টাকা পাঠাতে পেরেছি। ওঁরাই বেশি দিয়েছেন, বাকিটা আমার লেকচার থেকে।… আমি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে এখানে এসেছিলাম। সেটা তো হয়েছেই, বাড়তি প্রাপ্তি মামলা-মোকদ্দমার জন্যে এই ২,০০০ টাকা।… এটা ক্রমশই স্পষ্ট হচ্ছে, মঠের চিন্তা ঘাড় থেকে নামিয়ে, কিছুসময়ের জন্যে আমি মায়ের কাছে ফিরে যাই। আমার জন্যে তিনি বড্ড কষ্ট পেয়েছে। ওঁর শেষ দিনগুলো মসৃণ রাখতে হবে। আপনি কি জানেন, অমন যে অমন শঙ্করাচার্য তাকেও এই একই পথ বেছে নিতে হয়েছিল। মায়ের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তাকে মায়ের কাছে ফেরত যেতে হয়েছিল।… ১৮৮৪ সালে মাকে ছেড়ে আসা মস্ত ত্যাগের ব্যাপার ছিল, এখন তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া আরও বড় ত্যাগের ব্যাপার। ‘মা’ বোধ হয় চাইছেন শঙ্করাচার্য যা করেছিলেন আমাকে দিয়েও তাই করাবেন।”

আচার্য শঙ্করের জীবন ও শিক্ষা সম্বন্ধে এই বাংলায় তেমন আগ্রহ ইদানীং দেখা যায় না। অতি অল্পবয়সে তিনি সংসারত্যাগী হয়েছিলেন, মৃত্যুও হয়েছিল নিতান্ত কম বয়সে, অনেকের মতে মাত্র ৩২ বছরে। তার জননীর নাম বিশিষ্টা।

শঙ্কর যখন সন্ন্যাসের জন্য মাতৃ-অনুমতি চাইলেন, তখন জননী বললেন, “বাবা তুমি চলে গেলে কে আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করবে? তুমি থাকতে আমার সৎকার কি জ্ঞাতিরা করবে?” জননীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছিল।

শঙ্কর : “আপনি প্রসন্নমনে আমার গৃহত্যাগের অনুমতি দিন…আপনার সৎকার আমি যেখানেই থাকি, যথাসময়ে এসে আমিই করব। সন্ন্যাসীর এই কাজ নিষিদ্ধ, তবু আপনার জন্য আমি এই কাজ করব।”

অনেকদিন পরের কথা, জগদগুরু শঙ্কর তখন শৃঙ্গেরীতে অধ্যাপনা করছেন, এমন সময় তিনি জিভে মাতৃস্তনদুগ্ধের আস্বাদ অনুভব করলেন। তিনি বুঝলেন, মায়ের অন্তিমসময় উপস্থিত। তিনি দ্রুত জন্মস্থান কালাডি গ্রামে ফিরে এলেন।

রোগশয্যায় শায়িতা জননী বিশিষ্টা তার পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা এতে বিলম্ব কেন?”

আচার্য শঙ্কর নিঃশব্দে জননীসেবায় মনোনিবেশ করলেন। স্নেহময়ী জননী জানতে চাইলেন, “বৎস যে জন্য গৃহত্যাগী হয়েছ তাহা সিদ্ধ হয়েছে তো?”

শঙ্কর নীরবে মাতৃসেবায় ব্যস্ত রইলেন, পুত্রমুখ দর্শনে জননী সমস্ত যন্ত্রণা ভুলে গেলেন।

জননীর দেহাবসানের পর স্বার্থপর আত্মীয়রা বেশ হাঙ্গামা বাধালেন। তারা শঙ্করকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কেন শবপার্শ্বে বসে আছেন? সন্ন্যাসীর তো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অধিকার নেই।..বুঝেছি, সন্ন্যাসী হবার কষ্ট দেখে গৃহী হতে ইচ্ছা হয়েছে! মুখাগ্নি করে সম্পত্তির মালিক হবার ইচ্ছা রয়েছে। তুমি সন্ন্যাস নিয়ে বেদমার্গ থেকে বহির্ভূত হয়েছ, অন্যদেশে গিয়ে ম্লেচ্ছত্ব প্রাপ্ত হয়েছ, নষুদিরী ব্রাহ্মণ হয়ে কেরল ত্যাগ করে তুমি জাতিভ্রষ্ট হয়েছ–তোমাকে আমরা কিছুতেই মুখাগ্নি করতে দেব না।”

শঙ্কর : আপনারা তো আমার জননীর কোন যত্নই করেননি।.আমিই শেষকার্য সম্পন্ন করব।

চিতা সজ্জিত হল। কিন্তু অগ্নি কোথায়? কেউ অগ্নি দেবে না, তখন প্রয়াতা মায়ের দক্ষিণ হাতে অরণি কাঠ রেখে শঙ্কর অগ্নিমন্থন করলেন এবং সেই আগুনেই মাতৃদেহের সৎকার হলো।

শঙ্করের প্রতি নির্মম দুর্ব্যবহারের খবর পেয়ে স্থানীয় নরেশ রাজশেখর পরে শঙ্করদর্শনে এসেছিলেন এবং দুষ্ট আত্মীয়দের যথাবিহিত শাস্তিবিধান করেছিলেন। শঙ্করের জন্ম ৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে এবং দেহাবসান বোধ হয় ৮১২ খ্রিষ্টাব্দে।

.

এক, এমনকি দুই কোকিলেও বসন্ত আসে না। মাতৃপ্রেমে অপ্রতিদ্বন্দ্বী সন্ন্যাসী শঙ্করকে আমরা তো দেখলাম। আরও কে কে আছে তা একবার খোঁজ নিলে একালের বিবেকানন্দকে বোঝা বোধহয় সহজ হয়ে ওঠে।

বেশিদূর যাবার প্রয়োজন নেই, ঘরের কাছেই রয়েছেন শ্রীচৈতন্য। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিরচিত চৈতন্যচরিতামৃত অবশ্যই সন্ধানী পাঠকের চোখ খুলে দেয়। মহাপ্রভুর জীবনের কয়েকটি মুহূর্ত পাঠককে একবার মনে করিয়ে দিতে চাই।

“নবদ্বীপে শচীমাতাকে দেখে প্রভু দণ্ডবৎ করলেন। পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে শচীদেবী কাঁদতে লাগলেন। দুজন দুজনকে দেখে আকুল হয়ে পড়লেন। পুত্রের মাথায় চুল নেই দেখে শচীমাতা মনে বড় ব্যথা পেলেন। শচীদেবী পুত্রের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন, তাকিয়ে থাকেন, চুম্বন করেন। চোখে জল এসে ঝাঁপসা করে দিচ্ছে, ভাল দেখতে পাচ্ছেন না, কেঁদে কেঁদে বললেন,বাছা নিমাই, বিশ্বরূপের মত নিষ্ঠুর হবে না। সেও সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেল। আমি একটু দেখতে পেলাম না। তুমি সেরকম কোরো না, তাহলে আমি আর বাঁচবো না।

“প্রভু কেঁদে কেঁদে বললেন–শোনো মা, এই শরীর তো তোমারই দেওয়া, আমার কিছুই নয়। তোমার থেকেই জন্ম, তুমিই লালনপালন করে এত বড় করেছ, কোটি জন্মেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। যদিও সন্ন্যাস নিয়েছি, তা বলে তোমাকে কখনও ভুলতে পারব না।…প্রভু শচীমাতাকে সান্ত্বনা দিয়ে তার চরণবন্দনা করলেন। পরে তাকে প্রদক্ষিণ করে নীলাচলে যাত্রা করলেন।…

“পুরীতে শ্রীবাস পণ্ডিতকে আলিঙ্গন করে মহাপ্রভু বললেন, এই কাপড় এবং এই প্রসাদ মাকে দেবে, মায়ের সেবা ছেড়ে আমি যে সন্ন্যাস নিয়েছি এই অপরাধ ক্ষমা করার জন্য মাকে তুমি আমার হয়ে বলবে, মাকে সেবা করাই পুত্রের কাজ, আমি তা ছেড়ে পাগলের মত কাজ করেছি। মা পাগল ছেলের দোষ নেবে না, আমার কথা বলবে মাকে, মা খুশি হবে।… মায়ের আজ্ঞাতেই নীলাচলে রয়েছি, মধ্যে মধ্যে মায়ের চরণদর্শন করার জন্য যাব।”

আরও আছে। তার অত্যন্ত প্রিয় জগদানন্দকে চৈতন্যদেব প্রতি বছর। নবদ্বীপে পাঠাতেন, তিনি পুত্রবিচ্ছেদে দুঃখিতা জননী শচীদেবীকে প্রভুর সব সংবাদ জানিয়ে আশ্বস্ত করতেন। চৈতন্যচরিতামৃতের লেখকের প্রশ্ন : “মহাপ্রভুর মতন মাতৃভক্ত কতজন আছে?তিনি মাতৃভক্তের শিরোমণিতুল্য, সন্ন্যাস নিয়েও মাকে সেবা করে যাচ্ছেন।”

স্বামী বিবেকানন্দও বলতেন, “যে মাকে পুজো করেনি সে কখনও বড় হতে পারে না।”

ব্রহ্মবাদিন পত্রিকায় ভুবনেশ্বরী দেবীর মহাপ্রয়াণ বর্ষে (১৯১১)নামহীন এক লেখক অথবা লেখিকার তিনটি প্রবন্ধ বেরিয়েছিল। সেখানে বিশ্ববিজয় করে কলকাতায় ফিরে এসে (১৮৯৭) স্বামীজির মাকে দেখতে যাওয়ার একটি দৃশ্য আছে। “পেট্রিয়ট, অরেটর, সেন্ট কোথায় হারিয়ে গেল! তিনি আবার যেন মায়ের কোলের খোকাটি। মায়ের কোলে মাথা রেখে, অসহায় দুষ্ট শিশুর মতন তিনি কাঁদতে লাগলেন, মা, মা, নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে আমাকে মানুষ করো।”

স্বামী বিবেকানন্দ কি তখনই মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন? ৭ মার্চ ১৯০০ আমেরিকা থেকে তিনি মিসেস বুলকে লিখলে, শঙ্কর প্রদর্শিত পথেই তিনি ফিরে যাচ্ছেন মায়ের কাছে। সেই সঙ্গে কেমনভাবে ফেরবার খরচ তুলবেন তার হিসেব।

“নিউইয়র্কে আমার যে হাজার ডলার আছে তার থেকে মাসে ৯ টাকা আসবে। আমি যে জমি মাকে কিনে দিয়েছি তার থেকে আসবে ৬ টাকা। যে পুরনো বাড়িটা রয়েছে তার থেকে পাওয়া যাবে মাসে ৬ টাকা। যা নিয়ে মামলা চলছে সেটা আমাদের অধিকারে নেই। মা, দিদিমা, ভাই ও আমি মাসে কুড়ি টাকায় চালিয়ে নেবো। আমি এখনই ভারতে ফিরে যেতে রাজি যদি হাজার ডলারে হাত না দিয়ে জাহাজ ভাড়াটা যোগাড় করতে পারি।”

এর পরে আবার মায়ের কথা : “সমস্ত জীবন ধরে মায়ের ওপর বিরামহীন অত্যাচার করেছি। মায়ের পুরো জীবনটাই সীমাহীন এবং বিরতিহীন দুঃখ। যদি সম্ভব হয়, শেষ চেষ্টায় আমি মাকে একটু সুখী করতে চাই। আমি পরিকল্পনাটা ছকে নিয়েছি।…”।

পাঁচদিন পরে ব্রহ্মানন্দের কাছে স্বামীজি খোঁজখবর নিচ্ছেন–দেওয়াল তুলে ছোট্ট বাড়িটাকে আলাদা করে দেওয়া খুব শক্ত কাজ নয়। যদি পারা যায় একটা ছোট্ট বাড়িতে মা ও বৃদ্ধা দিদিমার সেবা করা।

মে মাসে স্বামীজির আর একটা চিঠি থেকে দেখছি, গঙ্গার ধারে ছোট্ট মাতৃনিবাসের পরিকল্পনা স্বামীজি ত্যাগ করেছেন, পয়সা নেই বলে। টাকাকড়ির আরও হিসেব রয়েছে : “মিসেস সেভিয়ার আমাকে যে ৬০০০ টাকা দিয়েছিলেন তা আমার খুড়ি এবং খুড়তুতো বোনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি কেনবার ৫০০০ টাকা মঠ-ফান্ড থেকে ধার করেছি। আমার খুড়তুতো বোনের কাছে আপনি যে টাকা পাঠান তা সারদানন্দ যাই বলুক বন্ধ করবেন না। এরপর স্বামীজি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন যে মঠের টাকা তার নিজের অথবা মায়ের খরচের জন্যে কখনও নেওয়া হয়নি।

বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজার সময় সঙ্ঘজননী সারদামণি স্বামীজিকে প্রধান ভূমিকা দিয়েছিলেন। গর্ভধারিণী জননীকেও স্বামীজি যে আনন্দোৎসবের সময় ভোলেননি তার প্রমাণ রয়েছে শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতিচিত্রে। আনন্দময়ীর আবাহনের সময় আনন্দময়ী জননীর একটা ছবি চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেলুড় মঠে ভুবনেশ্বরী বেগুন তোলেন, লঙ্কা তোলেন আর এ বাগান ও বাগান ঘুরে বেড়ান। “আমার নরেন এসব করেছে”, মনের আনন্দ তিনি চেপে রাখতে পারছেন না। বিব্রত বিবেকানন্দ মাকে সামলে বললেন, “মনে করছ বুঝি তোমার নরু এসব করেছে! নয়, যিনি করবার তিনিই করেছেন, নরেন কিছু নয়।”

*

১৯০০ সালেই স্বামীজির শেষ পাশ্চাত্যলীলা। বছরের শেষপ্রান্তে আমরা তাকে দেখি অনুরাগিণী পরিবৃত হয়ে প্যারিস থেকে কনস্ট্যানটিনোপলের পথে।

মাদাম কালভে ও মিস ম্যাকলাউড সহ তিনি যখন এথেন্স হয়ে কায়রোর পথে তখন পরমবিশ্বস্ত স্বামী সারদানন্দ চিঠি লিখছেন মিসেস বুলকে–”মঠ ফান্ড থেকে স্বামীজি যা টাকা ধার নিয়েছিলেন তা শোধ করে দিয়েছেন। মামলার জন্যও তিনি বাড়তি টাকা পাঠিয়েছে।”

এই মামলা নিশ্চয় খুড়ির বিরুদ্ধে, যিনি পয়সা নিয়ে, প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিবেকানন্দ-জননীকে সম্পত্তির দখল দেননি। মঠের জন্যও তিনি কিছু টাকা নিশ্চিত করেছেন।

কায়রোতে আকস্মিক যা ঘটে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে। এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ৯ই ডিসেম্বর ১৯০০ সালের সেই সন্ধ্যা, যখন স্বামীজি বিনা নোটিসে বেলুড়ে ফিরে এসেছিলেন এবং মঠের দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে তিনি সকলের সঙ্গে খিচুড়ি খেতে বসে গিয়েছিলেন। যারা তাঁকে সেদিন দেখেছিল তারা জানতো না কোন শারীরিক দুর্যোগের তোয়াক্কা না করে বিশ্বপরিভ্রমণ বন্ধ রেখে ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে এসেছে।

ফেরার পরেই স্বামীজি যে মায়ের সংসারের খবরাখবর নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার প্রমাণ রয়েছে। পাঁচ দিন পরে তিনি মিসেস ওলি বুলকে অনুরোধ করলেন, “যে টাকাটা আপনি আমার খুড়তুতো বোনের কাছে সোজাসুজি পাঠাতেন এবার সেটা আমার কাছে পাঠাবেন। আমি চেক ভাঙিয়ে, টাকা দেবার ব্যবস্থা করবো।” এই গুড়তুতো বোনকে (কাজিন) নিয়মিত টাকা দেবার ব্যাপারটা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত খুড়ির মেয়েদের কিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই বিমলহৃদয় সন্ন্যাসী।

জীবনের শেষপর্বে মা ও দিদিমার কাছে স্বামীজির যাতায়াত বেড়ে গিয়েছিল। স্বামীজি যেমন যেতেন মা-দিদিমার কাছে, তেমন মাঝে মাঝে মা চলে আসতেন বেলুড়ে, ডাক দিতেন বিলু-উ-উ বলে।

তাছাড়া ছেলের কাছ থেকে মাঝে মাঝে বিধবা মা-দিদিমার কাছে ফলমূল, শাকশজি উপহার যেতো।

ফিরে এসে যেবার প্রথম মামাবিহীন মামাবাড়িতে গেলেন সেবার আলোড়ন পড়ে গেল। দিদিমার বাড়িতে সবাইকে সীমাহীন আনন্দ দিতেন স্বামীজি। পাঠদ্দশায় দিদিমার বড় ন্যাওটা ছিলেন স্বামীজি। মাকে ছাড়িয়েও দিদিমা অপার্থিব সুন্দরী ছিলেন। বৃদ্ধ বয়সেও তার রূপ ফেটে পড়তো। প্রিয় নাতির জন্য নানা ব্যঞ্জন প্রস্তুত হতো। দলবল নিয়ে গিয়ে স্বামীজি খেয়ে আসতেন। এঁদের রান্না শুকতো ও মোচার ঘণ্টর কি রকম তারিফ করতেন স্বামীজি তা পরের অধ্যায়েই স্পষ্ট হবে।

ভুবনেশ্বরী জননীর সঙ্গে তার নাতি-দিদিমার সম্পর্ক। ভুবনবিজয়ী নাতিকে তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “আর কেন, তোর তো সব হলো। এবার বিয়েটা বাকি আছে! বিয়েটা করে ফেল।” দিদিমার কথা শুনে স্বামীজি হাসির হররা তুললেন।

একদিন ওঁদের আহারের অল্প পরে স্বামীজি হঠাৎ গিয়ে হাজির। বিশেষ ইচ্ছা মায়ের পাতের একটু প্রসাদ খান। তখন মায়ের থালায় সজনে খাড়াটুকু মাত্র অবশিষ্ট ছিল। কোনো কথায় কান না দিয়ে তাই অত্যন্ত পরিতৃপ্তি সহকারে খেলেন স্বামীজি।

*

অন্ত্যলীলা পর্বে স্বামীজির শরীরের অবস্থা যে ক্রমশই খারাপ হচ্ছে তা অনুগামীরা ভালভাবেই জানতেন।

সামান্য যেটুকু সময় অবশিষ্ট রয়েছে তার পূর্ণ ব্যবহারের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ। একদিকে চলেছে মঠ-মিশনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার দুর্জয় সাধনা, অন্যদিকে রামকৃষ্ণ ভাবধারাকে দিকে দিকে ছড়িয়ে দেবার নিরন্তর প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে চলেছে নতুন প্রজন্মের সাধকদলকে নবযুগের প্রস্তুতির জন্য প্রশিক্ষণ। এইসব কাজ সহজ নয়, বাধাহীনও নয়। স্বামীজির সন্ন্যাসী-ভ্রাতারাও ভালবাসায় এবং আনুগত্যে তুলনাহীন। এদেশের অধ্যাত্মজীবনে বিবেকানন্দর গুরুভ্রাতারা যে নিঃশব্দ ইতিহাস রচনা করে গিয়েছেন তার প্রকৃত মূল্যায়ন আজও হয়নি।

সন্ন্যাসী-বিবেকানন্দের এক তীর্থ থেকে অন্য তীর্থে যাত্রার বিরতি নেই। এইসব তীর্থযাত্রা নিতান্ত সুগম নয়। কোথাও কোথাও দুর্গম পথের যাত্রী পথের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। তবু নেই চলার বিরতি।

মায়াবতী ত্যাগ করছেন বিবেকানন্দ ১৮ই জানুয়ারি ১৯০১ এবং সেই দিনই খেতড়িরাজ অজিত সিং-এর বেদনাদায়ক এবং কিছুটা রহস্যজনক অকালমৃত্যুর সংবাদ নতুন অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত এঁকে দিল। যাঁর ওপর তিনি সবচেয়ে নির্ভরশীল ছিলেন তিনিই আর পিছনে রইলেন না। কিন্তু সন্ন্যাসীর নাইকো চলার শেষ।

বিবেকানন্দ এবার চললেন পূর্বভারতের তীর্থযাত্রায়। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের তীর্থপরিক্রমা তো নতুন কথা নয়, কিন্তু নতুন কথাটা হলো জননীর ইচ্ছাপূরণ। গুণের ছেলেরাই তো সাগ্রহে মাকে তীর্থে নিয়ে যায়।

বছরের গোড়াতেই (২৬শে জানুয়ারি) এক চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, “বাংলাদেশে, বিশেষত মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এস্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।”

স্বামীজির সানন্দ ঘোষণা: “আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি। তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ করতে কয়েক মাস লাগবে। তীর্থদর্শন হলো হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ। সারাজীবন আত্মীয়-স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।”

নিজের মাকে নিয়ে দাক্ষিণাত্যে যাবার পরিকল্পনাও হয়েছিল, কিন্তু স্বামীজির রোগজীর্ণ শরীরই বাদ সেধেছিল।

এক সপ্তাহ নয়, মার্চের ১৮ তারিখের আগে পূর্ববঙ্গের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়া সম্ভব হল না। স্বামী ব্রহ্মানন্দের ওই তারিখের দিনলিপিটি আকর্ষক। ‘আজ সন্ধ্যায় স্বামীজি, নিত্যানন্দ ও আরও পাঁচজন ঢাকায় যাত্রা করলেন।

স্বামীজির মা মঠে এসেছিলেন, বললেন ব্রহ্মপুত্রে স্নান করাতে। স্বামীজির কাছ থেকে রিপ্লাই টেলিগ্রাম এল, মাকে পাঠাতে বলেছেন।

ঢাকায় স্বামীজির ভগ্ন শরীর দেখে একজন ভক্ত জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনার শরীর এত তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল, আগে থেকে যত্ন নেননি কেন?”

স্বামীজির স্পষ্ট উত্তর : “আমেরিকায় আমার শরীরবোধই ছিল না।”

চিঠিতে স্বামীজি লিখছেন, “আমার মা ও তার সঙ্গিনীরা পাঁচদিন আগে ঢাকায় এসেছেন, ব্রহ্মপুত্রে পবিত্র স্নানের যোগে।” একই চিঠিতে স্বামীজি জননীসমা মিসেস বুলকে আমেরিকায় জানাচ্ছেন, “আমার মা ও আর সব মেয়েদের নিয়ে চন্দ্রনাথ যাচ্ছি, সেটা পূর্ব বাংলার শেষপ্রান্তে একটি তীর্থস্থান।”

ঢাকায় থাকার সময় স্বামীজি যে স্পষ্টভাবেই আসন্ন বিদায়কালের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা এখন আমরা জানি। যখন ঢাকায় জনসভায় গম্ভীর গলায় স্বামীজি বলেছিলেন তখন ব্যাপারটার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। স্বামীজি বলেছিলেন, “আমি বড়জোর একবছর আছি। এখন শুধু মাকে গোটাকতক তীর্থ দর্শন করিয়ে আনতে পারলেই আমার কর্তব্য শেষ হয়। তাই চন্দ্রনাথ আর কামাখ্যা যাচ্ছি। তোরা কে কে আমার সঙ্গে যাবি বল? স্ত্রীলোকের উপর যাদের খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে, শুধু তারাই সঙ্গে যাবে।”

স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে সমর্থন পাওয়া যায়, স্বামীজির মা ও বোন কামাখ্যাদর্শনেও গিয়েছিলেন। ঢাকা ও শিলং-এ স্বামীজির স্বাস্থ্যের ঘোরতর অবনতি ঘটেছিল।

১২ই মে ১৯০১ স্বামী ব্রহ্মানন্দের ডায়রি : “রবিবার : স্বামীজি, গুপ্ত, স্বামীজির মা, বোন, খুড়ি, রামদাদার বিধবা স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সী দত্ত সকালে শিলং থেকে ফিরলেন।” গুরুপ্রাণ রামচন্দ্র দত্তের স্ত্রী কৃষ্ণপ্রেয়সীর মৃত্যু পরের বছর ১লা এপ্রিল- ক্ষয়রোগে। তার শেষ ঠিকানা ১১ মধু রায় লেন। এঁর বিয়েতেই বিলু নিতবর হয়েছিলেন। কৃষ্ণপ্রেয়সী সম্পর্কে মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “আমার মাকে তিনি বিশেষ করিয়া সম্ভম করিতেন। এইরূপ ধীরা, নম্রা ও মিষ্টভাষিণী স্ত্রী জগতে খুব কম দেখিতে পাওয়া যায়।”

ব্রহ্মানন্দের ডায়রিতে উল্লিখিত খুড়িটিই কি আমাদের আদালতী খুড়ি? মনে হয় ইনিই জ্ঞানদাসুন্দরী দত্ত কারণ স্বামীজির দয়ার শরীর। তার শত্রু-মিত্র জ্ঞান থাকতো না। ক’দিন আগেই তিনি প্রিয় ব্রহ্মানন্দকে বলেছিলেন, “যদি একজনের মনে–এ সংসার নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি।”

আসামের সৌন্দর্য যে স্বামীজিকে মুগ্ধ করেছিল তার প্রমাণ, অবিশ্বাস্য প্রশস্তি গেয়ে তিনি বলেছিলেন–”কাশ্মীরের পরেই আসাম ভারতের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।” মহামূল্যবান এই উদ্ধৃতিটুকু বোধ হয় আজও আসাম পর্যটন বিভাগের নজরে পড়েনি!

.

শরীর ভাঙছে, কিন্তু তা বলে তো সন্ন্যাসীর চলার পথ রুদ্ধ হতে পারে না। এক বোন এবং মিসেস ব্যানার্জিকে নিয়ে আগস্ট মাসে স্বামীজি দার্জিলিং গিয়েছিলেন।

এই বোনটি কে? নাম পাওয়া যাচ্ছে প্রিয়ম্বদা দাসী। তাঁর পরিবারে দু’জন প্রিয়ম্বদাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভূপেন্দ্রনাথ তাঁর বইতে যে কবি। প্রিয়ম্বদার উল্লেখ করেছেন তিনি প্রিয়ম্বদা বসু। সেকালে দাসী লেখাটাই রেওয়াজ ছিল, স্বামীজির মাও লিখতেন ভুবনেশ্বরী দাসী।

মনে হয় দার্জিলিং-যাত্রী স্বামীজির সম্পর্কিত বোন ১২৩ মানিকতলা স্ট্রিটের প্রিয়ম্বদা ঘোষ। স্বামীজির অশেষ অনুগ্রহভাজনীয়া এবং সম্ভবত স্নেহের শিষ্যা। এই প্রিয়ম্বদা প্রায়ই বেলুড়ে আসতেন এবং স্বামীজির জন্য নানারকম খাবার তৈরি করতেন যা প্রায় সবই সেবকদের পেটে যেত!

আরও একজন বোনের সন্ধান এখনই সেরে ফেলা যাক। ইনি বড় জাগুলিয়ার দূরসম্পর্কের বোন মৃণালিনী বসু। দেহান্তের ঠিক আগে এঁর কাছেই স্বামীজি শেষ বেড়াতে গিয়েছিলেন (৬-১২ জুন ১৯০২)। গ্রামের জমিদার সর্বেশ্বর সিংহের কন্যা মৃণালিনী। তাঁর স্বামী সন্ন্যাসী হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান, ফলে তিনি সপুত্র পিত্রালয়ে বসবাস করতেন। ইনিই বেলুড়ে ফিরবার সময় ডায়াবিটিস রুগী দাদাকে এক ঝুড়ি কালজাম দিয়েছিলেন। এই জাম মঠে এনে মৃত্যুর ক’দিন আগে স্বামীজি বিপুল উৎসাহে ফারমেন্ট করে ‘সিরকা বানিয়েছিলেন।

সংসার সম্বন্ধে জীবনের শেষপ্রান্তে স্বামীজির যে বেশকিছু হতাশা ছিল তাও এখন অনুসন্ধানীদের কাছে স্পষ্ট। ভক্ত শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী একবার ঠাকুরের ভক্ত সুরেশ মিত্তিরের কথা তুলেছিলেন স্বামীজির কাছে। মঠ প্রতিষ্ঠার জন্য এঁর রেখে যাওয়া ৫০০ টাকাই একবার স্বামীজিকে ধার করতে হয়েছিল পারিবারিক মামলার জন্য। শিষ্য জিজ্ঞেস করলেন, “মহাশয়, শুনিয়াছি মৃত্যুকালে আপনারা তাহার সহিত বড় একটা দেখা করিতে যাইতেন না।”

স্বামীজির উত্তর : “যেতে দিলে তো যাব। যাক, সে অনেক কথা, তবে এইটা জেনে রাখবি, সংসারে তুই বাঁচিস কি মরিস, তাতে তোর আত্মীয়পরিজনদের বড় একটা কিছু এসে যায় না।”

“তুই যদি কিছু বিষয়-আশয় রেখে যেতে পারিস তা তোর মরার আগেই দেখতে পাবি, তা নিয়ে ঘরে লাঠালাঠি শুরু হয়েছে। তোর মৃত্যুশয্যায় আগুন দেবার কেউ নেই–স্ত্রী-পুত্র পর্যন্ত নয়। এরই নাম সংসার।”

শতসহস্র সমস্যায় জড়িত, মৃত্যুপথযাত্রী সন্ন্যাসীর বিবেকে গর্ভধারিণী জননীর প্রতি কর্তব্যবোধের অগ্নি দিবারাত্র ধিকিধিকি জ্বলছে। তার চিন্তা, দেহাবসানের পর এই স্বার্থপর সংসারে তার মাকে কে দেখবে?

২০ মার্চ ১৯০১ তারিখের একটি চিঠি নজরে পড়ে। আমাদের হিসেব অনুযায়ী স্বামীজি তখন ঢাকায়। মায়ের সঙ্গে মিলন হয় ২৫ মার্চ নারায়ণগঞ্জে।

২০ মার্চ ১৯০১-এর চিঠিতে স্বামীজির উদ্বেগ : “আমার ভাই মহিন এখন ইন্ডিয়ায়, বম্বের কাছে করাচিতে। সারদানন্দের সঙ্গে তার পত্রযোগাযোগ আছে। শুনছি সে এবার বর্মা এবং চিনে যাবে। যেসব লোক তাকে লোভ দেখাচ্ছে তাদের ঐসব জায়গায় দোকানপাট আছে। আমি ওর সম্বন্ধে মোটেই উদ্বিগ্ন নই।” এরপরেই সেই নির্মম উক্তি : “সে ভীষণ স্বার্থপর–হি ইজ এ ভেরি সেলফিশ ম্যান।”

এর আগে আমরা দেখেছি, আমেরিকান মিস্টার ফক্সের কাছে চিঠিতে স্বামীজি তাঁর ভূপর্যটক ভাইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। শারীরিক যন্ত্রণায় কাতর স্বামীজি বোধ হয় তাঁর মৃত্যুর পরে মায়ের দেখাশোনার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চাইছিলেন, হয়তো তিনি মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছিলেন তার দেহাবসানের পরেই ভূপেন রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে দেশছাড়া হবে, তখন কে দেখবে মাকে?

সম্প্রতি শ্রীনগর পোস্টাপিস থেকে লেখা মহিমবাবুর একটা চিঠি (২৪ এপ্রিল ১৯০২) আমাদের নজরে এসেছে। চিঠির প্রাপক স্বামী সদানন্দ, গুপ্তমহারাজ বলে যিনি পরিচিত। মহেন্দ্রনাথ লিখছেন, “যা খবর পাচ্ছি তাতে আমাকে মায়ের যত্ন নিতে হবে, তার অবস্থা মোটেই ভাল নয়। এবার আমাকে কাজ করতে হবে, রোজগার করতে হবে, যাতে তাকে ভালভাবে রাখা যায়।”

আমরা জানি ১৯০৩ থেকে ভূপেন্দ্রনাথ গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। এমনও কি হতে পারে, পরিবারের মধ্যে আরও আগে থেকে আগুন না হলেও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল?

মহিমকে হাতের গোড়ায় পাওয়া যাবে না বলেই কি স্বামীজি তাঁর পারিবারিক মামলার আগুন সম্পূর্ণ নিভিয়ে ফেলবার জন্যে এমন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন?

মায়ের কথা তিনি যে কখনই ভুলছেন না তার আরও প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব। কাশী থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখছেন (২১ ফেব্রুয়ারি ১৯০২)–”মা দিদিমা যদি আসতে চান পাঠিয়ে দিও। এই প্লেগ আসবার সময়টা কলকাতা থেকে সরে এলেই ভাল।”

শেষ পর্বে স্বামীজির শরীরের অবস্থা আমাদের মনকে ব্যথিত করে তোলে। পা ফুলে নানা রোগের লক্ষণ, হাঁটতে কষ্ট হয়, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এত শিথিল ও কোমল যে টিপলেই ব্যথা লাগে। দারুণ গ্রীষ্মে কবিরাজমশাই নির্দেশ দিলেন একুশ দিন জল খাওয়া বা নুন খাওয়া চলবে না। স্বামীজি প্রবল মনোবল নিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন। শরীরের ঐ অবস্থায় আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে সানন্দে বিলিতি কায়দায় তিনি রান্নাবান্না করলেন।

তার কয়েকজন বাল্যবন্ধু একদিন স্বামীজিকে বলেছিলেন, “তুমি যে ছেলেবেলায় বে করতে বললে বলতে ‘বে করব না, আমি কি হব, দেখবি, তা যা বলেছিলে তাই করলে।” স্বামীজি : “হ্যাঁ ভাই করেছি বটে। তোরা তো দেখেছিস-খেতে পাইনি, তার উপর খাটুনি। বাপ, কতই না খেটেছি।… কিন্তু ভাই ভোগ আমার অদৃষ্টে নেই। গদিতে শুলেই রোগ বাড়ে, হাঁপিয়ে মরি। আবার মেঝেয় এসে পড়ি, তবে বাঁচি।”

শেষের দিকে স্বামীজির একটি চোখ ডায়াবিটিসের প্রকোপে নষ্ট হয়েছিল।

সপ্তরথী রোগ একটি শরীরকে কেমনভাবে নানা দিক থেকে আক্রমণ করছে তার ধারাবিবরণী এই বইয়ের অন্য অধ্যায়ে পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দেওয়া যাবে। এখন আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের শেষপর্বে উপস্থিত হওয়া যাক।

আমরা জানি, ২২ মার্চ ১৯০২ সালে সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছিল, স্বামীজির মা, দিদিমা গাড়ি করে বেলুড়ে এসেছিলেন। ১৯ জুন স্বামীজি কলকাতায় গেলেন মা এবং অপর আত্মীয়দের দেখতে। আন্দাজ করা যায়, পরের সপ্তাহে বোনের বাড়িতে মায়ের সম্পত্তি সংক্রান্ত যে ম্যারাথন আলোচনার ব্যবস্থা হয়েছিল তার প্রস্তুতিপর্ব এইদিন শেষ হয়েছিল। মিটমাটের এই আয়োজন হয়েছিল স্বামীজির জীবনের শেষ শনিবার ২৮ জুন ১৯০২।

তার আগে আর একটি মর্মস্পর্শী দৃশ্যের বর্ণনা নতুন প্রজন্মের পাঠকদের অবগতির জন্য লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন।

মিস ম্যাকলাউডের মুখেই শোনা যাক, “এপ্রিল মাসের একদিন তিনি বললেন, ‘জগতে আমার কিছুই নেই; নিজের বলতে আমার এক কানাকড়িও নেই। আমাকে যখন যা কেউ দিয়েছে তা সবই আমি বিলিয়ে দিয়েছি। আমি বললাম, স্বামীজি, যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন আমি আপনাকে প্রতিমাসে পঞ্চাশ ডলার দেব। তিনি মিনিটখানেক ভেবে বললেন, তাতে কুলিয়ে নিতে পারব তো? হ্যাঁ নিশ্চয় পারবেন। অবশ্য তাতে হয়তো আপনার ক্রীম-এর ব্যবস্থা হবে না’–আমি তখনই তাকে দুশ ডলার দিয়েছিলাম, কিন্তু চার মাস যেতে না যেতেই তিনি চলে গেলেন।”

*

স্বামী ব্রহ্মানন্দের দিনলিপি থেকে আমরা আরও কিছু একান্ত ব্যক্তিগত খবরাখবর পাই। জানা যায় মিস ম্যাকলাউড পরে স্বামীজিকে আরও টাকা পাঠিয়েছিলেন, ঐ টাকা থেকে এবং অপরের দান থেকে স্বামীজি নিজের মাকে মাসে ১০০ টাকা এবং ভগ্নীকে ৫০ টাকা দিতেন। তখন সম্ভবত খেতড়ির দান বন্ধ ছিল।

স্বামীজির মহাপ্রয়াণের পরবর্তী দিনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ছবি রয়েছে নিবেদিতার লেখা চিঠিতে। এমন কাব্যময় হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যের অক্ষয় অঙ্গ হিসাবে বহুদিন বেঁচে থাকবে। আর বর্ণনা আছে ভূপেন্দ্রনাথের রচনায়।

ভূপেন্দ্রনাথের বাংলা বই ‘স্বামী বিবেকানন্দ’ এবং ইংরিজি সংস্করণ ‘পেট্রিয়ট প্রফেট’ এক নয়। দুটির মধ্যেই কিছু কিছু বাড়তি খবর এখানে ওখানে লুকিয়ে আছে। ইংরিজি সংস্করণে ভূপেন্দ্রনাথ মোকদ্দমায় মা দিদিমাকে প্রধান ভূমিকা দিয়েছেন। লিখেছেন, মেয়ের মামলা চালাবার জন্যে দিদিমাকে বলরাম দে স্ট্রিটের চার কাঠা জমি বিক্রি করতে হয়। তার দুঃখ, মা তার ত্যাগের স্বীকৃতি কখনও পাননি। তিনি কেবল বিবেকানন্দ অনুরাগীদের কৌতূহলের পাত্রী ছিলেন।

শেষ সংবাদের বিবরণটুকু ইংরিজি বাংলা উভয় বই থেকে নিলে এইরকম দাঁড়ায় : এক সকালে স্বামীজির সেবক নাদু (হরেন) স্বামীজির মৃত্যুর সংবাদ নিয়ে আসে। মা ও দিদিমাকে আমি খবরটা দিলাম। মা জানতে চাইলেন, হঠাৎ কী হলো? আমি বললাম, বাবার যা হয়েছিল। শোকে ভেঙে পড়ে ওঁরা কাঁদতে লাগলেন, পাড়ার একজন মহিলা এসে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। নাদু আমাকে বললো সিমলা স্ট্রিটের মিত্রদের খবর দিতে। বোনের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম আমার ভগ্নিপতি ইতিমধ্যেই খবরটা পেয়েছেন। নাদু এবং আমি বেলুড়ে রওনা দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি স্বামীজি অন্তিম শয্যায় শয়ান। ওঁকে ঘিরে রয়েছেন মঠের সাধুরা, অতুলচন্দ্র ঘোষ এবং সিস্টার নিবেদিতা। এবার দেখলাম নাতি ব্রজমোহন ঘোষকে নিয়ে মা এলেন এবং বিলাপ করতে লাগলেন। ভূপেন্দ্রনাথের ইংরিজি বইতে আছে, সাধুরা ভূপেনকে বললেন, মাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। অশ্রুসজল চোখে নিবেদিতা আমার মাকে বিদায় দিলেন। অপরাহে যখন চিতায় আগুন দেওয়া হচ্ছে তখন গিরিশচন্দ্র ঘোষ এলেন। নিবেদিতা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মাকে কেন বিদায় করা হল?” বাংলা বইতে আছে, “তাকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়া হল।” আর ইংরিজি বইতে : “সন্ন্যাসীদের নিয়মকানুনের কিছু অংশ ওঁর কাছে ব্যাখ্যা করা হলো।”

আমরা জানি, জীবনের শেষ শনিবার, স্বামীজি বাগবাজারে তার মানসকন্যা নিবেদিতার বাড়ি গিয়েছিলেন, বোনের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন এবং তারপর উদগ্রীব হয়ে পারিবারিক বিবাদের সমাধানসূত্র খুঁজতে বসেছিলেন। জীবনের শেষ শনিবার, স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এলেন শরিক হাবুল দত্ত। স্বেচ্ছায় বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা বললেন হাবুল দত্ত। স্বামীজি সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন। বললেন, যদি মীমাংসা হয় তাহলে তিনি আরও হাজার টাকা দেবেন। দুই শরিক হাবুল ও তমু দত্ত রাজি। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন হাবুলের সঙ্গে পন্টুবাবু এটর্নির অফিসে গেলেন। শর্তাদি জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এটর্নি এন সি বসুর কাছে চিঠি পাঠানো হলো। উত্তরে ওঁদের এটর্নি এন সি বসু শর্তস্বীকার করে চিঠি দিলেন। ২ জুলাই (মৃত্যুর দুদিন আগে) শান্তিরামের কাছ থেকে নিয়ে পন্টুকে (হাবুল দত্ত ও তমু দত্তর দাবি অনুযায়ী) চারশ টাকা দেওয়া হলো। অর্থাৎ শেষ হলো স্বামীজির জীবনব্যাপী আইনী সংঘাতপর্ব।

স্বামীজির মৃত্যুর পরে এক চিঠিতে নিবেদিতা তার বিস্ময় প্রকাশ করে লিখলেন, তিনি সবকিছু গুছিয়েটুছিয়ে রেখে গেলেন। শেষ দেখার সময় আমাকে বললেন, মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে আপসে–এবিষয়ে তার কোনো খেদ নেই।

অর্থাৎ মায়ের সব সমস্যার সমাধানের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেলেন তার সংসারবিরাগী জ্যেষ্ঠপুত্র। যাবার আগে মাতৃইচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি-পূরণের জন্য তিনি শুধু তীর্থভ্রমণ নয়, কালিঘাটে হত্যে পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তাঁর দেহাবসানের পরেও মায়ের যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্যে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে গিয়েছিলেন সন্ন্যাসীভ্রাতাদের।

ভুবনেশ্বরীর কাছে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ছিলেন সন্তানতুল্য। জ্যেষ্ঠপুত্রের অকালমৃত্যুর পরে শোকাহত জননীকে সান্ত্বনা দেবার প্রধান দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ।

প্রথমদিকে রোজ এবং কিছুদিন পরে মাঝে মাঝে ভুবনেশ্বরীর কাছে। গিয়ে তার শোকের বোঝা কমাবার চেষ্টা করতেন। “কোনোদিন তার রান্না খেতেন, জননীর সাংসারিক সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতেন। পরিবারের অর্থ সংস্থানের সমস্যা ছাড়াও পৈতৃক ভিটা সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমার তখনও পূর্ণ মীমাংসা না হওয়াতে ঐ সব বিষয়ের দায়িত্বও স্বামী ব্রহ্মানন্দকে গ্রহণ করতে হয়।”

বিবেকানন্দজননীর শোক কিছুটা কমলে রাজা মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) ভুবনেশ্বরী দাসীকে তীর্থদর্শনে পুরী পাঠিয়ে দেন। বিবেকানন্দ জননী যতদিন বেঁচেছিলেন (১৯১১) ততদিন স্বামী ব্রহ্মানন্দ নিজের ছেলের মতন সংসারের সব ব্যাপারে তাকে সাহায্য করতেন। এসব খবর স্বামী ব্রহ্মানন্দর দিনলিপিতে স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ আছে।

স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী অনুরাগিণীরাও নিঃশব্দে কীভাবে চরম বিপদের দিনে তাদের প্রিয় স্বামীজির পরিবারের সভ্যদের রক্ষা করেছিলেন সেও এক দীর্ঘগল্প।

*

ভূপেন্দ্রনাথ দত্তকে ইংরেজের রোষানল থেকে বাঁচাবার জন্য ভগ্নী নিবেদিতা নিজে সহায়সম্বলহীনা হয়েও ২০,০০০ টাকার জামিন দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। যদিও ভূপেন্দ্রনাথ বলেছেন তার প্রয়োজন হয়নি, মাসতুতো ভাই চারুচন্দ্র মিত্র ও ডা. প্রাণকৃষ্ণ আচার্য প্রত্যেকে পাঁচহাজার টাকা করে জামিনে প্রতিভূ হয়েছিলেন।

জেল থেকে মুক্তি পাবার পরে সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে না পালালে অন্য মামলায় ভূপেন্দ্রনাথ আবার জড়িয়ে পড়তে পারেন এই গোপন খবরও সিস্টার নিবেদিতারই সংগ্রহ বলে মনে হয়।

ভূপেন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাঁর মাতার অর্থানুকূল্যে আত্ম-পরিচয় গোপন করে তিনি বিদেশ পাড়ি দিয়েছিলেন। কিন্তু অভিজ্ঞমহলের ধারণা, জাহাজের টিকিটের দায়িত্ব নিবেদিতার পরম অনুগত একজন মানুষ নিয়েছিলেন। ভাগ্যে স্বামী সারদানন্দের অনুরোধে স্বামীজির তিরোধানের পনেরো দিন পরেই মহেন্দ্রনাথ দত্ত কাশ্মীর থেকে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে ফিরে এসেছিলেন।

বিবেকানন্দের জীবনকালেও গর্ভধারিণী জননীর দায়দায়িত্ব তার পরমপ্রিয় গুরুভাই স্বামী ব্রহ্মানন্দ কেমন ভাবে পালন করতেন তার কিছু নমুনা সেকালের সন্ন্যাসীরা রেখে গিয়েছেন।

স্বামী রমানন্দ ও খ্যাতনামা ডাক্তার তাপস বসু একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্বামী হরিহরানন্দ একবার ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যকে বলেছিলেন : আমেরিকা থেকে ফিরেই কিছু টাকা (১০ হাজার) স্বামী ব্রহ্মানন্দর হাতে দিয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, রাখাল, এই টাকাটা তুই মাকে দিয়ে আয়।

ব্রহ্মানন্দ বললেন, মাকে তোমার নিজের হাতে দেওয়া উচিত। স্বামীজি উত্তর দিলেন, না, তুই-ই দিয়ে আয়, আমি দিলে লোকে মনে করবে মা ভাইদের না-জানি কত টাকাই দিয়েছে, মঠকে আর কী দিয়েছে।

সুদূর মার্কিনী প্রবাসে ভূপেন্দ্রনাথের আশ্রয় ও লেখাপড়ার আর্থিক ব্যবস্থা কে করেছিলেন এবং কীভাবে করেছিলেন তা জানার জন্যে নিবেদিতা, সারা বুল ও মিস ম্যাকলাউডের পবিত্র জীবনকথা ধৈর্যের সঙ্গে পাঠ করা প্রয়োজন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত গুরুভ্রাতা বিবেকানন্দর জননী ও তার মাকে সবসময় রক্ষা করে এসেছেন পূজনীয় সন্ন্যাসীবৃন্দ। তারা মাকে সঙ্গে নিয়ে তীর্থযাত্রাতেও বেরিয়েছে। শেষ তীর্থযাত্রা পুরীতে, ১৯১১ খ্রীস্টাব্দে।

কলকাতায় ফিরে এসে মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হলেন বিবেকানন্দ গর্ভধারিণী ভুবনেশ্বরী। তাঁর চিকিৎসা করেছিলেন ডাক্তার জে কাঞ্জিলাল। দেহাবসান মঙ্গলবার ২৫ জুলাই ১৯১১। তাঁর প্রিয় পুত্র স্বর্গলোকে কী সংবাদ পেয়েছিলেন তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু আমরা জানি নিউইয়র্কে নির্বাসিত পুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথ সেদিন বিস্ময়কভাবে মায়ের মৃত্যুস্বপ্ন দেখেছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথের নিজের রচনাতেই এর স্বীকৃতি আছে।

শ্মশানে অবশ্যই উপস্থিত ছিলেন মহেন্দ্রনাথ। আর উপস্থিত ছিলেন বিবেকানন্দর মানসকন্যা নিবেদিতা। শেষ নিশ্বাস ত্যাগের কিছু আগে তিনিও বিবেকানন্দজননীর শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে থেকে এই চিরদুঃখিনী রত্নগর্ভাকে স্বস্তি দিয়েছিলেন।

২৮ জুলাই ১৯১১ নিবেদিতা তার ইংরেজ বন্ধু দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক র‍্যাডক্লিফকে লেখেন : “দুদিন আগে স্বামীজির গর্ভধারিণী দেহরক্ষা করলেন। তাঁর ইনকারনেশন’ অবতারপর্ব শেষ হলো এক অদ্ভুত পথে। শেষনিশ্বাসের কয়েকঘন্টা আগে মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আবার তাঁকে দেখলাম শ্মশানে।”

স্বামীজির মহাসমাধির পরে পুত্রশোকাতুরা জননীর ৯ বছর বেঁচে থাকা। এই পর্বে তার আর্থিক দায়দায়িত্ব কীভাবে মেটে?

বেণীশঙ্কর শর্মার ধারণা, খেতড়ি মহারাজের প্রতিশ্রুত মাসিক একশ টাকা অব্যাহত ছিল মায়ের মৃত্যু পর্যন্ত। হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছে। সুদূর প্রবাসে ভূপেন্দ্রনাথের দায়িত্ব যে বিবেকানন্দর বিদেশি অনুরাগিণীরা গ্রহণ করেছিলেন তা স্পষ্ট। মায়ের মৃত্যুর পরও দেখছি, তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছেন মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড। এমনকি স্বদেশে ভূপেন্দ্রনাথের একটা কাজের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। ইলিনয় থেকে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন, একজন ভূতপূর্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীকে তার ইস্কুলে চাকরি দিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হয়েছিল। স্বামীজির ভাইকে চাকরি দিয়ে সাহায্য করতে পারেননি অসহায় রবীন্দ্রনাথ। তার পরামর্শ ছিল, শাসক ইংরেজের মতিগতি যতক্ষণ না পাল্টাচ্ছে ততক্ষণ আমেরিকায় শিক্ষকতা করাটাই ভূপেন্দ্রনাথের পক্ষে শ্রেয়।

নিবেদিতা চিঠি লিখেছিলেন মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডকে। স্বামীজির অসমাপ্ত দায়দায়িত্ব গভীর ভালবাসায় নিঃশব্দে কারা নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন তার হৃদয়গ্রাহী দৃষ্টান্ত। ১৬ আগস্ট ১৯১১ : “.তোমার পাঠানো ১০ পাউন্ড এসেছে, কিন্তু এতোদিনে নিশ্চয় জেনে গিয়েছ স্বামীজির মা ইহলোকে নেই। …টাকাটা আমি ব্যাঙ্কে রেখেছি, তোমার পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। বোন এখনও ওখানে রয়েছে–অসুখের চিকিৎসা এবং দাহ খরচ ইত্যাদি যথেষ্ট, আমার আন্দাজ তুমি চাইবে এইটা শেষ অর্থ হোক। …দুদিন পরে সূর্যাস্তের সময় দিদিমাও চলে গিয়েছেন। সুতরাং ওপারে স্বামীজি তার আপনজনদের জড়ো করে নিয়েছেন।”

ওপারে আবার নিজের জনদের প্রসঙ্গ কেন? ভগিনী নিবেদিতা বোধ হয় ঠিকই আন্দাজ করেছিলেন। একালের বিবেকময় সন্ন্যাসী কামিনীকাঞ্চন অতি সহজে ত্যাগ করলেও, ভালবাসাকে এবং কর্তব্যকর্মকে বিসর্জন দিতে রাজি হননি। এর জন্যে বিশ্বসংসারকে তিনি তোয়াক্কা করেননি, বহুকাল আগেকার শঙ্করাচার্য ও শ্রীচৈতন্যের মতন।

গর্ভধারিণীকে আজীবন এই সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বলেই স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের বিবেকানন্দ হতে পেরেছেন। এবং হয়তো এই জন্যেই তিনি বহুদিন ধরে বহুমানুষের, বহু জননীর, বহু সন্তানের, বহু ভ্রাতার ও বহু ভগ্নীর হৃদিপদ্মাসনে নিত্য পূজিত হবেন।

স্বামীজির জীবনের কিছু বৃত্তান্ত এই লেখায় সংগ্রহ করে রাখা গেল এই বিশ্বাসে যে গর্ভধারিণী জননীকে না জানলে কোনও মানুষকে পুরো জানা যায় না।

২. সম্রাট-সন্ন্যাসী-সূপকার

গত দেড়শ বছরে এদেশের অভুক্তদের দুঃখ সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছেন কে? এই প্রশ্নের একটিই উত্তর : স্বামী বিবেকানন্দ। এই সেই মানুষ যিনি অসুস্থ এবং অনাহারি দেশবাসীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য নিজের মঠের জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে রাজি ছিলেন। পঞ্জাবের দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে সখারাম গণেশকে ও জনৈক পাহাড়ি ভদ্রলোককে তিনি বলেছিলেন, “দেশের একটি কুকুর পর্যন্ত যতক্ষণ অভুক্ত থাকবে ততক্ষণ আমার ধর্ম হবে তাকে খাওয়ানো এবং তার সেবা করা, বাকি সব অধর্ম।” আরও একবার জনৈক বেদান্তবিশারদের মুখের ওপর তিনি বলেছিলেন, “পণ্ডিতজী, যারা একমুঠো অন্নের জন্য কাতরাচ্ছে প্রথমে তাদের জন্যে কিছু করুন, তারপর আমার কাছে আসুন বৈদান্তিক আলোচনার জন্যে।”

স্বামী বিবেকানন্দর নামাঙ্কিত এক ইস্কুলে আমার পড়াশোনা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই সুবাদে ১৯৪২ সাল থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত স্বামীজির জীবনের একটি অল্প আলোচিত এবং অনালোকিত দিক সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ ও কিছুটা অনুসন্ধানের সুযোগ পাওয়া গিয়েছে, যদিও ইস্কুলে আমার সিনিয়র পটলাদা সেই কতদিন আগে বলেছিলেন, বিবেকানন্দ ও খাওয়াদাওয়া এই বিষয়টির ব্যাপ্তি ও গভীরতা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে তুলনীয়। পটলাদা তখনই সন্দেহ করেছিলেন, এই ধরনের গবেষণা একজীবনের কর্ম নয়, উনচল্লিশ বছরে খাওয়াদাওয়া নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বিবেকানন্দ বিশ্বভুবনকে যেভাবে কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেন তার যথার্থ মূল্যায়ন হতে অন্তত আরও তিনশো নব্বই বছর লাগবে।

আমার তখন হতাশ অবস্থা, উঁচুক্লাসের ছাত্র পটলাদার কাছে করুণভাবে আবেদন করেছিলাম, “থ্রিনাইনটি স্কোর তো আমার হবে না!” পটলাদা বকুনি দিয়ে বলেছিলেন, “তাহলে অ্যাদ্দিনে বিবেকানন্দ থেকে কী শিখলি? দশহাজার মাইলের যাত্রাও সামান্য একটি পদক্ষেপ দিয়ে শুরু করতে হয়। চীনা দার্শনিকের উক্তি, কিন্তু স্বামীজি তো ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছে, চীনারাই একদিন সারা বিশ্বকে আলোকিত করবে, পীতযুগ আর সুদূর নয়।”

পটলাদা আরও বলেছিলেন, “স্বামীজি অ্যান্ড খাওয়াদাওয়া স্টাডিটা তোর মতন পুরুত বংশের সন্তানই শুরু করতে সাহস পাবে, কারণ এর জন্য প্রয়োজন কখনও অনাহার, কখনও অর্ধাহার ও কখনও ভূরিভোজনের। থ্রি-ইন-ওয়ান অভিজ্ঞতা।”

এতোদিন পরে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা চেপে রেখে লাভ নেই, আমাদের ইস্কুলে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর স্মৃতিবিজড়িত কোনো অনুষ্ঠান হলেই ছাত্রদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা ছিল। বিশেষ আকর্ষণ-বিবেকানন্দ প্রবর্তিত ও সমর্থিত ‘দাঁড়া প্রসাদ’, যার অর্থ ভক্তদের বসিয়ে না খাইয়ে তাদের হাতে সরা অথবা মোড়ক বিতরণ করা। এইসব বিতরণকার্যে পটলাদার সবিশেষ ভূমিকা থাকতো। বিভিন্ন প্রসাদের প্রতি পটলাদার যে একটু বাড়তি দুর্বলতা ছিল তা পটলাদা কখনও চেপে রাখতেন না। কিন্তু বারবার বোঁদে খেয়ে পটলাদা স্বামীজি সম্বন্ধে কিছু গবেষণা চালিয়ে বেশ কিছু গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এবং আমাকে উসকে দিয়েছিলেন, “হেডমাস্টারমশায়কে বল, পর্যাপ্ত পরিমাণে রসগোল্লা খেতে পাবেন একমাত্র এই প্রত্যাশাতেই নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেননট বোঁদে।” পটলাদার মতে, “বোঁদেটা হলো বঙ্কিমচন্দ্রের ফেবারিট।” বিয়াল্লিশ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে মিছিলে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে হাওড়ায় পুলিশের খপ্পরে পড়ে পটলাদা থানায় বলেছিলেন, “বন্দেমাতরম্ কখনোই বলিনি, আমি স্লোগান দিয়েছি বোঁদে খেয়ে মাথা গরম!”

রসগোল্লার প্রসঙ্গে হেডমাস্টার সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য মহাশয় সোজা ব্যাটে খেলেছিলেন, “শোন, স্বামী বিবেকানন্দ মিষ্টি খাওয়ার লোক ছিলেন না, তিনি যা পছন্দ করতেন তার ব্যবস্থা করলে তোমাদের চোখে জল ছাড়া কিছু থাকবে না, তার নাম লঙ্কা।”

পটলাদা পরিস্থিতিটা বুঝে গেলেন। এ বড় শক্ত ঘাঁটি, এখানে লুজ বল একেবারেই দেওয়া চলবে না। এরপরেই শ্রদ্ধেয় পটলাদাকে আমি একটা নোটবই উপহার দিয়েছিলাম, মঠমিশনের ভোজনযোগ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ মাঝেমাঝে যাতে তিনি দুটো মলাটের মধ্যে বন্দি করতে পারেন।

তথ্য সংগ্রহে নেমে নতুন নেশায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন পটলাদা, তার ইচ্ছে, যদি কোনোদিন ইস্কুলে ও কলেজের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে সন্ন্যাসী হন, তাহলে অবশ্যই নাম নেবেন স্বামী ভোজনানন্দ। তিনি খবর পেয়েছেন, কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ প্রয়োজন হলেও রামকৃষ্ণ মঠমিশনে ভোজনে তেমন কোনো বাধানিষেধ নেই। খাওয়াতে বড় ভালবাসতেন দক্ষিণেশ্বরের বড় কর্তা এবং তার প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এবং সেই ট্রাডিশন আজও রামকৃষ্ণ মিশনের সর্বত্র অব্যাহত রয়েছে। ভক্তজনদের মধ্যে অকাতরে প্রসাদ বিতরণ করে আনন্দ পান না এমন কঠিনহৃদয় সন্ন্যাসী আমি আজ পর্যন্ত রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনে দেখিনি।

পটলাদা তার নোট বইতে অনেক কুইজ সযত্নে সংগ্রহ করে রাখতেন। একদিন ঘোষণা করলেন, “দু’খানা প্রমাণ সাইজ জিভে-গজা পুরস্কার পাবি, যদি বলতে পারিস একমাত্র কোন্ দেশে সম্রাট, সন্ন্যাসী ও সূপকার অর্থাৎ রাঁধুনিকে একই নামে ডাকা হয়?” উত্তর দিতে পারলাম না! কনসোলেসন প্রাইজ হিসেবে একখানা জিভে-গজা আমার শ্রীহস্তে অর্পণ করে পটলাদা বললেন, “ইন্ডিয়া! শব্দটা হলো মহারাজ! একমাত্র এই পবিত্র দেশে সম্রাটও মহারাজ, সন্ন্যাসীও মহারাজ, আবার রাঁধুনিও মহারাজ। বোধহয় এই কারণেই বিবেকানন্দ ছিলেন নরেন্দ্র, সন্ন্যাসী, আবার ওয়ার্লডের শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি। অনেক খোঁজখবর সংগ্রহ করতে হবে তোকে এবং আমাকে, তবে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, ওয়ার্লডের মধ্যে তিনিই একমাত্র ভারতীয় যিনি সপ্তসাগর পেরিয়ে আমেরিকায় গিয়ে বেদান্ত ও বিরিয়ানি একসঙ্গে প্রচার করবার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন।”

হাওড়া বিবেকানন্দ ইস্কুলের গণ্ডি পেরোবার পরেও পটলাদা তার নোটবই ও স্বামীজি সম্পর্কে গবেষণা ত্যাগ করেননি। আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। আমি বলেছি, “খুবই কঠিন বিষয় পটলাদা। এই খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনো বইতে কোনো রেফারেন্স পাচ্ছি না, তেমন কোন খাবারের দোকানের সন্ধানও পাচ্ছি না যেখানে বিবেকানন্দ নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করতেন বা রেসিপি সংগ্রহ করতেন।”

পটলাদা প্রচণ্ড বকুনি লাগালেন। “তুই শুধু খেতেই শিখেছিস, গবেষণা করার ব্যাপারটা এখন তোকে শিখতে হবে, দোকান পাবি কোথায়? জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা স্বামীজি তো আমেরিকা এবং ইউরোপে তার আদরের ইন্ডিয়াকে প্রচার করলেন, আর এদেশে যখন ছিলেন তখন তার হাতে পয়সা কোথায়? হঠাৎ বাবা মারা যাবার পরে তো অনাহার অথবা অর্ধাহার। পরে যখন বিশ্ববিজয় করে স্বদেশে ফিরে এলেন তখন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে শরীরটা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, মণ্ডা-মিঠাই তো দূরের কথা, টানা একুশ দিন জল না খেয়ে কাটাতে হয়েছিল কবিরাজের নির্দেশে।”

“তাহলে! যে লোকের খাওয়াদাওয়াই বারণ, একখানা বরফি খেয়েছে বলে গুরুভাইরা যাঁর নামে ডাক্তারের কাছে অভিযোগ করছে এই কারণেই তার অসুখ বেড়েছে, তাকে নিয়ে কীভাবে লিখবো?”

পটলাদা কেসটা জানতেন। “বাগবাজারের এই ডাক্তারের নাম শশীভূষণ ঘোষ। এঁকে আলমোড়া থেকে বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ মিঠাই বরফি সম্পর্কে কী উত্তর দিচ্ছেন তা ধৈর্য ধরে খুঁজে বার কর। দেখবি, বিবেকানন্দ তার প্রিয় শশী ডাক্তারের কাছে নিবেদন করছেন, আমি লউ-এ একটি বরফির ষোলভাগের এক ভাগ খেয়েছিলাম, আর যোগেনের মতে (স্বামী যোগানন্দ) ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ। যোগেন যা লিখেছে তা ভ্রূক্ষেপ না করবার জন্যে ডাক্তারের কাছে। করুণ আবেদন জানাচ্ছেন আমাদের যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ।”

আমাকে অবশ্য তেমন ঘাবড়াতে দেননি পটলাদা। বলেছিলেন, “সাহস অর্জন কর, একেবারে গোড়া থেকে শুরু কর আমার মতন, ইস্কুলেই তো পড়েছিস, মর্নিং শোজ দ্য ডে, ভোরবেলাটা দেখলেই বাকি দিনটা কেমন যাবে তা বোঝা যায়।”

“তা হলে আপনি বলছেন, ভবিষ্যতেও আমার দ্বারা কিসসু হবে না, আমি চিরকালই এইরকম বোকা-বোকা থেকে যাব?”

পটলাদা বললেন, “ওরে আমরা স্বামী বিবেকানন্দর জীবন নিয়ে আলোচনা করছি, তোর-আমার লাইফ নিয়ে নয়। আমার প্রার্থনা, তুই পরিণত বয়সে ছ’সাত ভলমের একখানা জব্বর বই লিখবি ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভোজনাদি’–দেখবি বইটা শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত ও গরম জিলিপির মতন বিক্রি হচ্ছে।”

“কথাটা হট কেক’!”

“রাখ তোর হট কেক, স্বামী বিবেকানন্দ পাঁউরুটিকেই সন্দেহ করতেন, তা হট কেক!”

পুরনো কথায় ফিরে এলেন পটলাদা। তিনি তখন কঁকুড়গাছির কাছে কোথায় পড়াশোনা করেন, চান্স পেলেই যোগোদ্যান, অদ্বৈত আশ্রম এবং বেলুড় মঠ ঘুরে আসেন এবং প্রবীণ সাধুদের বিশেষ প্রিয়পাত্র হিসেবে গোপন রিসার্চের কিছু কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে নোটবইতে লিখে ফেলেন। বিবেকানন্দকে স্বচক্ষে দেখেছেন এমন কেউ কেউ তখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের সঙ্গে পটলাদার যোগাযোগ হয়েছে।

পটলাদা বললেন, “বিদ্রোহী বিবেকানন্দর আগাম নমুনা আমরা কবে প্রথম দেখলাম বল তো?”

“ঠাকুর জানেন।”

“ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পাদপদ্মে তখনও আশ্রয় মেলেনি, সিমুলিয়ার তিন নম্বর গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে নরেন্দ্রনাথ দত্তর বয়স তখন মাত্র পাঁচ বছর। সংঘর্ষটা মায়ের সঙ্গে এবং রণস্থল খাওয়ার আসন। ডান হাতে খেতে খেতে বাঁ হাতে গ্লাস থেকে জল খাওয়া নিয়ে প্রবল মতবিরোধ! এঁটো হাতে গ্লাস ময়লা করার ইচ্ছে নেই নরেনের। কিন্তু সেযুগে বাঁ হাতে জল খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না, কিন্তু মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে নরেন বঙ্গীয় রীতি পাল্টালেন, আর আজকাল তো ভাতখাওয়ার সময়ে এঁটো হাতে গেলাস ধরলে মায়েরাই বকুনি দিচ্ছেন। বুঝতে পারছিস একটা পাঁচবছরের ছেলের বৈপ্লবিক গুরুত্ব? তুই-আমি সেখানে উপস্থিত থাকলে বলে দিতে পারতাম এ-ছেলে ক্ষুধানিবৃত্তির ব্যাপারে একদিন অবশ্যই হিসট্রি ক্রিয়েট করবে।”

আমাদের পটলাদাও একসময়ে নিঃশব্দে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, উপার্জনের জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। বিলেত যাওয়ার আগে পটলাদা আমাকে রসনারসিক বিবেকানন্দ-গবেষণা সম্পর্কে বহুবিধ পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “একটা নয়, অন্তত ১০৮টা পথ দিয়ে এই বিষয় মন্দিরে পৌঁছতে পারিস। এক : উনচল্লিশ বছরটা বেশ কয়েকটা পর্বে ভাগ করে নিতে পারিস। শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বে বিবেকানন্দ এক একরকম খাবারের ওপর নির্ভর করছে এবং অপরকে খাইয়েছে। পাঁচ বছর থেকে জীবনের শেষ দিন ৪ঠা জুলাই ১৯০২ পর্যন্ত রস ও রসনার কালানুপাতিক ইতিহাসটা ধাপে ধাপে উন্মোচিত হতে পারে।”

“আরও অনেক পথ আছে, যেমন আমিষ না নিরামিষ? স্বামীজির কুষ্ঠিটা একবার দেখে নিতে হবে, বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা ওঁর ভাগ্যে সবসময় লেখা রয়েছে, ওঁর বিরাটত্ব প্রমাণের এটাও মস্ত এক মাপকাঠি। আমিষ নিরামিষ পছন্দ না হলে রয়েছে তৃতীয় পথ; কোন স্কুলের রান্না তার পছন্দ? বাঙালি? না নবাবী? না সায়েবী? প্রত্যেকটির আবার বহু শাখা বর্ধমানি না ঢাকাই? লাহোর না লখনউ? আমেরিকান? না ফ্রেঞ্চ? না জার্মান? ইটালিয়ান? না স্প্যানিশ?”

পটলাদা একটুকরো কাগজ দেখতে দেখতে বলেছিলেন, “এই তো কলির সন্ধে! বাড়ির রান্না? না হৃষিকেশের ঝুপড়ির রান্না? না ফাঁইভস্টার মার্কিনী হোটেলের রান্না?”

আমি ঘাবড়ে যাচ্ছি কি না তা লক্ষ্য না করে পটলাদা বললেন, “ধর্মপথেও অনুসন্ধান করা যায় হিন্দু রান্না, মুসলিম রান্না, বৌদ্ধ রান্না, জৈন রান্না, চার্চের রান্না, মন্দিরের রান্না।”

“যথেষ্ট হয়েছে পটলাদা, মাত্র থার্টি নাইন ইয়ার্সে রসনার কত বৈচিত্র্যেকেই না স্বামীজি খুঁজে বেড়িয়েছেন।”

পটলাদার আশঙ্কা, “আমি কাছে না থাকলে তুই সব ভুলে যাবি, সাবজেক্টগুলো ভালভাবে ব্রেনে ঢুকিয়ে নে, স্বামীজির মতন স্মৃতিশক্তি নিয়ে তো তুই আমি এই দুনিয়ায় ভূমিষ্ঠ হইনি। যেমন ধর পূর্বদেশের রান্না? না ওয়েস্টার্ন রান্না? ঝাল, না বেঝাল? ফল না মূল? আইসক্রিম না কুলপি? লঙ্কা না গোলমরিচ? অ্যাসপারাগাস না ডেঙোর উঁটা? এসব নিতান্ত সাধারণ প্রশ্ন নয়! প্রত্যেকটার পিছনে বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল, কোরান পর্যন্ত উঁকি মারছে।”

আমি নতমস্তকে পটলাদার বক্তব্য নিজের খাতায় নোট করে নিয়েছি। পটলাদা বললেন, “আরও দার্শনিক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে তিনি ভয় পেতেন না! অতিভোজন, না অনশন? কোনটি শ্রেয়? তুই নোট করে নে, মতলীলার শেষপর্বে এসে স্বামীজি পরামর্শ দিচ্ছেন, অতিভোজন অপেক্ষা অনশন শ্রেয়! পরমুহূর্তেই কঠিন প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবার আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন, অনশন অপেক্ষা অর্ধভোজন যে শ্রেয় তা কারুর বলার অপেক্ষা রাখে না।”

এরপরেই পটলাদা বলেছিলেন, “অনেক পথ আমাদের দুজনকে একসঙ্গে অতিক্রম করতে হবে, কারণ খেয়ে এবং খাইয়ে অনেক বড় বড় লোক হয়ত অনেক নাম করেছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে ক’জন রান্নাঘরে প্রবেশ করে শত শত রান্নার রেসিপি আবিষ্কার করেছেন? এসব সম্ভব। হয়েছে এই জন্যে যে আমাদের হিরো কখনও ধনীর দুলাল, কখনও বা ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসী, কখনও বিশ্ববিজয়ী বক্তা। কখনও স্বামীজির সামনে। বিলাসবহুল হোটেলের শতপদের বুফে, আবার কখনও বা কচুপাতায় ছড়ানো ভাত ও ত্যালাকুচো পাতার ঝোল। কখনও বা স্রেফ অনাহার। এখন প্রশ্ন, কতদিন একটানা অনাহারে থাকতে হয়েছে এই মহামানবকে? ক্ষুধার সময় অন্ন না মেলার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কোথায় কোথায় তার হয়েছে? আমাদের এই কলকাতায়? না পরিব্রাজকের উত্তরাখণ্ডে? না অন্নপূর্ণার কৃপাধন্য মার্কিনদেশে?”

আমার চোখ দুটি অক্ষিগোলক থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এই আশঙ্কা হওয়ামাত্রই পটলাদা বলেছিলেন, “ভয় পাসনি। যদি আবিষ্কার করতে পারিস, কোন খাবারটি বীরসন্ন্যাসীর সব চেয়ে প্রিয় ছিল, কোন জিনিসটি তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না এবং কোন অভিজ্ঞতার আলোকে স্বামীজি ঘোষণা করতে সাহস পেয়েছিলেন, ভাল সন্ন্যাসী হতে হলে ভাল রাঁধুনিও হওয়া দরকার, তা হলে আমরা দু’জনেও এই দুনিয়াতে একটু দাগ রেখে যাব।”

পটলাদা এরপরেই বলেছিলেন, “এই নোটবুকখানা সঙ্গে নিয়ে বিদেশে চলোম। যথাসময়ে অনেক খবরাখবর পাবি সূপকার বিবেকানন্দ সম্বন্ধে! তুই নিজেও থেমে যাসনে, বুঝিয়ে দিস সবাইকে, প্রাচীন ভারতে সূপকার মানে রাঁধুনি এবং একমাত্র এই দেশেই রাঁধুনি ও ঠাকুর সমার্থক শব্দ। তুই চালিয়ে যা, তারপর টুপাইস রোজগার করে আমিও তো ফিরে আসছি।”

.

ঘটনাচক্রে পটলাদার আর এদেশে ফিরে আসা হয়নি; বিদেশেই তিনি ঘর সংসার পেতেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দ-অনুসন্ধান কখনও ত্যাগ করেননি। বেশ কিছু চিঠিপত্র নানা খবরে বোঝাই করে বিমান ডাকে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমিও কিছু কিছু খবর বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রহ করেছি নানা সূত্র থেকে, যার মধ্যে বিবেকানন্দর নিজের লেখা, নিজের চিঠি, নিজের বক্তৃতা ছাড়াও রয়েছে নানাজনের স্মৃতিকথা। এইসব সংগৃহীত হতে মহাসমাধির পরেও এক শতাব্দী লেগে গিয়েছে। শতাব্দীর সন্ধানেও সব খবর যে এখনও সংগৃহীত হয়নি তা জোরের সঙ্গেই বলা চলে। এক রান্নার পর্ব শেষ হতে না হতেই আরেক রান্নার সময় এসে যায়, কিন্তু কোথাও তো অপেক্ষমাণ অতিথিদের জানাতে হবে, খাবার রেডি, আসুন, মহামানব বিবেকানন্দকে নতুন এক ভূমিকায় দেখুন এবং আমাদের মতন আপনিও বিস্ময়ে অভিভূত হোন।

.

মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর পিতৃকুল ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব, শুধু নিরামিষ নয় সেখানে পরিবার সদস্যদের গোবর-তুলসীও নিয়মিত গ্রহণ করার রীতি ছিল। এই প্রভাব শুরুতে সিমুলিয়ার আমিষভক্ষক দত্তপরিবারেও পড়েছিল। আমরা একটি দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি–গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে খেতে বসে বালক নরেন পাতে কিছু নিতে রাজি হচ্ছেন না, কারণ তরকারির সঙ্গে মাছের স্পর্শ ঘটেছে এবং পরিবেশিকা দিদি স্বর্ণময়ীর সঙ্গে তার বাদানুবাদ চলেছে। পিতৃদেব বিশ্বনাথ নিজেও ছিলেন একজন ভোজনরসিক ও রন্ধন-বিলাসী। বাড়িতে বাবুর্চি আনিয়ে নানা মোগলাই খাদ্যের আয়োজন তিনি প্রায়ই করতেন। ভাই-বোনের কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনে স্নানের জায়গা থেকে পিতৃদেব বিশ্বনাথ বিরক্তি প্রকাশ করলেন, “ওর চোদ্দপুরুষ গেঁড়িগুগলি খেয়ে এল, আর এখন ও সেজেছে ব্রহ্মদত্যি, মাছ খাবে না!”

ব্রহ্মদত্যিরা যে মাছ-মাংস স্পর্শ করে না তা সেই প্রথম জানলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিমুলিয়ার দত্তপরিবারে যে যথেষ্ট রুচিপরিবর্তন ঘটেছে তাও দেখা গেল তখনকার সি পি অর্থাৎ সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসের পথে। মা-বাবার সঙ্গে নরেন, ভ্রাতা মহিম ও বোনরা চলেছে রায়পুরে। ঘোড়াতালাওতে মাংস রান্না হল। দিদিমার প্রভাবে মেজভাই মহিম তখন মাছ-মাংস মুখে দেয় না। পরবর্তীকালে মহেন্দ্রনাথ লিখছেন : “আমি খাব না, বমি আসতে লাগল। দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল–’খা। তারপর আর কি? বাঘ নতুন রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”

মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠার আগে নরেনের সাংগঠনিক শক্তির প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছে এই রান্নার ক্ষেত্রেই। নরনারায়ণের সেবার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে এক অভাবনীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিডি ক্লাব’ সংগঠন, যার বাংলা মহেন্দ্রনাথ করেছেন ‘পেটুক সঙ্ঘ’–যার উদ্দেশ্য কেবল ভোজন নয়, সেই সঙ্গে রান্না নিয়ে রীতিমত রিসার্চ। প্রতিষ্ঠাতার দৃষ্টি সারা বিশ্বের দিকে প্রসারিত। ভবিষ্যতের বিশ্ববিবেক এই সময় পুরনো বইওয়ালার কাছ থেকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত ফ্রেঞ্চ রান্নার বই কিনতে আরম্ভ করেছেন। যে ফরাসী জাত অর্ধসভ্য ইউরোপকে ভদ্রস্থভাবে রান্নাবান্না করে খেতে দেতে শিখিয়েছে, যে ফরাসীজাত ও সভ্যতার গুণগানে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ একদিন মুখর হবেন, তার আদিতে কমবয়সের ফ্রেঞ্চকুকিং এর সাধনা। ফরাসীরা বড়ই সৃষ্টিশীল, এঁদের সংস্পর্শে যাঁরাই আসেন তাঁরাও সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন। আমরা তার স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছি গ্রিডি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতার গবেষণামূলক রন্ধনে। এই পর্যায়ে নরেন্দ্রনাথের সফলতম আবিষ্কার হাঁসের ডিম খুব ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে কড়াইশুটি ও আলু দিয়ে ভুনি-খিচুড়ি। পলোয়ার চেয়ে এই রান্না যে অনেক উপাদেয় একথা বহুবছর পরেও বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন! বাবা রাঁধাতেন কালিয়া এবং পলোয়া, আর সুযোগ্যপুত্র আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে নতুন ডিশের মাধ্যমে পূর্বপশ্চিমকে একাকার করে দিলেন।

কিন্তু শুধু হাইলেভেলের রান্না নয়, এই ক্লাবের অন্যতম সভ্য হয়েছিলেন রাখাল, যিনি পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ নামে এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে রামকৃষ্ণ মঠমিশনের প্রকৃত রক্ষাকর্তা হয়েছিলেন। কুস্তিগীর রাখাল যে প্রতিদিন শরীরচর্চার পরে আধসের কচুরি ও আনুপাতিক আলুচচ্চড়ি খেতেন তা এখন আমাদের অজানা নয়। বলাবাহুল্য, তখন কচুরির সের ছ’আনা, আরও আগে নাকি তিন আনা সের ছিল, কিন্তু বিবেকানন্দ ভ্রাতা মহিমবাবু সেই স্বর্ণযুগ দেখেননি!

কিন্তু কচুরি, সিঙাড়া, খিচুড়ি, পলোয়ার বাইরেও আর একটি খাদ্যের প্রতি স্বামীজির প্রবল টানের প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। পরবর্তী জীবনে জেলা জজ নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, কম বয়সে নরেন তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন, “কৈলাস খাবারওয়ালা নানা রকমারি খাবার ঝুড়ি ভরে রোজ বাড়িতে আনত। সব ছেলেরা মিলে পরমানন্দে জলপান করা হত। আমাদের সব কারুর দু’পয়সা বরাদ্দ, কারুর চারপয়সা, কারুর দু’আনা।…স্বামীজির সিনিয়র গ্রেড, ন’কাকার র‍্যাঙ্কের…জিবে গজা ওঁর বড়ই প্রিয়, একদিনের কথা, ওঁর বখরায় যা পেলেন, তাতে সন্তুষ্ট নন। একখানা গজা হঠাৎ তুলে নিয়ে সব্বাইয়ের সামনে নিজের জিবে ঠেকালেন এবং অম্লান বদনে হাঁড়ির মধ্যে টপ করে ফেলে হো হো করে হেসে বললেন, ওরে তোরা কেউ গজা খাসনি–এই য্যা–সব এঁটো হয়ে গেল। হাঁড়িসুদ্ধ একাই মেরে দিলেন। কী আমোদই করতেন!”

আরও কিছু পরে কাশীপুর উদ্যানবাটী পর্বে কচুরি ইত্যাদি জলখাবারের জয়যাত্রা অব্যাহত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মেজভাই মহিমকে কাশীপুরে দেখে গুরুভাই শশী (পরে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ) অতি আগ্রহ সহকারে ফাগুর দোকান থেকে গরম লুচি, গুটকে কচুরি ও কিছু মিষ্টি এনে নরেন ও তাকে খাওয়ালেন।

শুনুন আরেকদিনের কথা। নরেন একদিন গায়ক পুলিন মিত্রর মেস বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন। কচুরি ভেজে দেওয়া হয়েছে, খাচ্ছেন, খুব ভাল লেগেছে। একটু খেয়ে পুলিনকে দিলেন। পুলিন খাচ্ছেন। তখন নরেন আবার বলছেন–”এটা থেকেই একটু দেনা! বেশ চমৎকার, কি বলিস?”

এই বিবেকানন্দ কিন্তু জগৎ চষে বেড়াবার পর বাঙালি ময়রার দোকান সম্বন্ধে মত একেবারেই পাল্টে ফেলেছিলেন। শুধু বক্তৃতায় না, লিখিতভাবে তিনি জানিয়েছেন, “এই যে ঘরে ঘরে অজীর্ণ, ও ঐ ময়রার দোকানে বাজারে খাওয়ার ফল।…ঐ যে পাড়াগেঁয়ে লোকের তত অজীর্ণদোষ…হয় না, তার প্রধান কারণ হচ্ছে লুচি-কচুরি প্রভৃতি ‘বিষলড়ুকের’ অভাব।” এইখানেই ইতি টানা যুক্তিযুক্ত মনে না করে বিরক্ত বিবেকানন্দ নিজের হাতে লিখে চলেছেন, “ভাজা জিনিসগুলো আসল বিষ। ময়রার দোকান যমের বাড়ি। ঘি-তেল গরমদেশে যত অল্প খাওয়া যায়, ততই কল্যাণ। ঘিয়ের চেয়ে মাখন শীঘ্র হজম হয়। ময়দায় কিছুই নাই, দেখতেই সাদা। গমের সমস্ত ভাগ যাতে আছে, এমন আটাই সুখাদ্য।…ময়রার দোকানের খাবারের খাদ্যদ্রব্যে কিছুই নেই, একদম উল্টো আছেন বিষ-বিষ-বিষ। পূর্বে লোকে কালেভদ্রে ঐ পাপগুলো খেতো; এখন শহরের লোক, বিশেষ করে বিদেশী যারা শহরে বাস করে, তাদের নিত্যভোজন হচ্ছে ঐ।…খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খানায় ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাও, সস্তাও হবে, কিছু খাওয়াও হবে।”

দীর্ঘদিনের ভ্রমকে এক ধমকে মুছে ফেলা যাবে না জেনেই সমাজসংস্কারক, জাতির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বিবেকানন্দ আবার গোলাবর্ষণ শুরু করেছেন : “ধনী হওয়া, আর কুড়ের বাদশা হওয়া–দেশে এককথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।…যেটা লুচির ফুলকো ছিঁড়ে যাচ্ছে, সেটা তো মরে আছে।…যার দু’পয়সা আছে আমাদের দেশে, সে ছেলেপিলেগুলোকে নিত্য কচুরি মণ্ডামেঠাই খাওয়াচ্ছেন!! ভাত-রুটি খাওয়া অপমান!! এতে ছেলেপিলেগুলো নড়ে-ভোলা পেটামোটা আসল জানোয়ার হবে না তো কি? এত বড় ষণ্ডা জাত ইংরেজ, এরা ভাজাভুজি মেঠাইমণ্ডার নামে ভয় খায়..আর আমাদের…আব্দার লুচি কচুরি মেঠাই ঘিয়ে ভাজা, তেলেভাজা। সেকেলে পাড়াগেঁয়ে জমিদার এককথায় দশ ক্রোশ হেঁটে দিত,…তাদের ছেলেপিলেগুলো কলকেতায় আসে, চশমা চোখে দেয়, লুচি কচুরি খায়, দিনরাত গাড়ি চড়ে, আর প্রস্রাবের ব্যামো হয়ে মরে; ‘কলকেত্তা’ই হওয়ার এই ফল!!”

পটলাদা একবার বিলেত থেকে তাঁর প্রিয় হাওড়ায় ছুটি কাটাতে এসেছিলেন। মূল্যবান সময়টুকুতে স্বামীজির এই কচুরি সম্পর্কে সাবধানবাণী সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। পটলাদা বললেন, “কচুরিবিরোধী মানসিকতাটা স্বামীজির জীবনের শেষপর্বের ঘটনা, তার আগে ১৮৯৬ সালে লন্ডনে বিশ্ববিজয়ী স্বামীজি বাড়ির বেসমেন্টে গিয়ে নিজেই মাখন গলিয়ে ঘি করে আলুপুর দেওয়া কচুরি ও বেশ ঝাল ঝাল চচ্চড়ি করে–ওপরকার ডাইনিং রুমে ফিরে এলেন।”

“দুর্দান্ত খবর পটলাদা, মহামানবের পরস্পরবিরোধী ঘটনাবলী দু’একটা না উপস্থিত করলে আজকাল পাঠক-পাঠিকারা সন্তুষ্ট হতে চায় না।”

“সেবারে লন্ডনে ভীষণ ব্যাপার হয়েছিল। স্বামীজির বাড়ির কাজের মেমটির নাম মিস্ কেমিরন। কচুরি ও চচ্চড়ি খেতে খেতে স্বামী সারদানন্দ সেবার বিবেকানন্দভ্রাতা মহেন্দ্রনাথকে বললেন, “ওহে, মিস কেমিরনের জন্যে একটু তুলে রেখে দাও নইলে বিকেলে এসে ঝগড়া করবে।” পরবর্তী ঘটনা : মিস কেমিরন এলেন এবং যথারীতি জানতে চাইলেন, “তোমাদের কী রান্না রয়েছে বল। নিজেরাই সব ভাল জিনিস খাবে আর আমার জন্যে কিছু রাখবে না।” সারদানন্দকে তিনি বললেন, “ইউ কুকি সোয়ামি, তুমি কেবল খাবে, আর খেয়ে খেয়ে মোটা হবে, আর আমার জন্যে কিছু রাখবে না।” দুখানা কচুরি আর আলুচচ্চড়ি অবশিষ্ট ছিল, তাই মিস কেমিরনের হাতে গেল।

কচুরি কিভাবে খেতে হয় তা সায়েব-মেমদের অজানা। মিস কেমিরন জিজ্ঞেস করলেন, “কী দিয়ে খেতে হয়? চিনি দিয়ে না নুন দিয়ে?” মিস কেমিরন প্রথমে চিনি ট্রাই করলেন। ভাল লাগল না। সারদানন্দ পরামর্শ দিলেন, নুন দিয়ে ট্রাই করতে। এরপরে ভীষণ ব্যাপার হয়েছিল, চামচে দিয়ে আলুচচ্চড়ি মুখে দিয়ে মিস কেমিরন চিৎকার করে উঠলেন–”ও, কি ভয়ঙ্কর জিনিস। গোলমরিচকে লঙ্কা দিয়ে বেঁধেছে”, এই বলে দু’হাতে নিজের দু’গাল চড়াতে লাগলেন, ওহো! বিষ! বিষ! পয়জন!

আন্দাজ করছি, এরপরে ইংরেজনন্দিনী আর কখনও কচুরি ও চচ্চড়ি মুখে দেবে না। পটলাদা বললেন, “তুই নোট ক’র মানুষের প্রতি ভালবাসা, গরম চা, সুগন্ধী তামাক এবং মাথাখারাপ করে দেওয়া লঙ্কা এই চারটে ব্যাপারে বিবেকানন্দ ছিলেন সীমাহীন।”

.

ফরেনে ফিরবার আগে তাঁর আদি নোটবইখানা পটলাদা আমার কাছে রেখে গিয়েছিলেন।

পটলাদার সংগ্রহের দিকে একবার তাকিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া। শেষের শব্দটিকে অসৌজন্যপূর্ণ ভাববেন না, স্বয়ং রামকৃষ্ণদেব একবার শিবনাথ শাস্ত্রীর ঈশ্বরভক্তি বোঝাতে গিয়ে অন্য শব্দ না পেয়ে বলেছিলেন, যেন রসে ফেলা ছানাবড়া।

“পটলাদা, আপনি যা যা লিপিবদ্ধ করেছেন বিভিন্ন সূত্র থেকে তার সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত পেশ করতে হলে সাতশ-সাঁইত্রিশ পাতার বই লিখতে হবে।”

পটলাদা; “বিষয়টাও বিশাল, একথা ভুললে চলবে না। সেবার তোকে বলেছি, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে রসনারসিক বিবেকানন্দকে দেখলে মাথা ঘুরে যায়! মনে হচ্ছে, সব দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করতে হলে তোর আরও উনচল্লিশ বছর লেগে যাবে, তার থেকে বরং ব্যাপারটাকে কালানুক্রমিক সাজিয়ে নে, তাহলে সংক্ষিপ্তসার লিখতে

তেমন কষ্ট হবে না।”

প্রথম পর্বটাকে সুখাসনে সুখাহার পর্ব বলা যেতে পারেনরেনের বাবা যতদিন বেঁচে আছেন এবং দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচয়ের আদিপর্ব কেবল শুরু হয়েছে। এই পর্বে দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর তার প্রিয় শিষ্যটিকে দেখেই মাখন, মিছরি ও কতকগুলো সন্দেশ এনে স্বহস্তে খাইয়ে দিতে লাগলেন। “আমি যত বলিতে লাগিলাম আমাকে খাবারগুলি দিন। আমি সঙ্গীদের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইব। তিনি তাহা কিছুতেই শুনিলেন না।”

এই পর্বে ঠাকুর বোধ হয় নরেনকে হুঁকোও খাইয়েছিলেন। নিকটজনের সাবধানবাণী, নরেন হোটেলে খায়! পরমহংসদেবের উত্তর : “ওরে শালা তোর কি রে?…তুই শালা যদি হবিষ্যিও খাস, আর নরেন যদি হোটেলে খায়, তা হলেও তুই নরেনের সমান হতে পারবি না।”

নরেনের মধ্যে সত্যকে চেপে রাখার প্রবৃত্তি ছিল না। একবার হোটেলে খেয়ে এসে ঠাকুরকে বললেন, “মহাশয় আজ হোটেলে, সাধারণে যাহাকে অখাদ্য বলে, খাইয়া আসিয়াছি।” ঠাকুরের উত্তর, “তোর তাতে দোষ লাগবে না।”

বোঝা যাচ্ছে তরুণ বয়সে হোটেলে খাওয়ায় নরেনের প্রবল উৎসাহ ছিল। এই সময়েই বোধ হয় তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন : “এরপর দেখবি কলকাতা শহরে গলির মোড়ে মোড়ে, রাস্তায় রাস্তায়, পানের দোকানের মতন চপ কাটলেটের দোকান হবে!”

.

শুনুন শ্রীশ্রীমায়ের মুখে নরেনের রান্নার কথা। ঠাকুরের জন্য রান্নার কথা উঠেছে। “..আমি যখন ঠাকুরের জন্য রাঁধতুম কাশীপুরে, কঁচা জলে মাংস দিতাম। কখানা তেজপাতা ও অল্প মশলা দিতুম, তুলোর মতো সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিতুম।…নরেন আমার নানারকমে মাংস রাঁধতে পারত। চিরে চিরে ভাজত, আলুচটকে কিসব রাঁধত,তাকে কি বলে?” বোধ হয় চপ-কাটলেট হবে।

বাবার অকালমৃত্যুর পর থেকে নরেন্দ্রনাথের জীবনে যে পর্বের শুরু হলো সেখানেই অনাহার ও অর্ধাহারের ছবি আমরা দেখতে পাই। এই পর্ব চলেছে বরানগর পেরিয়ে পরিব্রাজক বিবেকানন্দের সঙ্গে সঙ্গে মুমবাইয়ের জাহাজঘাটায় খেতড়ির দেওয়ান মুন্সি জগমোহনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া পর্যন্ত।

বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব কোন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছিল তা স্বামীজির মুখেই শোনা যাক :”প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপন অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার নাই, সেদিন মাতাকে আমার নিমন্ত্রণ আছে’ বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে ঘরে বাহিরে কাহারও নিকট ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।”

দেহত্যাগের কিছুদিন আগে প্রথম পর্বের দুঃখময় দিনগুলো ভোলা স্বামীজির পক্ষেও সম্ভব হয়নি। শিষ্যকে তিনি বলছেন “কিসব দুঃখের দিন না আমাদের গেছে! একসময় না খেতে পেয়ে রাস্তার ধারে একটা বাড়ির দাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলুম–মাথার ওপর দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। তবে হুঁশ হয়েছিল। অন্য একসময়ে সারাদিন না খেয়ে একাজ সেকাজ করে বেড়িয়ে রাত্রে ১০/১১টার সময় মঠে গিয়ে তবে খেতে পেয়েছি–এমন একদিন নয়।”

মঠ বলতে আদিপর্বের বরাহনগর মঠ বলেই মনে হয়। সেখানে সন্ন্যাসী ভ্রাতাদের কষ্টের অবধি ছিল না।

এই বরানগরেই একদিন হীরানন্দ নামক ভক্ত এসেছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের চলে কী করে?”

নরেন্দ্র : “সকলেই মুষ্ঠিভিক্ষা করে নিয়ে আসে, তাতেই একরকম চলে যায়।”

হীরানন্দর কাছে ছয় আনা পয়সা ছিল। তিনি তা দিয়ে বললেন, “এই পয়সায় এ বেলা চলুক।”

নরেন উত্তর দিলেন, “পয়সার আবশ্যক হবে না, এবেলার মতন চাল আছে।”

ভিক্ষার কথাটা স্বামীজি কত সহজভাবে বললেন, কিন্তু প্রকৃত অবস্থার দু’একটা নমুনা সংগ্রহ করা যাক। একদিন বরানগরে চারজন গুরুভাই ভিক্ষে করতে বেরিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে এলেন, ঠাকুরের ভোগের জন্য কিছু দিতে পারলেন না। তখন সিদ্ধান্ত হলো অনাহারে থেকে সেদিন সারাক্ষণ ভজন করা হবে।

অনাহার বা অর্ধাহারটাই ছিল বরানগরের রেওয়াজ। স্বামী প্রেমানন্দের কথায় : “একবেলা ভাত কোনদিন জুটতো, কোনদিন জুটতো না। থালাবাসন তো কিছুই নেই। বাড়ির সংলগ্ন বাগানে লাউগাছ, কলাগাছ ঢের ছিল। দুটো লাউপাতা, কি একখানা কলাপাতা আনতে গেলে মালী যা তা বলে গালি দিত। শেষে মানকচুর পাতায় ভাত ঢেলে তাই খেতে হতো। তেলাকুচো পাতা সিদ্ধ আর ভাত–তা আবার মানপাতায় ঢালা। কিছু খেলেই গলা কুটকুট করতো।”

কচুপাতা এড়ানোর উপায় অবশেষে উদ্ভাবিত হলো। ভিক্ষার চাল সিদ্ধ করে তা একটা কাপড়ের ওপরে ঢেলে সকলে মিলে খেতে বসতেন এবং লবণ ও লঙ্কার ঝোল করে তা দিয়ে ভোজন সমাপ্ত করতেন। সকলেই একগ্রাস করে ভাত মুখে নিতেন এবং বাটিতে রাখা নুন লঙ্কার ঝোলে হাত দিয়ে তা মুখে দিতেন।

ভারত-পরিক্রমায় বেরিয়ে বরানগরের অভিজ্ঞতা যে খুব কাজে লেগে গিয়েছিল তা বিবেকানন্দ অনুরাগীদের কাছে এখন আর অস্পষ্ট নয়। পরিব্রাজক বিবেকানন্দর একটি চিঠি গুরুভাইকে লেখা : “আমি নির্লজ্জভাবে ঘুরে ঘুরে অপরের বাড়িতে আহার করছি, আর এতে বিবেকের দংশনও হচ্ছে না–ঠিক যেন একটি কাক…আর ভিক্ষে করবো না। আমাকে খাইয়ে গরীবের লাভ কী? তারা একমুঠো চাল পেলে বরং নিজের ছেলেমেয়েদের খাওয়াতে পারে।”

পরিস্থিতি অবশ্য সর্বত্র সমান নয়। শুনুন মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়া ছাড়িয়ে একটা রিপোর্ট : “নিতান্ত অসভ্য ও অতিথিসকার বিমুখ, একমুঠো ভিক্ষা চাইলে দেয় না–আশ্রয় চাইলে তাড়িয়ে দেয়। কয়েক দিবস নিরস্তু উপবাস, পরে জীবনধারণোপযোগী সামান্য কিছু আহার করে শরীর রক্ষা।”

একবার বৃন্দাবন থেকে গিরিগগাবর্ধন পরিক্রমাকালে স্বামীজি সঙ্কল্প করলেন, না-চেয়ে যে ভিক্ষা মিলবে তাতেই ক্ষুধা নিবৃত্তি করবেন। তাছাড়া কারও কাছে কিছু চাইবেন না। প্রথম দিন দ্বিপ্রহরে ক্ষুধার তাড়না অসহ্য হয়ে উঠলো, আবার সেই সঙ্গে বৃষ্টি। পথশ্রমে দুর্বল সন্ন্যাসী শুনলেন, কে যেন পিছন থেকে তাকে ডাকছেন। ক্ষুধার্ত বিবেকানন্দ প্রথমে ছুটতে লাগলেন, পিছনের লোকটিও ছোটা শুরু করেছেন এবং সন্ন্যাসীকে ধরে ফেলে তাঁকে ভোজ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে অনুরোধ করলেন!

আরও একবার স্বামীজি স্থির করেছিলেন খাদ্যভিক্ষা করবেন না। ফলে মাঝে মাঝে উপবাসে কাটাতে হতো। একবার দুদিন অনাহারে আছেন, এমন সময় এক বড়লোকের ঘোড়ার সহিস তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, “সাধুবাবা, কিছু ভোজন হয়েছে?” এরপর দয়াপরবশ হয়ে সহিস কয়েকটা রুটি ও ঝালচাটনি খেতে দিলেন। এই চাটনিতে এত ঝাল যে দু’দিন উপবাসের পর ওটা খেয়ে তিনি পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। সহিসও খুব বিপদে পড়ে গিয়েছে। এমন সময় একটা লোক মাথায় ঝুড়ি নিয়ে যাচ্ছিল। স্বামীজি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ঝুড়িতে কি আছে? লোকটি বললো, তেঁতুল। “এই তো চাই!” ঐ তেঁতুল খেয়ে স্বামীজির পেটের যন্ত্রণার নিবৃত্তি হলো।

আলমোড়ার উপকণ্ঠে ক্ষুধা ও পথশ্রমে ক্লান্ত স্বামীজিকে একবার ভূমিশয্যা নিতে হয়েছিল। সামনেই গোরস্থান। একজন ফকিরের দয়ায় সেবার স্বামীজি বেঁচে গেলেন। দয়াময় ফকিরটি একফালি শশা এনে সন্ন্যাসীর হাতে দিলেন। পরে বিবেকানন্দ স্বীকার করেছেন, “আমি আর কখনও ক্ষুধায় এতটা কাতর হইনি।”

আর সেই বিখ্যাত গল্পটি, হাতরাস স্টেশনে রেলকর্মচারী এবং ভবিষ্যৎ শিষ্য শরৎ গুপ্তর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকার। সন্ন্যাসীকে দেখে সহকারী স্টেশন মাস্টারের প্রশ্ন : “স্বামীজি আপনি কি ক্ষুধার্ত?” সাধু : “হ্যাঁ।” শরৎ: “তবে দয়া করে আমার ঘরে আসুন।” সাধু : “আপনি কি খেতে দেবেন?” শরৎ একটি উর্দু কবিতা আউড়ে বললেন, “হে প্রিয়, তুমি আমার ঘরে এসেছ, আমি সুন্দর মসলাসহ আমার কলিজাটা বেঁধে আপনাকে খাওয়াব।”

পরিব্রাজক জীবনের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা স্বামীজি তুলনাহীন ভাষায় পরবর্তীকালে তাঁর ভক্তদের শুনিয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। “কতবার আমি অনাহারে, বিক্ষতচরণে, ক্লান্তদেহে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি। কতবার দিনের পর দিন এক মুষ্টি অন্ন না পেয়ে পথচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তখন অবসন্ন শরীর বৃক্ষচ্ছায়ায় লুটিয়ে পড়তো, তখন মনে হতো প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাচ্ছে! কথা বলতে পারতাম না, চিন্তাও অসম্ভব হয়ে পড়তো; আর অমনি মনে এই ভাব উঠতো, আমার কোনো ভয় নেই, মৃত্যুও নেই; আমার জন্ম কখনও হয়নি, মৃত্যুও হবে না; আমার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই। সারা প্রকৃতির ক্ষমতা নেই আমায় পিষে মারে। প্রকৃতি তো আমার দাসী। হে দেবাদিদেব, হে পরমেশ্বর, নিজ মহিমা প্রকাশ কর, স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হও! উত্তিষ্ঠত জাগ্রত! বিরত হয়ো না। অমনি আমি পুনর্বল লাভ করে উঠে দাঁড়াতাম। তাই আমি আজও বেঁচে আছি।”

.

অনাহারের ভয় যার চলে গিয়েছে জগৎসংসার তাকে আর অন্য কোনো ভয় দেখতে পারে না। এইটাই সর্বহারা মানুষের উপরি পাওনা।

একবার উত্তরভারতে স্বামীজি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একজন অসৎ থানাদার তার পিছনে লাগলো, কয়েদ করবার ভয় দেখাল। পরিব্রাজক বিবেকানন্দর মন তখন অতি বিষণ্ণ, তিনি ভয়শূন্য মনে বললেন, “চলুন না। এরূপ অনিশ্চিত অনাহারে থাকার চেয়ে তবুও থানায় দু’বার খেতে পাওয়া যাবে, সেতো ভাল কথা।”

স্বামীজির দীর্ঘতম উপবাসের মেয়াদ কত? এ-প্রশ্ন উঠতেই পারে। তার সোজাসুজি উত্তরের সন্ধানও পাওয়া গিয়েছে। এক-আধদিন উপবাসকে স্বামীজি সবসময় উপেক্ষা করেছেন, তবে ঈশ্বরের দয়ায় কখনও তিনদিনের বেশি উপবাস করতে হয়নি।

অনাহারের আশঙ্কা কিন্তু সন্ন্যাসী বিবেকানন্দকে কখনও দমিয়ে রাখতে পারেনি। ১৮৯০ সালে ডিসেম্বরের এক সন্ধ্যায় পরিব্রাজক বিবেকানন্দ কয়েকজন গুরুভাইকে নিয়ে মীরাটে হাজির হলেন। মীরাট শহরের ২৫৯ নম্বর রামবাগে লালা নন্দরাম গুপ্তর বাগানবাড়িতে ক’দিন ছিলেন। আফগানিস্থানের আমীর আব্দার রহমানের জনৈক আত্মীয় সেবার সাধুদের পোলাও খাওয়ানোর জন্য কিছু টাকা দেন! স্বামীজি উৎসাহভরে পোলাও রান্নার দায়িত্ব নেন। অন্যদিনেও স্বামীজি মাঝে-মাঝে রান্নায় সাহায্য করতেন। স্বামী তূরীয়ানন্দকে খাওয়ানোর জন্য একদিন নিজে বাজার থেকে মাংস কিনে আনেন, ডিম যোগাড় করেন এবং উপাদেয় সব পদ প্রস্তুত করেন।

মীরাটে স্বামীজি তাঁর গুরুভাইদের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ এবং সেইসঙ্গে পোলাও কালিয়া রান্না শেখাতেন। একদিন পোলাও বেঁধেছেন। মাংসের কিমা করিয়েছিলেন, কিছু শিক্ কাবাব করবার ইচ্ছা। কিন্তু শিক পাওয়া গেল না। তখন মাথা ঘামিয়ে স্বামীজি সামনের পিচগাছ থেকে গোটাকয়েক ছোট ডাল ছিঁড়ে নিয়ে তাতেই কিমা জড়িয়ে দিয়ে কাবাব করলেন। সবাইকে খাওয়ালেন, নিজে কিন্তু খেলেন না। বললেন, “তোমাদের খাইয়ে আমার বড় সুখ হচ্ছে।”

তবে স্বদেশের অনশন অপেক্ষা বিদেশের অনশন-আশঙ্কা যে অনেক বেশি আতঙ্কজনক তা বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। মেরি লুইস বার্ক-এর বিখ্যাত বইতে মার্কিনপ্রবাসী বিবেকানন্দের একটি মর্মস্পর্শী টেলিগ্রামের উল্লেখ আছে। বোস্ট থেকে বিবেকানন্দ এটি পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন মাদ্রাজে প্রিয় শিষ্য আলাসিঙ্গা পেরুমলকে : না খেয়ে রয়েছি! সমস্ত টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। অন্তত দেশে ফিরে যাবার মতন কিছু টাকা পাঠাও। Starving. All money spent. Send money to return at least.

দু’দিন পরে শিকাগোতে যিনি ঝড় তুলবেন এবং বিশ্ববিজয়ী হবেন, তিনি প্রবাসে অনাহারে মৃত্যুর মুখোমুখি। বড় ভীষণ জায়গা এই মার্কিন দেশ। এখানে ভিক্ষা করা অপরাধ, ভিক্ষা চাইলে জেলবাস অনিবার্য!

স্বামীজি অবশেষে খ্যাতি, সম্মান ও শ্রদ্ধার মুকুট পরিধান করেছেন। কিন্তু প্রবাসে অর্থসমস্যার সমাধান সব সময় হয়নি। তাঁর সহযোগী আমেরিকান সাধক কৃপানন্দ একসময় নিউইয়র্ক থেকে গোপনে মিসেস ওলি বুলকে জানাচ্ছেন : “স্বামীজি নিজেই ঘরভাড়া, বিজ্ঞাপন দেওয়া, ছাপানো ইত্যাদি খরচ বহন করছেন। এই সব খরচ বহন করতে গিয়ে অনেক সময় না খেয়ে থাকেন–হি স্টার্ভ হিমসেলফ। কিন্তু তিনি দৈত্যের মত খাটেন।”

অনাহার কাকে বলে তা জানতেন বলেই পৃথিবীর অনাহারী অর্ধ-আহারী মানুষের দুঃখের কথা বিবেকানন্দ এমনভাবে অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন।

দুমুঠো অন্ন সবার মুখে তুলে দেবার জন্য সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর সে কি ব্যাকুলতা। শেষজীবনে শত শারীরিক যন্ত্রণা সত্ত্বেও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ তাঁর প্রিয় শিষ্য শরচ্চন্দ্রকে অন্নসত্ৰ খোলার কথা বলেছেন। “যখন টাকা আসবে তখন একটা মস্ত কিচেন করতে হবে। অন্নসত্রে কেবল ‘দীয়তাং নীয়তাং ভুজ্যতাম’ এই রব উঠবে, ভাতের ফেন গঙ্গায় গড়িয়ে পড়ে গঙ্গার জল সাদা হয়ে যাবে। এই রকম অন্নসত্র হয়েছে দেখব তবে আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হবে।”

.

পটলাদা সেবার বলেছিলেন, “ওরে সন্ন্যাসীর অনাহারের পরিপ্রেক্ষিতে যদি সম্রাট বিবেকানন্দকে ফেলতে পারিস তা হলে ব্যাপারটা জমে ওঠে। কখনও এই বিবেকানন্দর পদসেবা করতে উন্মুখ এদেশের রাজা মহারাজারা এবং বিদেশের ধনপতিরা। আবার কখনও তার খাওয়া জুটছে না। যে লোক আজ অর্ধাহারে পথের প্রান্তে পড়ে আছেন, পরের দিন তাকেই আমরা দেখতে পাই তাঁর সামনে রাজপ্রাসাদের রাজভোগ সাজিয়ে রাজাধিরাজ স্বয়ং হাওয়া করছে। তার এক ভক্ত জুটেছিল পরিব্রাজক কালে। এই ভক্তটির ধারণা, সাধু-সন্ন্যাসীর স্থূলকায় হওয়া অসম্ভব। স্বামীজি তাকে বলেছিলেন, এটাই আমার ফেমিন-ইনসিওরেন্স ফান্ড যদি পাঁচদিন খেতে না পাই তবু আমার চর্বি আমাকে জীবিত রাখবে।”

মার্কিন দেশে এবং পরবর্তী সময়ে ইউরোপে স্বামীজি খাওয়ার ব্যাপারে কষ্ট এবং সুখ দুই-ই প্রবলভাবে পেয়েছেন। কখনও রাস্তায় রাত কাটাচ্ছেন, কখনও অনুরাগীদের স্নেহাশ্রয়ে তাদের প্রাসাদোপম অট্টালিকায় উঠছেন, কখনও অতি সস্তা হোটেলে, কখনও বা ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে, আবার কখনও পাঁচতারা হোটেলের লাক্সারি সুইটে তাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। অর্থাভাবে কখনও স্রেফ পাঁউরুটি ভরসা, আবার কখনও ব্যাংকোয়েট ভোজন।মুগ্ধবিবেকানন্দপ্রবাসের সংগ্রামের সময়নৰ্থক্যালকাটারগুরুভাইদের কাছেমাঝে-মাঝে বাংলায় যে সব বিবরণ দিয়েছেন তা বাংলা ভ্রমণসাহিত্যের অক্ষয় সম্পদ। স্বামীজি লিখছে, “কলাকৌশলে এরা অদ্বিতীয়, ভোগে বিলাসে এরা অদ্বিতীয়, পয়সা রোজগারে অদ্বিতীয়, খরচে অদ্বিতীয়।”

একটা লেকচারে “আমি ৫০০ ডলার পর্যন্ত পাইয়াছি।” তখন ডলারের দাম তিনটাকার মতন। “আমার এখানে এখন পোয়াবারো। এরা আমায় ভালবাসে, হাজার হাজার লোক আমার কথা শুনতে আসে।”

১৮৯৪ সালের গ্রীষ্মকালে মার্কিন দেশ থেকে কলকাতায় গুরুভাইদের লিখছেন : “এখানে হোটেলের কথা কি বলিব! নিউ ইয়র্কে এক হোটেলে আছি, যেখানে ৫০০০ পর্যন্ত রোজ ঘরভাড়া, খাওয়া-দাওয়া ছাড়া।…এরা হ’ল পৃথিবীর মধ্যে ধনী দেশ-টাকা খোলামকুচির মতন খরচ হয়ে যায়। আমি কদাচ হোটেলে থাকি, আমি প্রায়ই এদের বড় বড় লোকের অতিথি।”

.

বিদেশে এলাহি ডিনার কীরকম হয় তার বর্ণনা স্বামীজি নিজেই লিখে গিয়েছেন। “ডিনারটাই প্রধান খাদ্যধনী হলে তার ফরাসি রাঁধুনি এবং ফরাসি চাল। প্রথমে একটু আধটু নোনা মাছ বা মাছের ডিম, বা কোন চাটনি বা সবজি। এটা হচ্ছে ক্ষুধাবৃদ্ধি, তারপর স্যুপ, তারপর আজকাল ফ্যাশন–একটা ফল, তারপর মাছ, তারপর মাংসের একটা তরকারি, তারপর থান-মাংস শূল্য, সঙ্গে কাঁচা সবজি, তারপর আরণ্য মাংস মৃগপক্ষাদি, তারপর মিষ্টান্ন, শেষ কুলপি–মধুরেণ সমাপয়েৎ…থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে কাটা-চামচ সব বদলাচ্ছে; আহারান্তে কফি বিনা-দুগ্ধ।”

যাঁরা মদ্যপান করেন তাদের জন্য খাদ্যের তালে তালে পানীয়–থাল বদলাবার সঙ্গে সঙ্গে মদ বদলাচ্ছে–শেরি, ক্ল্যারেট, শ্যামপা ইত্যাদি এবং মধ্যে মধ্যে মদের কুলপি একটু আধটু। স্বামীজি লিখছেন, “খাওয়ার রকমারি, সঙ্গে মদের রকমারি দেখাতে পারলে তবে বিড়োমানুষি’ চাল বলবে। একটা খাওয়ায় আমাদের দেশের একটা মধ্যবিত্ত লোক সর্বস্বান্ত হতে পারে, এমন খাওয়ার ধুম এরা করে।”

উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে পৃথিবীর কোন জাত কখন কী খায়, কত বার খায় এবং তাদের সুখাসনটি কীরকম সে বিষয়ে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের থেকে বেশি খোঁজখবর কোনো ভারতীয় কস্মিনকালেও করেছেন বলে মনে হয় না।

একটু নমুনা চেখে দেখা মন্দ নয়। “ফরাসী চাল–সকালবেলা কফি এবং এক-আধটুকরো রুটি-মাখন; দুপুরবেলা মাছ-মাংস ইত্যাদি মধ্যবিৎ; রাত্রে লম্বা খাওয়া। ইতালি, স্পেন প্রভৃতি জাতিদের ঐ একরকম; জার্মানরা ক্রমাগতই খাচ্ছে–পাঁচবার, ছ বার, প্রত্যেকবারেই অল্পবিস্তর মাংস। ইংরেজরা তিনবার সকালে অল্প, কিন্তু মধ্যে মধ্যে কফি-যোগ, চা-যোগ আছে। আমেরিকানদের তিনবার–উত্তম ভোজন, মাংস প্রচুর।”

বিবেকানন্দ তুলনামূলকভাবে লক্ষ্য করেছেন, গরিব অবস্থায় সকল দেশের খাওয়াই ধান্যবিশেষ। বাংলায় তার সঙ্গে ডাল তরকারি, কখন কখন মাছমাংস চাটনিবৎ।

“ইউরোপের অবস্থাপন্ন লোকের এবং আমেরিকার আবালবৃদ্ধবনিতার। খাওয়া আর এক রকম–অর্থাৎ রুটি ভাত প্রভৃতি, চাটনি এবং মাছ-মাংসই হচ্ছে খাওয়া। আমেরিকায় রুটি খাওয়া নাই বললেই হয়। মাছ মাছই এল, মাংস মাংসই এল, তাকে এমনি খেতে হবে, ভাত-রুটির সংযোগ নয়।”

কোন জাত কীভাবে বসে খায় তাও বিবেকানন্দ মন দিয়ে অনুসন্ধান করেছেন : “আর্যরা একটা পীঠে বসত, একটা পীঠে ঠেসান দিত এবং জলচৌকির উপর থালা রেখে এক থালাতেই সকল খাওয়া খেত।” পাঞ্জাব, রাজপুতানা, মহারাষ্ট্র ও গুর্জর দেশে একই স্টাইল। বাঙালিরা “মাটিতেই সাপড়ান। মহীশূরে মহারাজও মাটিতে আঙট পেতে ডালভাত খান।…চীনেরা টেবিলে খায়…রোমান ও গ্রীকরা কোচে শুয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাত দিয়ে খেত। ইউরোপীয়রা টেবিলের ওপর হ’তে কেদারায় বসে–হাত দিয়ে পূর্বে খেত, এখন নানাপ্রকার কাঁটা চামচ।”

পটলাদা সেবার আমাকে বলেছিলেন, “দেখলি লোকটার প্রতিভা। তুলির কয়েকটা টানে পৃথিবীর ভোজনসভ্যতাটা এঁকে ফেললেন। পড়লেই বোঝা যায়, টুকলিফাইং ব্যাপার নয়, নিজের চোখে দেখে, বইপত্তর কনসাল্ট করে, বাড়তি জলটুকু বার করে দিয়ে ক্ষীরটুকু আমাদের জন্যে রেখে যাওয়া। ধর্টর্ম না করেও স্রেফ রসনার রহস্যভেদে মন দিলেও চিরকাল নাম থেকে যেতো মানুষটার। মহাজনরা এরকমই হন, যা কিছু স্পর্শ করেন তাই সোনা হয়ে যায়।”

“এবার বিবেকানন্দকে পরের পর কয়েকটা পর্বে ভাগ করে নেওয়া যাকবাড়ির বিবেকানন্দ, বরানগরের বিবেকানন্দ, পথের বিবেকানন্দ, পাশ্চাত্যের বিবেকানন্দ, বিলেতের বিবেকানন্দ, বিশ্ববিজয় করে দেশে ফেরা বিবেকানন্দ এবং মহাপ্রস্থানের পথে বিবেকানন্দ। এবার তার রান্নাবান্না। খাওয়া এবং না-খাওয়া বিবেকানন্দকে প্রথমপর্বের ম্যাপটার ওপর চাপিয়ে দেওয়া যাক, তবে বুঝতে পারা যাবে একটা মানুষ কত সহ্য করতে পারে এবং এতো সহ্য করেও সমস্ত মানুষের মঙ্গল ও মুক্তির জন্যে স্বামীজি কেমন করে এতো ভাবতে পারলেন?

.

পটলাদাকে সেবার প্রশ্ন করেছিলাম, “মানুষটা যেভাবে বনবন করে ঘুরেছে, শরীর স্বাস্থ্য এবং সামর্থ্যের তোয়াক্কা না করে, তাতে কেমনভাবে খোঁজ পাবো স্বামীজির খাওয়াদাওয়ার?”

পটলাদা বললেন, “নিরুৎসাহ হবি না, ওটা হলো ডিসপেপটিক জাতির লক্ষণ, পেটের রোগে আজন্ম ভুগলে মাঝে মাঝে অমন দিশাহারা ভাব হয়।”

স্বামীজির পাশ্চাত্যপর্বটা ইদানীং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচার-বিবেচনা করা হয়েছে। আমরা যখন বিবেকানন্দ ইস্কুলে পড়তাম তখন স্বামীজির কয়েকশ চিঠিপত্তর আর খানকয়েক বক্তৃতা ছাড়া আমাদের হাতে তেমন কিছুই ছিল না। তারপর মার্কিনী-গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক আসরে নেমে পড়ে কাগজপত্তর, চিঠিপত্তর এবং অসংখ্য পরিবারের স্মৃতিসঞ্চয় মন্থন করে ইংরিজি ভাষায় এমন আশ্চর্য কাজ করেছেন যে মাথা ঘুরে যায়। পড়তে পড়তে যেখানে ছিটেফোঁটা যা যা পাওয়া গিয়েছে নোটবইতে টুকে নিয়েছি।”

“স্বদেশীপর্বটা ব্যাকগিয়ারে পরে বিবেচনা করা যাবে। আগে আমেরিকা ও ইউরোপ-পর্বের খোঁজখবর নেওয়া যাক।

কেশব সেনের ভাগ্নে বি এল গুপ্ত তখন লন্ডনে থাকতেন। মিসেস গুপ্তের বাড়িতে প্রায়ই যে বিবেকানন্দর পদধূলি পড়তো তার প্রমাণ রয়েছে। মিসেস গুপ্ত খোদ লন্ডনে বসে ছানা কাটিয়ে পান্তুয়া তৈরি করতেন এবং অভ্যাগতদের খাওয়াতেন। আজকের কথা নয়, খোদ ১৮৯৬ সালের রিপোর্ট! ভেজিটারিয়ান মিস হেনরিয়েটা মুলারের বাড়িতে সান্ধ্য আহার–দুধ দিয়ে মোটা ম্যাকারনি স্যুপ। তাতে নুন দেওয়া ছিল–অদ্ভুত এই ইংরেজ জাত, দুধে নুন মেশাতে ভয় করে না। বিবেকানন্দ তাঁর গুরুভাই নবাগত স্বামী সারদানন্দকে শেখালেন, কেমন করে চামচ ধরতে হয় এবং কীভাবে স্যুপ খেতে হয়। একবার টেবিলের তলায় সারদানন্দের পা চেপে ধরে ইঙ্গিত দিলেন নাইফ সবসময় ডান হাতে ধরতে হয়, কখনই বাঁ হাতে নয়।

সারদানন্দকে স্বামীজি বললেন, “বাঁ হাতে কাটা দিয়ে মুখে তুলতে হয় অত বড় বড় গরস করে না, ছোট ছোট গরস করবি। খাবার সময় দাঁত জিভ বার করতে নেই, কখনও কাশবি না, ধীরে ধীরে চিবুবি। খাবার সময় বিষম খাওয়া বড় দূষণীয়; আর নাক ফোঁস ফোঁস কখনও করবি না।”

আর একদিন ভ্রাতা মহেন্দ্রকে বিবেকানন্দ জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে কী খেয়েছিস?” তারপর পরামর্শ দিলেন, “রোজ একঘেয়ে খেলে অরুচি হয়, বাড়ির মাগীটাকে বলিস, মাঝে মাঝে যেন পোট এগ বা অমলেট করে দেয়, তা হলে মুখ বদলানো হবে।”

আর একদিন স্বামীজির নিরামিষ লাঞ্চের মেনু, ভাত ও ওলন্দা কড়ায়ের মটর ডাল। ডালেতে একটু কারি পাউডার ও নুন দিয়ে সেদ্ধ করে খানিকটা মাখন দেওয়া ছিল। খেতে বসে স্বামী সারদানন্দের দুঃখ, “হায় কপাল! এখানেও মটর ডাল সিদ্ধ।”

আর একদিন দেড়টার সময় স্বামীজি তাঁর অনুরাগী মিস্টার ফক্সকে বললেন, “দূর, রোজ রোজ একঘেয়ে খাওয়া যায় না। চল দু’জনে গিয়ে একটা হোটেলে খেয়ে আসি।”

আর একদিন সন্ধ্যার আহারে মাছ দিয়ে কপির তরকারি রান্না হয়েছে, সঙ্গে ছিলেন অনুরাগী এবং বক্তৃতার ক্ষিপ্রগতি লেখক গুডউইন। গুডউইন খেলো না, জিজ্ঞেস করলো, “মাছ খেলেন কেন?”

স্বামীজি হাসতে হাসতে বললেন, “আরে বুড়ি ঝিটা মাছ এনেছে, সেটা না খেলে নদৰ্মতে ফেলতো, ওটা না হয় পেটে ফেলেছি।”

লন্ডনে জনৈকা মিসেস টার্নার একটি ছোট্ট ঘরোয়া ভোজনাগার চালাতেন। তিনি ইন্ডিয়ানদের পছন্দমতন কিছু রান্না শিখেছিলেন, সেইজন্য ভারতীয়রা মাঝে মাঝে তার বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসতো।

একদিন বিবেকানন্দ তার ভাই মহেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কোথায় গিয়েছিলি? ভাই উত্তর দিলেন, “মিসেস টার্নারের বাড়িতে খেতে গিয়েছিলাম।” স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন “কি বেঁধেছিল।” উত্তর : “চাপাটি রুটি, মাংসের একটা তরকারি, আরও দুটো তরকারি, পুদিনার চাটনি, আর চালের পায়েস।”

স্বামীজি : “একদিন সে এখানে এসে বেঁধে যায় না? তা হলে একটু খেয়ে বাঁচি, একটু মুখ তরাই।”

মহেন্দ্রনাথ জানালেন, “তা বোধহয় সম্ভব নয়। গৃহস্থ মহিলা, ঝি চাকরানি নন, অপরের বাড়িতে রাঁধতে আসবেন কেন?”

স্বামীজি তখন মিসেস টার্নারের বাড়িতে গিয়ে খেয়ে আসবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু তা শেষপর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

পত্রাবলীতে দেখছি, ৩০ মে ১৮৯৬ সালে স্বামীজি লন্ডনে বসে নিজেই এলাহি রান্না করেছিলেন। সারদানন্দ বোধ হয় স্বদেশ থেকে নানারকম মশলা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীজির জন্য। পরের দিন সেন্ট জর্জেস রোড থেকে স্বামীজি হেলভগ্নি মেরিকে মুখরোচক কারি তৈরির বিবরণ দিচ্ছেন। সেই কারিতে কি না মিশিয়েছিলেন। জাফরান, ল্যাভেন্ডার, জৈত্রী, জায়ফল, কাবাবচিনি, দারচিনি, লবঙ্গ, ছোট এলাচ, ক্রিম, লেবুর রস, পিঁয়াজ, কিসমিস, অ্যামন্ড, লঙ্কা এবং চাল! এতো মিশিয়েও মনের সাধ পূর্ণ হয়নি, দুঃখ করেছেন, আর একটি মশলার অভাব, যার ইংরিজি নামটা অদ্ভুত এবং আমার অজানা–অ্যাসাফিটিডা। এটা থাকলে নাকি খাবার আরও সুবিধে হতো।

অভিধানে দেখা যাচ্ছে ওটা হিং-এর ইংরিজি নাম! যার গন্ধ পেলে অমন পরমভক্ত গুডউইন সায়েবের বমি হয়ে যেতো! ওই চিঠিতেই স্বামীজি রসিকতা করছেন, “রান্নার ফলাফল এমনই হয়েছিল যে স্বয়ং রাঁধুনিও তা গলা দিয়ে নামাতে সমর্থ হলেন না!”

রাঁধা এক জিনিস আর খাওয়া আর এক জিনিসারাঁধুনি বিবেকানন্দ সম্বন্ধে আমরা আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করবো। এখন শুধু বলা যায় মিসেস টার্নার অজানা মহিলা, তাই তাকে বাড়ি এসে বেঁধে দিতে অনুরোধ করতে সাহস পেলেন না বিবেকানন্দ। কিন্তু আমেরিকায় বিখ্যাত সব মহিলারা স্বামীজিকে বেঁধে খাইয়ে ধন্য হয়েছেন। তিনিও কখনও কখনও প্রচণ্ড বিদুষীদের অনুরোধ করেছেন, এখানে খাবার-দাবার বড্ড নোংরা, আমার জন্যে একটু রান্না করতে পারো? এমন এক ভাগ্যবতী মহিলার নাম মিস্ ওয়ালডো। দুর্লভ সুযোগ পেয়ে মিস্ ওয়ালডো ধন্য। নিউইয়র্কে এই বিদুষীকে সস্নেহে নতুন নাম দিয়েছিলেন স্বামীজি—’হরিদাসী’।এই মহিলা প্রকৃত অর্থেইদশভুজা– সম্পাদিকা, প্রুফ রিডার, স্টেনোগ্রাফার, ভক্তিময়ী এবং দার্শনিক।

.

আমেরিকায় বিভিন্ন সময়ে স্বামীজির কখন কি খাবার জুটেছে, কি তার পছন্দ হয়েছে এবং কি অপছন্দ হয়েছে, তা অসীম ধৈর্যের সঙ্গে পটলাদা বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে আমাকে টুকলিফাইং-এর সুযোগ দিলেন।

নিউ ইয়র্কের চিঠি। মিসেস ওলি বুলকে বিবেকানন্দ লিখছেন : মিস্ হ্যামলিন দয়াপরবশ হয়ে একটা গ্যাস স্টোভ পাঠিয়েছেন–বেড রুমেই রাঁধতে হবে। আমাদের বাড়ির নিচে একটা সার্বজনীন রান্নাঘরেরও ইঙ্গিত রয়েছে।

সেখানেও স্বপাক অন্নের জন্য বিবেকানন্দ পিছপা হননি। বিশেষত্ব এই যে তিনি কখনও সব নিজে খেতেন না, জানা-অজানা সবাইকে দেদার খাওয়ানোটা তার আজন্ম দুর্বলতা।

স্টোভ পাওয়ার কয়েকদিন পরেই স্বামীজির আর এক চিঠি : কৃপানন্দ ও তিনি মিলে “কিছু ডাল ও বার্লি ফুটিয়ে নিচ্ছি…আমেরিকায় এমন সন্ন্যাসকঠোর জীবন আগে কাটাইনি।”

কলকাতায় এর কিছুদিন আগে গুরুভাইদের বিবেকানন্দ জানিয়েছেন, “কলায়ের দাল কি, কোনও দাল নেই, এরা জানেও না। একরকম শাক আছে, স্পিনাচ–যা রাঁধলে আমাদের নটে শাকের মত লাগে, আর যেগুলোকে এরা এস্পারেগাস বলে, তা ঠিক যেন কচি ডেঙ্গোর ভঁটা, তবে গোপালের মার চচ্চড়ি নেই বাবা।”

আরও খবর : “এখানে ইলিস মাছ অপর্যাপ্ত আজকাল। ভরপেট খাও, সব হজম। ফল অনেককলা, নেবু, পেয়ারা, আপেল, বাদাম, কিসমিস, আঙ্গুর যথেষ্ট, আরও অনেক ফল ক্যালিফোর্নিয়া হতে আসে। আনারস ঢের, তবে আম, লিচু ইত্যাদি নাই!”

নিউইয়র্ক নিবাসে এক বিখ্যাত হোটেলে বিবেকানন্দর সান্ধ্য নিমন্ত্রণ–এসব নিমন্ত্রণ করে যাঁরা ধন্য হতেন সেইসব ধনীদের জন্য তাঁর তৈরি বিশেষ ইংরিজি শব্দ ‘লং পকেট’ বা লম্বা পকেট। প্রায়শই স্বামীজির গন্তব্যস্থান জগদ্বিখ্যাত এসটোরিয়া হোটেল, কিংবা শোয়েল, কিংবা ডালমনিকো! যিনি তিনদিন পর্যন্ত পথের ধারে অনাহারে কাটিয়েছেন তাকেই যেতে হচ্ছে অন্তহীন ডিনার পার্টিতে যা সন্ধ্যায় শুরু হয়ে ভোর দুটোর আগে কিছুতেই শেষ হতে চায় না। এইসব বিখ্যাত রেস্তোরাঁকে প্রায়শই প্রাধান্য দিলে শরীর অসুস্থ হবার আশঙ্কা যথেষ্ট, তাই একসময় স্বামীজি “নিঃশব্দে” ভেজিটারিয়ানে রূপান্তরিত হয়েছেন এবং নেমন্তন্ন এড়িয়ে চলেছেন। ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে স্বামীজি লিখছেন, “আজ একটা ডিনারে যাচ্ছি, এইটাই শেষ।”

এর পরের চিত্র–থাউজেন্ড আইল্যান্ড পার্কে বিবেকানন্দ একেবারে নিরামিষাশী, ঘন ঘন উপবাসও চলেছে। জায়গাটা ছাড়বার আগে তিনি তিরিশ-চল্লিশ পাউন্ড ওজন কমাবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

নিউইয়র্কপর্ব সম্পর্কে আরও খবর আছে। মিস ওয়ালডো যেমন বহু দূরত্ব পেরিয়ে মূল শহরে এসে স্বামীজিকে বেঁধে দিতেন, তেমন সুযোগ পেলেই বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে স্বয়ং বিবেকানন্দ চলে যেতেন মিস ওয়ালডোর বাড়িতে, সেখানে তিনি সোজা উঠে যেতেন টঙে এবং শুরু করতেন রান্না।

অর্ডিনারি রাঁধুনি নন বিবেকানন্দ, গবেষক রাঁধুনি, তাই চলতো নব নব পদের পরীক্ষা এবং আবিষ্কার এবং কিভাবে পশ্চিমী মশলা ইত্যাদি দিয়ে পূর্বদেশের রান্নার কাছাকাছি পৌঁছনো যায় তার বিরতিহীন প্রচেষ্টা। শিশুর মতন এঘর থেকে ওঘরে স্বামীজি ছোটাছুটি করতেন। হরিদাসীর অন্য একটা নামও তিনি দিয়েছিলেন–যতী-মাতা’ সন্ন্যাসীদের মাতা।

বিদেশে থাকার সময় বিবেকানন্দ শুধু মোটাসোটা বেদ-উপনিষদ দেশ থেকে আনাচ্ছেন তাই নয়, সেই সঙ্গে নিউ ইয়র্কে কি পৌঁছচ্ছে ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে তা তার চিঠিতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কলকাতায় গুরুভ্রাতাকে স্বামীজি লিখছেন “যোগেনভায়া, অড়হর ডাল, মুগের ডাল, আমসত্ত্ব, আমসি, আমতেল, আমের মোরব্বা, বড়ি, মসলা সমস্ত ঠিকানায় পৌঁছিয়াছে।…এক্ষণে যদি ইংলন্ডে স্টার্ডির ঠিকানায়…ঐ প্রকার ডাল ও কিঞ্চিৎ আমলে পাঠাও তো আমি ইংলন্ডে পৌঁছিলেই পাইব। ভাজা মুগডাল পাঠাইবার আবশ্যক নাই। ভাজা মুগডাল কিছু অধিকদিন থাকিলে বোধ হয় খারাপ হইয়া যায়।”

এই সব মশলাপাতিতে সমৃদ্ধ হয়ে স্বামীজি মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন শহর দাপিয়ে বেড়ালেন! :

ডেট্রয়েট ১৮ মার্চ ১৮৯৬–এক ভক্তের বাড়িতে গিয়ে স্বামীজি রান্না করার অনুমতি চাইলেন। পকেট থেকে কয়েক ডজন গুঁড়ো মশলা ও ফোড়ন, আচার চাটনি ইত্যাদি ঝটপট বেরিয়ে এল। এসব ইন্ডিয়া থেকে সযত্নে পাঠানো। স্বামীজি যেখানেই যেতেন নানারকম মশলাপাতি সঙ্গে নিতেন। সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ এক বোতল চাটনি যা এক ভদ্রলোক মাদ্রাজ থেকে পাঠিয়েছেন। ভীষণ ঝাল থাকতো রান্নায়, সময়ও লেগে যেতো অনেক। কোন কোন ভক্তের ধারণা, এসব রান্না তার লিভারের পক্ষে ভাল নয়। কিন্তু তিনি ওসব বিশ্বাস করতেন না।

বিদেশে যতই শ্রদ্ধা ভালবাসা ও আদর যত্ন পান না কেন স্বামীজির ভারতীয়ত্ব যে শতকরা একশো ভাগ অক্ষুণ্ণ রয়েছে এবং ভারতীয় রান্নার প্রচার যে তিনি নির্বিবাদে করে বেড়াচ্ছেন তা নিউ ইয়র্ক থেকে (১৪ এপ্রিল ১৮৯৬) স্বদেশে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।..”মুগের ডাল তৈয়ার হয় নাই মানে কি? ভাজা মুগের ডাল পাঠাইতে আমি পূর্বেই নিষেধ করিয়াছি। ছোলার ডাল ও কাঁচা মুগের ডাল পাঠাইতে বলি। ভাজা মুগ এতদূর আসিতে খারাপ ও বিস্বাদ হইয়া যায়, সিদ্ধ হয় না। যদি এবারও ভাজা মুগ হয়, টেমসের জলে যাইবে ও তোমাদের পণ্ডশ্রম। আমার চিঠি না পড়িয়াই কাজ কেন কর? চিঠি হারাও বা কেন? যখন চিঠি লিখিবে, পূর্বের পত্র সম্মুখে রাখিয়া লিখিবে। তোমাদের একটু বিজনেস বুদ্ধি আবশ্যক।”

সন্ন্যাসী শুধু আটলান্টিকের ওপারে বেদান্ত ও বিরিয়ানি প্রচার করেননি, এক্সপোর্ট প্রমোশনের কর্তাব্যক্তিরা জেনে রাখুন সেই ১৮৯৬ সালে স্বামীজি নিউইয়র্কে বসে ভারতীয় মশলার রপ্তানি সম্ভাবনা সম্বন্ধে বিশেষ চিন্তা করেছেন। গুরুভাই ত্রিগুণাতীতানন্দকে ১৭ জানুয়ারি ১৮৯৬ নিউইয়র্ক থেকে স্বামীজি কি লিখেছিলেন তা শুনুন।

“…দয়ালবাবুকে বলবে, যে মুগের দাল, অড়র দাল প্রভৃতিতে ইংলন্ডে ও আমেরিকায় একটা খুব ব্যবসা চলতে পারে। ডাল-সুপ উইল হ্যাভ এ গগা ইফ প্রপারলি ইনট্রোডিউণ্ড। (ঠিকমত শুরু করাতে পারলে দালের ফুষের বেশ কদর হবে।) যদি ছোট ছোট প্যাকেট করে তার গায়ে রাঁধবার ডিরেকশন দিয়ে বাড়িতে বাড়িতে পাঠানো যায়–আর একটা ডিপো করে কতকগুলো মাল পাঠানো যায়, তো খুব চলতে পারে। ঐ প্রকার বড়িও খুব চলবে। উদ্যম চাই–ঘরে বসে ঘোড়ার ডিম হয়। যদি কেউ একটা কোম্পানি ফর্ম করে ভারতের মালপত্র এদেশে ও ইংলন্ডে আনে তো খুব একটা ব্যবসা হয়।”

বুঝতেই পারা যাচ্ছে, বেদান্তর সঙ্গে ভারতীয় রান্নার বিশ্বব্যাপি প্রচারকে স্বামীজি কতটা সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন।

প্রবাসের পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়েছে। বিবেকানন্দকে। একেবারে গোড়া থেকে ধরা যাক। শিকাগো বক্তৃতার কালে এক দয়াময়ীর আশ্রয়ে ছিলেন বিবেকানন্দ। তার নাতনি অনেক বছর পরে তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, “দিদিমা ট্যাবাসকো সস দিয়ে স্যালাড ড্রেসিং করতেন। প্রচণ্ড ঝাল এই টবাসকো সসের শিশিটি দিদিমা স্বামীজির হাতে দিলেন কয়েক ফোঁটা নেবার জন্য–স্বামীজিকে হুড়মুড় করে খাবারে টবাসকো সস ছড়াতে দেখে দিদিমা আঁতকে উঠলেন, ‘কোরো না, ভীষণ ঝাল। হেসে বিবেকানন্দ এমনভাবে ঝাল উপভোগ করতে লাগলেন যে এরপরে দিদিমা পুরো শিশিটাই স্বামীজির পাশে রেখে দিতেন!”

ভোজনরসিক বিবেকানন্দ সম্বন্ধে আরেকটি নিবেদন পারিবারিক ভ্রমণে বেরিয়ে আদিম পদ্ধতিতে স্বামীজির ক্ল্যাম বা ঝিনুক ভক্ষণ। গরম ঝিনুক থেকে আঙুল দিয়ে মাংস বার করে নিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয়, কিন্তু গেঁড়িগুগলির দেশ থেকে আমেরিকায় গিয়ে এসব শিখে নিতে স্বামীজির একটুও সময় লাগেনি। তবে সেবার একটি দুর্ঘটনায় স্বামীজির প্রাণ সংশয় হতে চলেছিল, ব্যাপারটা তেমন প্রচারিত নয়।

নৌকো চালাতে গিয়ে স্বামীজি হঠাৎ জলে পড়ে গিয়েছিলেন। ব্যাগলে পরিবারের একজন সভ্য তৎক্ষণাৎ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে উদ্ধার না করলে অঘটন ঘটতে পারতো।

.

মার্কিন মুলুকে দ্বিতীয়বার গিয়ে স্বামীজি কীভাবে খাওয়াদাওয়া সারতেন তার বিবরণও মার্কিনী গবেষকরা অনুগ্রহ করে সংগ্রহ করেছেন। প্যাসাডেনায় (দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায়) যাঁদের বাড়িতে স্বামীজি থাকতেন তাঁদের ব্রেকফাস্ট টেবিলের রিপোর্ট; দেখা যাচ্ছে স্বামীজির পছন্দ-ফল, ডবল ডিমের পোচ, দু পিস টোস্ট, চিনি ও ক্রিম সহ দু’কাপ কফি। গৃহবধূ মিসেস হ্যাঁনসবরো অতিথিকে জিজ্ঞেস করতেন, তৃতীয় কাপ চলবে কি না?

দেখা যাচ্ছে এই পর্যায়ে স্বামীজি চুরুট খাওয়া হয় বর্জন করেছেন, না হয় কমিয়ে দিয়েছেন। ওই পরিবারেই স্বামীজির মধ্যাহ্নভোজনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ : মাটন (বীফ কখনই নয়) এবং নানারকমের শাকসবজি। ওঁর বিশেষ প্রিয় কড়াইশুটি। এই পর্যায়ে ডেসার্ট হিসেবে মিষ্টির পরিবর্তে ফল, বিশেষ করে আঙুর।

“আর একটা জিনিস লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যাঁদের বাড়িতেই স্বামীজি আতিথ্য নিতেন, তাঁদের এক-আধটা পদ রান্না করে তিনি খাওয়াতে চাইতেন। আমাদের মতন নুলো জগন্নাথ হয়ে অতিথিসেবা উপভোগ তার ধাতে সইতো না! একজন মার্কিন মহিলা মিসেস উইকফ জানাচ্ছেন, স্বামীজি তাঁকে শুধু ডিনার তৈরিতে সাহায্য করতেন না, মাবে’ মাঝে পরিবারের সব কটা পদই তিনি বেঁধে ফেলতেন।

আর একজন মহিলার মন্তব্য; “নিক্রন পার্কে আমাদের বাড়িতে যখন থাকতেন তখন একটা মিল তিনি রাঁধবেনই।” আরেক মহিলা (মিসেস হ্যাঁনসবরো) জানাচ্ছেন, “তিনি চাপাটি ও কারি রাঁধতে উৎসাহী হয়ে উঠতেন, অনেক মশলা তাকে গুড়োতে হতো, তার জন্যে মেঝেতে বসে পড়া পছন্দ করতেন।” মশলা গুঁড়ো করে, মাখনে ভেজে, ফোড়ন দেবার সময় রান্নাঘর থেকে এমন ধোঁয়া উঠতো যে উপস্থিত মহিলাদের চোখে জল এসে যেতো। সমস্ত পরিবারের জন্যে রাঁধতে হলে তার আনন্দের সীমা থাকতো না। স্বামীজির এই রান্না সম্বন্ধে মার্কিনি গৃহবধূ পরম বিস্ময়ে বলেছেন–ইলাবোরেট ও অ্যালার্মিং-এলাহি এবং বিপজ্জনক!

একবার খাওয়াদাওয়ার শেষে বিবেকানন্দ জানতে চাইলেন, “পদটি ভাল লেগেছে তো?” মিসেস ওয়াইকফ উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ”। স্বামীজির প্রশ্ন : “সত্যি কথা? না স্রেফ বন্ধুত্ব রাখার জন্য বলছো?” মিসেস উইকফের মধুর স্বীকারোক্তি : “বন্ধুত্ব রক্ষার জন্য বলেছি!”

আর একটা পারিবারিক ডিনারের বিবরণ আমাদের কাছে রয়েছে। সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। মিড় পরিবারে মোক্ষম ডিনার-স্যুপ, মাছ অথবা মাংস, সবজি এবং মিষ্টি বলতে আমেরিকান পাই। তবে সেখানে প্রায়ই স্বামীজির সংযোজন চাপাটি ও কারি! আমরা দেখছি, স্বামীজি ডিনারে কফি এড়িয়ে চলেছেন। মনে হচ্ছে, এই পর্বে রাত্রে কফি পান তার মোটেই সহ্য হচ্ছে না।

বলা যেতে পারে, উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার রান্নাঘরে শেফ বিবেকানন্দ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য রাঁধতে রাঁধতে স্বামীজি দর্শন আলোচনা করছেন, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন! যারা সেসব শুনতে পেরেছে তারা সারাজীবন সেই সৌভাগ্যকে মনে রেখেছে।

.

সাধারণত পাবলিক বক্তৃতার আগে বিবেকানন্দ কিছু খেতে চাইতেন না। ভরাপেটে বোধ হয় চিন্তাস্রোতে বাধা আসে। তবে মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম হতে বাধ্য। একবার সন্ধ্যায় স্বামীজিকে বক্তৃতার আগে মিসেস স্টিলের বাড়িতে ডিনার সেরে নিতে হলো। সেদিন ডিনারের শেষপদে ছিল খেজুর। খুব ভাল লাগলো তার। তারপর মঞ্চে দাঁড়িয়ে এক স্মরণীয় প্রাণকাঁপানো বক্তৃতা। ফেরার পথে অভিভূত মিসেস স্টিল স্বামীজিকে অভিনন্দন জানালেন। বিবেকানন্দর মুখে হাসি!তার সহাস্য উত্তর :”ম্যাডাম, সবই আপনার খেজুরের মাহাত্ম্য!”

ঈশ্বরসন্ধান, বেদ-উপনিষদেরবাণীপ্রচার,মানবজীবনের গভীরতমঅনুভূতি ও প্রশ্নগুলির অসামান্য বিশ্লেষণ এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন রান্নার রেসিপি সম্বন্ধে সিরিয়াস চিন্তা বিশ্বসংসারে স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া কে করতে পেরেছেন?

লস অ্যাঞ্জেলিসে এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়ে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের সঙ্গে বাড়ি ফিরছেন বিবেকানন্দ। গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছেন বিবেকানন্দ, মিস ম্যাকলাউড ভাবলেন নিশ্চয় কোনো জটিল দার্শনিক চিন্তা? এখন কথা বলাটা ঠিক হবে না। এমন সময় বিবেকানন্দ সরব হলেন। মনে হলো, অবশেষে জটিল কোনো রহস্যের সমাধানে সমর্থ হয়েছেন তিনি। বিবেকানন্দ: “এবার বুঝেছি, ওটা কীভাবে হয়।” ম্যাকলাউড অতি সন্তর্পণে জিজ্ঞেস করলেন, “কীসের কথা বলছেন?” এবার সত্যিই অবাক হবার পালা। বিবেকানন্দ উত্তর দিলেন, “মুলিগাটানি স্যুপটা কীভাবে রান্না করা উচিত! আমি বুঝেছি, পাতাগুলো আগে দিতে নেই, ওগুলো পরে দিতে হয়, তবে অমন সুগন্ধ হয়।”

দক্ষিণী রান্না সম্পর্কে এবং একই সঙ্গে দক্ষিণীসভ্যতা সম্পর্কে স্বামীজির দীর্ঘদিনের দুর্বলতা! রামানুজী তিলক-পরিব্যাপ্ত ললাটমণ্ডল সম্পর্কে তাঁর বিরামহীন রসিকতা, সেই সঙ্গে বোষ্টমদের নিয়ে নানারকম মজা।সর্বাঙ্গে ছাপ দেওয়া এক গোঁসাই দেখে এক মাতাল তাকে চিতাবাঘ ঠাওরেছিল। স্বামীজি লিখছেন, “এ মাদ্রাজী তিলক দেখে চিতে বাঘ গাছে চড়ে! আর সে তামিল তেলুগু মালয়ালম্ বুলি–যা ছয় বৎসর শুনেও এক বর্ণ বোঝবার জো নেই, যাতে দুনিয়ার রকমারি লকার ও ডকারের কারখানা; আর সেই মুড়তন্নির রসম’ সহিত ভাত সাপড়ানো–যার এক গরাসে বুক ধড়ফড় করে ওঠে (এমনি ঝাল আর তেঁতুল!); সে মিঠে নিমের পাতা, ছোলার ডাল, মুগের ডাল, ফোড়ন, দুধ্যম্ল ইত্যাদি ভোজন; আর সে রেড়ির তেল মেখে স্নান, রেড়ির তেলে মাছ ভাজা,–এ না হলে কি আর দক্ষিণমুলুক হয়?”

কথাটা তাহলে মুলগাথানি নয়! মুড়গ্‌তন্নি!

এবিষয়ে ভুল হবার কোনও চান্স নেই। স্বয়ং স্বামীজি তাঁর লেখায় ফুটনোট জুগিয়েছেন “অতিরিক্ত ঝাল-তেঁতুল-সংযুক্ত অড়হর ডালের ঝোল বিশেষ। মুড়গ’ অর্থে কালো মরিচ ও তন্নি’ অর্থে দাল।”

প্রবাসে শুধু ঝাল কারি এবং বিলিতি চপ কাটলেট নয়, আরও কয়েকটি খানার ব্যাপারে গবেষকদের সংগ্রহে প্রচুর তথ্য রয়েছে। স্বামীজির কাছে ফলের ব্যাপারটাও যে মজার তা বারবার দেখা যাচ্ছে।

আমেরিকায় আসবার আগেই পরিব্রাজককালে এক যাদুকরের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাৎ হয়েছিল। হাতদুটো কম্বলের মধ্যে রেখে তাঁবুতে বসা জাদুকর জানালেন, তুমি যা খাবার চাইবে তা দিয়ে দেব। স্বামীজিও ছাড়বার পাত্র নন, জাদুকরকে ফাঁপরে ফেলবার জন্য এতো জিনিস থাকতে খেতে চাইলেন, ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর। বোঝা যাচ্ছে, ক্যালিফোর্নিয়া আঙুরের প্রবল ভক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু যা আশ্চর্য, যাদুকর সত্যিই কম্বল থেকে হাত বার করে ক্যালিফোর্নিয়ার আঙুর তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন এবং বিস্মিত স্বামীজি সেই গল্প মার্কিন দেশের অনুরাগিণীদের কাছে নিজেই করেছিলেন।

আঙুরের প্রবল প্রশস্তি স্বামীজি ইংলন্ডে বসেও করেছেন। ১৮৯৬ সালে লন্ডনে তখন গ্রীষ্মকাল। ভাই মহেন্দ্র দেখা করতে এসেছেন। স্বামীজি বললেন, “কাঁচের পাত্রে কালো আঙুর রয়েছে, এটা নতুন উঠেছে, খা, খুব গোটাকতক খা। আঙুর খেলে গায়ের রক্ত পরিষ্কার হয়।”

লন্ডনে থাকাকালীন মিস হেনরিয়েটা মুলারের কাছে কয়েকটি আম এল, ভারতবর্ষ থেকে কেউ উপহার পাঠিয়েছে। জাহাজে আসতে মাসাবধি লেগেছে। স্বামীজি একজন বিশেষজ্ঞের মতন আমের পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থায় নেমে পড়লেন।

ভক্ত গুডউইনকে তিনি বললেন, “খানিকটা বরফ এনে আমগুলোকে ভিজিয়ে দাও, তা হলে আমের কিছুটা স্বাদ হবে।” আর একজন বেদান্ত সন্ধানী যুবক মিস্টার জন পিয়ার ফক্স আমেরিকা থেকে এসেছে। তরুণ ফক্স কখনও আম দেখেনি। ছুরি কাঁটা দিয়ে আম খাওয়ায় সুবিধে করতে পারছিল না। স্বামীজি প্রথমে ফক্সকে বললেন, “ফক্স, চামচে দিয়ে কুরে কুরে খাও।” তারপর তিনি ভারতের আমের গল্প বলতে লাগলেন।

স্বামীজির নিজের জীবনেও কি আমের গল্প শেষ আছে? বেশ কয়েক জায়গায় আমকে তিনি ‘আঁব’ বলেছে। ভেবেছিলাম কলকেত্তিয়া উচ্চারণ, কিন্তু পরে ভাষাতত্ত্ববিদদের কাছে জেনেছি, আঁবটাই সঠিক উচ্চারণ।

একবার বেনারসের জগদ্বিখ্যাত ইম্পিরিয়াল ব্যাংকের ল্যাংড়া আম সম্বন্ধে আলোচনা হচ্ছিল খোদ বেনারসে বসেই। এই আমের বর্তমান নাম স্টেট ব্যাংকের ল্যাংড়া, স্বামীজির সময়ে নাম ছিল ইমপিরিয়াল ব্যাংকের ল্যাংড়া। তখন শীতকাল, গাছে আম থাকার কথা নয়, কিন্তু একজন ভক্ত বাগানে ঢুকে দেখলেন গাছে দুটি ভুবনমোহন ল্যাংড়া আম অসময়ে শোভা পাচ্ছে। অতএব জয় স্বামীজিকি জয়!

আরেকবার আমকে কেন্দ্র করে গিরিশ ঘোষ ভারসাস নরেনের বাকযুদ্ধ হয়েছিল। বলরামবাবুর উত্তর কলকাতার বাড়িতে গিরিশ নরেন দু’জনে পাশাপাশি বসে খাচ্ছেন। গিরিশের ভাষায়; “যত আম আমার পাতে দিচ্ছে। সবগুলো মিষ্টি, আর নরেনকে যত দিচ্ছে সব টক হচ্ছে। এইতে নরেন চটে গিয়ে আমাকে বললে, শালা জিসি তোর পাতে যত মিষ্টি আম, আর আমার পাতে যত টক! নিশ্চয়ই তুই শালা বাড়ির ভিতর গিয়ে বন্দোবস্ত করে এসেছিস।আমি বললাম, “আমরা গৃহী সংসারী, আমরাই মজা মারবো, তুই শালা সন্ন্যাসী-ফকির হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াবি, তোদের কপালে তো শুটকো টোকো জুটবে।” জিসি ওরফে গিরিশ এবং স্বামীজি দেখা হলেই নকল কথা কাটাকাটি করতেন, দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো শ্রীম সেসবের বর্ণনা রেখে যাননি।

.

লন্ডনে স্বামীজির ফল নিয়ে কিন্তু এক রহস্যময় ব্যাপার ঘটেছিল। ১৮৯৬ সালে স্বামীজি যখন লন্ডনে এসেছেন তখন ওখানকার বিখ্যাত ফলের দোকানের নাম উইলিয়ম হোয়াইটলি। কোনো এক ভক্ত রহস্যজনকভাবে এই দোকানে নিজের পরিচয় গোপন করে বেশ কিছু টাকা জমা রেখে গিয়েছিলেন, প্রত্যেকদিন স্বামীজির বাড়িতে সেরা ফল হোম ডেলিভারির জন্য।

বেলা এগারোটার সময় প্রত্যেকদিন হোয়াইটলির দোকান থেকে একজন কর্মচারি এসে কাগজে মোড়া বেশ কিছু ফল স্বামীজির বাসস্থানে দিয়ে যেতো। বাজারে ফল উঠবার তিন সপ্তাহ আগেই বিভিন্ন ধরনের টাটকা ফল স্বামীজির টেবিলে পৌঁছে যেতো। আনারস তখন লন্ডনে দুপ্রাপ্য, দাম প্রায় একগিনি।যখনকার যে ফলটি পাওয়া যেতো,যতই দাম হোক, হোয়াইটলির লোকটি তাই স্বামীজিকে দিয়ে যেতো।

কার আদেশে এই ফল আসতো সে রহস্য আজও পরিষ্কার হয়নি, তবে সন্দেহের তীর রয়েছে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডের দিকে। কারণ তিনি লন্ডনে আসার পর থেকেই অঘটন ঘটতে আরম্ভ করে।

চোখের সামনে দুষ্প্রাপ্য আনারস দেখে স্বামীজির খুবই আনন্দ। কিন্তু সেবক গুডউইন তা ছাড়াতে পারছেনা। আনারস ছাড়ানো খুব সহজ ব্যাপার নয়। গুডউইনের অবস্থা দেখে তখন স্বামীজি নিজেই ছুরি হাতে আসরে নামলেন। টুকরো টুকরো করে, গুঁড়ো চিনি দিয়ে সবাইকে দেওয়া হলো। মহেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় এসবের মনমাতানো উল্লেখ আছে।

মনে রাখতে হবে, নিত্য ফল সরবরাহের রহস্যজনক সম্পর্ক গড়ে ওঠার একটু আগে থেকেই উইলিয়ম হোয়াইটলির দোকানে বিবেকানন্দপ্রেমীদের যাতায়াত শুরু হয়েছিল। সেবার লন্ডনে হঠাৎ কাঁচা লঙ্কা খাবার সাধ হলো স্বামীজির। খুঁজতে খুঁজতে অনেক সন্ধানের পর কৃষ্ণ মেনন তিনটি খুব কঁচা লঙ্কা হোয়াইটলি থেকে সংগ্রহকরলেন।দাম শুনলেচক্ষুচড়কগাছ–তখনকার দিনে তিনটি কঁচা লঙ্কা তিন শিলিং, ঝাল নেই, তবে গন্ধ আছে। ব্রেকফাস্টে বসে লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজি একের পর এক লঙ্কাগুলো খেয়ে নিলেন।

লঙ্কার কথা আরও দীর্ঘনাহলে স্বামীজির জীবনের প্রতি যে অবিচার করা হয় এবিষয়ে মতানৈক্য নেই।

লঙ্কাকাণ্ডটা শুরুর আগে ফলের কথাটা গুটিয়ে আনাও প্রয়োজন। আমরা জানি স্বামীজি ফল ভালবাসতেন, বিশ্বাস করতেন সাধারণ মানুষের কর্মেও যেমন অধিকার, গাছের ফলেও তেমন অধিকার! স্বামী অদ্বৈতানন্দকে (গোপালচন্দ্র ঘোষ) তিনি বলেছিলেন, “ফল দুধ বরাবর খেয়ে কেউ যদি জীবন কাটায় তাহলে হাড়ে জং ধরে না!”

এবার প্রশ্ন হলো, কোন কোন ফল স্বামীজির ভালো লাগতো? আমরা দেখেছি, কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কথামৃতকার মাস্টারমশায়ের কাছে গিয়ে স্বামীজি তরমুজ খাবার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। আমরা দেখেছি, নেয়াপাতি ডাবের মধ্যে বরফ এবং চিনি ঢেলে ঠাণ্ডা অবস্থায় খেতে খুব ভালবাসতেন। আমাদের দুর্ভাগ্য স্বামীজিকে আমরা ফ্রিজের সুখ দিতে পারিনি। আমরা দেখেছি, তিনি একাধিক ভক্তকে দীক্ষান্তে গুরুকে লিচুর গুরুদক্ষিণা দেবার পরামর্শ দিচ্ছেন। আবার আমরা দেখছি, বেলুড় মঠে যে বিশাল সাইজের কাঁঠাল ফলেছে তার প্রশস্তি গেয়ে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বিদেশিনী শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে তিনি চিঠি লিখছেন। ইংরিজিতে কাঁঠালমাহাত্ম্য সুললিতভাবে বর্ণনা করা অত সহজ কর্ম নয়।

শেষপর্বে আমরা দেখছি, ডায়াবিটিসে কাতর স্বামীজি বড় জাগুলিয়ায় তার বোনের বাড়ি থেকে সেরা জাম নিয়ে বেলুড় মঠে ফিরছেন। সেবার বেলুড়ে কালোজামের রসকে বোতলবন্দি করে ছিপি এঁটে পাঁচ-সাতদিন রোদ্দুর খাইয়ে রান্নাঘরের পাশে দড়ি বেঁধে রাখা হলো। ফারমেন্ট হয়ে রস তেজি হওয়ায় বেলুড়ের সেই বোতল যখন দুম করে ফাটলো, তখন উৎফুল্ল বিবেকানন্দ অনুগতদের কাছে সগর্বে ঘোষণা করলেন, “এই সিরকা ভারি হজমি–এতোদিনে ঠিক তৈরি হয়েছে, তোরা রোজ একটু একটু খাবি।”

স্বামীজির সাধক জীবনের শুরুতে আমরা এক আজব ডাক্তারের পরিচয় পাচ্ছি, যিনি খালি হাতে রোগীর কাছে যেতেন না। নরেন্দ্রনাথের একবার পাথুরি হয়েছিল, ডাক্তার রাজেন দত্ত রোগী দেখবার সময় এনেছিলেন নতুন বাজার থেকে কেনা মস্ত এক বেল। সেই বেল নরেন্দ্রনাথ মুখে দিতে পারেননি, এমন কোনো রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে বিলেদের বেল অপছন্দ করার পথ থাকে না!

কিন্তু যতবড় ফলাহারি মহাপুরুষ হোন, দুনিয়ার সব ফল কারও ভাল লাগতে পারেনা। অনেক খোঁজখবর নিয়ে দেখা যাচ্ছে একমাত্র একটি ফলের বিরুদ্ধে স্বামীজি আকারে ইঙ্গিতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। বারুইপুরের পেয়ারাবাগানের মালিকদের পক্ষে দুঃসংবাদ, স্বামীজি একবার বলেছিলেন, যদি কখনও দেবতাকে ফলদান করে সেই ফলটি থেকে সারাজীবন তাকে দূরে থাকতে হয় তাহলে সেটি হবে পেয়ারা! মার্কিনী মহিলা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলেন, স্বামীজি পেয়ারা অপছন্দ করেন। জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থ শরীরকে সুস্থ করার জন্য আলমোড়ায় উপস্থিত হয়ে স্বামীজি তাঁর পরমপ্রিয় গুরুভাই রাখালকে লিখছেন, “রাত্রির খাওয়াটা মনে করছি খুব লাইট করব…রাত্রে দুধ ফল ইত্যাদি।তাই তোওৎ পেতে ফলের বাগানে পড়ে আছি, হে কর্তা!” সুরসিক তো এঁকেই বলে!

সত্যিই, মানুষটার কি রসিকতাবোধ! বিশ্বসংসারে শতযন্ত্রণার মধ্যেও কৌতুকবোধ এবং মানুষের প্রতি ভালবাসা হারাতে রাজি হননি বলেই আজও স্বামীজি এদেশের এতো মানুষের হৃদয়েশ্বর হয়ে আছেন।

স্বামীজির ভোজনবিলাস সম্পর্কে আমাদের দুঃসাহসী অনুসন্ধানপর্বের শেষ এইখানে নয়। সোজাসুজি বলে রাখি, সবে তো কলির সন্ধে! স্বয়ং স্বামীজিকে এইভাবে অর্ধসমাপ্ত রেখে রণে ভঙ্গ দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না।

রাঁধুনি বিবেকানন্দ সম্বন্ধে এখনও প্রাণখুলে আলোচনার সুযোগ পাওয়া যায়নি। আমরা শুধু সবিনয়ে উল্লেখ করেছি, বিবেকানন্দই একমাত্র ভারতীয় যিনি বেদান্ত ও বিরিয়ানিকে একই সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশে প্রচারের দূরদর্শিতা অথবা দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। এতোদিন পরে তার দুটো স্বপ্নই সাফল্যের পথে। ইয়োগা বলতে সায়েবদের উৎসাহ এখন আমাদের থেকে শতগুণ বেশি, আর অতি সম্প্রতি আমাদের প্রাক্তন শাসক ইংরেজ নতমস্তকে এবং বিষণ্ণবদনে স্বীকার করেছে যে খোদ ইংলন্ডে চিকেনকারি শ্বেতাঙ্গদের জাতীয় খাদ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। অর্থাৎ দাসের খাদ্য কারির কপালেই অবশেষেজুটেছেবহু আকাঙ্ক্ষিতরাজমুকুট। কিন্তু ইতিহাসে আমরা বিবেকানন্দ ছাড়া এক জনকেও পাচ্ছি না যিনি পশ্চিমের রান্নাঘরের দরজা প্রাচ্যের জন্য খুলে দেবার দুর্লভ কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ সর্বত্যাগী, কোনোরকম খ্যাতি বা স্বীকৃতির পিছনে ছোটা ছিল তার স্বভাববিরুদ্ধ, তিনি যা করেছেন তা করেছেন ভবিষ্যদ্রষ্টা হিসেবে, তিনি নিশ্চয় বুঝেছিলেন প্রাচ্যের প্রধান বাণীগুলো পাশ্চাত্যের রান্নাঘর দিয়েও পশ্চিমী মানুষের হৃদয়ে পৌঁছবে একদিন।

একটা মুখ দিয়ে স্বামীজির কত কথা আর বলা যায়! মন দিয়ে খিচুড়ি, পোলাও, বিরিয়ানি এটসেটা সম্বন্ধে স্বামীজির কাজকর্মটুকু খতিয়ে দেখা যাক। কী তার দূরদৃষ্টি, কি তার উদ্ভাবনী শক্তি, কি তার প্রচার ক্ষমতা!

এরপরে একের পর এক ছবি নোট বইতে তুলে রেখেছেন পটলাদা! “নরেন ও তাহার আলাপীরা সকলে একদিন ভুনি খিচুড়ি রাঁধিয়াছিল। কড়াইশুটি ও আলু ভাজিয়া রাখিল,চাউলগুলি একটু চমকাইয়া তাহাতেনানা প্রকার মশলা মাখাইয়া, হাঁসের ডিম ফাটাইয়া তাহাতে মাখিল এবং জলে সিদ্ধ করিয়া ঘিনুন দিল।”বলাবাহুল্য অভিনব ঝরঝরে ভুনি খিচুড়ি হয়েছিল। “অন্য পোলোয়ার চেয়ে এই রকম রন্ধন অনেক শ্রেষ্ঠ, এখবর দিয়েছেন মেজভাই মহিম।

ঠাকুরের দেহাবসানের পর দক্ষিণেশ্বরে তাঁর জন্মোৎসবে যে রান্নার মেনু নরেন্দ্রনাথ নির্ধারণ করেছিলেন, সেখানেও ব্যবস্থা হয়েছিল মুগের ডালের ভুনি খিচুড়ি–সেই সঙ্গে আলুকপির দম, দই, বোঁদে ইত্যাদি!

এটা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে যে স্বামী বিবেকানন্দই সাম্প্রতিক কালে জোরের সঙ্গে প্রমাণ করলেন পোলাটা খাঁটি ভারতীয়, বাইরে থেকে আমদানি করা মোগলাই খানা নয়। বোধ হয় এই প্রাচীন ভারতীয়ত্বের ওপর জোর দেওয়ার জন্যেই স্বামীজি মাঝে মাঝে পোলাও রাঁধবার জন্যে প্রবল উৎসাহী হয়ে উঠতেন।

প্রথমবার বিদেশ থেকে ফেরবার পরে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ শীতের এক সন্ধ্যায় বলরাম বসু মহাশয়ের বাড়িতে বসে আছেন। স্বামীজি বলছেন, বাংলা দেশে যেমন তরকারি ব্যবস্থা এমন কোথাও নেই, তবে রাজপুতানায় বেশ আহারের ব্যবস্থা আছে।

মহিষাদলের রাজার ম্যানেজার ভক্ত শচীনবসু মন্তব্য করলেন,”মহারাজ, ওরা কি খেতে জানে? সব তরকারিতে টক দেয়।”

স্বামীজি: ”তুমি বালকের মতো কথা কইছো যে!… সিভিলাইজেশন তো ওদের দেশেই ছিল–বেঙ্গলে কোন কালে ছিল? ওদের দেশে বড় লোকের বাড়ি যাও, তোমার ভ্রম ঘুচে যাবে।…আর তোমার পোলাওটা কি? লং বিফোর ‘পাক রাজ্যেশ্বর’ গ্ৰন্থে পলান্নের উল্লেখ আছে; মুসলমানরা আমাদের নকল করেছে। আকবরের আইনি-আকবরীতে কি করে হিন্দুর পলান্ন প্রভৃতি রাঁধতে হয় তার রীতিমত বর্ণনা আছে।”

এর আগে লন্ডনেও স্বামীজি পোলাও প্রসঙ্গ নিয়ে নিজের মতামত জানিয়েছিলেন। ”পেঁয়াজকেপলাণ্ডু বলে–পল মানে মাংস। পেঁয়াজ ভেজে খেলে দুষ্পচ্য, পেটের ব্যানো হয়, সিদ্ধ করে খেলে উপকার করে এবং মাংসের যে কস্টিভনেস’ থাকে সেটা নাশ করে।”

পিঁয়াজ সম্পর্কে স্বামীজি কি শেষ পর্যন্ত তার মত পরিবর্তন করেছিলেন? মেরি লুইস বার্ক-এর ঐতিহাসিক বইতে দেখা যাচ্ছে, একজন ছাত্র স্যানফ্রানসিসকোতে প্রশ্ন করছে, পিঁয়াজ সম্বন্ধে আপনার মত? স্বামীজির উত্তর : “আধ্যাত্মপথের যাত্রীদের পক্ষে পিঁয়াজ অবশ্যই সেরা খাদ্য নয়।” সেই সঙ্গে স্বামীজির সরল স্বীকারোক্তি, “ছোটবেলায় আমি কী ভীষণ ভালবাসতাম। পিঁয়াজ খেয়ে মুখের গন্ধ দূর করবার জন্যে খোলা হাওয়ায় অনেকক্ষণ হাঁটা চলা করতাম।”

পোলাও পর্বের যেন শেষ নেই। প্রথমবার আমেরিকা যাবার আগে স্বামীজি বোম্বাইতে রয়েছেন, হঠাৎ ইচ্ছে হলো স্বহস্তে সকলকে পোলাও বেঁধে খাওয়াবেন। মাংস, চাল, খোয়া-ক্ষির ইত্যাদি সকল প্রকার উপকরণ জোগাড় হল। এদিকে আখনির জল তৈরি হতে লাগল, স্বামীজি আখনির জল থেকে সামান্য কিছু মাংস তুলে খেলেন। পোলাও তৈরি হলো। স্বামীজি ইতিমধ্যে অন্য একটি ঘরে গিয়ে ধ্যান করতে লাগলেন। আহারের সময় সকলে বারবার তাকে খেতে অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি বললেন, আমার খেতে কোনো ইচ্ছে নেই, তোমাদের একটা বেঁধে খাওয়ানো উদ্দেশ্য ছিল, সেজন্য ১৪ টাকা খরচ করে এক হাঁড়ি পোলাও বেঁধেছি-খাওগে যাও।” স্বামীজি আবার ধ্যানে বসলেন।

প্রবাসে কোথায় কোথায় কতবার তিনি পোলাও/খিচুড়ি বেঁধেছেন তার পুরো হিসেব সংগ্রহ করা এখনও সম্ভব হয়নি। আধ্যাত্মিক চর্চার জন্যে শহর থেকে বহু দূরে শান্ত পরিবেশে তাঁবু খাঁটিয়ে সাধনা হচ্ছে। এরই মধ্যে রান্না।

আমেরিকার মাটিতে বসেহামানদিস্তা দিয়ে স্বামীজিমশলাগুঁডোকরলেন। তিনি রান্নায় ঝাল বেশি তত দিতেনই, তার সঙ্গে লাল লঙ্কা চিবিয়ে খেতেন। ভক্তিমতী আইডা অ্যানসেলকে বললেন, “খেয়ে দেখো, এতে তোমার ভাল হবে।” আইডা পরে বলেছিলেন, “স্বামীজি বিষ দিলেও খেতাম। তাই খেলাম, কিন্তু ফল হলোঅতীব যন্ত্রণাদায়ক।” মেমসায়েবদের কি অতোলঙ্কা সহ্য হয়! যদিও লঙ্কাটা এসেছে বলিভিয়া থেকে।

খিচুড়ি অথবা পোলাওতে ঝাল কম হবার যে উপায় নেই তা আমরা স্বামীজির পরিব্রাজক জীবন থেকেই দেখতে পাচ্ছি। হৃষিকেশে সেবার স্বামীজির কঠিন অসুখ হয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে খেতে চাইলেন স্বামীজি। নিবিড় জঙ্গলে চাল-ডাল জোগাড় করা কঠিন। প্রিয় গুরুভাই রাখাল এক ডেলা মিছরি সেবার খিচুড়িতে দেয়। ঝালখোর স্বামীজির খিচুড়ির আস্বাদ মোটেই ভাল লাগছে না। এমন সময় খিচুড়ির মধ্যে একটা লম্বা সুতো বেরুলো। অভিজ্ঞরা জানেন, তখনকার দিনে মিছরির মধ্যে এক আধটা সুতো থাকতো।সদ্য রোগ থেকে ওঠা স্বামীজির তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, খিচুড়িতে সুতো কেন? সকলে বললো, এক ডেলা মিছরি ফেলেছেরাখাল। মহাবিরক্ত স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে পাকড়াও করলেন গুরুভাইকে। “শালা রাখাল, এ তোর কাজ, তুই খিচুড়িতে মিষ্টি দিয়েছিস।দুঃ শালা। খিচুড়িতে কখনও মিষ্টি দেয় রে? তোর একটা আক্কেল নেই!”

আর একবার পরিব্রাজক অবস্থায় স্বামীজি মীরাটে হাজির হয়েছেন। জনৈক আমীরসায়েব সন্ন্যাসীকে রাজোচিত সিধা পাঠিয়েছিলেন। আর কথা নেই, ঈশ্বরপ্রেরিত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে পোলাও রাঁধার উদ্যোগ করলেন।

মীরাটে অবস্থান সম্বন্ধে স্বামী তুরীয়ানন্দর এক চিঠিতে (১৯ ডিসেম্বর ১৯১৫) মজার বর্ণনা আছে। “স্বামীজি আমাদের জুতা সেলাই হতে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত সব শিক্ষা সেই সময় দিতেন। এদিকে বেদান্ত, উপনিষদ, সংস্কৃত নাটক সকল পাঠ ও ব্যাখ্যা করিতেন, ওদিকে রান্না শিখাইতেন।…একদিন পোলাও প্রভৃতি রান্না করিয়াছেন…সে যে কি উপাদেয়। হলো আর কি বলব? আমরা ভাল হয়েছে বলায় সব আমাদের খাইয়ে দিলেন, নিজে দাঁতে কাটলেন না। আমরা বলায় বলিলেন, “আমি ওসব ঢের খেয়েছি–তোদের খাইয়ে আমার বড় সুখ হচ্ছে, সব খেয়ে ফেল।”

“স্বামীজির রান্নায় সবসময় এতো ঝাল কেন?” এই প্রশ্ন উঠতে পারে। এটাই তো রাঁধুনি, ডাক্তার, মনস্তাত্ত্বিক এবং দার্শনিকদের যৌথ গবেষণার বিষয় হতে পারে। লঙ্কা দেখলেই স্বামীজির ব্রেক ফেল করতো! পরিব্রাজক জীবনে তিনি তো একবার লঙ্কাভক্ষণ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিলেন। খেতে বসেছেন গোবিন্দ বসুর বাড়িতে, আর একজন অতিথি (সাধু অমূল্য) স্বামীজিকে দেখিয়ে মনের আনন্দে একটা শুকনো লঙ্কা খেলেন। চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে দুটি লঙ্কা খেলেন, অমূল্য তিনটি খেলেন, স্বামীজি চারটে খেলেন, এইভাবে প্রতিযোগিতা বেড়েই চললো, শেষ পর্যন্ত সাধু অমূল্যকে পরাজয় মানতে হলো।

আর একবার আলোয়ারে বৈষ্ণব সাধু রামসানাইয়ার সঙ্গে স্বামীজির অন্তরঙ্গ পরিচয় হয়েছিল। এই সাধুও ঝাল ভালবাসতেন। মাধুকরী করে আটা এনে তাতে নুন ও লঙ্কা মেখে ধুনি জ্বালিয়ে টিক্কর বানাতেন। স্বামীজিও স্রেফ এই ঝাল টিক্কর ও জল খেয়ে দিন কাটাতেন,দু’জনে প্রায়ই মনের আনন্দে ঘটি বাজিয়ে ভজন গাইতেন।

পরবর্তীকালে কোন সময়ে স্বামীজিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি এতো লঙ্কা খান কেন?”

স্বামীজির উত্তরটি স্মরণীয় : “চিরজীবনটা পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি আর বুড়ো আঙুলে টাকা দিয়ে ভাত খেয়েছি। লঙ্কাই তো একমাত্র সম্বল ছিল। ঐ লঙ্কাই তো আমার পুরনো বন্ধু ও মিত্র। আজকাল না হয় দু’চারটে জিনিস খেতে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু চিরটাকাল তো উপোস করে মরেছি।”

রান্নার ওপর স্বামীজি কতটা গুরুত্ব দিতেন তারও ইঙ্গিত নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। স্বামীজি বলতেন,”যে কাজই হউক, খুব মনোযোগের সহিত করা চাই।…যে রান্নাটাও ভাল করতে পারে না, সে কখনও পাকা সাধু হতে পারে না, শুদ্ধ মনে এক চিত্তে না রাঁধলে খাদ্যদ্রব্য সাত্ত্বিক হয় না।”

পরের দায়িত্ব সম্বন্ধে তো বললেন, কিন্তু তিনি নিজে কী? শাস্ত্রই বলছে, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শিখাইবে।

এবিষয়ে একজন গুরুভাই স্বামী তুরীয়ানন্দ (হরি মহারাজ) যা বলবার তা বলে গিয়েছেন।”দেখ নরেনের সব কাজ কি চটপট, পাগড়ী বাঁধবে তাও কি চটপট করে…অন্য লোক এক ঘণ্টায় যে কাজ করছে নরেন দুই মিনিটে সে কাজ করে ফেলে এবং এক সঙ্গে পাঁচছয়টা কাজ করে যায়।…এমন লোক জগতে খুব কম আছে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, কুটনো কোটা দেখ, পাঁচ মিনিটে সব কুটনো কুটে ফেললে। আলুর খোসা ছাড়ানো দেখ, আলুকে আঙুল দিয়ে ধরলে বঁটির গায়ে ছুঁয়াতে লাগল আর ঠিক খোসাটি উঠে গেল। আলুটা কোন জায়গায় বেধে গেল না বা চোকলা উঠে গেল না। কি আশ্চর্য তার কাজকর্ম! সব বিষয় যেন চনমন করছে, এই কুটনো কুটছে, এই হাসি তামাসা করছে, এই দর্শনের কথা বলছে, কোনটাই যেন তার পক্ষে কিছুই নয়।”

অনেকদিন পরে এই হরি মহারাজের সঙ্গে হরিদ্বারে এক প্রবীন সাধুর দেখা হয়। সাধুটি বিবেকানন্দ সম্বন্ধে তাকে বলেন,”এত সাধুর সঙ্গে মিশেছি। কিন্তু ওঁর মতন সাধু কখনও দেখিনি। হাসাতে হাসতে পেটে ব্যথা করে দিত, আর হাসির সঙ্গে এমন কথা বলত যে একেবারে বৈরাগ্য যেন আবার জেগে উঠত। অমন ইয়ার সাধু জীবনে কখন আর দেখিনি।”

শেষ কথাটি শুনে মনে একটু ভরসা জাগছে ইয়ারকির জন্য বাজারে আমার খুব বদনাম হয়ে গিয়েছে।

ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে, যে স্রেফ নিজের ব্রেন খাঁটিয়ে রসনারসিক বিবেকানন্দকে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়, মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খাবারের হিসট্রি জিওগ্রাফি কেমিস্ট্রি সব তিনি জেনে বসেছিলেন। নিজে প্রায়ই কিছুমুখে দিতেন না, সেই সঙ্গে ছিল হাজাররকম ডাক্তারি বাধা নিষেধ, তবু অপরকে খাইয়ে অপার আনন্দ পেতেন। চেনা-অচেনা যারাই খেতে পাচ্ছে না তাদের জন্যে ছিল সীমাহীন উদ্বেগ–এই হচ্ছেন আমাদের বিবেকানন্দ ইন এ নাটশেল অথবা একনজরে স্বামীজি।

আমাদের পরবর্তী আলোচনার বিষয় খাদ্য ও অখাদ্যর পদবিচার। স্বামীজি যে এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন তার প্রমাণ রয়েছে নিজের লেখা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে। এবিষয়ে লিখিত মতামত দেওয়ার পরেও স্বামীজি বেলুড়ে বসে শিষ্য শরচ্চন্দ্রের সঙ্গে দ্বিতীয়বার আলোচনা করেছেন যা স্বামী-শিষ্য-সংবাদ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

স্বামী-শিষ্য-সংবাদ এতোই গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য দলিল যে এই বইটিকে বাংলা বিবেকানন্দ রচনাবলীতে নির্দ্বিধায় স্থান দেওয়া হয়েছে।

শঙ্করশিষ্য রামানুজের মতে খাদ্যে ত্রিবিধ দোষ : (১) জাতিদোষ অর্থাৎ যে দোষ ভোজ্যদ্রব্যের জাতিগত; যেমন পাজলশুন ইত্যাদি উত্তেজক দ্রব্য খেলে মনে অস্থিরতা আসে অর্থাৎবুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়।(২) আশ্রয় দোষ অর্থাৎ যে দোষ ব্যক্তিবিশেষের স্পর্শ থেকে আসে–দুষ্ট লোকের অন্ন খেলেইদুষ্টবুদ্ধি আসবেই এবং (৩) নিমিত্ত দোষ অর্থাৎ ময়লা কদর্য কীট-কেশাদি-দুষ্ট অন্ন খেলেও মন অপবিত্র হবে।…নিমিত্ত দোষ সম্বন্ধে বর্তমানকালে বড়ই ভয়ানক অবস্থা দাঁড়িয়েছে; ময়রার দোকান, বাজারে খাওয়া, এসব মহা অপবিত্র দেখতেই পাচ্ছ, কিরূপ নিমিত্তদোষে দুষ্টময়লা আবর্জনা পচা পক্কড় সবওতে আছেন–এর ফল হচ্ছে তাই।

অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীজি বলেছেন, খাদ্যের আশ্রয় দোষ থেকে বাঁচা সকলের পক্ষে সহজ নয়।

মঠ থেকে বেরিয়ে পরিব্রাজক অবস্থায় এবং সাগরপারে স্বামীজি নিজে কীভাব আশ্রয়দোষের মোকাবিলা করেছেন তার এক-একটা উদাহরণ বিদেশিনীরাও সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন। এবিষয়ে তার বোধ হয় তৃতীয় নয়ন ছিল।

একবার খ্যাতনামা শিল্পী চার্লস নেলসন স্বামীজিকে স্যানফ্রানসিসকোর চায়নাটাউনে এক বিখ্যাত চাইনীজ রেস্তোরাঁয় ডিনারে নেমন্তন্ন করেছিলেন। দোকানের মালিক শিল্পী নেলসনের পরিচিত। তাই বিশিষ্ট অতিথিকে স্পেশাল খাতির করতে শেফ স্বয়ং ওঁদের টেবিলে দেখা করতে এলেন।সময় বাঁচাবার জন্য নেলসন অবশ্য আগে থেকেই খাবারের মেনু ঠিক করে দিয়েছিলেন। স্বামীজি কিন্তু চাইনিজ শেফকে একবার দেখেই সব বুঝে ফেললেন। একেই বলে তৃতীয় নয়ন। কিচেন থেকে লোভনীয় সব খাবার এলো, কিন্তু আশ্রয়দোষ আছে বুঝে স্বামীজি খাবার মুখে তুললেন না। নেলসন একটু লজ্জায় পড়লেন, কিন্তু কিছু করা গেল না।

স্বামীজি পরে বলেছিলেন, শেফের চরিত্র ভাল নয় বুঝেই তার পক্ষে খাদ্য স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি।

আর একবার স্বামীজি আমেরিকায় এক ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলেন। সেখানে চিংড়িমাছ মুখে দিয়ে, বাড়িতে এসেই তিনি বমি করতে আরম্ভ করলেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথা স্মরণ করে পরে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার রকমসকমও বুড়োর মতো হয়ে যাচ্ছে। কোনো অপবিত্র লোকের স্পর্শ করা খাদ্য বা পানীয় তার শরীর গ্রহণ করতে পারতো না।”

এর আগে ডেট্রয়েটে ভীষণ ব্যাপার হয়েছিল। কিছু মিশনারী তখন স্বামীজির সর্বনাশ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এক ডিনার পার্টি অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। শেষপর্বেকফিএলো। গুরুভাই স্বামী বিজ্ঞানানন্দকে অনেক বছর পরে স্বামীজি বলেছিলেন, “ঠাকুর চোখের সামনে ভেসে উঠলেন, বললেন, ‘খাস না! বিষ আছে।গুরু আমার সঙ্গে সব সময় আছেন, কে কি করতে পারে আমার?”

.

খাদ্যের জাতিদোষ সম্বন্ধে স্বামীজি যে কত জায়গায় কত মূল্যবান কথা বলেছেন তার হিসেব নেই। সেসব উপদেশ এখনও মানুষকে মাঝে মাঝে মনে করিয়ে দেওয়া মন্দ নয়। স্বামীজি বলতেন, “খিদে পেলেও কচুরি জিলিপি খাবার ফেলে দিয়ে এক পয়সার মুড়ি কিনে খাওসস্তাও হবে, কিছুখাওয়াও হবে।”

ডাল সম্বন্ধে তার যথেষ্ট দুর্বলতা ছিল, বিশেষ করে কলায়ের ডাল হলে তো কথাই নেই। বহুবার প্রিয়জনদের কাছে তিনি আব্দার করেছেন, কলায়ের দাল কর। তবে বলে রাখা ভাল, তার গুরুভাই অভেদানন্দ আবার কলায়ের ডাল একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। বোধ হয় এলার্জি ছিল, ওই ডাল দেখলেই কালী বেদান্তীর সর্দি হতো, হাঁচতে শুরু করতেন।

সঙ্ঘজননী শ্ৰীসারদামণির কাছে গরম ছোলার ডাল দিয়ে রুটি খাবার লোভও ছিল নরেন্দ্রনাথের।

ডাল ভালবাসলেও এ সম্পর্কে স্বামীজির পরামর্শ : খুব সাবধানে “ডাল দক্ষিণীদের মতন খাওয়া উচিত, অর্থাৎ ডালের ঝোলমাত্র, বাকিটা গরুকে দিও…ডাল অতি পুষ্টিকর খাদ্য, তবে বড়ই দুষ্পচ্য। কচি কলাইশুটির ডাল অতি সুপাচ্য এবং সুস্বাদু।… কচি কলাইশুটি খুব সিদ্ধ করে, তাকে পিষে জলের সঙ্গে মিশিয়ে ফেল। তারপর একটা দুধ ছাঁকনির মতো তারের ছাকনিতে ছাঁকলেই খেলাগুলো বেরিয়ে আসবে। তখন হলুদ, ধনে, জিরে, মরিচ, লঙ্কা, যা দেবার দিয়ে সাঁতলে নাওউত্তম সুস্বাদু সুপাচ্য ডাল হল।” এই হচ্ছে শখের শেফ স্বামীজির স্পেশাল রেসিপি।

বোঝা যাচ্ছে, রান্না শেখাতে এবং উদ্ভাবন করতে স্বামীজি ছিলেন তুলনাহীন।

একবার তিনি বোধগয়ায় রয়েছেন, জনৈক বাঙালি ভক্ত প্রতিদিন সকালে এক কলসি তালের রস এবং এক কলসি খেজুর রস স্বামীজি অ্যান্ড পার্টিকে পাঠিয়ে দিতেন। খেজুর রস নষ্ট করতে প্রাণ চায় না। অনেক ভেবেচিন্তে স্বামীজি ভাতের হাঁড়িতে জলের বদলে রস দিয়ে তাতে চাল ফেলে দিয়ে ভাত রাঁধতেবললেন! বোধহয় ওয়ার্লডের প্রথমও শেষ খেজুরেভাত!অনুসন্ধিৎসুরা শীতকালে স্বামীজি উদ্ভাবিত খেজুর রসের এই পদটি আর একবার বেঁধে দেখতে পারেন।

বিদ্রোহী বিবেকানন্দের উপস্থিতি আমরা তার খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও খুঁজে পেতে পারি। শাস্ত্রে বলে দুধ ও মাংস একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়, কিন্তু স্বামীজি বেপরোয়া, তাই দুধ-মাংসের বিপরীত আহারে তিনি বেশ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

ঠেসে ভাত খাওয়ার প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন আমাদের বিবেকানন্দ। একবার বেলুড়ে আহার করতে করতে বন্ধু প্রিয়নাথ সিংহকে বললেন, “দেখ সিঙ্গি, কনসেনট্রেটেড়’ ফুড খাওয়া চাই। কতকগুলো ভাত ঠেসে খাওয়া কেবল কুঁড়েমির গোড়া।…আমাদের যে দু’বার আহার কুঁচকিকণ্ঠা ঠেসে। একগাদা ভাত হজম করতে সব এনার্জি চলে যায়।”

.

দুধ সম্বন্ধেও তার সাবধানবাণী সংগৃহীত হয়েছে। “দুধ–যেমন শিশুতে মাতৃদুগ্ধ পান করে, তেমনি ঢোকে ঢেকে খেলে তবেশীঘ্র হজম হয়, নতুবা অনেক দেরি লাগে।”

দুধ থেকেই পরবর্তী প্রশ্নটা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। এবার আমাদের স্বাভাবিক প্রশ্ন, “আইসক্রিমের বাংলা কি?”

ওটা বহুকাল বাংলা হয়ে গিয়েছে বলেও অনুসন্ধিৎসুদের কাছ থেকে মুক্তি নেই।

অনুরাগীরা বলবেন, “বাহাদুর বাংলা লেখক! টপ করে আইসক্রিমকে কুলপি বলতে শুরু করেছিলেন স্বামীজি। কারণও ছিল। কলকাতায় যখন প্রথম বরফ এলো তখন ওই দুর্লভ বস্তুটি অতি অল্প সময়ের মধ্যে সিমলের দত্তবাড়িতে হাজির হয়েছিল। প্রাক-রেফ্রিজারেটর যুগ, তখন বরফের বাক্সে খাবার, ফল, দুধ রাখার রেওয়াজ হয়েছিল। আমরা দেখেছি, নেয়াপাতি ডাবের ভিতর চিনি দিয়ে সেই ডাবের খোলে বরফ দিয়ে খেতে খুব ভালবাসতেন স্বামীজি। বারবার বিদেশে গেলে কিছু একটার ওপর টান তো ধরবে, আমেরিকা স্বামীজির ক্ষেত্রে সেটি অবশ্যই আইসক্রিম। খাদ্যরসিকরা এখন জানেন, মার্কিন মুলুকে তিনি চকোলেট আইসক্রিমের প্রবল ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।”

একদিন মার্কিনদেশে তার সঙ্গিনীরা স্ট্রবেরি খাচ্ছিলেন, তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, “স্বামীজি আপনি কি স্ট্রবেরি পছন্দ করেন?”

স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ করলেন, “কখনও তো চেখে দেখিনি!”

“কখনও খাননি! সে কি? রোজই তো খাচ্ছেন!”

এবার স্বামীজির জোরালো উত্তর : “তোমরা তো সেগুলো ক্রিম দিয়ে ঢেকে দাও, ক্রিম মাখানো পাথরের নুড়িও ভাল লাগতে বাধ্য!”

লেগেট পরিবারে থাকার সময় ধূমপানের লোভে স্বামীজি সান্ধ্য-আহারের পর ঝটপট ডিনার টেবিল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতেন। ডিনার টেবিলে স্বামীজিকে আটকে রাখার সহজতম উপায়টি স্নেহময়ী মিসেস লেগেট আবিষ্কার করেছিলেন। টেবিল ছেড়ে স্বামীজির উঠে যাবার একটু আগেই তিনি ঘোষণা করতেন, “আইসক্রিম আছে।” অমনি ছোটছেলের মতন স্বামীজিনিজের সীটেবসেথাকতেন এবং তৃপ্তিসহকারে আইসক্রিম খেতেন।

একদিন ক্যালিফোর্নিয়ায় তার সান্ধ্য বক্তৃতায় নরক সম্বন্ধে স্বামীজি অনেক কথা বললেন। বক্তৃতার শেষে সবাই মিলে রেস্তোরাঁয় খেতে বেরোলেন। বাইরে তখন হাড়কাঁপানো শীত, কাঁপতে কাঁপতে স্বামীজি সঙ্গি নীদের বললেন, “এ যদি নরক না হয় তাহলে নরক কাকে বলে জানি না।”

রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়ে ঐ ঠাণ্ডাতেও স্বামীজি কিন্তু খেতে চাইলেন আইসক্রিম। দোকানের মালিক একটু দেরি করতে পারেন তা আশঙ্কা করে স্বামীজি বললেন, “দয়া করে দেরি করবেন না, তাহলে ফিরে এসে এখানেই দেখবেন একতাল চকোলেট আইসক্রিম।” অর্থাৎ বাইরে থেকে আসা অতিথিরাই ঠাণ্ডায় জমে আইসক্রিম হয়ে গিয়েছেন।

আইসক্রিম নিয়ে ভ্রান্তিবিলাসও হয়েছে! একবার লেকচারের শেষে আটজনকে স্বামীজি আইসক্রিম খেতে নেমন্তন্ন করলেন।

স্যানফ্রানসিসকোর পাওয়েল স্ট্রীট ধরে হাঁটছেন তাঁরা। দোকানের সেলস গার্লটি বোধ হয় নতুন, অর্ডার নেবার তেমন অভিজ্ঞতা তার নেই। কি নেবেন জিজ্ঞেস করায় স্বামীজি নির্দ্বিধায় অর্ডার দিলেন আইসক্রিম। মেয়েটি ভুল বুঝে একটু পরে সবার জন্য যা নিয়ে এল তা আইসক্রিম নয়, আইসক্রিম সোডা। বোতলগুলো খোলা হয়ে গিয়েছে। তবু ফেরত দেওয়া হল। কারণ তারা আইসক্রিম সোডা চাননি, চেয়েছেন আইসক্রিম। দোকানের ম্যানেজার ব্যাপারটা জেনে মেয়েটিকে প্রবল বকাবকি করতে লাগলেন। মেয়েটির এই অবস্থা দেখে স্বামীজির মন একেবারে গলে গেল, ম্যানেজারকে ডেকে তিনি বললেন, “প্লিজ, ওকে বোকো না। তুমি যদি ওকে আর কিছু বলো, তা হলে আমি কিন্তু একাই এই আইসক্রিম সোডার বোতলগুলো শেষ করে ফেলবো।”

আর একবার স্বামীজিআইসক্রিম আস্বাদন করেউচ্ছ্বসিত হয়েবলেছিলেন, “ম্যাডাম, ফুড ফর গড়। আহা সত্যি স্বর্গীয়।”

আইসক্রিমের প্রতি এই অস্বাভাবিক টান দেশে ফিরে এসেও অব্যাহত ছিল। এক আধবার নিবেদিতার কাছে আইসক্রিম খাওয়ার আব্দার করেছেন স্বামীজি। বেশ চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন নিবেদিতা, কারণ স্বামীজি তখন ডায়াবিটিসের রোগী।

অঢেল ঠাণ্ডা খাবার সম্বন্ধে স্বামীজি স্বদেশে রিপোর্টও পাঠিয়েছেন গুরু ভাই স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে। “দুধ আছে, দই কদাচ, ঘোল অপর্যাপ্ত।”

ক্রিমের চমৎকার বাংলা করেছেন স্বামীজি–মাঠা, “মাঠা সর্বদাই ব্যবহার চায়ে, কফিতে, সকল তাতেই মাঠা ব্যবহার–সর না, দুধের মাঠা। মাখন তো আছেন–আর বরফ জল–এন্তের বরফ জল…আর কুলফি এন্তের নানা আকারের।”

দুধের কথা যখন উঠলো তখন বেলুড়ে কবিরাজি নির্দেশে দুধ চিকিৎসার কথাও ভোলা যাক। তখন স্বামীজির পা ফুলেছে, সমস্ত শরীরে যেন জলসঞ্চার হয়েছে। কবিরাজের নির্দেশে একুশ দিন জল ও নুন না খেয়ে থাকতে হবে, খাবার মধ্যে সামান্য একটু দুধ।

শিষ্য শরচ্চন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, “মহাশয়, এই দারুণ গ্রীষ্মকাল! তাহাতে আবার আপনি ঘণ্টায় ৪/৫ বার করিয়া জলপান করেন, এ সময়ে। জল বন্ধ করিয়া ঔষধ খাওয়া আপনার অসহ্য হইবে।”

স্বামীজির অবিস্মরণীয় উত্তর : “তুই কি বলছিস? ঔষধ খাওয়ার দিন প্রাতে আর জলপান করব না’ বলে দৃঢ় সংকল্প করব, তারপর সাধ্য কি জল আর কণ্ঠের নীচে নাবেন! তখন একুশ দিন জল আর নীচে নাবতে পারছেন না। শরীরটা তো মনেরই খোলস। মন যা বলবে, সেইমত তো ওকে চলতে হবে, তবে আরও কি? নিরঞ্জনের অনুরোধে আমাকে এটা করতে হ’ল, ওদের (গুরুভ্রাতাদের অনুরোধ তো আর উপেক্ষা করতে পারিনে।”

স্বদেশ ফিরেও বিবেকানন্দর আইসক্রিমের প্রতি আকর্ষণ কমছে না। সেবার মায়াবতীতে প্রচণ্ড শীত–স্বামী বিরজানন্দকে স্বামীজি বললেন, “জীবনের শেষভাগে সব কাজ ছেড়ে এখানে আসা, বই লিখব আর গান করব।” ইতিমধ্যে হ্রদে বরফ জমেছে। সেই বরফ সংগ্রহ করে প্রকাণ্ড একতাল আইসক্রিম তৈরি করলেন স্বামী বিরজানন্দ। স্বামীজিকে সন্তুষ্ট করার সহজতর পথ আর কি থাকতে পারে?

এবার একটি ছোটখাট বোমা ফাটাতে চাই। কিছুদিন আগে প্রকাশিত নিবেদিতার পত্রাবলী তো এদেশের মানুষ মন দিয়ে পড়লো না। সংবাদের সোনারখনি বলতে যা বোঝায় তাই এই পত্রাবলী। বাগবাজার থেকে ১৮৯৯ সালের মে মাসে নিবেদিতা আমেরিকায় মিস ম্যাকলাউডকে যা লিখছেন তাতেও ইঙ্গিত রয়েছে আইসক্রিমের। “আগামীকাল এস (সদানন্দ?) এবং আমি ওঁর আইসক্রিমের জন্য পাঁচটাকা খরচ করবোবেজায় বড়লোকি, কিন্তু উনি চাইছেন!” তন্নতন্ন করে খুঁজেও স্বামীজিকে কিন্তু কোথাও আইসক্রিম তৈরি করতে দেখছি না। বোধহয় কিছু যন্ত্রপাতির দরকার ছিল এবং তখনও বেলুড়ে বিদ্যুৎ আসেনি।

সময় বেশ কমে আসছে। কিন্তু এখনও দুটো-তিনটে বিষয় আমাদের খুঁটিয়ে দেখতে হবে। রাঁধিয়ে হিসেবে স্বামীজির ভূমিকা এবং আইসক্রিম ছাড়া কোন্ কোন্ দিশি খাবার তাঁর প্রিয় ছিল? দুটোই অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন।

ভক্তদের ব্যাখ্যা, “অন্নদানকেই তিনি তাঁর সঙ্ঘের একনম্বর কাজ হবে বলে মনস্থ করেছিলেন। রান্নার ওপর সম্পূর্ণ কনট্রোল না থাকলে এতো বড় দায়িত্ব কাঁধে নেবার কথা কে ভাবতে পারে? যায় না। রাঁধিয়ে হিসেবে আমরা দেখছিও অন্তিমপর্বে তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য ও শিষ্যাদের আনন্দবর্ধন করতে চাইছেন, তবে সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে তাদের সেবাও করতে চাইছেন।

শিষ্য শরচ্চন্দ্রের কথাই ধরা যাক, পূর্ববঙ্গের ছেলে, স্বামীজির আদেশ, “গুরুকে নিজের হাতে বেঁধে খাওয়াতে হবে।”

মাছ, তরকারি ও রন্ধনের উপযোগী অন্যান্য দ্রব্য নিয়ে বেলা আটটা আন্দাজ শিষ্য শরচ্চন্দ্র বলরামবাবুর বাড়িতে উপস্থিত। তাকে দেখেই স্বামীজি নির্দেশ দিলেন, “তোদের দেশের মতন রান্না করতে হবে।…”

শিষ্য এবার বাড়ির ভেতর রন্ধনশালায় গিয়ে রান্না আরম্ভ করল। স্বামীজি মধ্যে মধ্যে ভেতরে এসে তাকে উৎসাহ দিতে লাগলেন, আবার কখনও বা “দেখিস মাছের ‘জুল’ যেন ঠিক বাঙালদিশি ধরনে হয়” বলে রঙ্গ করতে লাগলেন।

শিষ্যের মুখেই শোনা যাক পরবর্তী ঘটনা। “ভাত, মুগের ডাল, কই মাছের ঝোল, মাছের টক ও মাছের সুক্তনি রান্না প্রায় শেষ হইয়াছে, এমন সময় স্বামীজি স্নান করে এসে নিজেই পাতা করিয়া খাইতে বসিলেন। এখনও রান্নার কিছু বাকি আছে বলিলেও শুনিলেন না, আবদেরে ছেলের মতন বলিলেন, যা হয়েছে শীগগির নিয়ে আয়, আমি আর বসতে পাচ্ছিনে, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে।…শিষ্য কোনকালেই রন্ধনে পটু ছিল না; কিন্তু স্বামীজি আজ তাহার রন্ধনের ভূয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কলকাতার তোক মাছের সুজুনির নামে খুব ঠাট্টা তামাশা করে, কিন্তু তিনি সেই সুতুনি খাইয়া খুশি হইয়া বলিলেন, ‘এমন কখনও খাই নাই। কিন্তু মাছের জুল’টা যেমন ঝাল হয়েছে, এমন আর কোনটাই হয় নাই। টকের মাছ খাইয়া স্বামীজি বলিলেন, এটা ঠিক যেন বর্ধমানী ধরনের হয়েছে।”

এইবারেই স্বামীজি তাঁর শিষ্যকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছিলেন, “যে ভাল রাঁধতে পারে না সে ভাল সাধু হতে পারে না।”

এই শিষ্যকেই কয়েক বছর পরে মহাসমাধির কয়েক মাস আগে স্বামীজি কীভাবে বেঁধে খাইয়েছিলেন তা জেনে রাখা মন্দ নয়।

তখন স্বামীজির কবিরাজি চিকিৎসা চলছে। জলখাওয়া বন্ধ, শুধু দুধ পান করে পাঁচসাতদিন চলছে। এই সেই মানুষ যিনি ঘন্টায় পাঁচ-ছ বার জল পান করতেন।

শিষ্য মঠে একটি রুইমাছ ঠাকুরের ভোগের জন্য এনেছে। “মাছ কাটা হলে ঠাকুরের ভোগের জন্য অগ্রভাগ রাখিয়া দিয়া স্বামীজি ইংরেজি ধরনে রাঁধিবেন বলিয়া কতকটা মাছ নিজে চাহিয়া লইলেন। আগুনের তাতে পিপাসার বৃদ্ধি হইবে বলিয়া মঠের সকলে তাহাকে রাঁধিবার সঙ্কল্প ত্যাগ করিতে অনুরোধ করিলেও কোন কথা না শুনিয়া দুধ, ভারমিসেলি, দধি প্রভৃতি দিয়া চার-পাঁচ প্রকারে ওই মাছ রাঁধিয়া ফেলিলেন। …কিছুক্ষণ পরে স্বামীজি জিজ্ঞেস করিলেন, “কেমন হয়েছে? শিষ্য বলিল, এমন কখনও খাই নাই।…ভারমিসেলি শিষ্য ইহজন্মে খায় নাই। ইহা কি পদার্থ জানিবার জন্য জিজ্ঞাসা করায় স্বামীজি রসিকতা করিলেন, “ওগুলি বিলিতি কেঁচো। আমি লন্ডন থেকে শুকিয়ে এনেছি।”

.

এই শিষ্যই আরও পরে স্বামীজির মহাসমাধির অতি সামান্য আগে আহিরিটোলার ঘাটে গঙ্গাতীরে গুরুকে আবার দেখেছিল। স্বামীজির বাঁ হাতে শালপাতার ঠোঙায় চানাচুর ভাজা, বালকের মতো খেতে খেতে আনন্দে পথ ধরে এগোচ্ছেন।

স্বামীজি বললেন, “চারটি চানাচুর ভাজা খা না? বেশ নুন-ঝাল আছে।” শিষ্য হাসতে হাসতে প্রসাদ গ্রহণ করলেন।

অন্তিম পর্বেই আমরা জানতে পারি, ছোটবেলার স্মৃতিতে উদ্বেলিত হয়ে স্বামীজি একদিন বেলুড়ের মঠে বসে প্রকাশ্যে পাড়ার ফুলুরিওয়ালা হতে চাইলেন। উনুন জ্বললো, কড়া বসলো, তেল ঢালা হলো। ফাটানো বেসন গরম তেলে ছেড়ে, পিঁড়িতে বসে বিশ্ববিজয়ী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন ফুলুরিওয়ালা নরেন। ছোটবেলায় সিমলা পাড়ায় যেমন দেখেছেন ফুলুরিওয়ালাকে। বেলুড়ের মাঠে হাঁক ছেড়ে খদ্দের ডেকে স্বামীজি মহানন্দ পেতে লাগলেন।

এসব দৃশ্য কিন্তু স্বদেশ কিংবা কলকাতায় সীমাবদ্ধ নয়। সেবার ট্রেনে যেতে যেতে একজন মুসলমান ফেরিওয়ালাকে ফার্স্ট ক্লাসের সামনে ছোলা সেদ্ধ হাঁকতে দেখে সেবককে স্বামীজি বললেন, “ছোলা সেদ্ধ খেলে বেশ হয়, বেশ স্বাস্থ্যকর জিনিস”.. ছোলাওয়ালাকে একটা সিকি দেওয়ায় স্বামীজি তার সেবককে বললেন, “ওরে ওতে ওর কি হবে? দে একটা টাকা দে।” স্বামীজি ছোলা কিনলেন, কিন্তু খেলেন না। মনে হয় ফেরিওয়ালাটিকে কিছু দেবার জন্যেই এই ছোলা কেনা।

কিন্তু বিদেশে পরিস্থিতি অন্য। লস এঞ্জেলেসে তিনি তখন একের পর এক জগৎ-কাঁপানো বক্তৃতা করে চলেছেন। সারা শহরে বেশ আলোড়ন। আয়োজকদের একজন কিছু আলোচনার জন্য স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে দেখলেন, তিনি আপনমনে চিনেবাদাম ভাজা চিবোচ্ছেন। মানুষটির সরলতা দেখে সায়েবটি মুগ্ধ।

শুধু সাধারণ মানুষের নয়, শিষ্য ও শিষ্যাদের সর্ববিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যাপারে স্বামীজি যে তুলনাহীন ছিলেন একথা তাঁর কনিষ্ঠেরা পরবর্তীকালে বারবার স্মরণ করেছেন। এই শিক্ষার সিলেবাসে রান্না কখনও তার গুরুত্ব হারায়নি।

স্বামী বিরজানন্দসহ দলবল নিয়ে মায়াবতী থেকে বেরিয়ে পড়েছেন স্বামীজি। প্রথমে চম্পাবত, সেখান থেকে ডিউরির ডাক বাংলো।

রান্নার দায়িত্বে রয়েছেন স্বামী বিরজানন্দ। হাঁড়ির আকারের তুলনায় চাল বেশি হওয়ায়, ভাত আধসিদ্ধ হয়ে উথলে পড়ছে, আর ক্ষিদে পাওয়ায় স্বামীজি লোক পাঠিয়ে খবর নিচ্ছেন, রান্নার কত দেরি।

বিরজানন্দ ভাবছেন, খানিকটা ভাত নামিয়ে নিয়ে বাকি ভাত আরও জল দিয়ে ফুটোবেন। এমন সময় স্বামীজি রান্নার জায়গায় ঢুকে অবস্থা পর্যালোচনা করে প্রিয় শিষ্য বিরজানন্দকে বললেন, “ওরে ওসব কিছু করতে হবে না। আমার কথা শোন–ভাতে খানিকটা ঘি ঢেলে দে, আর হাঁড়ির মুখের সরাখানা উলটে দে, এখনই সব ঠিক হয়ে যাবে, আর খেতেও খুব ভাল হবে।”

রন্ধনবিদ গুরুর কথা শোনায় ফল খুব ভাল হল, সেদিনকার এমার্জেন্সি ঘি ভাত সবার খুব ভাল লেগেছিল।

অনেকের সবিনয় অনুসন্ধান, “খাওয়ার জন্যে অযথা দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হলে স্বামী বিবেকানন্দ কি একটু অধৈর্য হয়ে উঠতেন?”

সেইটাই তো স্বাভাবিক। মা বাবা কত আদর করে মানুষ করেছিলেন, অথচ বড় কাজের আহ্বানে চব্বিশ বছরে সন্ন্যাসী হয়ে সহায় সম্বলহীন অবস্থায় বাকি জীবনটা পথে পথে কেটে গেল। পরের দিনের অন্ন কোথা থেকে কীভাবে আসবে তা সন্ন্যাসীর জানা নেই। শরীর যখন রোগ জর্জরিত, যখন দু’একজন স্নেহের মানুষ তার কাছাকাছি রয়েছে তখন মানুষের একটু-আধটু অভিমান আসতে পারে। তাছাড়া রয়েছে সময়ানুবর্তিতার প্রতি স্বামীজির প্রবল আকর্ষণ–শুধু নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য।

সুদূর আমেরিকা থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে (১৮৯৫) স্বামীজি নির্দেশ দিচ্ছেন : “ভোগের নামে সকলকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না।”

আর এক চিঠিতে স্বামীজি সাবধান করে দিচ্ছেন, ঠাকুরের জন্মোৎসবে যেন খাওয়াতে খাওয়াতে দিন চলে না যায়। কী ধরনের আয়োজন করলে পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে থাকতে পারে যখন ভাবছেন, তখন তিনি নিজের কথা ভাবছেন না। তবে স্বামীজির ছেলেমানুষী সরলতা ছিল আপনজনদের মধ্যে। অনুরাগীরা, গুরুভ্রাতারা এবং শিষ্যরা জানতেন রাগ হলে স্বামীজি খাবার ফিরিয়ে দিতে পারেন।

স্বামীজির প্রিয় শিষ্য হাতরাস স্টেশনের প্রাক্তন সহকারী স্টেশনমাস্টার গুপ্ত মহারাজের গল্পটা অনেকের জানা। স্বামী সদানন্দর ভাষায় : “শেষের দিকে কয়েকদিন ওঁর রুচিমতো রান্না করি। তার শরীর তখন ভাঙনের পথে। একদিন চটে লাল হয়ে নিজের ঘরে বসে। মেজাজ অত্যন্ত গরম, কার সাধ্যি কাছে এগোয়। খানা তৈরি করে বাবুর্চির কায়দায় কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে ঘরে খাবার নিয়ে সাধাসাধি, মহারাজ নরম হোন, গুস্সা ছোড় দিজিয়ে। টেমপারেচার তবু নামে না–”মেহেরবানি করুন, সব কসুর মাফ কিজিয়ে। যাঃ শালা, দূর হ, খাব না। তখন আমি দাঁত দেখালাম, তুমভি মিলিটারি হাম ভি মিলিটারি’, আমি রেগে নেমে এলাম: যাঃ শালা! ভুখা রহো, হামারা ক্যা পরোয়া!”

এর পরে কী হয়েছিল তা কোথাও লেখা নেই। কিন্তু জোর করে বলা যায়, স্বামীজির রাগ নিশ্চয় সঙ্গে সঙ্গে কমে গিয়েছিল এবং স্বামীজি শেষপর্যন্ত খেয়েছিলেন। স্বামীজি অভুক্ত থাকবেন আর মঠের অন্য সবাই অনুগ্রহণ করবেন এটা অসম্ভব ব্যাপার। ওই কালচার বা মানসিকতা থাকলে সেদিনের রামকৃষ্ণ মিশন কিছুতেই আজকের রামকৃষ্ণ মিশন হতে পারতো না।

উৎসাহীদের পরবর্তী প্রশ্ন : “বিবেকানন্দ তোবুঝতে পারছি, দুনিয়ার সর্বত্র শত শত রান্নার মাধ্যমে বিশ্বপ্রেমের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। কিন্তু তার ম্যাগনাম ওপাস কোষ্টা? ওঁর কোন্ রান্নাকে বিশেষজ্ঞরা এক নম্বরে ফেলবেন?”

খুবই কঠিন প্রশ্ন। তবে মানসকন্যা নিবেদিতা এবং রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা ঘোষালকে এক রবিবারে তিনি যে লাঞ্চ খাইয়েছিলেন তার বোধ হয় তুলনা নেই। একটা লাঞ্চের মধ্যে সারাবিশ্বের ছায়া নামিয়ে এনেছিলেন বিশ্বপথিক বিবেকানন্দ।

সময় মার্চ ১৮৯৯, স্থান বেলুড় মঠ। এই লাঞ্চের মাত্র কয়েকদিন আগে বিনা নোটিসে সিস্টার নিবেদিতাকে তিনি সাপার খাইয়েছিলেন বেলুড়ে। তার মেনু : কফি, কোল্ড মাটন, ব্রেড অ্যান্ড বাটার। স্বয়ং স্বামীজি পরম স্নেহে পাশে বসে খাইয়ে নিবেদিতাকে বোটে করে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়েছিলেন। আর রবিবারের সেই অবিস্মরণীয় লাঞ্চের ধারাবিবরণী নিবেদিতা রেখে গিয়েছেন মিস ম্যাকলাউডকে লেখা এক চিঠিতে। “সে। এক অসাধারণ সাফল্য! তুমি যদি সেখানে থাকতে!” স্বয়ং স্বামীজি রান্না করেছেন, পরিবেশনও তিনি নিজে করলেন। “আমরা দোতলায় একটা টেবিলে বসেছি। সরলা পুবমুখো হয়ে বসেছিল যাতে গঙ্গা দেখতে পায়।”

এই ভোজনের নাম নিবেদিতা দিয়েছিলেন ‘ভৌগোলিক’ লাঞ্চ, কারণ সারা বিশ্বের রান্না একটি টেবিলে জমায়েত হতে শুরু করেছে। সব বেঁধেছেন স্বামীজি। রাঁধতে রাঁধতে তিনি একবার নিবেদিতাকে তামাক সাজতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুনুন সেই অবিস্মরণীয় মেনুর কথা।

১। আমেরিকান অথবা ইয়াঙ্কি–ফিস্ চাউডার।

২। নরওয়েজিয়ান ফিস বল বা মাছের বড়া–”এটি আমাকে শিখিয়েছেন ম্যাডাম অগনেশন”–স্বামীজির রসিকতা।

“এই ম্যাডামটি কে স্বামীজি? তিনি কি করেন? মনে হচ্ছে আমিও যেন ওঁর নাম শুনেছি!” উত্তর : “আরও কিছু করেন, তবে সেই সঙ্গে রাঁধেন ফিস্ বল।”

৩। ইংলিশ না ইয়াঙ্কি? –ববার্ডিং হাউস হ্যাঁশ। স্বামীজি আশ্বাস দিলেন ঠিকমতন রান্না করা হয়েছে এবং পেরেক মেশানো হয়েছে। “কিন্তু পেরেক? তার বদলে আমরা পেলাম লবঙ্গ!–আহা পেরেক না থাকায় আমাদের খুব দুঃখ হতে লাগলো।”

৪। কাশ্মিরী মিনল্ড পাই আ লা কাশ্মির। (বাদাম ও কিসমিস সহ মাংসের কিমা!)

৫। বেঙ্গলি রসগোল্লা ও ফল। রান্নার বিবরণ শুনলে বিস্মিত হবারই কথা। মানুষটা কত রকমভাবে বিশ্বকে বোঝবার ও জানবার চেষ্টা করেছেন!

সোজা কথাটা হলো, রান্নার বিবেকানন্দকে না জানলে ঈশ্বরকোটি বিবেকানন্দকে জানা যায় না, প্রেমের সাগর বিবেকানন্দকে বোঝা যায় না।

ভক্তিমতি নিবেদিতাকে মহাপ্রস্থানের ঠিক আগে নেমন্তন্ন করে বিবেকানন্দ যে রান্না খাইয়েছিলেন তাতে ছিল কাঁঠালবিচি সেদ্ধ। আরও যা সব খাইয়েছিলেন তার বিবরণ যথাস্থানে লিপিবদ্ধ রয়েছে, একটু কষ্ট করলেই পাঠক-পাঠিকারা জানতে পারবেন, সব কোশ্চেনের উত্তর একসঙ্গে না লিখে দেওয়াই ভাল।

স্বামী বিবেকানন্দ কি মহাপ্রয়াণের কিছু আগে পাঁউরুটি নিয়েও প্রচণ্ড গবেষণা শুরু করেছিলেন?”

উত্তর : ইয়েস। একসময় তিনি লুচি কচুরির সঙ্গে পাঁউরুটিকেও প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি নিজের হাতে লিখেছেন : “ঐ যে পাঁউরুটি উনিও বিষ, ওঁকে ছুঁয়ো না একদম। খাম্বীর (ইস্ট) মেশালেই ময়দা এক থেকে আর হয়ে দাঁড়ান। …যদি একান্ত পাঁউরুটি খেতে হয়

তো তাকে পুনর্বার খুব আগুনে সেঁকে খেও।”

স্বামীজির মধ্যে ছিল বৈজ্ঞানিকের অনুসন্ধিৎসা ও খোলা মন, নিশ্চয় কিছু মাথায় ছিল, তাই বেলুড় মঠে তৈরি পাঁউরুটির নমুনা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নিবেদিতার বাগবাজারের ঠিকানায় দেহাবসানের ঠিক আগে।

৪ঠা জুলাই ১৯০২ শুক্রবার শেষ মধ্যাহ্নভোজনে স্বামীজি কি গ্রহণ করেছিলেন?

অবশ্যই ইলিশ মাছ। জুলাই মাস, সামনেই গঙ্গা, ইলিশ মাছ ছাড়া অন্য কিছু রান্না হলেই তো পৃথিবী বলতো মানুষটা বেরসিক! আসন্ন বিয়োগান্ত নাটকের পরিণতির কথা কেউ জানেনা ৪ঠা জুলাই-য়ের সকালবেলায়। স্বামী প্রেমানন্দর বর্ণনাটা পড়বার মতন:”গঙ্গার একটি ইলিশ মাছ এ বৎসরে প্রথম কেনা হল, তার দাম নিয়ে আমার সঙ্গে কত রহস্য হতে লাগল। একজন বাঙাল ছেলে ছিল তাকে বললেন-”তোরা নতুন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কি দিয়ে পূজা করতে হয় কর।…আহারের সময় অতি তৃপ্তির সঙ্গে ইলিশ মাছের ঝোলঅম্বলভাজা দিয়ে ভোজনকরলেন।বললেন–একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।”

আরও প্রশ্ন আছে। বিবেকানন্দর সৃজনী প্রতিভা রান্নাঘরেও কীভাবে বহুমুখী হয়েছিল তা তো জানা গেল, কিন্তু তিনি নিজে সব চেয়ে কী খেতে ভালবাসতেন?

উত্তরটা অত সহজ নয়। দিশি খাবারের মধ্যে প্রবল দাবিদার রয়েছে, বিলিতিতেও দাবিদার রয়েছে। আমিষে দাবিদার রয়েছে, নিরামিষে দাবিদার রয়েছে; ঝাল-ঝোল চচ্চড়িতে দাবিদার রয়েছে, আবার শেষপাতের মিষ্টিতেও দাবিদার রয়েছে।

যাঁদের ধারণা নিরামিষ আহারে স্বামীজির অরুচি ছিল তারা বিবেকানন্দের কিছুই জানেন না। বিশেষ করে খিচুড়ি যাতে বেলুড় মঠের সন্ধের খিচুড়ি মিস না হয়ে যায় তার জন্যে দ্বিতীয়বার পাশ্চাত্য থেকে ফিরে স্বামীজির বেলুড়ের পাঁচিল টপকে খাবার জায়গায় চলে এসেছিলেন।

নিরামিষ ঝোল, যাকে অনেকে ঝালের ঝোল বলেন, তা স্বামীজি খুব ভালবাসতেন এবং সে নিয়ে নানা সময়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। জগদ্বিখ্যাত হওয়ার পরেও দলবল নিয়ে মা-দিদিমার কাছে চলে আসতেন শুকতো এবং মোচার ডানলা খাবার জন্যে। মায়ের এঁটো নিরিমিষ খেতে একদিন এমন সময় এলেন যখন মায়ের পাতে খাড়া ছাড়া আর কিছুই নেই, তাই আনন্দ করে খেলেন, যদিও স্নেহময়ী মা বললেন, একটু আগে আসতে হয়।

সুযোগ পেলে স্বামীজি বাগবাজারে এসে যোগীন-মায়ের কাছে আসতেন পুঁইশাক চচ্চড়ি দিয়ে ভাত খেতে। যোগীন মা যখন কাশীতে ছিলেন তখনও স্বামীজি তার বাড়িতে হাজির হয়ে বলতেন, “যোগীন-মা, এই তোমার বিশ্বনাথ এলোগা!” আবার কোনোদিন গিয়ে বলতেন, “আজ আমার জন্মতিথি গো! আমায় ভাল করে খাওয়াও। পায়েস করো।”

আরও পছন্দের জিনিস ছিল–কই মাছ। সিমলের দত্তবাড়ির বিখ্যাত রসিকতা কই দুরকমের, শিখ কই, গুখ কই–প্রথমটি লম্বা, দ্বিতীয়টি বেঁটে কিন্তু প্রচুর শাঁস।

প্রথমবার আমেরিকায় যাবার জন্যে বোম্বাইতে জাহাজে চড়বার আগে স্বামীজির হঠাৎ কই মাছ খাবার ইচ্ছে হলো। বম্বেতে তখন কই মাছ পাওয়া কঠিন ব্যাপার। ভক্ত কালিপদ ঘোষ ট্রেনে লোক পাঠিয়ে অনেক কষ্টে বিবেকানন্দকে কই মাছ খাওয়ানোর দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করলেন। কোনো কোনো ভক্তের বাড়িতে গিয়ে তিনি নিজেই মেনু ঠিক করে দিতেন। কুসুমকুমারী দেবী বলে গিয়েছেন, “আমার বাড়িতে এসে কলায়ের ডাল ও কই মাছের ঝাল পছন্দ করেছিলেন।” . কিন্তু পুঁইশাক ও ইলিশ এক মহাপরাক্রান্ত জুটি, যাকে বলে কিনা ডেডলি কম্বিনেশন! আমেরিকান বা জার্মান স্কলার হলে পুরো একটা ডক্টরেট থিসিস হয়ে যেতো, তারপর ভক্তরা গিয়ে সেই বইয়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তেন, সায়েবদের লেখা সম্বন্ধে, ভারতীয়দের যা দুর্বলতা!

স্বামীজির পছন্দ অপছেন্দর ক্ষেত্রে কলায়ের ডাল ও কই মাছের দুর্দান্ত প্রতিযোগী অবশ্যই ইলিশ ও পুইশাক। মহাসমাধির অনেকদিন পরেও এক স্নেহময়ীর অনুশোচনা, “পুইশাক দিয়ে চিংড়ি মাছ হলেই নরেনের কথা মনে পড়ে যায়।”

যেমন চাবি আর তালা, হাঁড়ি আর সরা, হর আর পার্বতী তেমনি এই ইলিশ আর পুইশাক স্বামীজির জীবনে। কান টানলেই যেমন মাথা আসবে, তেমন ইলিশ এলেই পুইশাকের খোঁজ করবেন স্বামীজি। শুনুন এলাহাবাদের সরকারি কর্মচারী মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা।

একবার স্বামীজি স্টিমারে গোয়ালন্দ যাচ্ছেন; একটা নৌকোয় জেলেরা ইলিশ মাছ জালে তুলছে। হঠাৎ বললেন, ‘বেশ ভাজা ইলিশ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। সারেঙ বুঝে গিয়েছে সব খালাসিদের খাওয়ানোর ইচ্ছে স্বামীজির। দর করে জানাল, এক আনায় একটি তিনটি-চারটিই যথেষ্ট। স্বামীজি বললেন, তবে এক টাকার কেন। বড় বড় ইলিশ ষোলটি, তার সঙ্গে দুচারটি ফাউ।

স্টীমার এক জায়গায় থামানো হলো। স্বামীজি অমনি বললেন, ‘পুঁইশাক হলে বেশ হতো, আর গরম ভাত। কাছেই গ্রাম। একটি দোকানে চাল পাওয়া গেল, কিন্তু সেখানে বাজার বসে না, কোথায় পুঁই? এমন সময় এক ভদ্রলোক বললেন, ‘চলুন, পুইশাক আমার বাড়ির বাগানে আছে। তবে একটি শর্ত। স্বামীজিকে একটিবার দর্শন করাতে হবে।

ভেবেচিন্তে দেখলে স্বামীজির প্রিয় খাদ্যতালিকায় শেষপর্যন্ত ফাঁইনাল রাউন্ডটা শুকতো-মোচার ডানলা ভারসাস ইলিশ-পুইশাক। আইসক্রিমটা সেমি-ফাইনালে হেরে গেল এই কারণে যে শেষপর্ব স্বামীজির রক্তে সুগার, আইসক্রিম খাওয়া নিশ্চয় নিষিদ্ধ।

স্বর্ণপদকটা ইলিশ-পুঁইশাকই পাবে এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা দেখছি গোয়ালন্দের পথে স্টিমারে পুইশাক সরবরাহ করায় স্বামীজি এমনই খুশি হয়েছিলেন যে সেই দিনই ফিরবার পথে পুঁইবাগানের মালিককে তিনি দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্যবান ভক্তটি বলেছেন, আমাকে কৃপা করবেন বলেই স্বামীজির মাছ ও পুঁইশাক খাবার কথা মনে উঠেছিল।

পুঁইশাকের বদলে দীক্ষা! মস্ত কথা, এই পদটিরই গোল্ডমেডাল পাওয়া উচিত। কিন্তু মা-দিদিমার কাছে শুকতো-মোচার ডানলা খেয়ে স্বামীজি যে মারাত্মক কথা বলেছিলেন তা গবেষকদের নজর এড়িয়ে গিয়েছে। নিরামিষ খেয়ে স্বামীজি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, “বাংলা দেশের এই দুটোর জন্যে আবার কিন্তু জন্ম নেওয়া যায়।” গোল্ডমেডালটা ওখানেই দেওয়া ছাড়া পথ নেই, কারণ পুনর্জন্ম নিয়ে ক্ষণজন্মা পুরুষরা কখনও রসিকতা করবেন না।”

শেষমুহূর্তে আর একটা সারপ্রাইজ দেওয়া নিতান্ত প্রয়োজন। শুকতো মোচাই বলুন, কই মাছই বলুন, ইলিশ পুঁইশাকই বলুন, আইসক্রিমই বলুন, স্বামীজির কাছে সব থেকে মূল্যবান এবং বোধ হয় সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি এতোক্ষণ আমাদের নজরের আড়ালে থেকে গিয়েছে।

সাধক সন্ন্যাসী, জগতের হিতের জন্য তার সংসারে আসা এবং জীবনধারণ। একটি ছোট্ট জিনিস তিনি সবসময় নিজের কাছে রাখতেন, প্রবাসের মাটিতে তাকে একটি ছোট্ট শিশি থেকে কিছু পান করতে দেখা গিয়াছে। স্বদেশে এবং প্রবাসে নিত্যসাথী এই দুর্লভ বস্তুটি সম্বন্ধে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দর একান্ত স্বীকারোক্তি : কখন প্রয়োজন হবে ঠিক নেই, তাই সবসময় সঙ্গে, যখনই সুযোগ পেয়েছি তার সদ্ব্যবহার করেছি। অগণিত মানুষের জনস্রোতে, সভ্যতার বিস্ফোরণের কছে দাঁড়িয়ে, লক্ষ লক্ষ মানুষের দুরন্ত পদক্ষেপে নিষ্পেষিত হবার সম্ভাবনাময় মুহূর্তে আমি শান্ত হয়ে গিয়েছি, আমি স্থির হতে পেরেছি, দু’একটি ফোঁটায়।

“কী সে জিনিস?”

বুঝতে পারলেন না? গঙ্গাজল! একটা ছোট্ট শিশিতে ভরা গঙ্গাজলই ছিল বিশ্বপথিক বিবেকানন্দর চিরসাথী, তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শক্তি!

অতএব এইটা দিয়েই শেষ করা যাক রসনারসিক বিবেকানন্দের এই পর্বের কথা।

৩. সন্ন্যাসীর চা পান

চা বনাম কফি! যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বনাম হরিদাস পাল! তুলনার যোগ্যই নয়। কিন্তু ঢাকঢোল নিরন্তর বাজাতে পারলে একুশ শতকের বাজারে সব অসম্ভবই সম্ভব হয়ে ওঠে! যেমন ধরুন আমরা মিষ্টি দইকে ছেড়ে দিয়ে আইসক্রিমের দিকে ঝুঁকে পড়লাম এই ক’বছরে। রসনার রণাঙ্গণে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের দেশবাসীরা এমন বেরসিক কাজ কিভাবে করে ফেলেলেন তা খোঁজবার জন্যে কমিশন বসানো যেতে পারে–মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় অবসরপ্রাপ্ত বিচারকগণ হুশিয়ার!

সারাজীবন চা-প্রেমী, আমাদের হাওড়া ইস্কুলের সিনিয়র পটলাদা সেবার আমাকে বলেছিলেন, “দূরদর্শী সাহেবরা অনেকদিন আগেই কিন্তু সাবধান করে দিয়েছেন, নিরেস জিনিস সব সময়ই সরেসকে বাজার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। এইটাই ভবিতব্য, এইটাই গ্রেশাম সাহেবের আইন। প্রথমে তিনি টাকা সম্বন্ধে একথা বলেছিলেন, পরে দেখা গেল জীবনের সর্বক্ষেত্রে একই আইনের অমোঘ শাসন চলছে!”

পটলাদা উঁচু ক্লাসে হাওড়া বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে পড়তেন তা আপনাদের অজানা নয়। খাওয়াদাওয়া সম্বন্ধে তার যে একটু বাড়তি কৌতূহল ছিল তাও আপনারা জানেন। ইস্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পটলাদার ব্রেক ফেল করতো, নির্ধারিত কোটার একটু বেশি খেয়ে ফেলতেন; তাই ছাত্রমহলে একটু বদনামও ছড়িয়েছিল। আমার ভাবমূর্তিতেও কালিমা লেপন উচিত ছিল, কিন্তু পটলাদা বলতেন, তুই মুখুজ্যে বামুন, অতিভোজনে তোর তো জন্মগত অধিকার! মুশকিল হলো, তোর লোভ আছে কিন্তু সাহস নেই, তাই ইস্কুলের কোন অনুষ্ঠানে একাধিক প্রসাদ প্যাকেট তুই তুলে নিতে পারিস না, ফলে তোর নোলার নিবৃত্তি হয় না। আমি ক্ষত্রিয় তেজে যা প্রাণ চায় তা করে ফেলি। মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে যাই।

পটলাদা ও আমার মধ্যে সেই স্কুলজীবন থেকে অবিচ্ছেদ্য ভালবাসা গড়ে উঠেছিল। পটলাদা তখন থেকেই স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের নানা দুষ্প্রাপ্য ঘটনাবলী নিয়ে খোঁজখবর করে বলতেন, এই একটা লোকই দুনিয়ার সমস্ত অনাহারী অর্ধাহারী লোকদের মুখে অন্ন তুলে দিতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। পটলাদার মন্তব্য, শুধু কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ এটসেটেরা নয়, মানুষটা দুনিয়ার সবাইকে খাওয়াতে ভালবাসতেন। পটলাদাই আমাকে বলেছিলেন, এ-সংসারের কিছু স্বার্থপর লোক চিরকাল কণ্ঠা-থেকে কুঁচকি পর্যন্ত খাবারে বোঝাই করেছে, কিন্তু ভুলেও অপরের খিদের কথা একটু ভাবেনি।

পটলাদার শব্দ প্রয়োগে একটু কর্কশভাব রয়েছে বলতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম। পটলাদাই জানালেন, কণ্ঠা-থেকে কুঁচকি শব্দটি স্বামী বিবেকানন্দই সানন্দে সৃষ্টি করেছেন।

বিমুগ্ধ আমি পটলাদাকে যে নোট বই উপহার দিয়েছিলাম, সেই বইতেই বহু বছর নিষ্ঠার সঙ্গে ধরে তিনি ভোজন, অতিভোজন ও অনাহার সম্বন্ধে নানা তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছেন।

অনাহার ও অর্ধাহার সম্বন্ধে ভাবনা-চিন্তা করে অর্থনীতিতে নোবেল পাওয়ার জন্য আমাদের সমবয়সী একজন ভারতীয় যে সেই পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে কাজ করে যাচ্ছেন তা জানা থাকলে পটলাদা কোনোসময়ে তার নোটবইটা অমর্ত্য সেনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতেন। অসুবিধাও ছিলো না, কারণ স্বয়ং পটালাদাও ভাগ্যচক্রে এন আর আই হয়েছেন, নিজের এবং পরিবারের অন্নসমস্যার সমাধান করেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দের খাওয়া-দাওয়া এবং খাওয়ানো দাওয়ানো সম্পর্কে নানা তথ্য তিলে তিলে ইউরোপে, আমেরিকায় এবং ভারতীয় উপমহাদেশে সংগ্রহ করে চলেছেন।

পটলাদা মাঝে মাঝে অল্প সময়ের জন্য বিদেশ থেকে হাওড়ায় এসে আমার সঙ্গে ভাব বিনিময় অব্যাহত রেখেছে। ইদানীং তিনি লক্ষ্য করেছেন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সন্ন্যাসীরা উদার হস্তে অতিথিদের চা-পানে আপ্যায়িত করেন। তার থেকেই পটলাদার সাজেশন, “আমাদের চা এবং চায়ের আমরা–এবিষয়ে আমিও একটু মাথা ঘামাই।”

উত্তম প্রস্তাব। উনিশ ও বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালিরা প্রায় সবাই চা বলতে অজ্ঞান, এমন কি যাঁরা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ‘চা-পান না বিষপান’ এই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়েছে তারাও প্রাণভরে চা খেতে থেকে তাদের চা বিরোধী বক্তব্য পেশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দ দুজনেই চা-পান থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন, যদিও দু’জনের চানুরাগের মধ্যে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের ছাপ রেখে গিয়েছেন। চাইনিজ চা, জাপানী চা, ভারতীয় চা ইত্যাদির সমন্বয়ের মধ্যে বিশ্বকবি তাঁর বিশ্বপথিকের দৃষ্টিভঙ্গি অক্ষত রেখেছেন আর স্বামী বিবেকানন্দের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার কারণ, তিনি যথেষ্ট চা-কে মাদকাশক্তির কালিমা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। মুক্তিসন্ধানী সন্ন্যাসীদের কাছেও কোনোক্রমে নিষিদ্ধ পানীয় নয় এই চা। যদিও এ বিষয়ে উচ্চতম স্তরে সরসিকতা করেছেন রামকৃষ্ণানুরাগী মহাকবি গিরিশচন্দ্র ঘোষ। নিজের পানাসক্তির দুর্বলতাকে লুকিয়ে না রেখে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, বিশ্ব সংসারে ‘মোদোমাতাল’-এর মতো ‘চেয়োমাতাল’ও আছেন অনেক। বিবেকানন্দ-ভ্রাতা দার্শনিক ও সুরসিক মহেন্দ্রনাথ দত্ত নিজেকে চেয়োমাতাল বলে মেনে নিতে লজ্জাবোধ করেননি।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গের যশস্বী লেখক স্বামী সারদানন্দ ছিলেন চায়ের প্রবল ভক্ত। চায়ে টান না থাকলে অত শক্ত শক্ত বিষয় নিয়ে অমন জলের মতো সহজ বই লেখা যায় না।

বিবেকানন্দ-ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ একবার সারদানন্দকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তুমি এতো চা খেতে শিখলে কোথা থেকে?”

এবার একটি বৃহৎ বিস্ফোরণ। স্বামী সারদানন্দের উত্তর: “তোমার ভাইয়ের পাল্লায় পড়ে। তোমাদের বাড়িতে যে চায়ের রেওয়াজ ছিল সেইটা বরাহনগর মঠে ঢুকিয়ে দিলে, আর আমাদের চাখোর করে তুললে। তোমরা হচ্ছে একটা নার্কটিকের ফ্যামিলি।”

মহেন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬৮ সালে। তার লেখা থেকেই দেখা যাচ্ছে, বঙ্গ জীবনের অঙ্গ হিসেবে চায়ের স্বীকৃতি মাত্র সেদিনের। “আমরা যখন খুব শিশু তখন একরকম জিনিস শোনা গেল–চা, সেটা নিরেট কী পাতলা কখনও দেখা হয়নি। আমাদের বাড়িতে তখন আমার কাকীর প্রসব হইলে তাহাকে একদিন ঔষধ হিসেবে চা খাওয়ানো হইল। একটি কালো মিসে (কেটলী) মুখে একটি নল দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তার ভিতর কুঁচো পাতার মোন কি দিলে, গরম জল দিলে, তারপর ঢাললো। একটু দুধ চিনি দিয়ে খেলো।” মহেন্দ্রনাথ এরপরই জানিয়ে দিয়েছে তখন চীন থেকে চা আসতো, “ভারতবর্ষে তখন চা হয়নি।”

পটলাদা বললেন, “শেষ কথাটা ঠিক সত্যি নয়। কারণ আমরা এর আগেই দেখেছি কলকাতার দূরদর্শী বাঙালি ব্যবসায়ীরা এবং স্বয়ং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এর আগেই চায়ের ব্যবসার জন্যে বিখ্যাত আসাম কোম্পানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। একদা ভুবনবিদিত এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠা ১৮২০ সালে। আরও দেখা যাচ্ছে, স্বয়ং বিবেকানন্দর বয়স যখন এক তখন এদেশ থেকে তিরিশ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের চা লন্ডনের মিনসিং লেনের নীলামে বিক্রির জন্য পাঠানো হচ্ছে।

তবে মহেন্দ্রনাথ যা বলেছেন, প্রথম পর্বে এদেশের সব চা ছিল দেবভোগ্য, অতএব তাদের গন্তব্যস্থল সোজাসুজি লন্ডনের মিনসিং লেনে।”

চায়ের গল্পে বাড়তি চিনি মেশালেন পটলাদা। বললেন, নরেন্দ্রনাথ যে অল্পয়বয়সে পাকা চাখোর হয়ে উঠছেন তার সাক্ষীও মহেন্দ্রনাথ। দ্যাখ, বড়দা একবার নিলামে ফিরিঙ্গিপাড়া থেকে পাঁচ আনা দিয়ে কেটলি কিনে আনলো। উপরটা কালিঝুলি মাখা, যেন অচ্ছেদ্দা, অবহেলার জিনিস। ওমা, ভুসোগুলো চাচতে চঁচতে দেখি, ভিতরটা খাঁটি রুপো।”

যখন নরেন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগের পর পরিবারে প্রবল অর্থাভাব তখনও দত্তবাড়িতে আমরা চায়ের মস্ত ভূমিকা দেখতে পাচ্ছি!– বন্ধু কালী (পরে স্বামী অভেদানন্দ)-কে নিয়ে রামতনু বসু লেনের বাড়িতে এসেছেন নরেন্দ্রনাথ। অভাবের সংসার, কিছু খাওয়ার সুযোগ জুটলো না। এদিকে প্রবল ঠাণ্ডা। গভীর রাতে ক্ষুধার তাড়নায় এবং শীতে

অতিথির প্রাণ ওষ্ঠাগত। তখন নরেন্দ্রনাথ শীত ও ক্ষুধাকে একই সঙ্গে বিতাড়নের জন্য কোথা থেকে কেটলি যোগাড় করে এনে চা বানালেন, তখনকার মতন সঙ্কট কাটলো। মনে রাখতে হবে তখন এল পি জি বা বিদ্যুৎ কোনটাই কলকাতায় আসেনি, সুতরাং মাঝরাতে চা বানানো খুব সহজ ব্যাপার ছিল না।

পটলাদা চা নিয়ে যে বিশেষ গবেষণা চালিয়েছে তাতে কিছু বিশেষ খবরও পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তীকালে স্বামী সারদানন্দ বলছেন, “ওহে! শিবরাত্রির উপোস করে আমাদের চা খেতে কোনও দোষ নেই। কেন জান?”

যেদিন কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগ হয় (১৮৮৬, ১৬ আগস্ট) সকলেই বিষণ্ণ, খাওয়া-দাওয়া কিছু হলো না। কেই বা উনুন জ্বালে? আর কেই বা রান্না করে। অবশেষে দরমা জ্বালিয়ে কেটলি করে জল গরম করে চা করা হলো, আর ঢকঢক করে খাওয়া গেলো। অমন শোকের দেহত্যাগের দিনেও চা খেয়েছিলুম তো শিবরাত্রির সামান্য উপোস করে চা কেন খাওয়া চলবে না বলো?”

পটলাদা বললেন, “গয়া থেকে ফিরে স্বামীজির এক গুরুভাই চা-কে এমনই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, চা দিয়ে তর্পণ করলে কেমন হয় তার এক্সপেরিমেন্টও করেছিলেন। স্বয়ং স্বামীজির পাশে বসে বরানগরে স্বামী শিবানন্দ মন্ত্রপাঠ করলেন, অনেন চায়েন।”

কিন্তু প্রশ্ন উঠলো চা স্ত্রীলিঙ্গ কিনা? সেক্ষেত্রে তো বলা উচিত, অনয়া চায়য়া!

বরানগরে ভাত জুটুক না জুটুক ত্যাগী সন্ন্যাসীদের চা খাওয়ার ধুম ছিল, গুঁড়ো চা কিছুটা সবসময় থাকতো, আর ছিল তলায় খুরো দেওয়া কয়েকটা গোল চীনামাটির বাটি। তখনকার কাপে আজকের কাপের মতন হাতল থাকতো না, এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে!

আর একজন সন্ন্যাসী পরিব্রাজক আসাম ভ্রমণে বেরিয়ে চায়ের নতুন গুণাবলী আবিষ্কার করেছিলেন। “আমরা যেমন ভাতের সঙ্গে ঝোল খাই, তেমন কোথাও কোথাও ঝোলের বদলে ভাতের সঙ্গে চা মেশায়।”

আর এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী আরও দুঃসাহসী হয়ে তিব্বতে গিয়েছিলেন। তিব্বতীরা চা নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তারা একটি হাঁড়িতে জল দেয়, তাতে ব্রিক-টি বা জমাট করা চা খানিকটা ফেলে দেয়। তারপর শুকনো মাংসের গুঁড়ো দেয়, তারপর ছড়িয়ে দেয় ছাতু। সবটা টগবগ করে ফুটলে দেয় মাখন। ভারি রসিক জাত এই তিব্বতী, হাড়ে হাড়ে বুঝেছে চায়ের কদর, তাই সর্বদা সঙ্গে রাখে একটা গরম করার পাত্র, যার নাম ‘সামবার। খানদানি তিব্বতী যেখানে বসবে সেখানে একটু চা তৈরি হবেই।

এতো সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেও চায়ের কাহিনী যে শেষ হয় না তা আমরা দেখতে পাচ্ছি লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দের জীবনযাত্রার মধ্যে। সময় ১৮৯৬ সাল, বিবেকানন্দের সঙ্গে লন্ডনে দেখা হয়ে গেল ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের। তিনি ওখানে হঠাৎ গিয়েছেন ব্যারিস্টারি পড়বার বাসনা নিয়ে।

উনিশ শতকের শেষ দশকে বিলেতে সাহেব-মেমদের চা-বিলাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য এবং অত্যন্ত উপাদেয় বর্ণনা আমরা মহেন্দ্রনাথের কলম থেকে পেয়েছি।

বিবেকানন্দ তখন বিশিষ্ট সাহেবদের আতিথ্যে বেলা চারটার সময় চা খেয়ে নানা আলাপ-আলোচনায় মগ্ন হতেন।

মহেন্দ্রনাথ, স্বামীজির ক্ষিপ্রলিপিকার গুডউইন, ফক্স ও স্বামী সারদানন্দ একদিন সাড়ে চারটের সময় চা-পানে বসলেন। “বাটিতে একজন বুড়ি ঝি বা হাউস-কিপার ছিল, সে চা লইয়া আসিল। একটা টি-পট করিয়া চা, একটি ছোট জা-এ করিয়া কাঁচা দুধ, পিচ বোর্ডের মতো পাতলা পাতলা মাখন দেওয়া পাউরুটি কাটা ও লাম্প সুগার! আর একটা বড় জাগ-এ গরম জল থাকে; যিনি পাতলা চা খান, তাকে গরম জল দেয়। সাধারণত ইংরেজরা পাতলা চা খায়, বাঙালিদের মতো কড়া চা খায় না। খালাসিরা কড়া চা খায় বলিয়া সেইজন্য তাহাকে ‘সেলার্স টি’ বলিয়া থাকে।”

মহেন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন, “গুডউইন কর্তা হইয়া সকলের বাটিতে চা ঢালিয়া দিলেন–সকলেই চা ও রুটি দু’টুকরা করিয়া খাইলেন। ইংরেজের দেশে দুধ গরম করিয়া খায় না, সর্বদা কঁচা থাকে। একবার বর্তমান লেখক গরম দুধ খাইয়াছিলেন কিন্তু এত লবণ বোধ হইতে লাগিলো যে, খাইতে কষ্ট হইতে লাগিলল। গোরুকে ইহারা অতিরিক্ত লবণ খাওয়ায়। ইহারা দুধ কাঁচা খায় বলিয়া বাংলাদেশে যাহাকে দুধের সর বলে তাহা তথায় নাই। সেইজন্য দুধের সরের কোন ইংরাজি কথাও নাই।”

মহেন্দ্রনাথের পরবর্তী ব্যাখ্যা, “চিনি হইতেছে বিট সুগার, অর্থাৎ বিট পালঙের চিনি। এক ইঞ্চি স্কোয়ার এবং তিনখানা রাখিলে কিউব হয়। ইহাকে বলে লাম্প সুগার।…লাম্প সুগার লইবার প্রথা হইতেছে যে, একটি জার্মান-সিলভার বা ঐরূপ কোন সাদা ধাতুর বাহারি চিমটার দুই দিকটা ডগাতে সরু সরু আঙুলের মতো কাঁটা দেওয়া আছে–চিনির টুকরো সেই কাটা দিয়া টিপিয়া ধরিয়া ইচ্ছামতো চায়ের বাটিতে দিতে হয়। হাত দিয়া চিনি তুলিয়া লওয়া নিষিদ্ধ।”

লন্ডনে স্বামী বিবেকানন্দ “একদিন প্রায় বেলা চারটার সময় ফিরিয়া আসিলেন এবং চায়ে দুধ না দিয়া লেবু দিয়া খাইতে লাগিলেন। সিট্রন বা গোঁড়া লেবুর মতো গোল গোল একরকম বড় লেবু হয়, তাহাকে দু’ভাগ করিয়া কাটিয়া জাপানী চার বাটিতে চা ঢালিয়া সেই লেবুর রস ও অল্প পরিমাণে চিনি দিয়া (লাম্প সুগার) স্বামীজি ধীরে ধীরে এক বাটি চা খাইতে লাগিলেন এবং বলিতে লাগিলেন, চা ভাল লাগে না খেতে। আর দুধ দিয়ে চা খাওয়া ঠিক নয়, উহাতে পেটের গোলমাল হয়। আমেরিকায় অনেকে লেবু দিয়া চা খায় সেটা বেশ।”

বিবেকানন্দ এরপর বললেন, “আরে, আমেরিকানদের সব বাড়াবাড়ি। চা খাবে লেবু দিয়ে, তাতে আবার এক চাপ বরফ দেবে। গরমকালে তারা আইস টি খুব খায়। আরে খাবে তত এইটুকু কিন্তু থালায় নেবে এতটা। ওদের সব বেয়াড়া।”

আর এক বিদেশিনী মহিলার লন্ডনে বসে তরিবৎ করে চা পানের বর্ণনা আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে লেখক মহেন্দ্রনাথের দাক্ষিণ্যে। “মিস মুলার একটি জাপানী বাটিতে গরম জল ঢালিলেন এবং ঝাজরিওয়ালা ছোটদের ঝুমঝুমির মতো হাতলওয়ালা একটি জিনিস লইলেন না। ঝুমঝুমির যেখানে কৌটা থাকে তার ঢাকনি খুলিয়া দিয়া জাপানী চা বা ‘গ্রীন টি’ ভরিয়া দিয়া ঢাকনিটা আবার টিপে বন্ধ করিলেন। সেই জিনিসটি রূপার ছিল, হাতলটি ধরিয়া জাপানী চায়ের বাটিতে গরম জলে ডুবাইয়া মাঝে মাঝে নাড়া দিতে লাগিলেন। খানিকক্ষণ পর বাটির সমস্ত জল বেশ লাল হইয়া উঠিলো এবং তাহাতে দুধ চিনি মিশাইয়া খাইতে লাগিলেন এবং যন্ত্রটা অন্যত্র রাখিলেন।”

চিনি ছাড়া যারা চায়ের কথা ভাবতেও পারেন না তাদের জন্যও সেকালের লন্ডনের বেশ কিছু খবরাখবর আমাদের কাছে রয়েছে। সমসাময়িক কালের জীবনযাত্রার সুনিপুণ ভাণ্ডারী স্বামীজির সঙ্গী এই মহেন্দ্রনাথ! “ভারতবর্ষের চিনি, সাদা বা কালো হইলেও, সবই গুড়া চিনি। আর আমরা যাকে মিছরি বলি, ওরূপ পদার্থ ইংল্যান্ডে নাই। ইংল্যান্ডের চিনি লাল্‌চে–উহাকে ব্রাউন সুগার বলে। সাদা দোব্‌রা চিনিও পাওয়া যায়, কিন্তু কম।…আর একরকম চিনি আছে, উপর দিকে মোটা ও নিম্নদিকে সরু–একরকম চোঙ্গার মতো। ইহাকে বলে লোফ সুগার। এই চিনিও যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়। লবণের ন্যায় ইহাও জল হইবার আশঙ্কায় চাপ দিয়া চাকা চাকা টুকরা বা ডেলা করিয়া রাখা হয়।”

পটলাদা জিজ্ঞেস করলেন “চিরঞ্জীব বনৌষধির অবিস্মরণীয় লেখক পণ্ডিত শিবকালী ভট্টাচার্যকে চিনতিস তুই?”

“চেনা মানে! আমি তার স্নেহধন্য ছিলাম। স্রেফ ভালবেসে প্রাচীন ভারতের কত খবরাখব্ব দিয়ে গিয়েছেন এই অধমকে। সেসব তথ্য যোগ্য পাত্রে পড়লে সারা বিশ্বে হৈ চৈ পড়ে যেত। শিবকালীই তো বলেছিলেন, একটা নয়, চায়ের পাঁচ-পাঁচটা খাঁটি সংস্কৃত নাম আছে, যা প্রমাণ করে চীনাদের প্রসাদ পেয়ে আমরা চেয়োমাতাল হইনি। এই পঞ্চ নাম আমি মুখস্থ করে রেখেছি, যদি কখনও চায়ের নতুন টি ব্রান্ড চালু করার সময়ে কেউ এই অধমের পরামর্শ চায়–শ্লেষ্মরী, গিরিভিৎ, শ্যামপর্ণী, অতন্দ্রী ও কমলরস! চা প্রসঙ্গে আর একটা শব্দ আমাকে শিখিয়েছিলেন শিবকালীবাবু—‘ফান্ট’।

বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন পটলাদা। “সাহেবরা যে ফান্টা’ পানীয় বার করেছে তার একটা প্রাচ্যদেশীয় উৎস সূত্র তাহলে পাওয়া যাচ্ছে।”

শিবকালী ভট্টাচার্যমশায় বলেছিলেন, “ওরে বাবা, গরম জলে কোনো জিনিসকে ভিজিয়ে ভালোভাবে চাপা দিয়ে কিছুক্ষণ রাখার পর গরম থাকতে থাকতে হেঁকে নিলে যে গরম পানীয় পাওয়া যায়, তাকেই প্রাচীন ভারতে বলতো ফান্ট! এদেশের গিরি পর্বতবাসীরা এইভাবেই চা উপভোগ করতেন। এর সঙ্গে দুধ-চিনির কোনো সম্পর্ক ছিল না।”

তা হলে দুধ-চিনির ব্যাপারটা কি আমরা সাহেবদের কাছ থেকে শিখে চায়ের ব্যাপারে অধঃপতিত হলাম?

পটলাদা বললেন, “চায়ের ব্যাপারে ইংরেজ এমন দেমাকী ভাব দেখায় যেন লিপটন ব্রুকবন্ড এঁরাই ইন্ডিয়াকে চা খাওয়াতে শিখিয়ে পতিত জনকে উদ্ধার করলেন। অথচ ১৬৫৯ সালের আগে খোদ লন্ডনেই কোনো চায়ের দোকান ছিল না।

একটু থেমে পটলাদা বললেন, “চায়ের ব্যাপারে আমরা হাওড়ার লোকরাও একটু স্পেশাল গর্ব করতে পারি। শিবপুরের কোম্পানিবাগানেই পলাশির যুদ্ধের তিরিশ বছর পরে কিড সাহেব ভারতের প্রথম চা গাছের পত্তন করেছিলেন।”

“কিন্তু পটলাদা, কিড সাহেব তো জানিয়েছিলেন এ জায়গা চায়ের উপযুক্ত নয়।”

পটলাদা বললেন, “সময় কীভাবে এগিয়ে চলে! এখন আই আই টির প্রচেষ্টায় খোদ খড়গপুরেও চায়ের চাষ হচ্ছে। সেই চা আমিও খেয়েছি, খারাপ লাগেনি!”

শিবকালীবাবু বলতেন, “চায়ের পাতা তিন থেকে পাঁচ মিনিটের বেশি ভেজাতে নেই, তাহলে চায়ের ট্যানিন বেশি আসবে না, কিন্তু বেশি ভেজালেই বা সেদ্ধ করলেই দ্বিগুণ মাত্রায় ট্যানিন ফান্টে চলে আসে।”

অতন্দ্ৰী নামটি নিয়েও সামান্য সন্দেহ থেকে যায়। চা কি মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়?

শিবকালী ভট্টাচার্য আমাকে বকুনি লাগিয়েছিলেন। “ওটা তো কফির কথা হয়ে গেল। যাদের ঘুম হয় না তারা রাতে কফিকে বাঘের মতো ভয়। পায়। কিন্তু অতন্দ্রী যখন চা, তখন তার অর্থ হলো, অসময়ের ঢুলু ঢুলু ভাবটা চা পান করলে কেটে যাবে, অথচ শরীরের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে না।”

অতন্দ্রী না হয় বোঝা গেল, কিন্তু ওই শ্যামপর্ণী ব্যাপারটা? পর্ণ তো আমরা জানি পাতা, কিন্তু কৃষ্ণের নামকেই একটু ভদ্রভাবে শ্যাম বলা?

শিবকালীবাবুর ব্যাখ্যা, শ্যান ঠিক সবুজও নয় আবার কালোও নয়, তারপরই নতুন সারপ্রাইজ দিয়েছিলেন শিবকালীবাবু। “ব্রাদার, সংস্কৃত অভিধান খুললে দেখবে, শ্যাম একটি অতি গোলমেলে শব্দ, এর মানে উজ্জ্বল গৌরও হতে পারে।”

পটলাদার ফান্ট শব্দটি খুব ভাল লেগেছে। “হাজারখানেক বহু ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দকে গরম জলে চুবিয়ে ঢেকে রেখে তৈরি করে রাখলে পাঠক ও লেখক দুই পার্টির খুব উষ্কার হবে।”

পটলাদা আবার স্বামী বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে ফিরতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। “মস্ত মানুষ, সবসময় সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ সাধ-আহ্লাদের কথা ভাবতেন। চায়ের ভক্ত হয়েই বুঝেছিলেন, সারা দেশকে এই পানীয় যথার্থ আনন্দ দিতে পারবে। মনে রাখতে হবে, সেই সময় পণ্ডিতরা চারদিকে চায়ের বদনাম ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন, বলছেন, শরীর স্বাস্থ্যের সর্বনাশ করবে এই নেশা। বিবেকানন্দ উলটোপথের বিপ্লবী, নিজের মঠে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করলেও চা-কে সম্মান ও স্বীকৃতি দিলেন। বেদ-বেদান্ত-উপনিষদ পাঠ করো, সেই সঙ্গে চা খাও কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আমাদের এই হাওড়া সন্ন্যাসীর সঙ্গে এবিষয়ে ভালো ব্যবহার করেনি। বেলুড় মঠের উপস্থিতি যেখানে সেই বালি মিউনিসিপ্যালিটির তঙ্কালীন চেয়ারম্যান মঠের ট্যাক্সো প্রচুর বাড়িয়ে দিলেন, যুক্তি এটা নরেন দত্তের তো বাগানবাড়ি, যেখানে ঘন ঘন চা খাওয়া হয়।”

“অ্যাঁ!”

“অ্যাঁ নয়, স্বামী বিবেকানন্দও অন্যায় সহ্য করবার পাত্র নন, পুরসভার বিরুদ্ধে দিলেন মামলা ঠুকে চুঁচড়ো জেলা কোর্টে। সেই মামলায় মঠে চা পানের ব্যাপারে সাক্ষী-সাবুদ নেওয়া হলো, সাক্ষীরা অস্বীকার করনে না তারা চা খান। জজ সাহেব আধুনিকমনস্ক, বুঝলেন ব্যাপারটা, আলতী নির্দেশে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেট ঘোড়ায় চড়ে বেলুড় মঠে তদন্ত করতে এলেন, এবং চা পানের অভিযোগকে পাত্তা দিলেন না।”

“তদন্ত করতে এসে গোরাসাহেব কি বেলুড় মঠে চা পান করেছিলেন?”

“ঠিক জানি না, তুই এ-বিষয়ে বেলুড় বাজারে খোঁজখবর নিয়ে, নথিপত্তর দেখে আলোকপাত করতে পারিস। তবে এটা জেনে রাখ, সেকালের কলকাতায় মণ্ডামিঠাই, কচুরি-জিলিপি-গজার অসংখ্য দোকান ছিল, কিন্তু ছিল না কোনো চায়ের দোকান, ছিলো না ডবল হাফ, ছিলো না ভড়। কিন্তু দূরদ্রষ্টা বিবেকানন্দ সেই কবে ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, একদিন পাড়ায় পাড়ায় চপ কাটলেটের দোকান হবে। এবং বুঝতেই পারছিস, চপ কাটলেট টোস্ট এটসেটরার পর চা আসতে বাধ্য, এর উল্লেখ পর্যন্ত প্রয়োজন হয় না। সাহিত্যে এবং শিল্পে একে বলে পরিমিতিবোধ, ঠিক জায়গায় থেমে যেতে পারলে ইঙ্গিতে অনেক বেশি বলা হয়ে যায়।”

পটলাদার সংযোজন, “শুধু আদালতে মামলা করা নয়, চা নিয়ে এদেশে এতো চিন্তা-ভাবনা বিবেকানন্দর মতো কেউ করেননি। লেখার মধ্যে যেখানেই পেয়েছে চায়ের কথা ঢুকিয়েছেন, দুনিয়ার যেখানে গেছেন সেখানে চা-কে মন দিয়ে স্টাডি করেছেন। পরিব্রাজক বইতে স্বামীজি দুঃখ করছেন, চায়ের চল–ইংল্যান্ড ও রাশিয়া ছাড়া অন্যত্র বড়ই কম।…চা পানের ধুম রাশিয়াতে অত্যন্ত–বেজায় ঠাণ্ডা, আর চীন-সন্নিকট। চীনের চা খুব উত্তম চা–তার অধিকাংশ যায় রুশে। রুশের চা-পানও চীনের অনুরূপ, অর্থাৎ দুগ্ধ মেশানো নেই। দুধ মেশালে চা বা কফি বিষের ন্যায় অপকারক। আসল চা-পায়ী জাতি চীনে, জাপানী, রুশ, মধ্য এশিয়াবাসী বিনা দুগ্ধে চা পান করে..তবে রাশিয়ায় তার মধ্যে এক টুকরো পাতি লেবু এবং এক ডেলা চিনি ফেলে দেয়।”

পটলাদা বলে চললেন, “এরপর মারাত্মক কয়েকটা লাইন রয়েছে। বিবেকানন্দ জানাচ্ছেন, গরিবরা এক ডেলা চিনি মুখের মধ্যে রেখে তার উপর দিয়ে চা পান করে এবং একজনের পান শেষ হলে, আর একজনকে সে চিনির ডেলাটা বার করে দেয়। সে ব্যক্তিও সে ডেলাটা মুখের মধ্যে রেখে পূর্ববৎ চা পান করে।”

পটলাদা আর একটা পয়েন্ট তুললেন। “ভাল চা ভালভাবে পান করবার লোক সংসারে কম নেই। তারা যে ভাল লোক তাও মেনে নিচ্ছি, কিন্তু ক’জন নামীদামী লোক নিজেই চা তৈরি করতে পেরেছেন? রবীন্দ্রনাথ চা রসিক, কিন্তু তাঁকে রান্নাঘরে ঢুকে চা করতে দেখা গিয়েছে এমন বর্ণনা আজও আমার নজরে পড়েনি। বিবেকানন্দের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, যিনি হাঁড়ি হাঁড়ি খিচুড়ি বা পলান্ন রাঁধতে পিছপা নন তার পক্ষে চা তৈরি তো নস্যি! এর ভূরি ভূরি বর্ণনা রয়েছে, মাঝরাতেও এইসব বাই উঠেছে, কিন্তু লোকশিক্ষকরা নিজেরা কিছু করেই হাত গুটিয়ে নেন না, অন্যদেরও মাঠে নামান।

আমি বললাম, “পুণাতে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাণ্ডটা করেছিলেন। স্বহস্তে শ্যামপর্ণী প্রস্তুত করে এই অধমকে খাইয়েছেন, তারপর শিষ্যকেও সুযোগ দিয়েছে পরের রাউন্ডটা খেলবার। আমার উইকেট পতন হয়নি, এই কারণে যে, ছাত্রাবস্থায় ইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই বিবেকানন্দ-পাগল হাঁদুদা ওরফে সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্যের বাড়িতে অভ্যাগতদের জন্য বহুবার চা তৈরি করতে হয়েছে। তবে ফুল মার্কস পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ প্রেসার স্টোভ জ্বালানোর দক্ষতা আমি শত চেষ্টাতেও অর্জন করতে পারিনি। হায়, তখন যদি এল পি জি গ্যাস থাকতো তা হলে একশ’র মধ্যে একশ আমিও পেতাম।”

পটলাদা বললেন, “বিখ্যাত লেখক শরদিন্দু একজন অখ্যাত লেখককে দয়াপরবশ হয়ে চা তৈরির ঘরানা দিলেন, এটা প্রমাণ করে যে তিনি ছিলেন স্নেহপ্রবণ, দয়ার শরীর তার। কিন্তু চাপ্রেমী বিবেকানন্দর মধ্যে ছিল মিশনারি মনোবৃত্তি। শোন, স্বয়ং বালগঙ্গাধর তিলককে স্বামীজি আসরে নামিয়ে দিয়েছিলেন। রেকর্ডে রয়েছে, বেলুড় মঠে এসে ‘মোগলাই’ চা প্রস্তুত করে লোকমান্য তিলক সকলকে চা খাইয়েছিলেন। জায়ফল, জয়ত্রী, ছোট এলাচ, লবঙ্গ, জাফরান ইত্যাদি একসঙ্গে সিদ্ধ করিয়া ঐ সিদ্ধ জলের কাথে চা, দুধ, চিনি মিশাইয়া এই চা প্রস্তুত হইয়াছিলো।”

ভীষণ ব্যাপার! বেলুড় মঠে টিবয়ের ভূমিকায় স্বয়ং তিলক। “কিন্তু পটলাদা, ঐ মোগলাই ব্যাপারটায় একটু খটকা লাগছে। মোগলসম্রাট আকবর কি কখনও চা খাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন? আইন-ই আকবরিতে তো কোন চায়ের উল্লেখ নেই। চাকফি-কোকো এবং সেই সঙ্গে লঙ্কা এটসেটরা এদেশের আসর আলোকিত করলো মোগলসম্রাট শাজাহানের আমল থেকে। তার আগে আমাদের নোলাতে ছিল অবিশ্বাস্য অপূর্ণতা। সপ্তদশ শতকে এক সাহেব (ওডিংটন) সুরাটের বেনেদের আসরে চা-পানের বর্ণনা দিচ্ছেন। সেই চায়ে চিনি নেই, কিন্তু আছে মাথাধরা ছাড়াবার জন্যে নানারকম মশলা ও কণেক ফোঁটা লেবুর রস।

পটলাদা বললেন, “ইতিহাসে একটু-আধটু উল্লেখ যেখানেই থাকুক, বিশ শতকটাই চায়ের শতক–চেয়ো বাঙালি প্রাণভরে চায়ের সায়রে ডুব দিলো, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের উপদেশ সে কানেই নিলো না। ভাড়ে চা, কাপে চা, রুপোর সরঞ্জামে চা, কাগজের পাত্রে চা, প্লাস্টিকের আধারে চা। শুনেছি এক-আধজন রসিক মাঝে মাঝে সাবেকি বাঙালি কায়দায় বেলের। খোলাতেও চা পানের এক্সপেরিমেন্ট করেছে।”

একটু থেমে পটলাদা বললেন, “অনেকে বদনাম দিয়েছে, বাঙালির বদহজম, ডিসপেপসিয়া ইত্যাদির পিছনে চায়ের অবদান নিতান্ত কম নয়। খালি পেটে চা-খাওয়ার এমন দুঃসাহস পৃথিবীর খুব কম জাতই দেখাতে পেরেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, চা আমাদের মস্ত উপকার করেছে, আমাদের চেয়ে মাতালরা এদেশের মোদো মাতালদের সবসময় দাবিয়ে রেখেছে। মাদকতার প্রসার যতটা হতে পারতো এই বঙ্গভূমে ততটা হয়নি স্রেফ এই চায়ের জন্যে।”

“টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি শেষ হয়ে গিয়েছে। একবিংশ শতকেও আমাদের এই কলকাতায় চা যুগ যুগ জিও!”

পটলাদা এবার কিন্তু মোটেই উৎসাহ দেখালেন না। “অনেকদিন পরে এলাম, পরিস্থিতি মোটেই সুবিধের নয় মুখুজ্যে। কলকাতার পুরনো চায়ের দোকানগুলো আরও মলিন হয়ে ধুকছে–চায়ের সঙ্গে তারুণ্যের সম্পর্কটা খালি চোখে ধরা পড়ছে না। মনে হচ্ছে, কফির অভাবনীয় অনুপ্রবেশ ঘটছে।”

“সে তো পঞ্চাশ বছরের ওপর চলছে পটলাদা, কফি হাউস ইনটেলেকচুয়ালরা তো সব বাহাত্তুরে হতে চললো।”

“ওরে সে তো মাত্র দু’খানা কফি হাউসে কলেজ স্ট্রিটের অ্যালবার্ট হলে আর চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে কটা আর তোক ধরতো, বাকি সবাই তো চায়ের খদ্দের। জেনুইন বাঙালি তো বাড়িতে কখনও কফি ঢুকতে দেয়নি, কফি বোর্ডের প্রাণান্ত প্রচার সত্ত্বেও। এবার তো পদে পদে দুঃসংবাদ, পাড়ায় পাড়ায় বারিস্তা, কাফে কফি এটসেটার সমারোহ শহরের ছেলেমেয়ে, বুড়োবুড়ি সবাই ওইসব জায়গায় দ্বিগুণ-ত্রিগুণ দামে কফি পান করতে বদ্ধপরিকর। চায়ের বাঙালি এবং বাঙালির চা মস্ত চোট খেতে চলেছে।”

“বাঙালির রক্তে চায়ের লিকার রয়েছে, কেউ কিসসু করতে পারবে না পটলাদা, পোড়া শালপাতার গন্ধওয়ালা কফি এবং দার্জিলিঙের শ্যামপেনসম চা যে এক বস্তু নয় তা বাঙালির পক্ষে ভোলা সম্ভব নয়।”

“চোখ বুজে থাকাই আমাদের জাতীয় স্বভাব। বিয়েবাড়িতে মিষ্টি দই উঠে গেল। নিমন্ত্রিতরা আইসক্রিম চাখছে এটাও তো ভাবা যেতো না, শেষ হয়ে গেল মিষ্টি দইয়ের সাংস্কৃতিক আধিপত্য। মাটির খুরিকে দাবড়াচ্ছে প্লাস্টিক কাপ, ভাবা যায় না! রসনার রাজত্বেও সংখ্যালঘু হবার দুঃখ কি তা তোরা এখনও বুঝতে চেষ্টা করছিস না।”

পটলাদা বললেন, “বিশেষ একটা লবি তিনশ বছর ধরে কফিকে জাতে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে, অথচ এঁরা জানতেন সুরসিক সম্রাট চতুর্দশ লুই প্রথমে কফি পান করে মোটেই সন্তুষ্ট হননি। অথচ ফ্রান্সে প্রচারের ধাক্কায় কফির এমন প্রমোশন হলো যে লেখা হলো, ইংরেজের চা, জার্মানদের বিয়ার, স্প্যানিয়ার্ডের চকোলেট, তুর্কের আফিম আর ফরাসির কফি এক জিনিস। এই পানীয়কে জনপ্রিয় করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্যাস্কাল নামে এক ভদ্রলোক, যাঁকে কফি মিশনারি বলা যেতে পারে। প্যারিসের এক মেলায় উর্দিপরা ওয়েটাররা গরম কফি ফেরি করতে লাগলো। মেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর প্যাস্কাল এক কফি বুটিক খুলেছিলেন। খরিদ্দারের ভিড় থাকায় প্যাস্কালকে পাড়ায় পাড়ায় গরম কফির ফেরিওয়ালা পাঠাতে হতো। তারপর ডাক্তাররা কফির গুণে মোহিত হয়ে নাকি রোগীদের বলতে লাগলেন কফি খাও।”

পটলাদার দুঃখ চায়ের প্রচারের জন্য কেউ কিছু করে না, কলকাতার চায়ের দোকানগুলোর সঙ্গে কফির দোকানগুলোর তুলনা করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। “বাঁচতে হলে বিবেকানন্দর প্রদর্শিত পথে তোদের ফরাসী সাহায্য ভিক্ষা করতে হবে। জপল স্টেশনের কাছে একটা টি সালো আছে যেখানে কুড়িটা দেশের তিনশো রকম চা মজুত থাকে, আর আছে দুশ রকমের টি-পট, রসিকের মর্জি অনুযায়ী চা পরিবেশন করবে ফরাসী সুন্দরীরা। আমাদের এই শহরে চা আছে, টি-পট আছে, দোকান আছে, সুন্দরীরাও অঢেল, নেই শুধু আইডিয়া এবং উদ্যম, ফলে দার্জিলিঙের এতো কাছে থেকেও আমরা বিবেকানন্দের শহর কলকাতাকে চায়ের ওয়াটারলু করে তুলেছি।”

বললাম, “এক সময় ব্যান্ডেল স্টেশনেই দশ রকম গরম চা পাওয়া যেতো, রসিকরা জানতেন কোন্ ভেন্ডারের কেটলিতে কি জিনিস আছে।”

“কলকাতার কপালে অনেক দুঃখ! ভড়কে চায়ের প্রচারে নিয়োগ না করে তা দিয়ে পূজামণ্ডপ বানানো হচ্ছে,” পটলাদার খেদোক্তি।

“তা হলে কিংকর্তব্যম, পটলাদা?”

“খোদ কলকাতায় কফির হাতে চায়ের পরাজয় হবার আগেই যেন আমার কলকাতায় আসা বন্ধ হয়। কফির সঙ্গে পাঞ্জা লড়া, প্রয়োজনে কফির দোকানের সামনে অবস্থান প্রতিবাদ করা, লোককে বলা, কলকাতার সেরা মানুষরা কখনও কফিকে প্রশ্রয় দেননি, বড়জোর নিষিদ্ধ পানীয় হিসেবে নমাসে ছ’মাসে একবার কফি হাউসে পদার্পণ করেছেন। অমন যে অমন স্বামী বিবেকানন্দ তিনিও খোদ প্যারিসে সূর্যাস্তের পর কফি পান করতেন না, ওতে ওঁর ঘুমের বারটা বেজে যায়।”

আমি পটলাদার পয়েন্টগুলো নোট করে নিচ্ছি। পটলাদা বললেন, “বাঙালির বাঙালিত্ব বলতে ওই চটনা ওঠা চায়ের কাপটুকুই পড়ে আছে, ওটা কিছুতেই আমরা ছাড়বো না, আমাদের চূড়ান্ত দাবি, কফি দূর হটো! বিবেকানন্দের চা, যুগ যুগ জিও। যুগ যুগ জিও।” এই বলে পটলাদা উঠে পড়লেন। এন আর আই মানুষ, কলকাতা ছাড়বার আগে ক্যামেরায় কলকাতার বিলুপ্তপ্রায় চায়ের দোকানগুলোর ছবি তাকে তুলে নিতে হবে।

৪. সন্ন্যাসীর শরীর

শরীরম্‌ ব্যাধিমন্দিরম্‌! এদেশের কোন মহাপুরুষ কথাটা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন তা আমার জানা নেই। স্বামী বিবেকানন্দের অসুখবিসুখ সম্বন্ধে খবরাখবর নিতে গেলেই কথাটা কিন্তু বারবার মনে পড়ে যায়। আমার পিতৃদেব অকালে মৃত হয়েছিলেন, সেই থেকে পিতৃস্থানীয়দের অকালপ্রয়াণ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ওপর ওই ধরনের দুর্ঘটনার সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাকে আজও নাড়া দেয়। এই মানসিকতা থেকেই নরেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দের শরীর-স্বাস্থ্য আমার অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

নরেন্দ্রনাথের পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্তর মৃত্যু হয় ১৮৮৪ সালে, ৫২ বছর বয়সে। তার জ্যেষ্ঠপুত্রের বয়স তখন ২১ বছর।

কর্পোরেশন ডেথ রেজিস্টার অনুযায়ী বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুর কারণ বহুমূত্ররোগ, দেহাবসানের তারিখ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪। স্বামী গম্ভীরানন্দের বিবরণ সামান্য আলাদা : “১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি সোমবার অপরাহ্নে তিনি (নরেন্দ্র) বরাহনগরে আগমনপূর্বক সঙ্গীতাদিতে রাত্রি প্রায় এগারটা পর্যন্ত কাটাইয়া শয্যাগ্রহণানান্তে বন্ধুদের সহিত নানাবিধ আলাপে নিযুক্ত আছেন, এমন সময় তাহার বন্ধু ‘হেমালী রাত্রি প্রায় দুইটার সময় সেখানে আসিয়া খবর দিলেন, তাঁহার পিতা অকস্মাৎ ইহলোক ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন।” বিভিন্ন সূত্র থেকেই হৃদরোগকে বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে।

পিতৃদেবের স্বাস্থ্যের ইতিহাসটি ভাল নয়। মৃত্যুর একমাস আগেই ডায়াবিটিসের রোগী বিশ্বনাথের হৃদরোগ দেখা দেয় এবং মৃত্যুর দিনে তিনি স্ত্রীকে বলেন, “তিনি হৃদয়ে বেদনা অনুভব করিতেছেন। অতঃপর রাত্রে আহারের পর বুকে ঔষধ মালিশ করাইয়া তামাক সেবন করিতে করিতে তিনি কিছু লেখাপড়ার কাজে মন দেন; নয়টায় উঠিয়া বমি করেন এবং তারপরেই রাত্রি দশটায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া যায়।”

মধ্যমভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের স্মৃতি অনুযায়ী নরেন্দ্রনাথ বরাহনগর থেকে সোজা নিমতলা ঘাটে চলে আসেন। শ্মশানের মিউনিসিপ্যাল ডেথ রেজিস্টারে নরেন্দ্রনাথ তার পুরো নাম ইংরিজিতে লেখেন।

পৈত্রিক দিক থেকে দীর্ঘজীবী হওয়ার তেমন কোনো প্রমাণ স্বামীজির বংশতালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না। দশভাইবোনের সংসারেও অনেকেই অকালে দেহরক্ষা করেছেন। তবে তাঁর দিদি স্বর্ণলতা, মেজভাই মহেন্দ্রনাথ এবং ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথ দীর্ঘজীবনের সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। জননী ভুবনেশ্বরী শোকতাপে জর্জরিত হয়েও বাহাত্তর বছর বেঁচেছিলেন, তার মৃত্যুর কারণ যে মেনিনজাইটিস তা আমাদের অজানা নয়। ভুবনেশ্বরী-জননী রঘুমণি দেবী বেঁচেছিলেন ৯০ বছর, তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে মিউনিসিপ্যালিটির খাতায় লেখা আছে ‘বার্ধক্যজনিত দৌর্বল্য’। জীবিতকালে তাঁর শেষ আশ্রয় নিমতলা গঙ্গাযাত্রীনিবাস।

স্বামীজির স্বল্পায়ুকে চেষ্টা করে পুরোপুরি বংশধারার সঙ্গে যুক্ত করাও সুবিবেচনার কাজ হবে না, কারণ দিদি স্বর্ণময়ী বেঁচেছিলেন ৭২ বছর। কর্পোরেশন মৃত্যু-রেজিস্টার অনুযায়ী স্বর্ণময়ীর দেহাবসান ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, আনুমানিক বয়স ৭০। মেজভাই মহিম বেঁচেছিলেন ৮৮ বছর এবং ছোট ভূপেন্দ্রনাথ ৮১ বছর। তবু পারিবারিক ব্যাধি ডায়াবিটিস ও হার্ট অ্যাটাকের কথা মনে রেখেই স্বামীজির শরীর ও রোগের মানচিত্র আমাদের আঁকতে হবে।

সেই সঙ্গে সকলকে জানানো দরকার কী-ধরনের শারীরিক জ্বালাযন্ত্রণার মধ্যে তিনি কী সব কাজ এই পৃথিবীতে করে গেলেন। অসম্ভব যেভাবে তার জীবনে সম্ভব হয়েছে তা পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হতে পারে।

নরেন্দ্রনাথের শৈশবকাল থেকে ৪ জুলাই ১৯০২ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে বিভিন্নভাবে শরীর সংক্রান্ত যেসব খবরাখবর ছড়িয়ে রয়েছে তা এবার সাজিয়ে না ফেললে অনেক মূল্যবান ছোটখাট বিবরণ চিরদিনের মতন অনুসন্ধিৎসুদের দৃষ্টির বাইরে চলে যেতে পারে।

ব্যাধির প্রসঙ্গে ঢোকবার আগে স্বামীজির অবয়ব সম্বন্ধে কিছু জানবার আগ্রহ সর্বস্তরেই রয়েছে। কেমন দেখতে ছিলেন মানুষটি? কত ছিল তার উচ্চতা? ওজন কত? গায়ের রঙ কী রকম? পায়ের জুতোর সাইজ কত? এসব বিষয়েও সম্পূর্ণ তথ্য সবসময় আমাদের হাতের গোড়ায় নেই।

সমকালের ভারতীয়দের মস্ত দোষ, তারা একজন স্মরণীয় মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে নানাবিধ মন্তব্য করেন, কেমন দেখতে তাও বলেন, কিন্তু তথ্যভিত্তিক বিবরণ দেন না।

প্রমথনাথ বসু তাঁর বইতে বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলেছেন, সুগঠিত অবয়ব, তার মধ্যে সিংহাবয়বের সৌন্দর্য। কিন্তু স্বামীজির শরীরের মাপজোখের জন্য আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে রোমাঁ রোলাঁর। সাবধানী ইউরোপীয় ও আমেরিকান লেখকরা যথা সময়ে কলম না ধরলে আমরা অনেক বিবরণ জানতে পারতাম না।

রোলাঁ তার বিখ্যাত বইয়ের শুরুতেই লিখছেন : “বিবেকানন্দের দেহ ছিল মল্লযোদ্ধার মত সুদৃঢ় ও শক্তিশালী। তাহা রামকৃষ্ণের কোমল ও ক্ষীণদেহের ছিল ঠিক বিপরীত। বিবেকানন্দের ছিল সুদীর্ঘ দেহ (পাঁচফুট সাড়ে আট ইঞ্চি), প্রশস্ত গ্রীবা, বিস্তৃত বক্ষ, সুদৃঢ় গঠন, কর্মিষ্ঠ পেশল বাহু, শ্যামল চিক্কণ ত্বক, পরিপূর্ণ মুখমণ্ডল, সুবিস্তৃত ললাট, কঠিন চোয়াল, আর অপূর্ব আয়ত পল্লবভারে অবনত ঘনকৃষ্ণ দুটি চক্ষু।”

ভারতীয় অপেক্ষা তাতারদের সঙ্গেই তার চোয়ালের সাদৃশ্য ছিল বেশি। বিবেকানন্দর কণ্ঠস্বর ছিল ভায়লিনচেলো বাদ্যযন্ত্রের মতো। তাতে উত্থানপতনের বৈপরীত্য ছিল না, ছিল গাম্ভীর্য, তবে তার ঝঙ্কার সমগ্র সভাকক্ষে সকল শ্রোতার হৃদয়ে। ফরাসি গায়িকা এমা কালভে বলেন, তিনি ছিলেন চমৎকার ব্যারিটোন, গলার সুর ছিল চীনা গঙের আওয়াজের মতো। রোমাঁ রোলাঁর বর্ণনা অনুযায়ী বিবেকানন্দর ওজন ১৭০ পাউন্ড।

এই ওজন কি মাঝে-মাঝেই ওঠা-নামা করতো? কারণ অন্য এক পরিপ্রেক্ষিতে জনৈক মার্কিনী সাংবাদিক আন্দাজ করেছেন, স্বামীজির ওজন ২২৫ পাউন্ড। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে, স্বামীজি নিজেই ওজন কমাবার জন্য কৃতসংকল্প হয়ে উঠেছেন। মনে হয়, ঝপ করেই তার ওজন বাড়তো আবার একটু চেষ্টাতেই আয়ত্তে এসে যেত।

প্রথমবার মার্কিন প্রবাসকালে নিউইয়র্ক থেকেডায়েটিংসম্বন্ধেবিবেকানন্দ লিখেছেন, “আজকাল দুধ, ফল, বাদাম–এই সব আমার আহার। ভাল লাগে, আছিও বেশ। এই গ্রীষ্মের মধ্যেই মনে হয় শরীরের ওজন ৩০৪০ পাউন্ড কমবে, শরীরের আকার অনুসারে ওজন ঠিকই হবে।”

প্রথমবার যখন স্বামীজি আমেরিকায় যান তখন “ফ্রেনলজিক্যাল জার্নাল অব নিউ ইয়র্কে” তাঁর শরীরের মাপ প্রকাশিত হয়।

নিজের ওজন নিয়ে স্বামীজির রসরসিকতার অন্ত ছিল না। আমেরিকায় একবার বক্তৃতার পর জনৈক মুগ্ধ ভক্ত তাঁকে প্রশ্ন করলেন,”স্বামীজি, আপনি কি ভগবানকে দেখেছেন?” স্বামীজির তাৎক্ষণিক উত্তর : “বলেন কি? আমাকে আমার মতন একজন মোটা লোককে দেখে কি তাই মনে হয়?”

কারও শারীরিক ওজনের উত্থান-পতনের গ্রাফের দিকে সাবধানী নজর রাখা দেহান্তের এতোদিন পরে সহজ কাজ নয়। আমাদের কাছে উপাদানের মধ্যে তখনকার মানুষের কিছু স্মৃতিকথা, ইংরিজি, বাংলা, সংস্কৃত ও ফরাসিতে লেখা তাঁর চিঠিপত্র এবং বিভিন্ন সময়ে তোলা কিছু ফটো, যা দেখলে সহজেই বোঝা যায় কোনো অজ্ঞাত কারণে তার ওজন সব সময় স্থির থাকছে না। এর পিছনে অদৃশ্য ডায়াবিটিস এবং কিডনির ব্যাধি কতটুকু কাজ করেছে তা নিয়ে ডাক্তারি অনুধ্যান করলে মন্দ হয় না।

১৮৯৯ সালে দ্বিতীয়বার বিদেশ যাবার সময় কলকাতায় তোলা ফটোগ্রাফে স্বামীজিকে উদ্বেগজনকভাবে শীর্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু লন্ডন হয়ে কয়েকমাস পরেই যখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় উপস্থিত হলেন, তখন ওজন আবার বেশ বেড়ে গিয়েছে।

রসিকচূড়ামণি বিবেকানন্দ তখন প্রায়ই নিজেকে ফ্যাট বা মোটকা মহারাজ বলতেন। আরও কয়েকমাস পরে বিবেকানন্দ যখন প্যারিসে হাজির হলেন তখন তার ওজন হুড়মুড় করে তিরিশ পাউন্ড কমে গিয়েছে। ব্যাপারটা মার্কিনী ভক্তদের সাবধানী নজর এড়ায়নি।

প্যারিস থেকে মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড তার বান্ধবী সারা বুলকে লিখছেন, “ওজন কমে যাওয়ায়, স্বামীজিকে বালকের মতন দেখাচ্ছে।” মার্কিনী ভক্তরা স্বামীজির বিভিন্ন ফটো দেখে আরও কিছু বিশ্লেষণ করেছেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় ভোলা ছবিগুলোতে তাকে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর দেখাচ্ছে। “উল্লেখযোগ্যভাবে হ্যাঁন্ডসাম”, এই শব্দটি তার সম্পর্কে ব্যবহার করা হয়েছে।

এ-বিষয়ে আরও আলোচনার আগে, বিবেকানন্দর ওজন ও অবয়ব নিয়ে আরও এক সরল মন্তব্যের আনন্দ উপভোগ করা যেতে পারে। প্রথমবার আমেরিকা থেকে ফিরে স্বামীজি অসুস্থ অবস্থায় কিছুদিন আলমোড়ায় ছিলেন। সেখান থেকে মেরি হেলবয়েস্টারকে তিনি লিখছেন, “…চিকিৎসকের ব্যবস্থামতো আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে সরলোলা দুধ খেতে হয়েছিল, আর তার ফলেই আমি পিছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশি এগিয়ে গিয়েছি। যদিও আমি সবসময়ই আগুয়ান–কিন্তু এখনই এতোটা অগ্রগতি চাই না, তাই দুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”

স্বামীজির বিদেশি জীবনীকাররা মোটামুটি একমত যে তাঁর ওজনের ওঠানামা কখনই আয়ত্তে আনা যায়নি, যদিও মাঝে মাঝে তিনি খাওয়া দাওয়া বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে দিতেন। তথ্যাভিজ্ঞদের মতে, ঐতিহাসিক শিকাগো বক্তৃতার সময় (১৮৯৩) তার ওজন মোটেই বাড়তির দিকে ছিল না, কিন্তু সম্ভবত তার পরেই ওজন স্বামীজির বাড়তে থাকে।

এর কিছুদিন পরেই মিস্টার হেলের বাড়িতে একটা ঘরে তোলা ছবিতে স্বামীজিকে বেশ মোটাসোটা দেখাচ্ছে, যদিও ক্যামেরা অনেকসময় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়ে মোটাকে রোগা এবং রোগাকে মোটা দেখাতে পারে। তবে এই সময় বল্টিমোরের এক সাংবাদিক তাঁর লেখায় ইঙ্গিত করেন, স্বামীজির ওজন ২২৫ পাউন্ড হবে।

কেমন ছিল স্বামীজির গায়ের রঙ? রোমাঁ রোলার বর্ণনা অনুযায়ী অলিভ। মনে হয় উজ্জ্বল গৌর বলতে পশ্চিমীরা যা বোঝেন তা তাকে বলা চলে না। এবিষয়ে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ একটি চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেছেন। স্বামীজির দেহের রঙের পরিবর্তন ঘটতো–কোনদিন মনে হত একটু ময়লা, কোনদিন আরও ফরসা, কিন্তু সবসময় তাতে একটু আভা দেখা যেত যাকে সোনালি বলা চলে। স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ আরও জানিয়েছেন, তার “হস্তদ্বয় যে কোন নারীর হস্তের তুলনায় সুন্দর ছিল।”

বিবেকানন্দের শরীরের রঙ সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত–”কালোও নন প্রচণ্ড ফর্সাও নন”, “অলিভ”, “বেশ চাপা”, “লাইট”,”মুখে স্বাভা” ইত্যাদি, যা এতোদিন পরে ঠিকমতন আন্দাজ করা বোধ হয় সম্ভব নয়। তবে স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ যে পরিবর্তনের কথা বলেছেন তা বেশ নির্ভরযোগ্য।

স্বামীজির মুখের আকার সম্বন্ধে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তোলা বিভিন্ন ফটোগ্রাফ কিছুটা দৃষ্টিবিভ্রম ঘটায়–বোঝা যায় কেন অনেকে তাঁর পরিপুষ্ট গোল মুখের কথা বলেছেন। আবার কারও নজর কেড়ে নিয়েছে তার শক্তিময় চিবুক।

স্বামীজির ঘন চুলের ঐশ্বর্য সম্পর্কে কিছু ধারণা কয়েকটা ছবি থেকে আমরা পাই। কোকড়া নয়, ঢেউ খেলানো বাবরি চুলের অরণ্য। এই ঘন কালো চুলের সামান্য একটু অংশ আচমকা মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউড একবার কেটে নিয়ে তার অস্বস্তির সৃষ্টি করেছিলেন। সেই চুলের অংশটুকু স্বর্ণালঙ্কারে ঢুকিয়ে মিস্ ম্যাকলাউড় সারাক্ষণ নিজের কাছে রাখতেন। দেশে ফিরে এসে বেলুড়মঠে মস্তক মুণ্ডনের সময়েও স্বামীজি নিজের চুল নিয়ে রসিকতা করেছেন। অমন সুন্দর চুল যা বিদেশে বক্তৃতাকালে কপাল পেরিয়ে প্রায় চোখের ওপর এসে পড়তো তা স্বদেশে ফিরে এসেই তিনি ফেলে দিলেন।

আমরা জানি বেলুড়মঠে তিনি প্রতি মাসে মস্তক মুণ্ডন করতেন। বেলুড় মঠে মাথা কামাচ্ছেন, যখন নাপিত চুলগুলো তাল পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, তখন তিনি সহাস্য মন্তব্য করলেন, “ওরে দেখছিস কি! এরপরে বিবেকানন্দর একগোছা চুলের জন্য ওয়ার্লডে ‘ক্ল্যামার’ পড়ে যাবে।”

নরেন্দ্র-অবয়ব সম্বন্ধে যখন নানা তথ্য একত্রিত করছি তখন বলে রাখি তাঁর ছিল ট্যাপারিং ফিঙ্গার’, বাংলায় মহেন্দ্রনাথ দত্ত যাকে চাপারকলি আঙুল বলেছেন। এই ধরনের আঙুল দ্বিধাশূন্য নিশ্চয়াত্মিক মানসিকতার ইঙ্গিত দেয়। তার নখ ছিল ঈষৎ রক্তবর্ণাভ এবং নখের মাথাটি ছিল ঈষৎ অর্ধচন্দ্রাকার। সংস্কৃতে এই দুর্লভ নখকে নখমণি’ বলে।

মহেন্দ্রনাথতার দাদারপদবিক্ষেপসম্বন্ধেওইঙ্গিত রেখেগিয়েছে–অতি দ্রুত বা অতি শ্লথ ছিল না, যেন গভীর চিন্তায় নিমগ্ন থেকে বিজয়াকাঙ্ক্ষায় অতি দৃঢ় সুনিশ্চিতভাবে ভূপৃষ্ঠে পদবিক্ষেপ করে চলতেন।

বক্তৃতা দেবার সময়ে বিবেকানন্দ ডান হাতের আঙুল প্রথমে সংযত করে হঠাৎ ছড়িয়ে দিতেন। মনে যেমন যেমন ভাব উঠতে “অঙ্গুলি সঞ্চালনও তদনুরূপ হইত।”

.

অবয়বের যে অংশ নিয়ে দেশে বিদেশে ভক্তদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই তা হলো স্বামীজির চোখ। যাঁরাই তার কাছে এসেছেন তারা এই সম্মোহিনী আঁখিপদ্মের জয়গানে মুখর হয়েছে।

“ভেরি লার্জ অ্যান্ড ব্রিলিয়ান্ট” এই কথাটি বারবার এসে পড়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে ও বিভিন্ন স্মৃতিকথায়। আরও কয়েকটি দুর্লভ ইংরিজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে : “ফ্লোয়িং, গ্রেসফুল, ব্রাইট, রেডিয়ান্ট, ফাইন, ফুল অফ ফ্ল্যাশিং লাইট।” নিন্দুকরাও প্রকারান্তরে তার চরিত্রহননের ব্যর্থচেষ্টা করে আমেরিকায় গুজব ছড়িয়েছেন–মার্কিনী মহিলারা তার আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে পতঙ্গের মতন ছুটে আসছেন না, তাঁরা আসছেন তার আঁখিপদ্মের চৌম্বকশক্তিতে।

রোমাঁ রোলাঁও স্বামীজির পদ্মপলাশলোচনের রাজকীয় মহিমা বর্ণনার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।”বুদ্ধিতে, ব্যঞ্জনায়, পরিহাসে, করুণায় দৃপ্ত প্রখর ছিল সে চোখ, ভাবাবেগে ছিল তন্ময়, চেতনার গভীরে তা অবলীলায় অবগাহন করতো, রোষে হয়ে উঠতো অগ্নিবর্ষী, সে দৃষ্টির ইন্দ্রজাল থেকে কারও অব্যাহতি ছিল না।”

স্বামীজির চোখের বর্ণনায় ভারতীয়রাও তেমন পিছিয়ে থাকেননি। শুনুন স্বামী নির্লেপানন্দের মন্তব্য : “সে আঁখির তুলনা হয় না। স্বামী সারদানন্দ একদিন মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, সে যে কি চোখ–কি আর বলবো!..একজন বলেন, তিনি যখন বলরামবাবুর হলঘরে ঘুমিয়ে থাকতেন, দেখেছি, তখনও চোখ সবটা বুজতো না। পাতায় পাতায় কখনও জোড়া লেগে মুড়তো না। শিবনেত্র–সত্য সত্য।”

এই শিবনেত্রের জয়গান বিশ্বভুবনের প্রান্তে প্রান্তে। এই নেত্ৰবহ্নি যেমন সময়ে অসময়ে সমস্ত মায়ালোককে দগ্ধ করেছে, তেমন মুগ্ধ করেছে। সত্যানুসন্ধানী ভক্তজনকে। কিন্তু এই চোখে যে ঘুম আসতো না সেই বেদনাদায়ক সত্যটুকুর সঙ্গেও আমাদের পরিচয় প্রয়োজন।

এই ঘুমের ব্যাপারে কলকাতার শশী ডাক্তারকে (ঘোষ) আলমোড়া থেকে ১৮৯৭ সালে স্বামীজি লিখেছিলেন, “জীবনে কখনও শোবার সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমুতে পারি না; অন্তত দু’ঘণ্টা এপাশ-ওপাশ করতে হয়। কেবলমাত্র মাদ্রাজ থেকে দার্জিলিং-এর প্রথম মাস পর্যন্ত বালিশে মাথা রাখার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম আসত। সেই সুলভ নিদ্রার ভাব এখন একেবারে চলে গেছে। আর আমার সেই পুরানো এপাশ ওপাশ করার ধাত এবং রাত্রে আহারের পর. গরম বোধ করার ভাব আবার ফিরে এসেছে।”

অথচ স্বামীজি যে চিরকাল বিনিদ্র থাকতেন না তার প্রমাণ তিনি নিজেই রেখে গিয়েছেন।

ছাত্রাবস্থায় কীভাবে রাত জেগে পড়াশোনা করতেন তার চমৎকার বর্ণনা স্বামীজি নিজেই দিয়েছেন, : “আমি ঘরের ভিতর বই নিয়ে বসতাম, আর পাশেই রাত্রে গরম চা বা কফি থাকতো; ঘুম পেলেই পায়ে একটি দড়ি বাঁধতাম, তারপর ঘুমে বেহুশ হয়ে পড়লে যেই পায়ের দড়িতে টান পড়তো অমনি জেগে উঠতুম।”

এই বিবেকানন্দই পরবর্তীকালে তাঁর কনিষ্ঠতম সন্ন্যাসীশিষ্য স্বামী অচলানন্দকে করুণভাবে বলেছিলেন, “বেশ, তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারিস? তুই যা চাস তোকে আমি তাই দেব।” অচলানন্দ আমাদের জানিয়েছেন, “তার তখন নিদ্রা বেশি হতো না। শারীরিক কষ্ট ছিল যথেষ্ট, তিনি আমাকে বললেন, জ্ঞান হওয়ার পর হতে আমি জীবনে কখনও চারঘণ্টার বেশি ঘুমোইনি। ইদানিং তো তার একেবারেই ঘুম হতো না।”

নিদ্রা বা নিদ্রাহীনতা সম্পর্কে লিখতে গেলেই বালক নরেন্দ্রনাথের নিদ্রাভ্যাস সম্বন্ধে যা প্রচলিত আছে তা মনে করিয়ে দেওয়া মন্দ নয়। তার অভ্যাস ছিল উপুড় হয়ে শোওয়া। বালিশে মাথা রাখলেই তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন না। নিদ্রার জন্য চোখ বন্ধ করলেই তিনি মধ্যে এক জ্যোতির্বিন্দু দেখতে পেতেন। পরবর্তীকালে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ এই জ্যোতি দেখার কথা শুনে বলেছিলেন, ধ্যানসিদ্ধরা এই রকম জ্যোতি দেখতে পায়। এ বিষয়ে আধুনিক চিকিৎসকদের কোনো মতামত আছে কি না তা জানবার কৌতূহল হয়।

স্বদেশে এবং বিদেশে পরিভ্রমণরত বিবেকানন্দ যে কতবার অসহায়ভাবে কিছুক্ষণের নিদ্রার জন্য অপেক্ষা করছেন নানা চিঠিপত্রে তার উল্লেখ রয়েছে। পুরো বিবরণ দিতে গেলে লেখার আকার বড় বড় হয়ে যায়। যখন কোথাও কোনদিন দুদণ্ডের ঘুম হলো তা নিয়ে স্বামীজির কত না আনন্দ।

আসলে জীবনের কোনদিন কখন তিনি ঘুমোতে সফল হয়েছেন তা তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকতো। যেমন মহাপ্রয়াণের আগের বছর মে মাসে (১৯০১) তিনি প্রিয়ভক্ত স্বামী-শিষ্য সংবাদের লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেছেন, ঢাকায় নাগমশায়ের বাড়িতে যাবার কথা।”বাড়িখানি কি মনোরম–যেন শান্তি-আশ্রয়। ওখানে গিয়ে পুকুরে সাঁতার কেটে নিয়েছিলুম। তারপর, এসে এমন নিদ্রা দিলুম যে বেলা আড়াইটা। আমার জীবনে যে কয়দিন সুনিদ্রা হয়েছে, নাগ-মহাশয়ের বাড়িতে নিদ্রা তার মধ্যে একদিন।”

ভক্ত নাগ মহাশয়ের সঙ্গে ১৮৯৯ সালের প্রারম্ভে বেলুড় মঠে বিবেকানন্দর দেখা হয়েছিল। স্বামীজি : “কাজ করতে মজবুত শরীর চাই; এই দেখুন, এদেশে এসে অবধি শরীর ভাল নয়; ওদেশে বেশ ছিলুম।”

নাগমশায় উত্তর দিলেন, “শরীর ধারণ করলেই ঠাকুর বলতেন–ঘরের টেক্স দিতে হয়। রোগশোক সেই টেক্স। আপনি যে মোহরের বাক্স; ঐ বাক্সের খুব যত্ন চাই। কে করবে? কে বুঝবে? ঠাকুরই একমাত্র বুঝেছিলেন।”

শরীর খারাপ, কিন্তু শরীরচর্চায় এই সময়েও বিশ্বাস হারাননি বিবেকানন্দ। ১৮৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি প্রিয় শিষ্যকে বলছেন, “এখনও রোজ আমি ডামবেল কষি।” দেহ ও মন সমানভাবে চলা যে। বিশেষ প্রয়োজন তা বিবেকানন্দ তার প্রিয়জনদের বারবার বলেছেন।

১৮৯৮ সালে বলরাম বসুর বাড়িতে বিনিদ্রাবেদনায় জর্জরিত স্বামীজির আরও একটা মর্মস্পর্শী ছবি পাওয়া যায়। সে সময় তাঁর খুবই ইচ্ছা হতো যে একটু ঘুম হোক, শরীরের ক্লান্তি একটু দূর হোক, মস্তিষ্ক একটু বিশ্রাম লাভ করুক।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পরে, চারদিকে শাঁখ বেজে উঠলো এবং স্ত্রীকণ্ঠের উলুধ্বনি শোনা গেল। “স্বামীজি বলিলেন, ‘ওরে গেরন লেগেছে–আমি ঘুমোই, তুই আমার পা টিপে দে।’ এই বলিয়া একটুকু তন্দ্রা অনুভব করিতে লাগিলেন…গ্রহণে সর্বগ্রাস হইয়া ক্রমে চারিদিকে সন্ধ্যাকালের মতো তমসাচ্ছন্ন হইয়া গেল। গ্রহণ ছাড়িয়া যাইতে যখন ১৫।২০ মিনিট বাকি আছে, তখন স্বামীজি উঠিয়া…শিষ্যকে পরিহাস করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘লোকে বলে, গেরনের সময় যে যা করে, সে নাকি তাই কোটিগুণে পায়; তাই ভাবলুম মহামায়া এ শরীরে সুনিদ্রা দেননি, যদি এই সময় একটু ঘুমুতে পারি তো এর পর বেশ ঘুম হবে, কিন্তু তা হ’ল না; জোর ১৫ মিনিট ঘুম হয়েছে।”

গেরনে ঘুমিয়ে সত্যিই যে স্বামীজির কিছু লাভ হয়নি তার সাক্ষী শিষ্য শরচ্চন্দ্র নিজেই। কয়েক বছর পরেও (১৯০২) বেলুড় মঠের ছবি আঁকতে আঁকতে তিনি লিখছেন, স্বামীজির ঘুম নেই বললেই চলে। রাত্রি তিনটে থেকে শয্যাত্যাগ করে উঠে বসে থাকেন।

আরও এক রাতের বর্ণনা আমাদের কাছে আছে। স্থান : বলরাম বসুর বাড়ি। সময়: ভোর সাড়ে চারটে। বিনিদ্র স্বামীজি অধৈর্য হয়ে বললেন, খিদে পেয়েছে। ভক্তিময়ী সরোজিনী সেই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে লুচি, হালুয়া, কি কি ভাজা সেই ভোররাতে তৈরি করে ফেললেন। স্বামীজি হাসতে হাসতে তুলসী মহারাজকে বললেন, “দেখছিস আমার কেমন শিষ্য?”

অসুস্থ অবস্থায় পরিবেশ যাতে স্বামীজির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায় তার জন্য বিভিন্ন জায়গায় অনুরাগী ও শিষ্যদের সে কি ব্যাকুলতা। আলমোড়ায় একসময় (১৮৯৭) যে বাড়িতে ছিলেন সেখান থেকে মেরি হেলবয়েস্টারকে স্বামীজি লিখছেন, “আমার শরীর খুবই খারাপ…আশা করি খুব শীঘ্রই সেরে উঠবো।…আলমোড়ার কোন ব্যবসায়ীর একটি চমৎকার বাগানে আছি–এর চারদিকে বহুক্রোশ পর্যন্ত পর্বত ও অরণ্য।…রোজ রাত্রে কুকুরগুলিকে বেশ কিছুটা দূরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হচ্ছে, যাতে তাদের চেঁচামেচিতে আমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।

আহা! ঘুম নিয়ে কি হাহাকার। আলমোড়ার চিঠির কয়েক মাস আগে (১৮৯৬) নিউইয়র্কে বিনিদ্র রজনীতে ক্ষতবিক্ষত বিবেকানন্দ তাঁর ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে লিখেছেন : “আমার শরীর প্রায় ভেঙে পড়েছে। এখানে আসা পর্যন্ত আমি এবছরে একদিনও ভালভাবে ঘুমোইনি…আমার ইচ্ছে হয় মহাসমুদ্রের গভীরে গিয়ে মনের সাধে লম্বা একটা ঘুম দিই।”

প্রায় একই সময়ে বিনিদ্র বিবেকানন্দ একই কথা লিখেছেন মেরি হেলকে–”এবারের শীতে আমি একটা রাত্রিও ঘুমোতে পারিনি।”

পদ্মপলাশলোচনের কথা বলতে গিয়ে আমরা যে-চোখে ঘুম আসতে না তার আলোচনায় চলে গিয়েছিলাম। এই ঘুম না আসার রোগ ইনসোমনিয়া, চিকিৎসা মাঝে মাঝে হয়েছে, কিন্তু রোগী যে কখনও তেমন সুফল লাভ করেননি তা শতবর্ষের দূরত্ব থেকেও আমরা সহজে বলতে পারি।

*

স্বামীজির রোগজর্জরিত শরীর সম্বন্ধে আমরা নানা কথা নানা জায়গায় পড়ে থাকি, কিন্তু এ-সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা এখনও গড়ে ওঠেনি। সাধারণ পাঠকদের মনে।

আমরা শুধু জানি, তার পারিবারিক রোগ মধুমেহ বা ডায়াবিটিসের কথা এবং আরও জানি তার জীবিতকালে ডায়াবিটিসের তেমন কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। এর ফলে অ্যালোপ্যাথ, হোমিওপ্যাথ, কবিরাজ ছাড়াও বারবার দেশবিদেশের হাতুড়ে ডাক্তারদের দ্বারস্থ হয়েছেন বিবেকানন্দ, নানা আজব পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে তাঁর শরীরের ওপরে।

এইসব চিকিৎসা ব্যবস্থায় ক্লান্ত হয়েই বোধ হয় অন্তিমপর্বে রোগের উপশম সম্পর্কে স্বামীজি বলেছেন (জুন ১৯০১), “উপকার অপকার জানিনে। গুরুভাইদের আজ্ঞাপালন করে যাচ্ছি।”

শিষ্যের মন্তব্য : “দেশী কবিরাজী ঔষধ বোধ হয় আমাদের শরীরের পক্ষে সমধিক উপযোগী।”

স্বামীজির ঐতিহাসিক উত্তর : “আমার মত কিন্তু একজন সায়ান্টিফিক চিকিৎসকের হাতে মরাও ভাল; হাতুড়ে যারা বর্তমান বিজ্ঞানের কিছুই জানে না, কেবল সেকেলে পাঁজিপুঁথির দোহাই দিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছে, তারা যদি দু-চারটে রোগী আরাম করেও থাকে, তবু তাদের হাতে আরোগ্যলাভ আশা করা কিছু নয়।”

রোগের আরও খবরাখবর নেওয়ার আগে বিবেকানন্দ-অবয়বের আরও কিছু বর্ণনা যা আমরা মেজভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তর স্মৃতি থেকে পাই, তা এইখানে লিপিবদ্ধ করে রাখলে মন্দ হয় না।

স্বামীজির পায়ের তলার সামনেটা ও পিছনটা মাটিতে ঠেকতো, একে খড়ম-পা বলে। তার পা পাতলা, সরু এবং অপেক্ষাকৃত লম্বা। হাতের আঙুল : সরু, লম্বা ও অগ্রভাগ ছুঁচলো।নখ : মুক্তার মত উজ্জ্বল ও কিঞ্চিৎ রক্তাভ। মুখ : গোল ও পুরুষ্টু। ঠোঁট : পাতলা, ইচ্ছামত দৃঢ় করতে পারতেন। নাসিকা : উন্নত–সিঙ্গি নাক। হাত : সুডৌল, সরু ও লম্বা। মাথার পিছন : চ্যাপ্টা, মাথার সামনের দিক এবং ব্রহ্মতালু; উঁচু।

মন্মথনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের আন্দাজ, বিবেকানন্দের উচ্চতা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি। আরও যা বিবরণ তিনি দিয়েছেন : “বলিষ্ঠ গঠন, চওড়া ছাতি, কিন্তু হাতপা খুবনরম।…তার হাড় চওড়া ছিল–হাতের কব্জি এতখানি বুকও এতখানি।…পায়ের থেকে কোমরের ভাগ দীর্ঘ ছিল। হাতদুটো লম্বা আজানুলম্বিত।”

ডাক্তারদের কাছে লেখা স্বামীজির চিঠি আমাদের হাতে বেশি নেই। এরমধ্যে তার শরীরের দীর্ঘ ইতিহাস দিয়ে শশী ডাক্তারকে আলমোড়া থেকে লেখা (২৯ মে ১৮৯৭) চিঠিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

স্বামীজির ছেলেবেলায় স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা এই চিঠি থেকে সহজেই করা যায়। “ছেলেবেলায় যখন কুস্তি করতাম, আমার তখন সত্যই বোধ হত যে শরীর থাকা একটা আনন্দের বিষয়। তখন শরীরের প্রতি ক্রিয়াতে আমি শক্তির পরিচয় পেতাম এবং প্রত্যেক পেশীর নড়াচড়াই আনন্দ দিত।”

সেই উৎফুল্লভাব যে আলমোড়ায় কমে গিয়েছে তা ডাক্তারকে জানিয়েছেন বিবেকানন্দ। “তবু আমি নিজেকে বেশ শক্তিমান বোধ করি।” এই চিঠির ক্ষেত্রেই বিবেকানন্দ লিখেছেন মৃত্যুহীন প্রাণের কথা। “ডাক্তার, আমি যখন আজকাল তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গের সম্মুখে ধ্যানে বসে উপনিষদ থেকে আবৃত্তি করিন তস্য রোগোন জরান মৃত্যু: প্রাপ্তস্য যোগাগ্নিময়ং শরীর’–সেই সময় যদি তুমি আমায় একবার দেখতে!” উপনিষদের এই মন্ত্রটির অর্থ–যে যোগাগ্নিময় দেহ লাভ করেছে, তার রোগ জরা মৃত্যু কিছুই নেই।

সময়ের সিঁড়ি ধরে এবার একটু পিছিয়ে আসা প্রয়োজন। কমবয়সে নরেন্দ্রনাথের শরীর ও স্বাস্থ্য যে বেশ ভালই ছিল তা বাল্যবয়সের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে বুঝতে কষ্ট হয় না। আমরা শুধু একটি দুর্ঘটনার খবর পাই, যার ফলে তাকে চোখের ওপরে একটা কাটা দাগ সারাজীবন ধরে বহন করতে হয়। আর একটি ইস্কুলের মাস্টারের কাছে অকারণ নিগ্রহ, যার ফলে তার কান দিয়ে বেশ রক্তপাত হয়। এতো রক্ত বেরোয় যে ইস্কুলের ড্রেশ ভিজে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই আঘাতের ফল সুদূরপ্রসারী হয়নি। প্রাণবন্ত নরেন্দ্রনাথ খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যচর্চায় নিজেকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রেখে হৈ-হৈ করে বেড়ে ওঠেন।

প্রথম জীবনের সুস্বাস্থ্যের কথা নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে প্রসন্ন মনে স্মরণ করেছেন। মনে রাখতে হবে, সেকালের অস্বাস্থ্যকর কলকাতায় ছিল কলেরা-টাইফয়েডের প্রবল দাপট। বিবেকানন্দ-জননী ভুবনেশ্বরী দেবী তার কনিষ্ঠপুত্ৰ ভূপেন্দ্রনাথকে একবার বলেন, কলকাতায় কলের জল আসবার আগে প্রতি গরমে কলেরা হত, এসময় প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই দু’একজন মারা যেত।

দাহকার্যে সহায়তা করা তরুণ নরেনের প্রিয় কর্তব্য ছিল। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ স্মরণ করেছেন, “নরেন তিরিশ পঁয়ত্রিশটা মড়া ফেলেছে… বিকেলে এসে ওই কাজ ছিল, বাবা রাগ করতেন। দারুণ স্বাস্থ্য না থাকলে, এইভাবে শ্মশানযাত্রীর কাজ সম্ভব নয়।”

.

তবু আদিপর্বে নরেন্দ্রনাথের শারীরিক অসুস্থতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে পারিবারিক সূত্র থেকে। পিতার আকস্মিক মৃত্যুর পরে বিধ্বস্ত নরেন্দ্রনাথ সারাক্ষণ কঠিন শিরঃপীড়ায় কাবু–যন্ত্রণামুক্তির জন্য তিনি ঘনঘন কর্পূরের ন্যাস নিচ্ছেন। এই শিরঃপীড়া উচ্চ রক্তচাপের আদি লক্ষণ কি না তা এতদিন পরে কে বলতে পারে?

নরেন্দ্রনাথের পিতৃবিয়োগের পর থেকে মহাসমাধি পর্যন্ত প্রায় দু’দশক বিভিন্ন রোগভোগের খবর বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করা যাক। শেষ দিকে প্রিয় শিষ্য স্বামী বিরজানন্দকে মায়াবতীতে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার অভিজ্ঞতা দেখে শেখ। অত কষ্ট করে শরীরটাকে মাটি করিস না। আমরা শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি। তার ফল হয়েছে কি?–না জীবনের যেটা সবচেয়ে ভাল সময়, সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে। আর আজ পর্যন্ত তার ঠেলা সামলাচ্ছি।”

কলম্বো থেকে প্রথম প্রবাস সম্পূর্ণ করে মাদ্রাজে ফিরে এলেন বিবেকানন্দ, সেখান থেকে জাহাজে চড়লেন কলকাতার উদ্দেশে। শরীর তখন ভাঙতে শুরু করেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ তিনি নিজেই লিখছেন, “আমি এখন মৃতপ্রায়…আমি ক্লান্ত–এতই ক্লান্ত যে যদি বিশ্রাম না পাই, তবে আর ছ’মাসও বাঁচব কি না সন্দেহ।”

বলাবাহুল্য এই সময়েই তার ডায়াবিটিস ধরা পড়ে। স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য কৃষ্ণলাল মহারাজের স্মৃতিচিত্র থেকে আমরা জানতে পারি স্বামীজির ডায়াবিটিস সায়েবডাক্তারদের চোখ এড়িয়ে গেলেও প্রথম ধরা পড়ে কলম্বোয়। তখনও ডায়াবিটিসের ইনসুলিন আবিষ্কার হয়নি। ডাক্তারদের পরামর্শ–প্রতিকার চাইলে নিয়মিত খাওয়াদাওয়া এবং গভীর চিন্তা থেকে বিরতি প্রয়োজন।

বিভিন্ন সময়ে স্বামীজি যেসব অসুখে আক্রান্ত হয়েছিলেন তার একটা তালিকা তৈরি করলে একনজরে এইরকম দাঁড়ায় :

• শিরঃপীড়া

• টনসিল

• সর্দিকাশি

• হাঁপানি

• টাইফয়েড

• ম্যালেরিয়া

• নানাবিধ জ্বর

• লিভার সংক্রান্ত ব্যাধি

• বদহজম ও অন্যান্য পেটের গোলমাল

• উদরী বা পেটে জল হওয়া

• ডায়ারিয়া

• ডিসপেপসিয়া

• পাথুরি

• লাম্বেগো বা কোমরের ব্যথা

• ঘাড়ে ব্যথা।

• ব্রাইটস ডিজিজ

• কিডনির গোলযোগ

• ড্রপসি–শোথ বা পা ফোলা

• অ্যালবুমিনিউরিয়া

• রক্তাক্ত চক্ষু

• একটি চোখে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা

• নিদ্রাহীনতা

• অকালে চুল দাড়ি সাদা হয়ে যাওয়া

• স্নায়ু রোগ–নিউরোসথেনিয়া

• রাত্রে খাবার পর প্রচণ্ড গরম অনুভব করা

• গরম সহ্য করতে না পারা

• অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়া

• সমুদ্রযাত্রা ব্যাধি বা সি-সিকনেস

• সান স্ট্রোক

• ডায়াবিটিস

• হৃদরোগ।

বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং স্মৃতিকথায় এইসব রোগের যৎসামান্য অথবা বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। ভাবতে আশ্চর্য লাগে এতো শারীরিক যন্ত্রণা নিয়েও তিনি কেমনভাবে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় এতো অল্পসময়ের মধ্যে এমন সব অবিশ্বাস্য কাজ করে গেলেন যা বহুযুগ ধরে মানুষের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। যাঁরা সামান্য শারীরিক যন্ত্রণায় ব্যাকুল হয়ে কর্মবিরতির আবেদন জানান, তাঁদের কাছে স্বামীজির শরীর ও ধৈর্য এক দুয়ে রহস্য।

ব্যাধি যত মারাত্মকই হোক, অসামান্য মনোবলের অধিকারী বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন, রোগকে প্রশ্রয় দিলে তার আরদ্ধ কাজগুলো কোনোদিন সম্পূর্ণ হবে না। কিন্তু তাকে নিয়ে প্রিয় সন্ন্যাসীভ্রাতাদের সারাক্ষণের দুশ্চিন্তা।

.

১৮৯৭ সালে ২০ মে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে আলমোড়া থেকে বিবেকানন্দ যা লেখেন তা আমাদের চোখ খুলে দেয়। বুঝতে পারা যায় এই পৃথিবীতে মৃত্যুঞ্জয়ী হতে গেলে কী ধরনের মানসিকতা প্রয়োজন।

স্বামীজি তার প্রিয় গুরুভ্রাতাকে লিখছেন : “তুমি ভয় পাও কেন? ঝট করে কি দানা মরে? এই তত বাতি জ্বলল, এখনও সারারাত্রি গাওনা আছে। আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, জ্বরভাবগুলো সব ওই লিভার–আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা, ওকেও দুরস্ত বানাচ্ছি–ভয় কি?”

দু’মাস পরে স্বামী অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি আবার লিখছেন, “আমিও ‘ফের লেগে যা’ আরম্ভ করেছি। শরীর তো যাবেই, কুঁড়েমিতে কেন যায়? মরচে পড়ে মরার চেয়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরা ঢের ভাল। মরে গেলেও হাড়ে ভেল্কি খেলবে। তার ভাবনা কি?”

যে অসুখটি প্রায় সারাজীবন স্বামীজিকে যথেষ্ট বিব্রত করেছে তার গেরস্ত নাম পেটের অসুখ। এই অসুখের শুরু শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর বরানগরের সন্ন্যাসজীবনে। এই সময়ে আজীবন সযত্নে লালিত নরেন্দ্রনাথের জীবনযাত্রার আমূল পরিবর্তন হয় এবং সেই সুযোগে নানা রকমের ব্যাধি তাকে আক্রমণ শুরু করে। কখনও রাজকীয় সুখ এবং কখনও চরম দারিদ্র্য–এই বিরতিহীন ওঠানামা বিবেকানন্দর নজর এড়ায়নি।

দ্বিতীয়বার বিদেশযাত্রার সময় মানসকন্যা নিবেদিতাকে তিনি জাহাজে বলেছিলেন, “আমার মতো মানুষেরা চরমের সমষ্টি। আমি প্রচুতম খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি! ইন্দ্রিয়দমনে আমার এত ক্ষমতা, অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি; নচেৎ দমনের মূল্য কোথায়!”

এই বৈপরীত্য সম্বন্ধে স্বামীজি আরও একবার নিবেদিতাকে চিঠি লিখেছিলেন নিউইয়র্ক থেকে : “এ জাতীয় স্নায়ুপ্রধান শরীর কখনও বা মহাসঙ্গীতসৃষ্টির উপযোগী যন্ত্রস্বরূপ হয়, আবার কখনও বা অন্ধকারে কেঁদে মরে।”

জ্বর ও পেটের গোলমালের ইতিবৃত্ত লিখতে গেলে সব দায়ই বরানগর মঠকে দেওয়া বোধ হয় যুক্তিযুক্ত হবে না।

স্বামী গম্ভীরানন্দ তার যুগনায়ক বিবেকানন্দ বইতে স্পষ্ট বলেছেন, এফ এ পড়ার সময় প্রথম বর্ষের শেষে ছাত্র নরেন্দ্রনাথ “ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হইয়া যথানিয়মে কলেজে আসিতে পারিতেন না; কাজেই নিয়মানুসারে বৎসরে যতদিন উপস্থিত থাকা আবশ্যক, তাহা সম্ভব হইল না এবং যথাকালে এফ এ পরীক্ষার অনুমতিপ্রাপ্তির বিষয়ে গোল বাধার সম্ভাবনা দেখা গেল।”

এর কিছুদিন পরেই ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ প্রিয় নরেনের শরীরের লক্ষণ পরীক্ষা করে বলেছিলেন, “তোর শরীরের সকল স্থানই সুলক্ষণাক্রান্ত, কেবল দোষের মধ্যে নিদ্রা যাইবার কালে নিঃশ্বাসটা কিছু জোরে পড়ে। যোগীরা বলেন, অত জোরে নিশ্বাস পড়িলে অল্পায়ু হয়।”

বরানগরের কঠিন কঠোর দৃশ্যগুলি ভাবীকালের জন্য অত্যন্ত স্পষ্টভাবে আঁকা রয়েছে। দুর্ভাবনা ও অনাহারের ফলে, ১৮৮৭ সালের গ্রীষ্মের প্রারম্ভে, নরেন্দ্রনাথের এক উৎকট পীড়া হইল। জ্বর-বিকার বড় ভয়ের কারণ হইয়া উঠিল। ভিতরকার বড় ঘরটিতে একটি বিছানায় তাহাকে রাখা হইয়াছে; শুইয়া আছেন। চন্দ্র ডাক্তার আসিয়া ঔষধ দিয়া যাইতেছেন।…বলরামবাবু নরেন্দ্রনাথের মাতাকে সংবাদ দেওয়ায় তিনি নরেন্দ্রনাথের এক ভ্রাতাকে সঙ্গে লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। নরেন্দ্রনাথের কিছু জ্ঞান আছে কখনও নিস্তব্ধ–অর্ধ-অজ্ঞান অবস্থায় বলিতেছেন, এখানে কেন স্ত্রীলোক ঢুকিতে দিলে? আমিই নিয়ম করলুম, আর আমার বেলায়ই নিয়ম রদ হল? বড্ড গায়ের জ্বালা, রাত্রে ব্যামো বৃদ্ধি হইল, নরেন্দ্রনাথের নাড়ীও একটু খারাপ হইল, বাবুরাম মহারাজ আর চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া উচ্চৈস্বরে কাঁদিয়া উঠিলেন। নরেন্দ্রনাথ জোর করে…অস্পষ্টস্বরে বলিতে লাগিলেন…”কাঁদিস না, আমি এখন মরব না। তুই ভয় করিসনি। আমায় ঢের কাজ করতে হবে, আমি কাজগুলো যেন চোখে দেখতে পাচ্ছি, মরবার সময় নেই।”

এই বরানগরপর্বেই নরেন্দ্রনাথের ‘গ্রেভেল স্টোন বা পাথুরির ব্যারাম ধরা পড়ে, তিনি কিছুদিন মাতুলালয়ে এসে থাকতে বাধ্য হলেন। চিকিৎসা করতে এলেন ডাঃ রাজেন্দ্রলাল দত্ত। অবিশ্বাস্য হলেও জেনে রাখুন এই। বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ রোগী দেখতে যাবার সময় উপহার হিসেবে কিছু খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতেন। নরেনের জন্যে তিনি নতুন বাজার থেকে মস্ত একটা বেল নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় নরেন্দ্রনাথ যন্ত্রণামুক্ত হন।

বরানগরে নরেন্দ্রর তৃতীয় অসুখ পেটে। “কিছুই হজম হয় না, অনবরত পেট নামাইতেছে।” স্বামী সারদানন্দ তার বাবার ওষুধের দোকান থেকে এক শিশি ‘Fellows Syrup’ নরেনের দিদিমার বাড়িতে দিয়ে গেলেন। বৈকুণ্ঠ সান্যাল মশায় এনেছিলেন নতুন বাজার থেকে এক হাঁড়ি মাগুরমাছ।

১৮৮৭ সালের মে-জুন মাসে নরেন্দ্রনাথের আর এক রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছেটাইফয়েড ব্যামো।

মহেন্দ্রনাথ দত্ত বরানগরে নরেনের উদরাময় রোগের কারণ হিসেবে বলেছেন, তার মাংস খাওয়ার অভ্যাস ছিল, কিন্তু সাধু হয়ে মুষ্টিভিক্ষার অন্ন এবং অনিশ্চিত অন্ন আহারে শরীর ভেঙে পড়ে।

ভক্ত বলরাম বসু এই সময় নরেনকে দু-একদিন নিজের বাড়িতে এনে রাখেন। রোগীর পথ্য মোটেই পছন্দ নয় নরেন্দ্রনাথের, তিনি ভাবিনী নামে কাজের মহিলাটিকে গোপনে রুটি ও কুমড়োর ছক্কা তৈরি করতে অনুরোধ করেন। “আশ্চর্যের বিষয় এই যে ভক্তিমতী ভাবিনীর রুটি খাইয়া তাহার উদরাময় রোগ তখনকার মত ভাল হইয়াছিল।”

এই পর্বের আরও দুটি অসুস্থতা সংবাদ আমরা পাই নরেন্দ্রনাথের রচনা থেকে। গিরিশচন্দ্র ঘোষের ভাই অতুলবাবুর বাড়িতে বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার সালজার এসেছিলেন।

“নরেন্দ্রনাথের তখন গলার আলজিভ ফুলিয়াছিল এবং এই ব্যাধিটি তাহার আত্মীয়দের সকলেরই আছে।…ডাক্তার সালজার বলিলেন, ‘ঔষধের কোন আবশ্যক নাই, ঠাণ্ডা জল দিয়া কুলকুচি করিবে এবং গলায় ঠাণ্ডা জল লাগাইবে।নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে শাস্ত্র আলোচনায় ডাক্তার এতোই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কাজকর্ম ভুলে তিন-চারঘণ্টা সময় ব্যয় করেছিলেন। বলাবাহুল্য টনসিলসমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে পরিব্রাজক জীবনে উত্তর ভারতের বিখ্যাত ডাক্তার দিল্লির হেমচন্দ্র সেনকে একই বিষয়ে চিকিৎসা করতে হয়েছিল।

বরাহনগর-পর্বে পেটের অসুখের সমস্যা যে চিন্তার কারণ হয়েছিল তার প্রমাণ, কেউ কেউ রোগ আয়ত্তে আনবার জন্য নরেন্দ্রনাথকে অল্প পরিমাণে অফিম খেতে বললো। “তাহাতে শরীরের বড় যন্ত্রণা হয়। অতুলবাবু আফিমের কথা শুনিয়া অত্যন্ত চঞ্চল হইয়া পড়িলেন এবং কয়েকদিন ধরিয়া বলিতে লাগিলেন, এরা কি কচ্ছে, নরেন্দ্রনাথকে আফিম খাওয়ান শেখাচ্ছে? এমন তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোকটাকে নষ্ট করবে।”

.

পত্রাবলীর প্রথম দিকে স্বামীজি তার বিভিন্ন চিঠিতে যেসব শারীরিক সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে জ্বর ও পেটের গোলমালই প্রধান।

নতুন একটি উপসর্গ কোমরের ব্যথা। ১৮৮৯-এর গোড়ায় বরাহনগর থেকে বারাণসীতে প্রমাদাস মিত্রের কাছে লেখা চিঠি থেকে আমরা কামারপুকুর যাবার পথে বিবেকানন্দর অসুস্থতার ইঙ্গিত পাই। ”গুরুদেবের উক্ত গ্রামে যাইবার পথে অত্যন্ত জ্বর হইল ও তৎপরে কলেরার ন্যায় ভেদবমি হইয়াছিল। তিন চারিদিনের পর পুনরায় জ্বর হইয়াছে; এক্ষণে শরীর এ প্রকার দুর্বল যে দুই কদম চলিবার সামর্থ্যও নাই…আমার শরীর এপথের নিতান্ত অনুপযুক্ত।”

প্রমদাদাসবাবুকে লেখা পরের চিঠিতে (মার্চ ১৮৮৯) জানা যাচ্ছে, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা চলছে, কিন্তু “শরীর এক্ষণে অত্যন্ত অসুস্থ, মধ্যে মধ্যে জ্বর হয়, কিন্তু প্লীহাদি কোন উপসর্গ নাই।”

কয়েকমাস পরে (আগস্ট ১৮৮৯) প্রমদাবাবুকে স্বামীজি আবার চিঠি লিখলেন…”পুনরায় জ্বর হওয়ায় উত্তরদানে অসমর্থ ছিলাম…মধ্যে মাস দেড়েক ভাল ছিলাম, কিন্তু পুনরায় ১০/১২ দিন জ্বর হইয়াছিল, এক্ষণে ভাল আছি।” চারমাস পরে (ডিসেম্বর ১৮৮৯) বৈদ্যনাথ থেকে চিঠি: “শরীর বড় ভাল নহে–বোধহয় লৌহাধিক্যের জন্য।”

পরিব্রাজকরূপে গাজীপুরে এসে পরের বছরের জানুয়ারি মাসে স্বাস্থ্যের ভাল রিপোের্ট। “…যে কয়টি স্থান দেখিয়া আসিয়াছি, তন্মধ্যে এইটি স্বাস্থ্যকর। বৈদ্যনাথের জল বড় খারাপ, হজম হয় না…কাশীতে যে ক’দিন ছিলাম দিনরাত জ্বর হইয়া থাকিত–এত ম্যালেরিয়া।”

কিন্তু পরের মাসেই (ফেব্রুয়ারি ১৮৯০) স্বামীজির নতুন শারীরিক উপসর্গ। “লাম্বেগো (কোমরের ব্যথা) বড়ই ভোগাইতেছে, নহিলে ইতিপূর্বেই যাইবার চেষ্টা দেখিতাম।”

এপ্রিল-এর শুরুতেই (১৮৯০) পরিস্থিতি যে ভাল নয় তার ইঙ্গিত গাজীপুর থেকে অভেদানন্দকে লেখা স্বামীজির চিঠিতে–”কোমরের বেদনাটা কিছুতেই সারে নাক্যাডাভারাস (জঘন্য)।”

মে মাসে স্বামীজি বরানগরে ফিরে এসেছেন। কাশীতে প্রমাদাসবাবুকে চিঠি, “পুনরায় জ্বর হওয়ায় আপনাকে পত্র লিখিতে পারি নাই।”

এই প্রমদাদাস মিত্র ছিলেন স্বামীজির খুব কাছের লোক। স্বামীজির পারিবারিক অবস্থার কথা জেনে তিনি সবিনয়ে সামান্য অর্থ সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। স্বামীজির উত্তর : “আপনি ২০ টাকার এককেতা নোট পাঠাইয়াছিলেন। আপনি অতি মহৎ; কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, মহাশয়ের প্রথমোদ্দেশ্য পালনে আমার মাতা ভ্রাতাদির সাংসারিক অহংকার প্রতিবন্ধক হইল; কিন্তু দ্বিতীয় উদ্দেশ্য আমি আমার কাশী যাইবার জন্য ব্যবহার করিয়া চরিতার্থ হইব।”

বহু বছর পরে শেষবার কাশীধাম পরিদর্শনের সময় প্রমদাদাস মিত্রর পুত্র কালিদাস মিত্র এসেছিলেন বিবেকানন্দকে দেখতে। সেই সাক্ষাৎকারটি মর্মস্পর্শী। স্বামীজি বেশ অসুস্থ, ডায়াবিটিসে কষ্ট পাচ্ছেন। তার গায়ে একটা সোয়েটার ও পায়ে একজোড়া গরম মোজা। তিনি সামনের তাকিয়ায় হাত রেখে বাঁকাভাবে বসে আছেন এবং অতি কষ্টে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন।

স্বামীজি বললেন, “শরীরটা ভগ্ন, বড় কষ্ট পাচ্ছি।” কালিদাসবাবুর প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি আরও বললেন, “কি ব্যারাম তা বলতে পারি না। প্যারিসে ও আমেরিকায় অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, তারা রোগ নির্ণয় করতে পারেন নি, ব্যাধিরও প্রতিকার বা উপশম করতে পারেননি।”

স্বামীজি যখন জ্বর ও ডিসপেপসিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে প্রবলবিক্রমে নিজের অসম্পূর্ণ কাজ করে যাচ্ছেন তখন একবার রসিকতা করেছিলেন, “আমার অধিকাংশ রোগ পেটে। পেটের রোগগ্রস্ত লোকরা কি প্রায় নিরুৎসাহ ও বৈরাগ্যবান হয়?” সন্দেহটা যে সব সময় সত্য নয় তার চলমান প্রমাণ তিনি নিজেই। শরীর, বিশেষ করে পেটকে নো তোয়াক্কা করেই তিনি টোটো করে সমস্ত ভারত চষে বেড়িয়েছে।

আরও আশ্চর্য ব্যাপার যে মানুষ পেটের রোগকে কিছুতেই আয়ত্তে আনতে পারছেন না এবং শরীরের এই অবস্থা মনে রেখে খেতড়ির মহারাজা যাঁকে আমেরিকা যাবার সময় উচ্চ শ্রেণীর টিকিট কিনে দিলেন, তিনিই জাহাজ থেকে খেতড়িকে চিঠি লিখেছিলেন, “আগে দিনে লোটা হাতে করে ২৫ বার পায়খানা যেতে হত, কিন্তু জাহাজে আসা অবধি পেটটা বেশ ভাল হয়ে গেছে, অতবার আর পায়খানায় যেতে হয় না।” প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণেরও পেটের ব্যারাম ছিল, ভুগে ভুগে একসময় দু’খানা হাড় হয়ে গিয়েছিলেন।

জাতীয় স্বাস্থ্যের ওপর ডিসপেপসিয়া রোগের প্রতিক্রিয়া নিয়ে স্বামীজির বিরামহীন ভাবনাচিন্তা ছিল।

শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। তাঁকে স্বামীজি বলেছিলেন, “শুনেছি, পূর্ববাংলার পাড়াগেঁয়ে লোকে অম্বলের ব্যারাম কাকে বলে তা বুঝতেই পারে না।” শিষ্য : “আজ্ঞে হ্যাঁ, আমাদের দেশে অম্বলের ব্যারাম বলিয়া কোন ব্যারাম নাই। এদেশে এসে এই ব্যারামের নাম শুনিয়াছি। দেশে দু’বেলাই মাছ ভাত খাইয়া থাকি।”

স্বামীজি; “তা খুব খাবি। ঘাসপাতা খেয়ে যত পেটরোগা বাবাজীর দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে।…ওসব মহাতমোগুণের…। তমোগুণের লক্ষণ : হচ্ছে আলস্য, জড়তা, মোহ, নিদ্রা এইসব।”

আর একবার একটি রোগা ছেলেকে প্রশ্ন করে স্বামীজি জানলেন সে ক্রনিক ডিসপেপসিয়ায় ভুগছে। স্বামীজির মন্তব্য : “আমাদের বাংলা দেশটা বড় সেন্টিমেন্টাল কিনা, তাই এখানে এত ডিসপেপসিয়া।”

মার্কিন মুলুক থেকে ফেরার পরে আবার যে পেটের রোগ ফিরে এসেছিল তার যথেষ্ট ইঙ্গিত স্বামীজির বিভিন্ন চিঠিতে রয়েছে। একবার আলমোড়া থেকে (মে ১৮৯৮) স্বামী ব্রহ্মানন্দকে তিনি লিখেছিলেন, “আমার শরীর অপেক্ষাকৃত অনেক ভাল, কিন্তু ডিসপেপসিয়া যায় নাই এবং পুনর্বার অনিদ্রা আসিয়াছে। তুমি যদি কবিরাজী একটা ভাল ডিসপেপসিয়ার ওষুধ পাঠাও তত ভাল হয়।”

*

পরিব্রাজক জীবনের অন্যান্য অসুখবিসুখগুলোর কথা এবার ঝটপট সেরে নেওয়া যেতে পারে।

কামারপুকুরে যাবার পথে স্বামীজির জ্বর ও ভেদবমির কথা আমরা জানি। ফিরে এসে বরানগরে তার প্রায়ই জ্বর আসত। তখন শিমুলতলায় যান, সেখানে গ্রীষ্মের আতিশয্যে উদরাময় হয়।

এরপরে ১৮৯০ সালে স্বামীজি গাজীপুরে যান পওহারী বাবার সন্ধানে। ইনি থাকতেন গঙ্গার ধারে এক দীর্ঘ সুড়ঙ্গের মধ্যে, আহার করতেন একমুঠো নিমপাতা অথবা গোটা কয়েক লঙ্কা। এইসময় দুমাস ধরে স্বামীজি কোমরের ব্যথায় ভোগেন। একই সঙ্গে তিনি যে পেটের অসুখে কষ্ট পাচ্ছেন তা কারও অজানানয়।ভিক্ষালব্ধ খাদ্য তাঁর বোধহয় সহ্য হতোনা। তবে বাসস্থানে প্রচুর লেবু গাছ থাকায় তিনি যথেষ্ট লেবু খেতেন।

আলমোড়া থেকে বদরীনারায়ণের পথে, সলড়কাড় চটিতে স্বামীজি ও তার সহযাত্রী অখণ্ডানন্দ একই সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামীজির জ্বর এবং অখণ্ডানন্দের কাশি। সেবার তার যাত্ৰাসঙ্গী ছিলেন সারদানন্দ অখণ্ডানন্দ, কৃপানন্দ ও একজন মালবাহক।

পরিব্রাজক স্বামীজির পরবর্তী রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে হৃষীকেশে। ওই জায়গাটি তখন ছিল ম্যালেরিয়ার অবাধ বিচরণ ভূমি। কাছাকাছি কোনো ডাক্তারও ছিলনা। স্বামীজি জ্বরে পড়লেন এবংযথাসময়ে তাবিকারে পরিণত হয়। চিকিৎসার অভাবে জীবনসংশয়।স্বামীগম্ভীরানন্দের রচনায় আমরা এই অবস্থার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা পাই : “সেদিন ক্রমাগত ঘর্মনিঃসরণের পর শরীর হিম হইয়া নাড়ী ছাড়িয়া গেল–যেন অন্তিমকাল উপস্থিত।” একজন অচেনা সাধু থলি থেকে কিঞ্চিৎমধু ও পিপুলচূর্ণ একত্রে মাড়িয়া রোগীকে ধীরে ধীরে খাওয়ালেন। “অমনি আশ্চর্য ফল ফলিল, স্বামীজি ক্ষণকালের মধ্যে চক্ষু মেলিয়া অস্পষ্টস্বরে কি যেন বলিতে লাগিলেন।”

এরপর মীরাট। অসুস্থ অখণ্ডানন্দকে দেখতে তিনি ডাক্তার ত্রৈলোক্যনাথ ঘোষের বাড়িতে গেলেন। স্বামীজি তখন খুব রোগা হয়ে গিয়েছেন। তাঁর রোগজীর্ণ শরীর দেখে অখণ্ডানন্দ চিন্তিত : “স্বামীজিকে এত রুগ্ন আমি কখনও দেখিনি, ঠিক যেন একখানি ছায়ামূর্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। মনে হয়েছিল তিনি যেন তখনও হৃষীকেশের সাংঘাতিক পীড়া থেকে উদ্ধার পাননি।”

নিজের চিকিৎসার জন্যও স্বামীজি দিন পনেরো ডাঃ ত্রৈলোক্যনাথ ঘোষের আশ্রয়ে থেকে গেলেন। জ্বরের প্রতিক্রিয়া ও পুনরাবির্ভাব প্রতিরোধের জন্য স্বামীজি তখন নিয়মিত ওষুধ খেতেন। ঠিক কতদিন মীরাটে থাকা হয়েছিল তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে, কারও মতে কয়েক সপ্তাহ, কারও ধারণা তিন মাসের অধিক কাল–অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথার মতে চার-পাঁচমাস। ১৮৯১ সালের জানুয়ারিতে স্বামীজি মীরাট ছেড়ে দিল্লির পথে অগ্রসর হলেন। এখানেই ডাক্তার হেমচন্দ্র সেনের কাছে। টনসিলের চিকিৎসা করানো প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

দেশে দেশে ঘুরতে ঘুরতে রাজস্থানের আলোয়ারে এসে একজন বাঙালি ডাক্তারের সঙ্গে স্বামীজির আকস্মিক পরিচয় হয়, এঁর নাম গুরুচরণ লস্কর।

ডাক্তার লস্করই স্বামীজির থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখানেই এক মন্ত্রশিষ্য স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করেন, “তেল মাখার কি কোন উপকার আছে?”

স্বামীজি উত্তর দিলেন, “আছে বই কি! এক ছটাক তেল ভাল করে মাখলে এক পোয়া ঘি খাওয়ার কাজ করে।”

অনেক পথ পেরিয়ে মাণ্ডবীতে স্বামীজির সঙ্গে স্বামী অখণ্ডানন্দের আবার দেখা হলো। ততক্ষণে স্বামীজির স্বাস্থ্যের যে বিশেষ উন্নতি হয়েছে তা অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।

অখণ্ডানন্দ দেখলেন, স্বামীজি যেন এক অপরূপ নবকলেবর প্রাপ্ত হয়েছেন। “তিনি রূপলাবণ্যে ঘর আলো করে বসে আছেন।”

.

ডাক্তারি সম্পর্কে স্বামীজির কিছু মতামত পাওয়া যাচ্ছে বেলগাঁওয়ের ফরেস্ট অফিসার হরিপদ মিত্রর বাড়িতে।

হরিপদবাবু স্বাস্থ্যের জন্য অনেকরকম ওষুধ খাচ্ছেন জেনে স্বামীজি বললেন, “যখন দেখিবে কোন রোগ এত প্রবল হইয়াছে যে শয্যাশায়ী করিয়াছে, আর উঠিবার শক্তি নাই, তখনই ওষুধ খাইবে, নতুবা নহে। স্নায়বিক দুর্বলতা প্রভৃতি রোগের শতকরা নব্বইটা কাল্পনিক…যতদিন বাঁচ আনন্দে কাটাও।”

চিকিৎসা সম্পর্কে স্বামীজির একটা স্পষ্ট মতামত পাওয়া যাচ্ছে, যদিও পরবর্তীকালে তিনি নিজেই স্নায়বিক রোগের বলি হয়েছিলেন।

অনেকদিন পরে স্যানফ্রানসিসকো থেকে ব্রহ্মানন্দকে (মার্চ ১৯০০) স্বামীজি লিখছেন, “আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া–এ স্নায়ু রোগ। এ একবার হলে বৎসরকতক থাকে। তবে দু-চার বৎসর একদম বিশ্রাম হলে সেরে যায়।…এদেশ ঐ রোগের ঘর। এইখান থেকে উনি ঘাড়ে চড়েছেন। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দূরে থাকুক দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্যে ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”

.

বোম্বাই থেকে জাহাজে অজানার সন্ধানে প্রথম আমেরিকা যাত্রা পর্যন্ত সময়কালে স্বামীজির স্বাস্থ্যের একটা ছবি কোনোরকমে উপস্থিত করা গেল। ১৮৯৩ সালে জুন মাসে জাহাজে তার অপ্রত্যাশিত স্বাস্থ্যোন্নতির খবরও আমরা পেয়ে যাচ্ছি খেতড়ির মহারাজা অজিত সিংকে লেখা চিঠি থেকে।

সৌভাগ্যবশত অপরিচিতপ্রবাসেজীবনসংগ্রামের প্রথম পর্যায়ে স্বামীজির বড়রকম অসুখবিসুখের কোনো ইঙ্গিত নেই। এই সময় শরীর বিদ্রোহ করলে তার মিশন অবশ্যই ব্যর্থ হতে পারতো। নানা পথ পেরিয়ে অপরিচিত দেশে সহায়সম্বলহীন সন্ন্যাসী যে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন তার পিছনে ছিল অপরিসীম মনোবল ও অমানুষিক পরিশ্রম। বিরামহীন এই শ্রম যে ভিতরে ভিতরে স্বামীজির শরীরকে আক্রমণ করছে তা প্রকট হতে কিছু সময় লেগেছিলো। এমন যে হতে পারে তা আশঙ্কা করেই বোধ হয় কর্মযজ্ঞে স্বামীজির তাড়াহুড়ো। পরবর্তীকালে হরিমহারাজকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) স্বামীজি বলেছিলেন, “২৯ বছরের মধ্যে সব সেরে নিয়েছি।”

কিন্তু আমরা জানি ১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ববিজয়টাই তার শেষ বড় কাজ এদেশে নয়, তার থেকেও সুদূরপ্রসারী কর্মযজ্ঞ স্বদেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এই কাজের গুরুত্ব ইউরোপ-আমেরিকা জয় থেকে অনেক বড়।

*

আমেরিকায় স্বামীজির শরীর ভাঙার প্রথম সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে ১৮৯৬ সালের শুরু থেকে নিউ ইয়র্কে। ১৮৯৫-এর বড়দিনেও তার ছিল দুর্ধর্ষ শরীর ও অমানুষিক পরিশ্রম করার ক্ষমতা। নববর্ষের চিঠিতে (মিসেস ওলি বুলকে লেখা) রয়েছে তার সমর্থন : “দৈহিক ও মানসিকভাবে আমি খুব ভাল আছি।”

কিন্তু স্বামীজির পরের চিঠিতেই (৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬) অশনিসংকেত। “আমার শরীর প্রায় ভেঙে পড়েছে। নিউ ইয়র্কে আসা পর্যন্ত আমি একরাতও ঘুমোতে পারিনি।”

এমন যে হতে পারে তা আশঙ্কা করছিলেন বিদেশী শিষ্য স্বামী কৃপানন্দ। তিনি লিখছেন, “দৈত্যর মতন পরিশ্রম করছেন বিবেকানন্দ, ঘরভাড়া, বিজ্ঞাপন, মুদ্রণ ইত্যাদির খরচ সামলাতে গিয়ে তিনি প্রায় না খেয়ে থাকছেন।” শিষ্যের আশঙ্কা স্বামীজি না অসুখে পড়ে যান।

নিষ্ঠুর আশঙ্কাটি সত্য হলো, ১৮৯৬ জানুয়ারি থেকেই স্বামীজির শরীর যখন ভাঙতে আরম্ভ করলো তখন তার বয়স মাত্র তেত্রিশ।

এই সময় একটা আজব কাণ্ড ঘটেছিল। মার্কিনী অনুরাগিণী ব্রুকলিন নিবাসিনী মিস্ এস ই ওয়ালডোকে স্বামীজি একবার বলেছিলেন, “এলেন, একটা অদ্ভুত কাণ্ড, আমি কেমন দেখতে তা আমি মনে রাখতে পারছি না, আমি আয়নার দিকে বারবাব তাকিয়ে থাকি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি মুখ ফিরিয়ে নিই, আমি কেমন দেখতে তা সম্পূর্ণ ভুলে যাচ্ছি।”রাল এমার্সনের আত্মীয়া এই নিষ্ঠাবতী শিষ্যাটির স্বামীজি নাম দিয়েছিলেন হরিদাসী।

মনে রাখা ভাল, ৬ ডিসেম্বর ১৮৯৫ স্বামীজি জাহাজযোগে ইউরোপ থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসেন। সমুদ্র যাত্রাটি মোটেই সুখকর হয়নি। ৮ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক থেকে স্বামীজির চিঠি : “দশদিন অতিবিরক্তিকর দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পর আমি গত শুক্রবার এখানে পৌঁছেছি। সমুদ্র ভয়ানক বিক্ষুব্ধ ছিল এবং জীবনে এই সর্বপ্রথম আমি সমুদ্রপীড়ায় অতিশয় কষ্ট পেয়েছি।”

নিউ ইয়র্কে ফিরে এসে দারুণ শীতে প্রায়ই সর্দিতে ভুগতে লাগলেন স্বামীজি। “আমার ঠাণ্ডা লেগেছে”–জানুয়ারির প্রবল ঠাণ্ডায় কে কারে ব্রুকলিন ব্রিজ বারবার পেরোতে হলে অসুখটা অস্বাভাবিক নয়।

.

১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসে আবার লন্ডনে ফিরে আসার পরে মেজভাই মহেন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়। তার যে এখানেই মৃদু হলেও হার্ট অ্যাটাক হয় তার বিবরণ আমরা যথাসময়ে বিশ্বস্ত সূত্র থেকে দেবো।

এবার জাহাজে সমুদ্রপীড়া এড়াবার জন্য আমি নিজেই কিছু চিকিৎসা করেছিলাম।”

লন্ডনে স্বামীজির বিচিত্র জীবনের নানা খবরাখবর পাঠক-পাঠিকারা এই বইয়ের শুরুতে ইতিমধ্যেই পেয়েছেন। আগস্ট মাসে কিছুটা ছুটি ও কিছুটা স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য স্বামীজি সুইজারল্যান্ডে উপস্থিত হয়েছেন।

সাবধানী পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন লুসার্ন থেকে স্বামীজি লিখছেন, “আমি বিশ্রী রকম সর্দিতে ভুগছি।”

মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাঁর চিন্তার শেষ নেই। মিস্টার ই টি স্টার্ডিকে স্বামীজি লিখছেন, “আশা করি রাজার কাছ থেকে মহিমের টাকা ইতিমধ্যেই তোমার জিম্মায় এসেছে। এসে থাকলেও আমি যে টীকা তাকে দিয়েছিলাম তা ফেরৎ চাই না। তুমি ওর সবটাই ওকে দিতে পার।”

১৬ই ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে সেবারের মতন পশ্চিমের পালা শেষ করে স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডন ত্যাগ করলেন এবং ১৫ জানুয়ারি ১৮৯৭ কলম্বো পৌঁছলেন।

সিংহলে বিপুল অভ্যর্থনার স্রোতে এবং অবিরাম পথশ্রমে স্বামীজি যে অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন এবং তা যে ডায়াবিটিসের লক্ষণ তা যথাসময়েই জানা গেল। তার এই রোগ কোথায় প্রথম ধরা পড়লো? কলম্বো, মাদ্রাজ না কলকাতায় তা আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়। আমরা শুধু দেখছি, মাদ্রাজ থেকে জাহাজে কলকাতা আসবার সময় ডাক্তাররা তাঁকে জলের বদলে ডাব খাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং সে জন্য জাহাজে প্রচুর ডাব তুলে দিয়েছিলেন অনুরাগীরা। সত্য কথাটি হলো স্বামীজি ভাঙা শরীর নিয়েই কলকাতায় ফিরে এসেছিলেন।

.

ভগ্নস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৯৬ সালের প্রারম্ভকেই অন্তিমলীলাপর্বের শুরু বলাটা বোধ হয় অন্যায় হবে না। এই পর্বের তিনটি অধ্যায়, যার প্রথমটির বিস্তার স্বামীজির স্বদেশে অবস্থিতি পর্যন্ত, দ্বিতীয় পর্যায়ের বিস্তৃতি দ্বিতীয়বার বিদেশ গমন থেকে আকস্মিক আবার ভারতে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত। তৃতীয় পর্যায়ের শেষপ্রান্তে বেলুড়ে ৪ঠা জুলাই ১৯০২ এ মহাসমাধি।

১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৮৯৭ স্বামীজি কলকাতায় ফিরে এলেন আর ডাক্তারদের পরামর্শে ৮ই মার্চ তাকে দার্জিলিং যেতে হলো। এই সময় স্বামীজির গরম একেবারেই সহ্য হচ্ছে না। এর আগেও তিনি প্রচণ্ড গরমকে এড়িয়ে শরীর বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

প্রচণ্ড গরমে তার মাথার ঘিলু যে টগবগ করে ফোটে একথা তিনি আগেই লিখেছেন। দার্জিলিঙে প্রথম দিকে স্বাস্থ্যপরিস্থিতি যে খুব উদ্বেগজনক নয় তার প্রমাণ স্বামীজি খেতড়ির রাজা অজিত সিংকে দেখবার জন্য ২১ মার্চ কলকাতায় ফিরে এলেন। মহারাজ অজিত সিং কলকাতা ত্যাগ করেন ২৬ মার্চ এবং স্বামীজি সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিঙে ফিরে যান।

মেরি হেলকে দার্জিলিঙের চিঠি (২৮ এপ্রিল ১৮৯৭), “আমার চুল গোছ গোছ পাকতে আরম্ভ করেছে এবং মুখের চামড়া অনেক কুঁচকে গেছে–দেহের এই মাংস কমে যাওয়াতে আমার বয়েস যেন আরও কুড়ি বছর বেড়ে গিয়েছে। [এই সময় স্বামীজির বয়স ৩৪] এখন আমি দিন দিন ভয়ঙ্কর রোগা হয়ে যাচ্ছি, তার কারণ আমাকে শুধু মাংস খেয়ে থাকতে হচ্ছে–রুটি নেই, ভাত নেই, আলু নেই, এমনকি আমার কফিতে একটু চিনিও নেই!!…আমি এখন মস্ত দাড়ি রাখছি; আর তা পেকে সাদা হতে আরম্ভ হয়েছে–এতে বেশ গণ্যমান্য দেখায়।…হে সাদা দাড়ি, তুমি কত জিনিসই না ঢেকে রাখতে পারো! তোমারই জয় জয়কার।”

“ব্যারাম-ফ্যারাম দার্জিলিং-এ একেবারেই পালিয়েছে। কাল আলমোড়া নামক আর একটি শৈলাবাসে যাচ্ছি–স্বাস্থ্যোন্নতি সম্পূর্ণ করবার জন্য, কলকাতায় আলমবাজার মঠ থেকে মিসেস সারা বুলকে স্বামীজি চিঠি লিখছেন ৫ই মে ১৮৯৭।

আলমোড়া থেকে “অভিন্নহৃদয়” স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লেখা দু সপ্তাহ পরের চিঠি (২০ মে ১৮৯৭): “জ্বরভাবটা সব সেরে গেছে। আরও ঠাণ্ডা দেশে যাবার যোগাড় দেখছি। গরমি বা পথশ্রম হলেই দেখছি লিভারে গোল দাঁড়ায়।…আজকাল মেজাজটাও বড় খিটখিটে নাই, ও জ্বরভাবগুলো সব ঐ লিভার–আমি বেশ দেখছি। আচ্ছা, ওকেও দুরস্ত বানাচ্ছি–ভয় কি?”

কলকাতা থেকে প্রিয় শশী ডাক্তারের চিঠি ও দু বোতল ওষুধ এসে গিয়েছে। ২৯ মে শশী ডাক্তারকে স্বামীজির চিঠি : “যোগেন কি লিখছে, তা হৃক্ষেপ করবে না। সে নিজেও যেমন ভয়-তরাসে, অন্যকেও তাই করতে চায়। আমি লখনৌ-এ একটি বরফির ষোল ভাগের একভাগ খেয়েছিলাম; আর যোগেনের মতে ঐ হচ্ছে আমার আলমোড়ার অসুখের কারণ।”

এবার ১ জুন স্বামী শুদ্ধানন্দকে শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষায় লেখা চিঠি : “অব্যাহতবায়ুসেবনেন মিতেন ভোজনেন সমধিকব্যায়ামসেবয়া চ সুদৃঢ়ং সুদৃশ্যং চ সঞ্জাতং মে শরীর।” সেই সঙ্গে আশীর্বাদং বিবেকানন্দস্য। “মুক্তবায়ু সেবন, মিতাহার এবং যথেষ্ট ব্যায়ামের ফলে আমার শরীর বিশেষ সুদৃঢ় ও সুদৃশ্য হয়েছে।”

পরের দিন, ২রা জুন ১৮৯৭ ইংরিজিতে লেখা চিঠি মেরি হেলবয়েস্টারকে পুনরায় বিলেতে যাওয়া সম্পর্কে–”আমার চিকিৎসকরা এত শীঘ্র আমাকে কাজে নামতে দিতে নারাজ। কারণ ইউরোপে যাওয়া মানেই কাজে লাগা। তাই নয় কি? সেখানে ছুটি নিলে রুটি মেলে না। এখানে গেরুয়াকাপড়খানাই যথেষ্ট, অঢেল খাবার মিলবে।…নিদ্রা আহার ব্যায়াম এবং ব্যায়াম আহার নিদ্রা–আরও কয়েক মাস শুধু এই করে আমি কাটাতে যাচ্ছি।”

পরের দিনে জনৈক এক আমেরিকান ভক্তকে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট, স্বামীজি আবার অজীর্ণরোগে মাঝে মাঝে ভুগছে এবং তা সারাবার জন্যে “নিজের বিশ্বাস বলে রোগ সারানোর (ক্রিশ্চান সায়ান্স মত অনুযায়ী) বিশেষ চেষ্টাও করছি। দার্জিলিং-এ শুধু মানসিক চিকিৎসাসহায়েই আমি নীরোগ হয়েছিলাম।…যদি শেষপর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভেঙেই পড়ে, তাহলে এখানে কাজ একদম বন্ধ করে দিয়ে আমি আমেরিকায় চলে যাব। তখন আমাকে আহার ও আশ্রয় দিতে হবে–কেমন, পারবে তো?”

এদিকে ডায়াবিটিসের প্রকোপ বোধ হয় কমের দিকে। স্বামীজি এবার ব্রহ্মানন্দকে লিখছেন, “আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই…কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই; লিভারও ভাল। শশীর ঔষধে কি ফল হ’ল বুঝতে পারলাম না কাজেই বন্ধ।”

শরীরে নানা রোগের প্রকোপ, কিন্তু জর্জরিত বা পরাজিত নন আমাদের বিবেকানন্দ।

এই সময় তিনি যেসব বৈপ্লবিক কাজকর্মের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন তা আজও মানুষকে বিস্মিত করে। আলমোড়া থেকেই আপনজনদের কাছে যুগনায়ক পাঠাচ্ছেন তার মৃত্যুঞ্জয়ী বাণী, “হে মূর্খগণ, যে-সকল জীবন্ত নারায়ণে ও তাঁর অনন্ত প্রতিবিম্বে জগৎ পরিব্যাপ্ত, তাকে ছেড়ে তোমরা কাল্পনিক ছায়ার পিছনে ছুটেছ! তার–সেই প্রত্যক্ষ দেবতারই উপাসনা করো এবং আর সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।”

পরের দিনই (১০ জুলাই, ১৮৯৭) অভিন্নহৃদয় বন্ধু স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রথম দুর্ভিক্ষ সেবাকার্য “অতীব সুন্দর।…

ফিলসফি, যোগ, তপ, ঠাকুরঘর, আলোচাল, কলা মূলো–এসব ব্যক্তিগত ধর্ম, দেশগত ধর্ম; পরোপকারই সার্বজনীন মহাব্রত।”

সারাক্ষণই শরীরকে ডোন্টকেয়ার করে বিবেকানন্দ ভাবছেন তার প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের কথা। পরের দিনই স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখছেন, “এখন মনে হচ্ছে–মঠে অন্তত তিনজন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।”

আরও লিখছেন, “মঠ দর্শন করতে কেবল কলকাতার বাবুর দল আসছেন জেনে বড় দুঃখিত হলাম। তাদের দ্বারা কিছু হবে না। আমি চাই সাহসী যুবকের দল–যারা কাজ করবে; আহাম্মকের দল দিয়ে কি হবে?”

প্রিয় শিষ্যদের তিনি বলছেন, “তোমরা মনে রেখো, আমি আমার গুরুভাইদের চেয়ে আমার সন্তানদের নিকট বেশী আশা করি–আমি চাই, আমার সব ছেলেরা, আমি যতবড় হতে পারতাম, তার চেয়ে শতগুণ বড় হোক।”

মনে রাখতে হবে, স্বামীজি যখন এইসব চিন্তা করছেন, তখন তার “উঠতে বসতে হাঁপ ধরে…পূর্বে আমার দুইবার সর্দি-গরমি হয়, সেই অবধি রৌদ্র লাগিলেই চোখ লাল হয়, দুই তিনদিন শরীর খারাপ যায়।”

নিজের শরীরযন্ত্রণার কথা ভুলে স্বামীজি তাঁর গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দের শরীর নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন।”তোমার শরীরের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রাখবে-তবে বিশেষ আতুপুতুতে শরীর উল্টে আরও খারাপ হয়ে যায়।”

রোগভোগের কথা স্বামীজি একেবারেই মনে রাখতে চান না। কিন্তু মধ্যিখানের কিছু চিঠি থেকে বোঝা যাচ্ছে টনসিল, জ্বর ইত্যাদি কিছুতেই তাঁকে ছাড়তে রাজি নয়, যদিও “ধর্মশালা পাহাড়ে যাইয়া শরীর অনেক সুস্থ হইয়াছে।”

কাশ্মীর থেকে (৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৭) স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে স্বামীজি সুখবর পাঠাচ্ছেন, “এবার শরীর অনেক সুস্থ হওয়ায় পূর্বের ভাবে পুনরায় ভ্রমণ করিব, মনস্থ করিয়াছি।”

সেই সঙ্গে রয়েছে বিপুল আর্থিক দুশ্চিন্তা : “এদেশের লোক ত এখনও এক পয়সা গাড়িভাড়া পর্যন্ত দিলে না–তাহাতে মণ্ডলী লইয়া চলা যে কি কষ্টকর বুঝিতেই পার। কেবল ঐ ইংরেজ শিষ্যদের নিকট হাত পাতাও লজ্জার কথা। অতএব পূর্বের ভাবে কম্বলবন্ত’ হইয়া চলিলাম।”

কম্বলবন্ত অবশ্যই আবার চলমান! সন্ন্যাসী চষে বেড়াতে চাইছেন সমস্ত ভারতবর্ষ, কিন্তু রোগ কিছুতেই তাকে ছাড়তে রাজি নয়।

এই সময়ে স্বামীজির শারীরিক ছবিটা এই রকম : আলমোড়া থেকে কাঠগোদাম যাবার পথে অসুস্থ স্বামীজি একদিনের জন্যে বন্দী ভীমতালে। ৯ই আগস্ট ১৮৯৭ বেরিলী পৌঁছে আবার ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত জ্বরের বেশ প্রকোপ। কিন্তু ওই সময় হাতগুটিয়ে বসে না থেকে, স্বামীজি একের পর এক বক্তৃতা করছেন, আবার এরই মধ্যে আর্যসমাজের স্বামী অচ্যুতানন্দকে বলছেন, আর পাঁচ-ছ বছরের বেশি মরজগতে থাকবেন না।

১২ আগস্ট স্বামীজি আম্বালায় উপস্থিত। এবার জ্বর নয়, কিন্তু প্রবল উদর বেদনা। তাই নিয়েই দেড়ঘণ্টা হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতা করলেন স্বামীজি, কিন্তু অনাহারে রইলেন।

ধর্মশালার পথে অমৃতসরে স্বামীজি যে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন তার খবর আছে, বাধ্য হয়ে তিনি টাঙ্গা-গাড়িতে মারী-তে গেলেন। সেখানেও কিন্তু স্বামীজি শয্যাশায়ী হতে রাজি নন, ভগ্ন শরীর নিয়ে স্থানীয় গুণগ্রাহীদের অনেকক্ষণ ধরে ধর্মসঙ্গীত শোনালেন।

নিজেকে যখন তিনি তিলে তিলে ক্ষয় করছেন, সেই সময় স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখছেন (১১ অক্টোবর ১৮৯৭), “আজ দশ দিন পর্যন্ত সমস্ত কাজ যেন একটা ঝেকে করেছি বলে মনে হচ্ছে। সেটা শরীরের রোগ হোক বা মনেরই হোক। এক্ষণে আমার সিদ্ধান্ত এই যে, আমি আর কাজের যোগ্য নই।…তোমার উপর অত্যন্ত কটু ব্যবহার করেছি বুঝতে পারছি, তবে তুমি আমার সব সহ্য করবে জানি; ও মঠে আর কেউ নেই যে সব সইবে। তোমার উপর অধিক অধিক কটু ব্যবহার করেছি; যা হবার তা হয়েছে কর্ম! আমি অনুতাপ কি করব, ওতে বিশ্বাস নাই–কর্ম! মায়ের কাজ আমার দ্বারা যতটুকু হবার ছিল ততটুকু করিয়ে শেষ শরীর-মন চুর করে ছেড়ে দিলেন মা। মায়ের ইচ্ছা!..দু-একদিনের মধ্যে আমি সব ছেড়ে দিয়ে একলা একলা চলে যাব; কোথাও চুপ করে বাকী জীবন কাটাব। তোমরা মাপ করতে হয় করো, যা ইচ্ছা হয় করো।… আমি লড়াইয়ে কখনও পেছপাও হইনি; এখন কি…হবো? হার-জিত সকল কাজেই আছে; তবে আমার বিশ্বাস যে, কাপুরুষ মরে নিশ্চিত কৃমিকীট হয়ে জন্মায়। যুগ যুগ তপস্যা করলেও কাপুরুষের উদ্ধার নেই–আমায় কি শেষে কৃমি হয়ে জন্মাতে হবে?…আমার চোখে এ সংসার খেলামাত্র–চিরকাল তাই থাকবে। এর মান অপমান দুটাকা লাভলোকসান নিয়ে কি ছমাস ভাবতে হবে?…আমি কাজের মানুষ! খালি পরামর্শ হচ্ছে–ইনি পরামর্শ নিচ্ছেন, উনি দিচ্ছেন; ইনি ভয় দেখাচ্ছেন, তো উনি ডর! আমার চোখে এ জীবনটা এমন কিছু মিষ্টি নয় যে, অত ভয়-ডর করে হুঁশিয়ার হয়ে বাঁচতে হবে।…লড়াই করলুম কোমর বেঁধে–এ আমি খুব বুঝি; আর যে বলে কুছ পরোয়া নেই, ওয়া বাহাদুর, আমি সঙ্গেই আছি’..তাকে বুঝি, সে বীরকে বুঝি, সে দেবতাকে বুঝি।…তারাই জগৎপাবন, তারাই সংসারের উদ্ধারকর্তা। আর যেগুলো খালি বাপ রে এগিও না-ওই ভয়, ওই ভয় ডিসপেপটিকগুলো প্রায়ই ভয়তরাসে। তবে আমার মায়ের কৃপায় মনের এত জোর যে, ঘোর ডিসপেপসিয়া কখনো আমায় কাপুরুষ করতে পারবে না। কাপুরুষদের আর কি বলব, কিছুই বলবার নাই।”

মৃত্যুচিন্তার যে অবসান নেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে লাহোর থেকে ইন্দুমতী মিত্রকে লেখা চিঠিতে : “কলিকাতায় এক মঠ হইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারা জীবন দুঃখ কষ্টে কাজ করিলাম, সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়।”

একই দিনে (১৫নভেম্বর ১৮৯৭) স্বামীজি জানাচ্ছেন স্বামীব্ৰহ্মানন্দকে, “আমার শরীর বেশ আছে। তবে রাত্রে দু-একবার উঠিতে হয়। নিদ্রা উত্তম হইতেছে। খুব লেকচার করিলেও নিদ্রার ব্যাঘাত হয় না, আর এক্সারসাইজ রোজ আছে। ভাত তো আজ তিন মাস রোজ খাই, কিন্তু কোনও গোল নাই। এইবার উঠে-পড়ে লাগো।”

দশদিন পরেই স্বামীজি ডেরাডুন থেকে স্বামী প্রেমানন্দকে পুরনো ঘি পাঠাতে অনুরোধ করছেন, কারণ “ঘাড়ের একটা বেদনায় অনেকদিন যাবৎ ভুগিতেছি।” এই ঘি কোথা থেকে সংগ্রহ হবে? “হাবু, শরৎ (উকিল)-এর নিকট নিশ্চিত পাইবে।”

ঐ বছরের শেষ পর্বে আর একটি মাত্র রোগের খবর পাওয়া যাচ্ছে, দিল্লিতে স্বামীজি সর্দির প্রকোপ এড়াতে পারছে না।

.

আরও কয়েকটা মাস ঝপঝপ করে এগিয়ে যাওয়া যাক। স্বামীজি কাজের মাধ্যমে নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে ফেললেন। তিনি নিবেদিতাকে (২৫ আগস্ট ১৮৯৮) কাশ্মীর থেকে লিখছেন, “কাজের চাপে নিজেকে মেরে ফেলো না যেন। ওতে কোন লাভ নেই; সর্বদা মনে রাখবে কর্তব্য হচ্ছে যেন মধ্যাহ্ন সূর্যের মতো–তার তীব্র রশ্মি মানুষের জীবনী শক্তি ক্ষয় করে।”

এর আগে ১৭ জুলাই ১৮৯৮ শ্রীনগর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজির চিঠি, “যদি উত্তম ঘর হয় এবং যথেষ্ট কাঠ থাকে এবং গরম কাপড় থাকে, বরফের দেশে আনন্দ বই নিরানন্দ নাই। এবং পেটের রোগের পক্ষে শীতপ্রধান দেশ ব্রহ্মৌষধ।..আমার শরীর বেশ আছে। রাত্রে প্রায় আর উঠিতে হয় না, অথচ দু-বেলা ভাত আলু চিনি যা পাই তাই খাই। ওষুধটা কিছু কাজের নয়-ব্ৰহ্মজ্ঞানীর শরীরে ঔষধ ধরে না। ও হজম হয়ে যাবে কিছু ভয় নাই।”

কিন্তু ঠিক দুমাস পরে (১৭ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮) শ্রীনগর থেকে শ্রীযুক্ত হরিপদ মিত্রকে অবসন্ন স্বামীজির চিঠি মনকে বড় কষ্ট দেয়। “মধ্যে আমার শরীর অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়ায় কিঞ্চিৎ দেরি হইয়া পড়িল, নতুবা এই সপ্তাহের মধ্যে পঞ্জাবে যাইবার পরিকল্পনা ছিল।…ডাক্তার যাইতে নিষেধ করিতেছেন।”

মাত্র পঞ্চাশটি টাকার জন্য অসুস্থ স্বামীজি চিঠি লিখছেন হরিপদ মিত্রকে। অনুরোধ করছেন টেলিগ্রামে টাকা পাঠাতে। “আমার এখানকার সমস্ত খরচপত্র উক্ত আমেরিকান বন্ধুরা দেন এবং করাচি পর্যন্ত ভাড়া প্রভৃতি তাহাদের নিকট হইতেই লইব। তবে যদি তোমার সুবিধা হয়, ৫০ টাকা টেলিগ্রাম করিয়া ঋষিবর মুখোপাধ্যায়, চিফ জজ, কাশ্মীর স্টেট, শ্রীনগর এঁর নামে পাঠাইলে অনেক উপকার হইবে। কারণ সম্প্রতি ব্যারামে পড়িয়া বাজে খরচ কিছু হইয়াছে এবং সর্বদা বিদেশী শিষ্যদের নিকট টাকা ভিক্ষা করিতে লজ্জা করে।”

একই দিনে চিঠির মাধ্যমে খেতড়ির মহারাজা অজিত সিং-এর শরণাপন্ন হয়েছে স্বামীজি।”এখানে আমি দু’সপ্তাহ খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।… আমার কিছু টাকার টান পড়েছে।..অসুখ করলে খরচের বহর অনেক বেড়ে যায়। এই জগতে শুধু একজনের কাছেই আমার কিছু চাইতে লজ্জা হয় না এবং তিনি হলেন আপনি।”

.

ডায়াবিটিস, বিনিদ্রা এবং হার্টের ট্রাবল নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসে স্বামীজিকে বড় ডাক্তারের শরণ নিতে হলো। তার আর্থিক অবস্থা তখন কেমন তা আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি।

স্বামী ব্রহ্মানন্দ যে খ্যাতনামা ডাক্তার কে এল দত্তর চেম্বারে গেলেন ব্যবস্থার জন্য তা আমরা তার ডায়রি থেকে জানতে পারছি। ভিক্ষাজীবী সন্ন্যাসীকে সে যুগের বড় ডাক্তারকে কত দিতে হল তা সকলের জেনে রাখা ভাল। ওষুধের খরচ দশ টাকা, কিন্তু ফি বাবদ চল্লিশ টাকা! ১৮৯৮ সালের অক্টোবর মাসের চল্লিশ টাকা আজকের মূল্যায়নে কত টাকা তা আন্দাজ করতে অনুরোধ জানাই পাঠক-পাঠিকাদের।

স্বামীজির স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রিয় গুরুভাইরা হাতগুটিয়ে বসে থাকতে মোটেই রাজি নন। তারা বড় ডাক্তারের বড় কড়ি জমা দিয়ে, কবিরাজেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

কিন্তু ডাক্তারের বড় চিকিৎসাতে স্বাস্থ্যের উন্নতি না হওয়ায়, বায়ু পরিবর্তনের জন্য স্বামীজি ১৯ ডিসেম্বর ১৮৯৮ ব্রহ্মচারী হরেনকে নিয়ে দেওঘরে গেলেন। কলকাতায় ফিরে আসেন ২২ জানুয়ারি ১৮৯৯। দেওঘরে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভবনে হাঁপানির প্রবল আক্রমণে স্বামীজির জীবন সংকটাপন্ন।

যুগনায়ক বিবেকানন্দ গ্রন্থে স্বামী গম্ভীরানন্দের সংযোজন : “সময় সময় এত শ্বাসকষ্ট হইত যে মুখ-চোখ লাল হইয়া উঠিত, সর্বাঙ্গে আক্ষেপ হইত এবং উপস্থিত সকলে মনে করিতেন, বুঝিবা প্রাণবায়ু নির্গত হইয়া যাইবে। স্বামীজি বলিতেন, এইসময় একটি উঁচু তাকিয়ার উপর ভর দিয়া বসিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতেন।”

বেলুড় থেকে আমেরিকান শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে (২৬ জানুয়ারি ১৮৯৯) স্বামীজি মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার খবর দিচ্ছেন। “ডায়াবিটিস উধাও, কিন্তু পরিবর্তে যা এসেছে তাকে কোনো কোনো ডাক্তার অ্যাজমা, আবার কেউ কেউ ডিসপেপসিয়া বলেন। দুশ্চিন্তা ঘটাবার মতন অসুখ, দিনের পর দিন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। যদি মার্চের মধ্যে সুস্থ হই তাহলে ইউরোপে যাব।”

ফেব্রুয়ারির গোড়ায় মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজির চিঠি, “বৈদ্যনাথে বায়ু পরিবর্তনে কোন ফল হয়নি। সেখানে আটদিন আট রাত্রি শ্বাসকষ্টে প্রাণ যায় যায়। মৃতকল্প অবস্থায় আমাকে ফিরিয়ে আনা হয়। এখানে এসে বেঁচে উঠবার লড়াই শুরু করেছি।”

ডাক্তার সরকার যে এইসময় তার চিকিৎসা করছেন তাও মিস ম্যাকলাউডকে জানিয়েছেন তিনি। “আগের মতো হতাশ ভাব আর নেই অদৃষ্টের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি। এটা আমাদের পক্ষে বড় দুর্বৎসর।”

“দু’বৎসরের শারীরিক কষ্ট আমার বিশবছরের আয়ু হরণ করেছে,” স্বামীজি এক চিঠিতে লিখেছিলেন ১৮৯৯ এপ্রিল মাসে। “ভাল কথা, কিন্তু এতে আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। হয় কি? সেই আপনভোলা আত্মা একই ভাবে বিভোর হয়ে তীব্র একাগ্রতা ও আকুলতা নিয়ে ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে আছে।”

এই সময়ে স্বামীজির কোষ্ঠী পরীক্ষা করিয়ে প্রবল বকুনি খেয়েছিলেন নিবেদিতা। কোষ্ঠীর ভাষ্য : স্বামীজির লগ্নে বৃহস্পতি, অতএব নয় বছর কোন ভয় নেই, তবে শরীর অসুস্থ থাকবে। এই ভবিষ্যদ্বাণীকে স্বামীজি কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

*

২০ জুন ১৮৯৯। স্বামী তুরীয়ানন্দ ও মানসকন্যা নিবেদিতাকে নিয়ে বিবেকানন্দ বিদেশের উদ্দেশে গোলকুন্ডা জাহাজে উঠলেন কলকাতা বন্দর থেকে। যাঁরা তাঁকে জাহাজে তুলে দিতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন শচীন্দ্রনাথ বসু। তাঁর মতে, “সত্যি কথা বলতে কি তাকে মোটেই সুস্থ দেখাচ্ছিল না।”

জাহাজে ধূমপান, জলপান, ইত্যাদি কমিয়ে দিয়ে স্বামীজি বেশ ভাল ছিলেন। নিবেদিতাকে স্বামীজি বলেছিলেন, “আমার মতন মানুষেরা চরমের সমষ্টি, আমি প্রচুর খেতে পারি, একেবারে না খেয়ে থাকতে পারি; অবিরাম ধূমপান করি, আবার তাতে সম্পূর্ণ বিরত থাকি। ইন্দ্রিয় দমনে আমার ক্ষমতা অথচ ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যেও থাকি। নাহলে দমনের মূল্য কোথায়?”

৩১ জুলাই ১৮৯৯ লন্ডনের টিলবেরি ডকে স্বামীজিকে জাহাজ থেকে নামতে দেখে জনৈকা ভক্তিমতী লিখলেন, “তিনি খুব রোগা হয়ে গিয়েছিলেন, তাকে দেখে মনে হল যেন ঠিক একটি বালক।”

সমুদ্রগামী জাহাজে স্বামীজির শরীর ভাল ছিল। কিন্তু ডাঙায় নামার সঙ্গে সঙ্গে পেটে বায়ুর প্রকোপ।

স্বামী ব্রহ্মানন্দকে স্বামীজি লিখলেন (১০ আগস্ট) “একজন বড় ডাক্তার বললে, নিরামিষ খাও, আর ডাল ছুঁয়ো না। ইনি এখানকার একজন মুরুব্বি ডাক্তার। এঁর মতে ইউরিক এসিড-গোলমালে যত ব্যারাম হয়। মাংস এবং ডাল ইউরিক এসিড বানায়; অতএব ত্যাজ্যং ব্রহ্মপদং’ ইত্যাদি। যা হোক আমি তাকে সেলাম করে চলে এলাম।… এগজামিন করে বললে চিনি-ফিনি নেই-আলবুমেন আছে। যাক! নাড়ী খুব জোর, বুকটাও দুর্বল বটে। মন্দ কি, দিনকতক হবিষ্যাশী হওয়া ভাল।”

দু’চারদিনের মধ্যেই আমেরিকা-যাত্রার ইঙ্গিত রয়েছে স্বামীজির এই চিঠিতে। বিবেকানন্দ সেবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছলেন ২৬ আগস্ট ১৮৯৯।

.

স্বামীজির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য মার্কিনী ভক্তরা বড় ডাক্তারের সঙ্গে হাতুড়ে ডাক্তারদের খোঁজখবর করতেও অনুৎসাহিত নন।

সেপ্টেম্বর মাসে রিজলি ম্যানর থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের মেরী হেলকে লিখছেন, “তোমার চিকিৎসা (ক্রিশ্চান সায়ান্স) দিয়ে আমাকে ভাল করতে পারলে না। তোমার রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার আস্থা বেশ কিছুটা কমে যাচ্ছে।…আমার চুল তাড়াতাড়ি পেকে যাচ্ছিল, এখন কোনক্রমে তা বন্ধ হয়েছে। দুঃখের বিষয় এখন সবেমাত্র কয়েকটি পাকা চুল আছে; অবশ্য ভাল করে সন্ধান করলে আরও অনেক বেরিয়ে পড়বে। শুভ্র কেশ আমার বেশ পছন্দ।”

একই চিঠিতে স্বামীজি সরসভাবে মিস মেরী হেলকে লিখছেন, “তুমি কি অস্থিবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু জানো? নিউ ইয়র্কে একজন এসে বাস্তবিক অবাক কাণ্ড করছে। এক সপ্তাহ পরে তাকে দিয়ে আমার হাড়গোড় দেখানো হবে।”

২২ ডিসেম্বর তার ধীরামাতা মিসেস সারা বুলকে চৌম্বক-চিকিৎসার খবর দিচ্ছেন স্বামীজি। “সম্প্রতি আমার আবার শরীর খারাপ হয়েছিল। তাই চিকিৎসক রগড়ে রগড়ে আমার ইঞ্চি কয়েক চামড়া তুলে ফেলেছে। এখন আমি তার যন্ত্রণা বোধ করছি।”

পরের দিন সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজির রিপোর্ট, “সত্যি আমি চৌম্বক চিকিৎসা-প্রণালীতে ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছি।…আমার শরীরের কোন যন্ত্র কোনকালেই বিগড়ায়নি-স্নায়বিক দৌর্বল্য ও অজীর্ণতাই আমার দেহে যা-কিছু গোল বাধিয়েছিল।”

ম্যাগনেটিক হাতঘসার মহিলা চিকিৎসকটি জুটিয়েছিলেন মিস। জোসেফিন ম্যাকলাউড।”হাতঘসা চিকিৎসার ফলেই হোক, ক্যালিফোর্নিয়ার ‘ওজোন’ বাষ্পের ফলেই হোক, অথবা বর্তমান কর্মের দশা কেটে যাবার ফলেই হোক, আমি সেরে উঠছি। পেটভরা খাবার পরে তিনমাইল হাঁটতে পারা একটা বিরাট ব্যাপার নিশ্চয়।” এই রিপোর্ট স্বামীজি স্বয়ং দিচ্ছেন তাঁর ধীরামাতা মিসেস বুলকে লস্ এঞ্জেলেস থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৮৯৯।

ভগ্ন স্বাস্থ্যের কথা স্বামীজি আর কত বলবেন। ১৯০০ সালের মার্চ মাসে স্যানফ্রানসিসকো থেকে মিসেস বুলের কাছে তার দাবি :”সম্ভবতঃ স্বাস্থ্যের উন্নতিই হচ্ছে–যদিও অজ্ঞাতসারে। আমি ৩০০০ শ্রোতাকে শোনাবার মতন উঁচু গলায় বক্তৃতা দিতে পারি; ওকল্যান্ডে আমায় দু’বার তাই করতে হয়েছিল। আর দু’ঘণ্টা বক্তৃতার পরেও আমার সুনিদ্রা হয়।”

ঠিক তিনদিন পরেই (৭ মার্চ) কিন্তু দুঃসংবাদ।”দিনকয়েক যাবৎ আমার শরীর খারাপ হয়েছে এবং বড় বিশ্রী বোধ হচ্ছে। আমার বোধ হয়, রোজ রাত্রে বক্তৃতা দেবার ফলেই এরকম হয়েছে। আমার আশা আছে যে, ওকল্যান্ডের কাজের ফলে অন্তত নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ফিরে যাবার টাকা সংগ্রহ করতে পারব।” নিউ ইয়র্কে পৌঁছে ভারতে ফেরবার টাকা যোগাড়ের স্বপ্ন দেখছেন আমাদের স্বামীজি।

রোগ-জর্জরিত স্বামীজি স্যানফ্রান্সিস্কো থেকে নিজেকে খুলে ধরেছেন স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে ১২ মার্চের এক চিঠিতে: “শরৎকে বলল যে, আমি বেশি খাটছিনা আর। তবে পেটের খাওয়ার মতো না খাটলে শুকিয়ে মরতে হবে যে।…আমি সত্য সত্য বিরাম চাই, এ রোগের নাম নিউরোসথেনিয়া–এ স্নায়ুরোগ। এএকবার হলে বৎসর কতক থাকে। তবেদু’চার বৎসর একদম রেস্টহলে সেরে যায়।..এদেশ এই রোগের ঘর। এইখান থেকেই উনি ঘাড়ে চড়েছে। তবে উনি মারাত্মক হওয়া দুরে থাকুক, দীর্ঘ জীবন দেন। আমার জন্য ভেবো না। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে যাব।”

.

১৮৯৯ নভেম্বর দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বামীজি একজন বিখ্যাত ডাক্তার ভক্তর (ডাক্তার এগবার্ট গার্নসি) নিউ ইয়র্কের বাড়িতে চলে আসেন রিজলি ম্যানর থেকে। ডাক্তার গানসির পরামর্শ, অস্টিওপ্যাথ ডাক্তার হেলমারের চিকিৎসায় থাকুন স্বামীজি। ওঁর কথা শোনেন স্বামীজি। কিন্তু ডাক্তারের আতিথেয়তায় থাকতে থাকতেই তাঁর প্রবল সর্দিজ্বর হয়। সে বিবরণ মার্কিনি ভক্তরা সংগ্রহ করেছেন।

হাতুড়ে মিসেস মিল্টনের চৌম্বক চিকিৎসা! ইনি লিখতে পড়তে পারতেন না। কথা বলতেন নিগ্রো ডায়ালেক্টে। তার হাতে রোগীর কি হলো? “আমার বেলায় বুকে অনেকগুলি বড় বড় লাল লাল দাগ ফুটে উঠেছে।” আরোগ্যের ব্যাপারে কতদুর কী হয়, তা পরে বিস্তারিত জানাবার প্রতিশ্রুতি স্বামীজি দিচ্ছেন জননীসমা মিসেস বুলকে।

শরীরের অন্য সব সমস্যার সমাধান না হোক, স্বামীজি এই সময় বিনিদ্রার হাত থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছিলেন মনে হয়। নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি এখন সকাল-সন্ধ্যা খুব খাঁটি, যখন যা পাই খাই, রাত্রি বারটায় শুতে যাই, আর কি গভীর নিদ্রা! আগে কখনও আমার এমন ঘুমোবার শক্তি ছিল না।”

শেষ পর্যন্ত চৌম্বক চিকিৎসা যে কিছু করতে পারলো না তা কয়েকদিনের মধ্যেই স্বামীজিকে স্বীকার করতে হলো মিস ম্যাকলাউডকে লেখা চিঠিতে। “যাই হোক আমার চলে যাবে।”

এপ্রিল মাসে আলমেডা থেকে লেখা মিসম্যাকলাউডকে লেখা স্বামীজির আর এক চিঠিতে বিষণ্ণ বিদায়ের সুর, শরীরের চেয়ে মনের শান্তি স্বচ্ছতাই খুব বেশি বোধ করছি, লড়াইয়ে হার-জিত দুই-ই হ’ল–এখন পুটলি-পাঁটলা বেঁধে সেই মহান মুক্তিদাতার অপেক্ষায় যাত্রা করে বসে আছি।”

এপ্রিলের শেষেও স্বামীজির অসুস্থতা ও জ্বর। সেই সঙ্গে স্নায়ুরোগ। ২রা মে ১৯০০ নিবেদিতাকে তিনি লিখছেন, “আমি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম-মাসখানেক ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফলে আবার রোগের আক্রমণ হয়েছিল। যাই হোক, এতে আমি এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে আমার হার্ট বা কিডনিতে কোন রোগ নাই, শুধু অতিরিক্ত পরিশ্রমে স্নায়ুগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।”

স্নেহময় ডাক্তার লোগানের উল্লেখ রয়েছে এই সময়ের চিঠিতে। তার ঠিকানা ৭৭০ ওক স্ট্রিট। ডাক্তার লাগানের নির্দেশ, সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যাত্রার ধকল নয়। এই ডাক্তার আমাকে সবল করে ছাড়বে! আমার পেট ভাল, নার্ভ ফাইন।”

এই সময় আমরা আর এক ডাক্তারের খোঁজ পাচ্ছি। ডাক্তার উইলিয়াম ফস্টার, ঠিকানা ১৫১০ মার্কেট স্ট্রিট, তাঁর কাছেও চিকিৎসা হয়েছিল। অসুস্থ স্বামীজির কিন্তু রসবোধের কোন অভাব নেই। ২৩ জুন মেরি হেলকে নিউইয়র্ক থেকে লিখছেন, “তোমার চিঠিটা হজম করতে পারিনি, কারণ গত কয়েকদিন অজীর্ণতা কিছু বেশীরকম ছিল।”

আগস্টের মাঝামাঝি বিবেকানন্দকে আমরা মানুষের মহাতীর্থ প্যারিসে কর্মব্যস্ত দেখছি। স্বামী তুরীয়ানন্দকে তিনি লিখছেন (সেপ্টেম্বর ১৯০০), আগামীকাল যার ফ্ল্যাটে থাকবেন তার বাড়ি দেখে এসেছেন, ছ’তলার ফ্ল্যাট, কিন্তু লিফট নেই। “চড়াই-ওতরাই। ওতে কিন্তু আমার আর কষ্ট হয় না।”

তুরীয়ানন্দকে লেখা আরও এক চিঠি : “শরীর একরকম গড়মড় করে চলছে। খাটলেই খারাপ, না খাটলেই ভাল, আর কি? মা জানেন।”

*

প্যারিসে একদিন মধ্যাহ্নভোজের সময় কিংবদন্তি গায়িকা মাদাম এমা কালভে তার বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে বললেন, তিনি মিশরে যাচ্ছেন। মিস ম্যাকলাউড যখন বললেন তিনিও সহযোগী হবেন, অমনি মাদাম কালভে স্বামীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমার অতিথি হিসেবে মিশরে যাবেন কি?”

স্বামীজি সম্মত হলেন। মিশরে কী হয়েছিল তা যথাসময়ে জানা যাবে। মাদাম কালভে স্বামীজিকে বাবা বলতেন।

পূর্ব থেকে পশ্চিম নয়, প্রজ্বলিত সূর্য এবার পশ্চিমে থেকে ফিরে আসছেন পূর্বগগনে।

প্যারিস থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৪ অক্টোবর ১৯০০। ঐদিন মাদাম কালভের বিশিষ্ট অতিথি স্বামী বিবেকানন্দ প্যারিসের রেল স্টেশন থেকে ভুবনবিদিত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসের যাত্রী হলেন। এবারের ভ্রমণপর্ব শেষ হয়েছিল ২৬ নভেম্বর ১৯০০, যেদিন মিশরের পোর্ট তাফিক থেকে বিবেকানন্দ বোম্বাইমুখী ইতালীয় জাহাজ এস এস রুবাত্তিনোতে উঠে বসলেন স্বদেশ ফিরে যাবার ব্যাকুলতা নিয়ে।

এই ভ্রমণের সময় স্বামীজির শারীরিক অসুস্থতার তেমন বহিঃপ্রকাশ ছিল না। বরং তিনি সীমাহীন প্রাণশক্তিতে পূর্ণ। শুধু নব নব দেশের দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখছেন এবং অবসর সময়ে উদ্বোধন পত্রিকার জন্য পরিব্রাজক’ এর কিস্তি রচনা করছেন তা নয়, স্বামীজি সারাক্ষণ যেখানে যাচ্ছেন সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এবং মাতিয়ে রাখছেন যাত্রাসঙ্গিনী ও সঙ্গীদের। সেসব দিনের হৃদয়গ্রহী বর্ণনা লিপিবদ্ধ রয়েছে মাদা কালভে ও মিস্ জোসেফিন ম্যাকলাউডের স্মৃতিকথায়। পরিব্রাজক-এর পাঠক-পাঠিকারাও তার কিছুটা স্বাদ পেয়েছেন।

একনজরে স্বামীজির ভ্রমণসূচিটি এরকম : ২৪ অক্টোবর ১৯০০ সারারাত ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস দক্ষিণ ফ্রান্স দিয়ে চললো, পরের দিনের বেশির ভাগ সময় দক্ষিণ জার্মানি। ২৫ তারিখে ভিয়েনা পৌঁছে পরের দিন ভিয়েনাদর্শন হলো। এই শহর সম্বন্ধে লেখক বিবেকানন্দর মতামত : “ভিয়েনায় তিনদিন–দিক করে দিলে! প্যারিসের পর ইউরোপ দেখা চর্ব চূষ্য খেয়ে তেঁতুলের চাটনি চাখা; সেই কাপড়চোপড়, খাওয়া-দাওয়া, সেইসব এক ঢঙ,দুনিয়াসুদ্ধ, সেই এক কিম্ভুত কালো জামা, সেই এক বিকট টুপি।”

৩০ অক্টোবর ১৯০০ : স্বামীজির দল কনস্টান্টিনোপল পৌঁছলেন ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেসে। এই ট্রেন বলকান দেশগুলির মধ্য দিয়ে চলে এসেছে। লঙ্কাপ্রেমী স্বামীজির আনন্দের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এখানকার লঙ্কায় এমন ঝাল যে মাদ্রাজীদেরও কঁদিয়ে দেবে!

কনস্টানটিনোপল, অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে, ক’দিন থাকা হয়েছিল? কারুর মতে দু’তিন দিন, আর মিস ম্যাকলাউডের স্মৃতি অনুযায়ী নদিন। গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক ন’দিনকেই নির্ভরযোগ্য মনে করেন। এই সময়েই ঘুরতে ঘুরতে এঁরা এক সুফি ফকিরের তাকিয়া দেখেন। এখানকার দরবেশরা রোগ সারায়। প্রথমে ঝুঁকে পড়ে কলমা পড়ে, তারপর নৃত্য করে; তখন ভাব হয় এবং ভাবাবেশে রোগীর শরীর মাড়িয়ে দিয়ে রোগ আরাম করে। রাস্তায় বেরিয়ে স্বামীজির ছেলেমানুষের স্বভাব সর্বদা ছিল। স্বামী গম্ভীরানন্দের বর্ণনায় : সুতরাং বালকসুলভ ভোলাভাজা দেখিয়া উহা কিনিয়া খাইলেন, সঙ্গীদের সহিত তুর্ক-দেশীয় অন্যান্য সুখাদ্যও আস্বাদন করিলেন।

১০ নভেম্বর কনস্টান্টিনোপল থেকে গ্রীসের উদ্দেশে যাত্রা। সেবার গ্রীসে তিন দিন থেকে ১৩ অথবা ১৪ নভেম্বর মিশরের উদ্দেশে যাত্রা। জাহাজের নাম ‘জার’। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দিগ্বিজয়ী বীরের মতন স্বামীজি কিভাবে গ্রীস জয় করে মিশরে উপস্থিত হয়েছিলেন তার বিবরণ বিভিন্ন স্মৃতিকথায় রয়েছে।

মনে রাখা ভাল, ইউরোপের যশস্বিনী মিউজিক বার্ড মাদাম কালভে এক দুঃসময়ে প্রাণঘাতিনী হবার চেষ্টা করেছিলেন, মার্কিন মুলুকে বিবেকানন্দ-সান্নিধ্যে এসে তিনি নবজীবন লাভ করেন।

এবার লক্ষ্যস্থল কায়রো। মিশরীয় সভ্যতার ওপর নতুন আলোকপাত করে সহযাত্রীদের রোমাঞ্চিত করছেন বিবেকানন্দ। এমনই রোমাঞ্চিত তারা, যে কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে তারা ট্রেনও ফেল করছেন! এই কায়রোতেই সবান্ধব বিবেকানন্দ পথ হারিয়ে পতিতাপল্লীতে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে অসহায় অর্ধনগ্না রমণীদের দর্শনে যে প্রাণস্পর্শী নাটকের সৃষ্টি হয়েছিল তার বিবরণ বিবেকানন্দ অনুরাগীদের অজানা নয়। নাটকের চরমপর্বে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক ক্রন্দনরতা হতভাগিনী স্পেনীয় ভাষায় বলে উঠেছিল Hombre de Diosঈশ্বরের প্রেরিত মানুষ!

কায়রোপর্ব সম্বন্ধে অনেক কথাই অনেকদিন এদেশে অজানা ছিল। বিবেকানন্দর দেহাবসানের বহু বছর পরে মাদাম এমা কালভে মুখ খুলেছিলেন। পরলোকগত প্রকাশক রঞ্জিত সাহার সঙ্গে ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের নিবিড় যোগাযোগ ছিল দীর্ঘদিন। তিনি নিবেদিতার ইংরিজি পত্রাবলী ও ভূপেন্দ্রনাথ রচিত বিবেকানন্দ জীবনীর প্রকাশকও বটে। ওঁর কাছে শুনেছি, বিবেকানন্দর পারিবারিক সূত্রের ধারণা, কায়রোতে স্বামীজিকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। কিন্তু তার কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ আমি সংগ্রহ করতে পারিনি। আমরা স্বামীজির জীবনীর মাধ্যমে প্রথম দিকে জেনেছি, প্রিয় ভক্ত মৃত্যুপথযাত্রী ক্যাপটেন সেভিয়ারের জন্য ব্যাকুল হয়ে তিনি আচমকা মাঝপথে সব প্রোগ্রাম বাতিল করে দেশে ফিরতে চাইলেন।

কায়রোপর্ব সম্বন্ধে প্রধান প্রধান বিবেকানন্দ-বিশারদরা আজও কিছুটা আলো-আঁধারিতে থেকে গিয়েছেন মনে হয়। বিবেকানন্দ জীবনীকারের মতে, স্বামীজি কায়রোর যাদুঘর, স্ফিংকস (অর্ধনারী-সিংহ মূর্তি) ও পিরামিড দেখলেন। “বিগতগৌরব প্রাণহীন এইসব বিশাল স্মৃতিচিহ্নগুলি তাহার মনে এক অবসাদ আনিয়া দিল এবং তিনি তথা হইতে দূরে–স্বদেশে চলিয়া যাইবার জন্য ব্যগ্র হইয়া পড়িলেন।”

মিস ম্যাকলাউড ও এমা কালভে তাদের স্মৃতিকথায় কিছু নতুন খবর দিয়েছেন। কিন্তু এঁদের দুজনের সঙ্গেই কথা বলে মাদাম ভার্দিয়ার যে বিস্তারিত নোট অগ্রন্থিত অবস্থায় রেখে গিয়েছেন তার থেকেই বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।

মাদাম কালভে অন্যত্র গান গাইতে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে মিস ম্যাকলাউডের কাছে শুনলেন, স্বামীজি খুব বিষণ্ণ অবস্থায় রয়েছেন। মাদাম কালভে জানতে চাইলেন, কেন স্বামীজি মাঝপথে যাত্রাভঙ্গ করতে চাইছেন? বিমর্ষ বিবেকানন্দ বললেন, তিনি তার গুরুভাইদের কাছে ফিরে যেতে চান। তাকে আশ্বস্ত করা হল, টাকা পয়সার জন্যে চিন্তা নেই, প্রয়োজন হলে ফিরে যাবার টিকিট অবশ্যই কিনে দেবেন মাদাম কালভে। কিন্তু কেন আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন?” জিজ্ঞেস করলেন মাদাম কালভে।

বিবেকানন্দর চোখ এবার জলে ভরে উঠলো। মাদাম কালভের ভাষায়, এরপর তিনি বললেন, “আমি দেশে ফিরতে চাই, মরবার জন্য, আমার গুরুভাইদের কাছে যেতে চাই আমি।”

কালভে বললেন, “আপনাকে আমরা মরতে দিতে পারি না, আমাদের প্রয়োজন আপনাকে।”

তারপরেই বিস্ফোরণ! কালভেকে স্বামীজি জানালেন, ৪ঠা জুলাই আমার মৃত্যু হবে।

২৬ নভেম্বর ১৯০০ স্বামীজি মিশর থেকে বোম্বাই বন্দরের উদ্দেশে রুবাত্তিনো জাহাজে চড়লেন একাকী।

তিনদিন পরে মিস ম্যাকলাউডের চিঠি তাঁর বান্ধবী সারাকে: “স্বামীজির খবর ভাল নয়। তার আর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল–এখন ভারতে ফিরে যাচ্ছেন।”

আমাদের প্রশ্ন : “আর একটা কথার মানে কি দ্বিতীয় আক্রমণ? সেক্ষেত্রে বেলুড়ে ৪ জুলাই ১৯০২ সন্ধ্যায় তৃতীয় হার্ট অ্যাটাকেই কি তাঁর মতলীলার অবসান?

বিদেশিনী গবেষিকা মেরি লুইস বার্ক দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাককে তেমন গুরুত্ব দিতে পারছেন না। কারণ মিশর ভ্রমণপর্বে তাকে কখনও প্রচণ্ড অসুস্থ দেখায়নি।

৫. উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন

শেষ পর্বের শুরু এবার। আশঙ্কিত হৃদয় নিয়ে আমরা চলেছি ৪ জুলাই ১৯০২-এর দিকে।

কিন্তু এ দেশের সনাতন চিন্তাধারায় স্মরণীয় মানুষদের তিরোধান দিবস সম্পর্কে আমাদের বিশেষ উৎসাহ নেই।

“আবির্ভাব নিয়েই আমাদের আনন্দোৎসব, মৃত্যু সে তো বাসাংসি জীর্ণানি, পুরনো বস্ত্র ছেড়ে নতুনে চলে যাওয়া”, আমাকে বলেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ ও মিশনের এক প্রবীণ শ্রদ্ধেয় সন্ন্যাসী। এর অর্থ, ৪ জুলাই ২০০২ যে বীরসন্ন্যাসী বিবেকানন্দর তিরোধান দিবস নিয়ে তেমন ব্যস্ততা নেই তাদের মধ্যে, যাঁরা শতবর্ষের বেশি সময় ধরে এই মহাপুরুষের বাণীকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবু এদেশের সংখ্যাহীন মানুষের মনে ৪ জুলাই নাড়া দিয়ে যায়, আজও মনে প্রশ্ন ওঠে, যে অলৌকিক শরীরের তিরোধান ঘটেছিল ১৯০২ সালে, সেই শরীর যদি ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিনের বেশি স্থায়ী হত, তা হলে এদেশের ভাগ্যাকাশে আরও কী কী পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেত? আমরা জগৎবাসীরা আরও কী কী উপহার পেতে পারতাম সেই অমৃতপুত্রের কাছ থেকে?

একথাও সত্য যে এই পৃথিবীতে ঈশ্বরপুত্ররা প্রায়ই দীর্ঘজীবী হননি খ্রিস্ট ও শঙ্করাচার্যের সংক্ষিপ্ত জীবনের কথা তো আমাদের অজানা নয়। কিন্তু সেই সঙ্গে ভগবান বুদ্ধও তো আছেন। একজন বিদেশিনী তো সস্নেহে বিদগ্ধ বিবেকানন্দকেও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, বুদ্ধ তো চল্লিশ বছর থেকে আশি বছর পর্যন্ত বিশ্বসংসারকে কম সেবা করেননি।

স্মরণীয় দিনে মৃত্যুকে এই যে উপেক্ষা, বিশেষ করে মহামানবদের তিরোধান, তারই পিছনে সত্যিই কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে কিনা তার প্রারম্ভিক অনুসন্ধান করতে গিয়েই এই অধ্যায়ের সূচনা।

কিন্তু সেই সঙ্গে অন্য কিছু প্রসঙ্গও এসে পড়ে, আর স্মরণে আসে–যাঁকে নিয়ে এই অনুসন্ধান তিনি নিজেই একবার বলেছিলেন : “চিন্তা করো, উপাদান সংগ্রহ করো, সমস্ত অলৌকিকত্ব বাদ দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের একটা জীবনী রচনা করো।” অর্থাৎ অলৌকিকত্ব থাকলেও তা নিয়ে বিভোর হওয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি ইচ্ছে করেই এসেছিলেন অতি অল্পদিনের জন্য এবং ইচ্ছা করেই বিবেকানন্দ অতি অল্প সময়ের মধ্যে চলে গিয়েছেন, এসব সত্য হলেও, পৃথিবীর অন্য মহাপুরুষদের প্রদর্শিত পথেই করতে হবে তাঁর অনুধ্যান।

বিবেকানন্দ বিষয়ের চলমান বিশ্বকোষ শঙ্করীপ্রসাদ বসু মহাশয় আমাকে উৎসাহ দিলেন। ৪ জুলাই ১৯০২ সম্বন্ধে তিনি ইতিমধ্যেই কিছু হৃদয়গ্রাহী ছবি এঁকেছেন, বিদেশিনী ভক্তিমতীরাও নিরন্তর অনুসন্ধানের পরে উপহার দিয়েছে নানা অমূল্য তথ্য, তবু লোভ হয়–আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি বসি পড়িছ আমার শেষদিনের কথা?

ব্যস্ত জীবনযাত্রার স্রোতে ভেসে যেতে যেতে শতবর্ষ পরের মানুষ জানুক, যাকে আমরা আজ প্রায় দেবতার সিংহাসনে বসিয়ে পূজা করছি, কত কঠিন ছিল তার জীবনসংগ্রাম। খ্যাতির হিমালয়শিখরে আরোহণ করেও কেন শেষ হয়নি তার প্রতিদিনের সংগ্রাম? কেন স্বামীজি বলেছিলেন,সতত প্রতিকূল অবস্থামালার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের নামই জীবন? এবং সেই সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কৌতূহল, সনাতন ভারতবর্ষ জন্মদিবস অপেক্ষা মৃত্যুদিবসকে কেন এতো কম গুরুত্ব দিয়েছে?

শেষ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছে এবং সেই উত্তর এই লেখার পরিসমাপ্তিতে উল্লিখিত হবে। কিন্তু তার আগে আমার অতি সংক্ষিপ্ত অনুসন্ধানের একটা ছোট্ট ছবি তাড়াতাড়ি এঁকে ফেলা যাক।

নানা প্রশ্ন অবশ্যই জড়ো হয়ে আছে। কেন এবং কীভাবে বিবেকানন্দ এত কম বয়সে চলে গেলেন? মহামানুষদের জীবনপথ নিরন্তর কণ্টকিত করতে সমকাল কেন দ্বিধা করে না? এবং কেমন করে তিলেতিলে অতিপরিশ্রমে নিজেকে ক্ষয় করে ক্ষণজন্মা পুরুষরা এই বিশ্বসংসারকে চিরঋণে আবদ্ধ করে যান? আর সেই সঙ্গে একজন জার্মান দার্শনিকের সেই বিখ্যাত উক্তি–যদি কোনও মহাপুরুষকে সত্যিই শ্রদ্ধা করে থাক তবে তার তিরোধানে ক্রন্দন করো না, বরং তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্যে লেগে পড়।

আমাদের প্রথম কৌতূহল, প্রথম যুগের বিবেকানন্দকে আমরা তো প্রবল প্রতাপান্বিত শরীরের অধীশ্বর হিসেবেই দেখেছি। তার শরীর হঠাৎ এমনভাবে ভেঙে পড়ল কেন? একালের মানুষের শরীর তো এইভাবে জীর্ণ হয় না। পূর্বসূরীদের নির্দেশিত পথেই আমার এই অনুসন্ধান, তেমন কোনও অপ্রকাশিত তথ্য আমার হাতে নেই, কিন্তু বিভিন্ন সূত্র থেকে কুড়িয়ে নিয়ে একটা মালা গাঁথার চেষ্টা চালানো গেল।

অসীম শারীরিক শক্তি নিয়েই নরেন্দ্রনাথ সন্ন্যাসের দুর্গম পথে যাত্রা করেছিলেন। আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি, অনেকেরই ধারণা স্বামীজির অনেক অসুখবিসুখই শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পর বরানগরের কঠিন দারিদ্র্য ও পরিব্রাজক জীবনে ভিক্ষান্নে ভোজনং যত্রতত্র এবং শয়নং হট্টমন্দির থেকে উদ্ভূত। এ-বিষয়ে অবশ্যই আরও অনুসন্ধানের প্রয়োজন থেকে গেল। কিন্তু সেই সঙ্গে সিমুলিয়ার দত্তদের পারিবারিক অসুখবিসুখগুলোর দিকে নজর দেওয়াটাও প্রয়োজন।

আমরা বিবেকানন্দর ছোটভাই ভূপেন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানতে পারি, পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত অল্পবয়সেই ডায়াবিটিসের রোগী হন। এই রোগ পরবর্তী সময়ে শুধু নরেন্দ্রনাথকে নয়, তার অন্য দুই ভাই মহেন্দ্রনাথ ও ভূপেন্দ্রনাথকেও আক্রমণ করে। মহেন্দ্র ও ভূপেন্দ্র অবশ্য দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের অন্তরঙ্গ শ্রী রঞ্জিত সাহার কাছে শুনেছি, ভূপেনবাবু মিষ্টি এড়িয়ে চলতেন। দু’জনেরই হাইপারটেনশন ছিল, যা নরেন্দ্রনাথের মধ্যেও অল্পবয়স থেকে থাকতে পারে। কারণ কম বয়সেও মাথার যন্ত্রণার উল্লেখ রয়েছে পারিবারিক স্মৃতিতে।

আরও বলা যাক। স্বামীজির পিতৃদেব বিশ্বনাথ দত্ত বাহান্ন বছর পেরোননি। মৃত্যুর মাসখানেক আগে তার হার্টের রোগ হয়েছিল। বহু বছর পরে ৫ জুলাই ভোরবেলায় যখন উত্তর কলকাতার বাড়িতে স্বামীজির দেহরক্ষার সংবাদ এল তখন শোকবিহ্বলা জননী জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ কী হল? তখন কনিষ্ঠ পুত্র বললেন, “বাবার যা হয়েছিল।” পিতার মৃত্যুও রাত ন’টা নাগাদ, খাবার পরে বাঁ হাতে তামাক খাচ্ছিলেন, বমি করলেন, তারপরেই হৃদযন্ত্র বন্ধ।

কৌপীনধারী অবস্থায় ভিক্ষান্নে জীবন অতিবাহিত করে নরেন্দ্রনাথের শরীরে বেশ কয়েকটি রোগের আবির্ভাব বা সূত্রপাত হয়েছিল একথা আমরা আগেই জেনেছি।

সন্ন্যাসজীবনে পেটের অসুখ নিত্যসাথী হওয়ায় সদা চলমান সন্ন্যাসীর খুবই অসুবিধা হয়েছিল। বারবার টয়লেটে ছোটার তাগিদে, ট্রেনের নিচু ক্লাসে ভ্রমণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ছাত্রাবস্থায় আমাদের ইস্কুলে বারবার শুনেছি, পরিব্রাজক সন্ন্যাসীকে দয়াপরবশ হয়ে কেউ কেউ ট্রেনের টিকিট কেটে দিতে চাইলে, নরেন্দ্রনাথ তাকে তখনকার উচ্চশ্রেণীর (সেকেন্ড ক্লাস) টিকিট দিতে অনুরোধ করতেন।

এই পেটের গোলমালের জন্য একবার এদেশের মহা উপকার হয়েছিল। এমন দাবিও অন্যায় হবে না! প্রথমবার আমেরিকা যাবার সময় কম খরচে ডেকের যাত্রী হওয়া তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। খেতড়ির মহারাজা তাঁকে জাহাজের ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কিনে না দিলে সে যাত্রায় তাঁর সঙ্গে টাটা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজী টাটার পরিচয় হত না।

টাটা দেশলাই আমদানির জন্য জাপানে গিয়েছিলেন। ধনপতি ব্যবসায়ীকে কাছে পেয়ে স্বামীজি তাঁকে স্বদেশে শিল্প স্থাপন করার অনুপ্রেরণা দেন এবং সেই সঙ্গে স্বদেশে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। জামশেদজী পরবর্তীকালে টাটা স্টিল ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসেন। টাটা-বিবেকানন্দ পত্রাবলীর পুনর্সন্ধান করে সাম্প্রতিক গবেষকরা এদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।

মার্কিন দেশের সংগ্রাম ও রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠা বিবেকানন্দের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মার্কিন গবেষকদের দয়ায় আমাদের হাতের গোড়ায় রয়েছে। সেখানে তাঁর অসুখবিসুখ এবং খাওয়াদাওয়া সম্পর্কেও যথেষ্ট খবরাখবর রয়েছে। আমরা দেখেছি তার স্মোকিং বেড়েছে; নতুন আকর্ষণ নবাবিষ্কৃত আমেরিকান আইসক্রিম। আধুনিক চিকিৎসা এবং আজব চিকিৎসা দুটোর কাছেই তিনি আত্মসমর্পণ করেন, তবে অমানুষিক পরিশ্রমের মতন শরীর তখনও তার রয়েছে।

বহুদিন পরে জীবনের শেষ পর্বে অসুস্থ স্বামীজিকে একজন অনুরাগী জিজ্ঞেস করেছিলেন, “স্বামীজি, আপনার শরীর এতো তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল, আগে যত্ন নেননি কেন?” স্বামীজি উত্তর দিয়েছিলেন, “আমেরিকায় আমার শরীরবোধই ছিল না।”

তা হলে প্রথম বড় অসুখের ইঙ্গিত আমরা কোথায় পেলাম? বিশ্বাসযোগ্য উপাদান রয়েছে ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তর লেখায়। ১৮৯৬ সালে আমেরিকা থেকে দ্বিতীয়বার ইংলন্ডে এসেছেন বিবেকানন্দ।

এই পর্বেই কিন্তু বড় আকারের দুঃসংবাদের ইঙ্গিত। লন্ডনেই আমরা প্রথম স্বামীজির হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়েছি। লন্ডনে একদিন মধ্যাহ্ন ভোজনের পর স্বামীজি বসে ভাবছিলেন। সামনে আমেরিকান অনুরাগী জন পিয়ার ফক্স ও মহেন্দ্রনাথ।

মহেন্দ্রনাথের বর্ণনা অনুযায়ী “হঠাৎ যেন তাঁহার মুখে বড় কষ্টের ভাব দেখা গেল। খানিকক্ষণ পরে তিনি নিশ্বাস ফেলিয়া ফক্সকে বলিলেন, দেখ ফক্স, আমার প্রায় হার্ট ফেল করছিল। আমার বাবা এই রোগে মারা গেছেন, বুকটায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল, এইটা আমাদের বংশের রোগ।” অর্থাৎ তেত্রিশ বছর বয়সেই অকাল দেহাবসানের সুনিশ্চিত ইঙ্গিত।

এখন প্রশ্ন, পরবর্তী সময়ে স্বামীজির হার্টের অবস্থা কেমন ছিল? ১৮৯৮ সালে অমরনাথ তীর্থ দর্শনের সময় আবার একটা অস্বস্তিকর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। পাহাড়-ভাঙার অবর্ণনীয় ধকলের পরে ডাক্তার বলছেন, ওঁর হৃদয়যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারত। চিকিৎসকের সাবধানবাণী, স্বামীজির হার্টের আকার বিপজ্জনকভাবে বড় হয়ে গিয়েছে। বেলুড়ে ফেরার কয়েকদিন পরে স্বামী-শিষ্য সংবাদের স্মরণীয় লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে যখন স্বামীজির দেখা, তখন তাঁর বাঁ চোখের ভিতরটা লাল হয়ে রয়েছে। আর ডাক্তারদের সাবধানবাণী : ওই চোখে ব্লাড ক্লট হয়েছে। শেষপর্বে আমরা দেখছি, তার ডান চোখটিও নষ্ট হয়ে গেছে, অর্থাৎ জীবন দীর্ঘতর হলে সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হওয়ার প্রবল আশঙ্কা ছিল। মানুষটি কিন্তু এমনই রসিক যে নিজেকে একচক্ষু শুক্রাচার্যের সঙ্গে তুলনা করেও আনন্দ পাচ্ছেন!

কিন্তু ধারাবাহিকতায় ফেরা যাক এবার। আমাদের স্বামীজিকে নিয়ে ইতালীয় জাহাজ রুবাত্তিনোবোম্বাই বন্দরে পৌঁছে গিয়েছে।

রুবাত্তিনো হয় ৬ অথবা ৭ ডিসেম্বর ১৯০০ বোম্বাই বন্দরে ফিরেছিল আমাদের স্বামীজিকে নিয়ে। শেষ হলো তার বিদেশ ভ্রমণপর্ব। হাওড়াগামী ট্রেনের জন্য স্বামীজিকে স্টেশনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

ট্রেনে দৈবক্রমে পূর্বপরিচিত বন্ধু মন্মথনাথ ভট্টাচার্যর সঙ্গে স্বামীজির দেখা হয়ে গিয়েছিল। বিদেশি পোশাকে সজ্জিত স্বামীজিকে তিনি প্রথমে চিনতেই পারেননি, পরে দু’জনে খুব আমোদ-আহ্লাদ হয়েছিল।

বম্বে-হাওড়া এক্সপ্রেসে স্বামীজি একা হাওড়া স্টেশনে নামলেন, ওখান থেকে সন্ধ্যায় গাড়িভাড়া করে আচমকা বেলুড়ে আগমন। সে এক মধুর প্রত্যাবর্তন–আমরা জানি ডিনারের ঘণ্টা শুনে, গেটের তালা খোলার জন্যে অপেক্ষা না করে সায়েবী সাজসজ্জায় যে মানুষটি মালপত্তর সমেত দেওয়াল টপকে ভোজনের আসরে সানন্দে বসে পড়ে প্রাণভরে প্রিয় খিচুড়ি খেয়েছিলেন রবিবার ৯ ডিসেম্বর ১৯০০র সন্ধ্যায়, সে মানুষটির মধ্যে গুরুভাইরা গুরুতর অসুস্থতার কোনও ইঙ্গিত লক্ষ্য করেননি।

স্বয়ং বিবেকানন্দও তখন প্রবলভাবে সহাস্য। বেলুড়ের সবাইকে তিনি বলছেন, “তোদের খাবার ঘণ্টা শুনেই ভাবলুম, এই যাঃ, এখনি না গেলে হয়তো সব সাবাড় হয়ে যাবে, তাই দেরি করলাম না।”

.

কিন্তু পত্রাবলীর আলোকে এতদিন পরে পরিস্থিতি খুঁটিয়ে দেখলে শরীর সম্পর্কে কিছু কিছু অস্বস্তিকর ইঙ্গিত ছ’মাস আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। জুন মাসে বিবেকানন্দ তাঁর চিঠিতে বদহজম ও ডিসপেপসিয়া নিয়ে রসিকতা করছে। প্রায় একই সময় স্নেহের ক্রিশ্চিনকে স্বামীজি লিখেছেন নিউইয়র্ক থেকে, “কিডনির অসুখের ভয়টা কেটে গেছে, এখন দুশ্চিন্তাই আমার প্রধান অসুখ, এই রোগটাও আমি দ্রুত জয় করার চেষ্টা চালাচ্ছি।” কিন্তু দু’মাস পরেই আগস্ট মাসে মার্কিন অনুরাগী জন ফক্সকে স্বামীজি জানাচ্ছেন, “আমার শরীর দ্রুত ভেঙে যাচ্ছে। মহিমকে (ভাই) মাকে এবং সংসারকে দেখার ভার নেবার জন্যে তৈরি হতে হবে। আমি যে কোনও সময়ে চলে যেতে পারি।”

স্বদেশে আচমকা ফিরে এসে, বেলুড় মঠের সন্ন্যাসী ভাইদের সঙ্গে হৈহৈ করে খিচুড়ি খাওয়ার আনন্দে বিভোর বিবেকানন্দ তার প্রিয় খেতড়ির নরেশকে লিখছেন : “আমার হার্ট খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে।…আমার মনে হচ্ছে, এজীবনে যা করার ছিল তা শেষ হয়েছে। এর আগে প্যারিস থেকে (আগস্ট ১৯০০) প্রিয় হরিভাইকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) স্বামীজি লিখছেন, “আমার কাজ আমি করে দিয়েছি বস্। গুরু মহারাজের কাছে ঋণী ছিলাম–প্রাণ বার করে আমি শোধ দিয়েছি। সে কথা তোমায় কি বলব?..দলিল করে পাঠিয়েছি সর্বেসর্বা কত্তাত্তির। কত্তাত্তি ছাড়া বাকী সব সই করে দিয়েছি।”

*

জীবন নাটকের যবনিকাপাতের সত্যিই আর দেরি নেই, আর মাত্র আঠারো মাস। কিন্তু পায়ের তলায় সরষে নিয়ে যাঁদের জন্ম তারা ভগ্নশরীরেও ঘুরে বেড়াতে চান চরকির মতন।

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা দেখছি বিবেকানন্দকে মায়াবতী আলমোড়ার পথে। কাঠগোদামে স্বামীজির জ্বর জ্বর ভাব। সেখানে একদিন বিশ্রাম করলেন। মায়াবতীতে পৌঁছে শিষ্য বিরজানন্দকে বলছেন, “শরীরটাকে বেজায় কষ্ট দিয়েছি, তার ফল হয়েছে কি?না জীবনের যেটা সবচেয়ে ভাল সময় সেখানটায় শরীর গেল ভেঙে। আর আজ পর্যন্ত তার ঠেলা সামলাচ্ছি।”

১৯০১ জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বেলুড়ে ফিরে মিসেস ওলি বুলকে পরমানন্দে স্বামীজি জানাচ্ছেন, “বাংলাদেশে, বিশেষত মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনি আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এস্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ। আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি…তীর্থদর্শন হলো হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ; সারাজীবন সব আত্মীয়স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।”

এর আগে মায়াবতী থেকে ধীরামাতা মিসেস বুলকে (৬ জানুয়ারি ১৯০১) স্বামীজি লিখেছেন, “কলকাতায় প্রথম দিনের ছোঁয়াতেই আমার হাঁপানি আবার দেখা দিয়েছিল। সেখানে যে দু-সপ্তাহ ছিলাম প্রতি রাত্রেই রোগের আক্রমণ হত।”

মার্চের শেষে অসুস্থতার তোয়াক্কা না করে ঢাকা চললেন স্বামী বিবেকানন্দ। সেখান থেকে চট্টগ্রাম, কামরূপ, কামাখ্যা এবং শিলং।

হাঁপানিও যে স্বামীজির সঙ্গের সাথী তার প্রমাণ অনেক রয়েছে। ঢাকায় এক বারাঙ্গনা করুণভাবে তার কাছে নিবেদন করল, সে হাঁপানিতে ভুগছে, স্বামীজির কাছে সে ওষুধ ভিক্ষা চাইছে। অসহায় স্বামীজি সস্নেহে বললেন, “এই দেখ, মা! আমি নিজেই হাঁপানির যন্ত্রণায় অস্থির, কিছুই করতে পারছি না। যদি আরোগ্য করবার ক্ষমতা থাকতো, তা হলে কি আর এই দশা হয়!”

ঢাকাতে স্বামীজির ডায়াবিটিসও বেড়েছিল। গৌহাটিতে হাঁপানি বাড়ে, আর শিলং-এ তো খুব খারাপ অবস্থা। যখন হাঁপানির টান বাড়ত তখন কতকগুলো বালিশ একত্র করে বুকের ওপর ঠেসে ধরতেন এবং সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করতেন। শিলং-এ অ্যালবুমেন। বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল।

কিন্তু বেলুড় মঠে ফিরতেই স্বামীজির রোগের প্রকোপ কমে গেল। এই সময়কার চিঠিতে বাংলার পাহাড়ের মৃদু নিন্দা করেছেন আমাদের পরমপ্রিয় সন্ন্যাসী। জোসেফিন ম্যাকলাউডকে স্বামীজি লিখছেন, “আমাদের পার্বত্যস্বাস্থ্যনিবাস শিলং-এ আমার জ্বর, হাঁপানি ও অ্যালবুমেন বেড়েছিল এবং শরীর দ্বিগুণ ফুলে গিয়েছিল। যাহোক, মঠে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে রোগের লক্ষণগুলি হ্রাস পেয়েছে।” শিলং-এ চিফ কমিশনার স্যর হেনরি কটন স্থানীয় সিভিল সার্জনকে তার চিকিৎসার ভার নিতে বলেছিলেন এবং দু’বেলা নিজে খবর নিতেন।

পরের বছরে (১৯০২) জানুয়ারির শেষে আবার পথের ডাক। এবার জাপানিদের সঙ্গে বোধগয়ায়, সেখান থেকে পরের মাসে ট্রেনে বারাণসী। চলার শেষ টানতে রাজি নন সন্ন্যাসী, শরীর অশক্ত হলেও কী আসে যায়? মন তো আছে।

অনুসন্ধিৎসুরা এইসব ভ্রমণ বৃত্তান্তর বিবরণ যথাস্থানে পড়ে নিতে এখন আমাদের সময় নেই, আমাদের সামনে সেই দুঃখময় শুক্রবার ৪ জুলাই। মোদ্দা কথা, পাখি তার শেষ আশ্রয় বেলুড় মঠে ফিরে এসেছে–হয় ৭ মার্চ ১৯০২ অথবা পরের দিন,দু’জন শ্রদ্ধেয় মানুষ দু’রকম তারিখ লিখে রেখে গিয়েছেন। পণ্ডিতরা বিবাদ করুন লয়ে তারিখ সাল, আমরা বরং খোঁজ করি স্বামীজির শরীর স্বাস্থ্যের।

শেষ পর্বে নিজের শরীরের কথা কর্তা স্বয়ং প্রায় নিয়মিতভাবেই লিখে গিয়েছেন তার প্রিয় শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে। এই চিঠিগুলি সম্প্রতি প্রকাশিত ইংরিজি রচনাবলির নবম খণ্ডে স্থান করে দিয়েছেন পরম নিষ্ঠাবান ও সাবধানী প্রকাশক অদ্বৈত আশ্রম।

.

এইসব চিঠিতে আমাদের প্রিয় বিবেকানন্দ নিরন্তর আশা-নিরাশার দোলায় দুলছেন। কখনও লিখছেন, খুব ভাল ঘুম হচ্ছে, জেনারেল হেথ মোটেই খারাপ নয়। আবার কখনও লিখছেন, বঙ্গজননী আমাকে মাঝে মাঝে হাঁপানি উপহার দেন, কিন্তু হাঁপানি এবার পোষ মানছে। তবে সর্বনাশা রোগ ডায়াবিটিস ও ব্রাইটস ডিজিজ একেবারেই উধাও।

দ্বিতীয় অসুখটি কিডনি সংক্রান্ত, ডায়াবিটিস অনেক সময় একে সঙ্গে নিয়ে আসে, সাধারণ ভাষায় বোধ হয় নেফ্রাইটিস। শুকনো জায়গায় গেলে হাঁপানি যে ঠিক হয়ে যাবে, সে বিষয়ে মহানায়ক বিবেকানন্দ সুনিশ্চিত। কিন্তু রোগের ধাক্কা যখন আসে তখন শরীর আধখানা করে দিয়ে যায়। “তবে আবার শরীরে একটু মেদ জড়ো করতে আমার সময় লাগে না,” আশ্বস্ত করছেন বিবেকানন্দ তাঁর এক মানসকন্যাকে।

আরও একটি চিঠিতে দারুণ গরমে ঘামাচির বিরুদ্ধে সরস মন্তব্য করেছেন স্বামীজি। শরীরের নানা অংশে দগদগে ঘামাচি–আর সেই সঙ্গে তিক্ত মেজাজ। নার্ভ উত্যক্ত, বুঝছেন বিবেকানন্দ, স্বীকার করছেন মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুত হয়ে এতই রাগারাগি করছেন যে একজনকেও কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছেন না যে ধৈর্যময় হয়ে তাকে সহ্য করবে। কিন্তু এবার তিনি রাগ কমিয়ে ফেলতে কৃতসংকল্প, “দেখো, এবার আমি ভেড়ার মতন শান্ত হয়ে উঠবো।”

অক্টোবরের চিঠিতে গরমের বিরুদ্ধে স্বামীজির প্রবল অভিযোগ– আমার গায়ের রঙ এখন কালা আদমিদের থেকেও কালো! স্বামীজির শারীরিক লক্ষণ বিচার করে, খ্যাতনামা চিকিৎসক ডাক্তার সুব্রত সেন আমাকে বললেন, “ব্যাপারটা সুবিধের নয়, কারণ ওটা রেনাল ফেলিওরের লক্ষণও হতে পারে।” ঐতিহাসিক পুরুষদের শরীর স্বাস্থ্য সম্পর্কে নতুন বৈজ্ঞানিক আলোকপাতের চেষ্টা ইদানীং দেশে দেশে চালু হয়েছে, আমরা অবশ্য একেবারেই পিছিয়ে আছি।

নভেম্বরে সিস্টার নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখছেন, দুর্গাপূজার সময় থেকে শরীরটা মোটেই ভাল নয়। একই দিনে সিস্টার ক্রিশ্চিনকে আর একখানা চিঠি– কয়েকদিনের মধ্যেই কলকাতা এবং বাংলা ছাড়তেই হবে বর্ষার পরেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ভীষণ বেড়ে যায়। এরপর তিনি বর্ণনা করেছেন, বেলুড়ে পোষা জন্তু জানোয়ার পাখিদের সঙ্গে তার শিশুসুলভ আনন্দময় জীবনের কথা। মজার মন্তব্য আছে, “আমার চিড়িয়াখানায় মুরগি নেই, ওই জীব এখানে নিষিদ্ধ!”

নভেম্বরের শেষে পরপর দুটি খারাপ খবর “ডান চোখটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” (মনে হয় ডায়াবিটিসের ফল।) বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন কিনা জানি না, তবে লোকে তাকে বলছে কলকাতায় গিয়ে চোখের ডাক্তার দেখাও। স্বামীজি অবশ্যই যাবেন, কিন্তু এই মুহূর্তে সর্দিতে তিনি বিছানাবন্দী। স্বামীজির পরের চিঠিতে সর্দিকাশির সঙ্গে হাঁপানির পুনরাবির্ভাব ঘোষণা।

দুসপ্তাহ পরে বিবেকানন্দ নিজেই শরীর সম্বন্ধে আরও খারাপ খবর দিচ্ছেন শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে তিন বছর ধরে তিনি অ্যালবুমিন-ইউরিয়ায় জর্জরিত। মাঝে মাঝে প্রবল ধাক্কা আসে, আবার চলে যায়–তবে কিডনি বোধহয় সুস্থ আছে। বিবেকানন্দ নিজেই ব্যাখ্যা করছেন, ডায়াবিটিস থেকেও খারাপ এই অ্যালবুমিন, রক্ত বিষাক্ত হয়, হার্ট আক্রমণ করে এবং আরও নানারকম বিপদ ঘটায়। সর্দি হলে এর প্রকোপ বেড়ে যায়। এবার আমার ডান চোখটায় ব্লাড ভেসেল ফাটিয়ে দিয়েছে, ফলে আমি প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।…

ডাক্তাররা একসময় আমাদের বিবেকানন্দকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ, হাঁটাচলা এমনকি দাঁড়িয়ে থাকাও বারণ। এখানে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ইঙ্গিত আছে, কবিরাজরা টন টন সোনাচাদি এবং মুক্তা গিলতে বাধ্য করছেন রোগীকে।

এইভাবে জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ এসে গেল। আশানিরাশার দোলায় দুলছে পত্রলেখক বিবেকানন্দ। কখনও বলছেন, ঘুম হচ্ছে, কোনো অসুবিধা নেই, একটু বিশ্রাম নিলেই দুরাত্মা ডায়াবিটিস ও অ্যালবুমিন দূর হয়ে যাবে। কখনও লিখছেন, সম্ভব হলে ভাল আমলকী পাঠাও, কলকাতার আমলকী সুবিধের নয়। ক্রিশ্চিনকে লেখা স্বামীজির শেষ চিঠি : আমার সম্বন্ধে একটুও উদ্বিগ্ন হয়ো না। সেই সঙ্গে সুখবর, শরীর ইদানীং এতই ভাল যে শীর্ণতা কাটিয়ে মধ্যপ্রদেশে একটু ভুঁড়ির ইঙ্গিতও দেখা যাচ্ছে!

কিন্তু দুঃসময় তো সুদূর নয়। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা দেখছি, বারাণসীতেও তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তিনজন সেবক পালা করে সারারাত বিনিদ্র বিবেকানন্দকে হাত পাখার হাওয়া করছেন।

স্বামীজি বারাণসী থেকেই নিবেদিতাকে লিখছেন : বসতে পর্যন্ত পারছি না। সবসময় ঘুসঘুসে জ্বর, সেই সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। কয়েকদিন পরে পা এমন ফুলে ওঠে যে হাঁটতে পারছেন না।

জীবনের শেষ কয়েক মাস স্বামীজির রোগজীর্ণ শরীরকে কেন্দ্র করে অনেক ডাক্তারি হয়েছে।

অন্যতম চিন্তার কারণ শোথ বা ড্রপসি। কবিরাজ মহানন্দ সেনগুপ্ত এলেন। তার নির্দেশ, কয়েক সপ্তাহ জল ও নুন একেবারেই খাওয়া চলবে না। প্রতিজ্ঞা করলেন বিবেকানন্দ, তাই হবে। কী অসীম মনোবল থেকে এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা যায়, তা আমাদের মতন মানুষের চিন্তার বাইরে। তরল পদার্থের মধ্যে একটু দুধ। এমন দুর্জয় মনোবল যে মুখে জল দিয়ে মুখ কুলকুচি করছেন কিন্তু এক বিন্দু তৃষ্ণার জল গলা দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন না। শুধু কবিরাজী নয়, প্রিয় গুরুভাইরা বড় বড় অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তারের কাছেও ছুটছে। একজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে–ডাক্তার সন্ডার্স।

মহাসমাধির কয়েকদিন আগে হাওয়া বদলাতে স্বামীজি কলকাতার কাছে বড় জাগুলিয়া গিয়েছিলেন প্রথমে ট্রেনে, পরে গোরুর গাড়িতে সাত মাইল। আনন্দিত বিবেকানন্দ তার চিঠিতে লিখলেন, এমন ধকলের পরেও ড্রপসি ফিরে এল না, পা ফুলল না।

এরই মধ্যে নানা চিন্তায় বিপন্ন এবং বিব্রত আমাদের বিবেকানন্দ। অর্থাভাব। নিবেদিতার কাছে চিঠি, ইউরোপ থেকে সামান্য যে অর্থ নিয়ে এসেছিলাম তা মায়ের অন্নসংস্থান ও দেনা শোধে খরচ হয়ে গিয়েছে। সামান্য যা পড়ে আছে তা আমি স্পর্শ করতে পারব না, কারণ আত্মীয়দের সঙ্গে পৈত্রিক বাড়ির মামলায় খরচ যোগাতে হবে।

এই সময় গুরুভাই রামকৃষ্ণানন্দ মাদ্রাজ থেকে স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এসে, অবাক কাণ্ড করলেন। তার সারাজীবনের ব্যক্তিগত সঞ্চয় ৪০০ টাকা জোর করে তার প্রিয় গুরুভাইকে দিয়ে গেলেন। বিবেকানন্দ বিমোহিত–এমন ভালবাসা কে কোথায় দেখেছে? সেই টাকা গ্রহণ করলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিবেদিতাকে লিখলেন, ওই টাকা আমি মঠে রেখে দিয়েছি। যদি হঠাৎ আমার দেহাবসান হয় তা হলে অবশ্যই দেখো ওই টাকা যার সে যেন ফেরত পায়।

প্রায় এক বছর রাত্রে স্বামীজির চোখে ঘুম নেই। বিনিদ্র বিবেকানন্দর শরীর তখন এমন যে অসাবধানে স্পর্শ করলেও প্রবল যন্ত্রণা হয়। প্রিয় শিষ্যকে স্বামীজি বললেন, “আর কেন শরীর সম্পর্কে প্রশ্ন? প্রতিদিন দেহটা আরও বিকল হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় জন্মে, এই শরীরটা কোনও দিনই অসুখ থেকে মুক্ত ছিল না। স্বাস্থ্যের পক্ষে এই প্রদেশটা মোটেই ভাল নয়। একটু বেশি পরিশ্রম করতে চাইলেই, চাপ সহ্য করতে না পেরে দেহটা ভেঙে পড়ে।”

কাজ করতে করতে চলে যেতে চান কর্মযোগী বিবেকানন্দ। কুঁড়েমি করে বসে থাকার জন্যে তো এই মানব শরীরের সৃষ্টি হয়নি।

শেষ পর্বে স্বামীজির রোগের তালিকায় নতুন সংযোজন উদরী, অর্থাৎ পেটে জল হওয়া। তিরোধানের কিছু আগে রোগাক্রান্ত, বিনিদ্র, ধৈর্যচ্যুত, তিতিবিরক্ত যে বিবেকানন্দকে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রায়ই প্রিয়জনদের এমন বকাবকি করেন যে তাদের চোখে জল পড়ে।

*

আমরা আগেই দেখেছি, স্বামীজির অন্যতম সমস্যা ছিল বিনিদ্রা। ঈশ্বর এই মানুষটির চোখে ঘুম দিতে চাইতেন না, ফলে প্রায়ই সারারাত ধরে চলত নিদ্রাদেবীর চরণে হৃদয়বিদারী সাধাসাধি।

স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, “বেলুড়ে তখনও রাত আছে, উঠে পড়েছি, উঠেই স্বামীজিকে দেখতে ইচ্ছে হল। স্বামীজির ঘরে গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছি, ভেবেছি স্বামীজি ঘুমোচ্ছেন, উত্তর না আসলে আর জাগাবো না। স্বামীজি কিন্তু জেগে আছেন–ঐটুকু টোকাতেই উত্তর আসছে গানের সুরেনকিং নকিং হু ইজ দেয়ার? ওয়েটিং ওয়েটিং ও ব্রাদার ডিয়ার।”

মঠে এমন দিনও গিয়েছে যে আলোচনা করতে গিয়ে রাত দুটো বেজে গিয়েছে, স্বামীজি বিছানায় শোননি, চেয়ারে বসেই রাতটা কাটিয়েছেন। একবার নীলাম্বর মুখুজ্যের বাগানে নানাবিষয়ে রাত দুটো পর্যন্ত সন্ন্যাসীদের প্রাণবন্ত আলোচনা চললো। চারটে না বাজতেই অখণ্ডানন্দকে স্বামীজি সবাইকে তুলে দিতে বললেন–”লাগা ঘণ্টা, সব উঠুক, শুয়ে থাকা আর দেখতে পারছি না।”

অখণ্ডানন্দ বললেন, “এই দুটোর সময় শুয়েছে, ঘুমোক না একটু।”

স্বামীজি : “কি দুটোর সময় শুয়েছে বলে ছ’টার সময় উঠতে হবে নাকি? দাও আমাকে, আমি ঘণ্টা দিচ্ছি–আমি থাকতেই এই! ঘুমোবার জন্য মঠ হল না কি?”

বিনিদ্র বিবেকানন্দ সম্বন্ধে এত কথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে তা ধৈর্য ধরে সংগ্রহ করতে পারলে বোঝা যাবে মানুষটা জীবনের প্রতি মুহূর্তে কত কষ্ট সহ্য করেছেন, কিন্তু কিছুতেই পরাজয় মেনে নিতে চাননি। যে ৪ জুলাই (১৯০২) তার মহাসমাধি হলো, সেদিনও তিনি দিবানিদ্রার নিন্দা করলেন। সাধুদের বলেন, বললেন, “তোরা ঘুমোবি বলে মঠ হল নাকি?”

স্বামীজিকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে স্বামী অখণ্ডান মন্তব্য করেছেন, স্বামীজি কখনও রাগতেন না, তবে বকাবকি করতেন খুব। পান থেকে চুন খসবার উপায় ছিল না। যার উপর তার যত বিশ্বাস, যে যত আপনজন সে তত বেশি বকুনি খেত তাঁর কাছ থেকে। অন্তলীলা পর্বে এই বকুনির পরিমাণ বেশ বেড়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি চাইছিলেন এমন এক মঠজীবন তৈরি করে যাবেন যার কোনও তুলনা থাকবে না। শুধু অধ্যাত্মজীবন ও শাস্ত্ৰপঠন নয়, মঠের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাও হবে ত্রুটিহীন। তাই বিশ্ববিজয় করে বেলুড়ে ফিরে এসেও তিনি মঠের বড় বড় হান্ডা মেজেছিলেন–এক ইঞ্চি পুরু ময়লা।

শুনুন স্বামী অখানন্দের মুখে : “তিনি মঠের খাটা পায়খানা পরিষ্কার করেছেন–তা জানো? একদিন গিয়ে দেখেন খুব দুর্গন্ধ। বুঝতে আর বাকি কিছু রইল না। স্বামীজি গামছাটা একটু মুখে বেঁধে দু’হাতে দুটো বালতি নিয়ে যাচ্ছেন! তখন সবাই দেখতে পেয়ে ছুটে আসছে, বলছে, স্বামীজি আপনিস্বামীজির হাসি হাসি মুখ, বলছেন, এতক্ষণে স্বামীজি আপনি।”

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, স্থানীয় বালি মিউনিসিপ্যালিটি বেলুড় মঠকে বিদেশপ্রত্যাগত নরেন্দ্রনাথ দত্তের আমোদ-উদ্যান বলে নির্ধারিত করে মোটা ট্যাক্সো বসিয়ে দেন এবং এ নিয়ে শেষপর্যন্ত স্বামীজিকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। এই পর্বে মঠের পায়খানা পরিষ্কার বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সমকালের কোনও অবিচার, অবজ্ঞা ও অপমান কিন্তু বিবেকানন্দকে স্পর্শ করতে, স্তব্ধ করতে, অথবা বিরক্ত করতে পারেনি। তার যত কিছু মান-অভিমান ও বকাবকি সব তার প্রিয় গুরুভাই ও শিষ্যদের প্রতি। শেষপর্বে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা সামলেছেন তার চিরবিশ্বস্ত সখা স্বামী ব্রহ্মানন্দ। যাঁর ডাকনাম রাখাল। স্বামীজি ছিলেন রাখালের থেকে নয়দিনের বড়। বিশ্বসংসারের সমস্ত আঘাত, আর সেইসঙ্গে রোগজর্জর শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা নিঃশব্দে সহ্য করে, স্বামীজি বকতেন তার অতি প্রিয়জনদের, তাদের কাছে আশা করতেন পান থেকে চুন খসবে না, সবকিছু হয়ে উঠবে সর্বাঙ্গসুন্দর।

হরিমহারাজের স্মৃতি থেকে (স্বামী তুরীয়ানন্দ) আমরা জানতে পারি, স্বামীজি একদিন মঠ থেকে রেগে বেরিয়ে গেলেন। বললেন, “তোরা সব ছোটলোক, তোদের সঙ্গে থাকতে আছে! তোরা সব আলু-পটল শাক পাতা নিয়ে ঝগড়া করবি।”

বলাবাহুল্য রাগতেও যত সময় ঠাণ্ডা জল হয়ে যেতে তার থেকেও কম সময় নিতেন স্বামীজি। কিন্তু সন্ন্যাসীদের কাছে তার প্রত্যাশা ছিল সীমাহীন। “তোরা সব বুদ্ধিমান ছেলে, হেথায় এতদিন আসছিস। কী করলি বল দিকি? পরার্থে একটা জন্ম দিতে পারলি না? আবার জন্মে এসে বেদান্ত-ফেদান্ত পড়বি। এখন পরসেবায় দেহটা দিয়ে যা, তবে জানব আমার কাছে আসা সার্থক হয়েছে।”

রামকৃষ্ণ মঠের প্রথম অধ্যক্ষ রাজা মহারাজ (ব্রহ্মানন্দ) একবার বলেছিলেন, “স্বামীজিকে কে বুঝেছে, কে বুঝতে পারত? তাঁর বই পড়ে, তাকে বোঝা, আর তার কাছে থেকে তাকে বোঝা এক জিনিস নয়। তার কাছে থাকা, তাকে সহ্য করা যে কত কঠিন ছিল তা এরা জানে না। তার বকুনি সহ্য করতে না পেরে আমারই কতবার মনে হয়েছে মঠ ছেড়ে চলে যাই। একদিন বকুনি খেয়ে দুঃখে অভিমানে দরজা বন্ধ করে কাঁদছি, কিছুক্ষণ পরেই স্বামীজি দরজায় টোকা মারছেন, দরজা খুল্লম। চোখে জল দেখে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘রাজা, ঠাকুর তোমাকে কত আদর করতেন, ভালবাসতেন, সেই তোমাকেই আমি বকি, কত কটু কথা বলি, আমি আর তোমাদের কাছে থাকবার যোগ্য নই।

বলতে বলতে স্বামীজির চোখে জল ঝরছে, আমি তখন তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললাম, তুমি ভালবাস বলেই বকো, বুঝতে পারি না বলে অনেক সময় কান্না পায়।

স্বামীজি বলতে লাগলেন, আমি কী করব, আমার শরীরটা চব্বিশ ঘণ্টাই জ্বলছে, মাথার ঠিক থাকে না। আমি বেঁচে থাকলে তোমাদের হয়ত বৃথা কষ্ট দেব। দেখ রাজা, একটা কাজ করতে পারো? ওদের রেসিং হর্স যখন অকেজো হয়ে পড়ে তখন কী করে জানো? তাকে বন্দুকের গুলিতে মেরে ফেলে। আমি তোমাকে একটা রিভলবার জোগাড় করে দেব, তুমি আমাকে গুলি করে মারতে পারবে? আমাকে মারলে কোনও ক্ষতি হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে।”

এই রাজা মহারাজ বেলুড়ে পাঁচটি চারা বাতাবি লেবু গাছ। লাগিয়েছিলেন, কারণ ডাক্তাররা বিবেকানন্দকে বাতাবি লেবু খেতে বলেছিলেন।

স্বামীজির শরীর থাকতে থাকতে কেবল গাছগুলিতে ফুল দেখা দিয়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দ খুব দুঃখ করতেন। শোনা যায়, রাজা মহারাজকে স্বামীজি শেষের দিকে একবার বলেছিলেন, “এবার যা হয় একটা এপার ওপার করব, হয় শরীরটা ধ্যান, জপ করে সারিয়ে কাজে ভাল করে লাগব, না হয় তো এ ভাঙা শরীর ছেড়ে দেব।”

রোগজর্জরিত সিংহের আর এক মর্মস্পর্শী ছবি পাওয়া যায় স্বামী গম্ভীরানন্দর বর্ণনায়। “স্বাস্থ্য ভাল না থাকায় তিনি সবসময় নিচে নামিতে পারিতেন না–তখন শয্যাতেই শায়িত থাকিতেন–অসুখ কম থাকিলে তিনি নিচে নামিয়া ভ্রমণে বাহির হইতেন…কখনও কেবলমাত্র কৌপীনপরিহিত হইয়া মঠের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতেন, অথবা একটা সুদীর্ঘ আলখাল্লায় দেহ আবৃত করিয়া পল্লীর নিভৃত পথে একাকী বিচরণ করিতেন।…অনেক সময় রন্ধনশালায় গিয়া রন্ধনাদি পর্যবেক্ষণ করিতেন, অথবা স্বয়ং শখ করিয়া দুই-একটি উৎকৃষ্ট দ্রব্য প্রস্তুত করিতেন।”

এই পর্বে তিনি যে সামাজিক আদব-কায়দার ধার ধারতেন না তা এখন আমাদের অজানা নয়।

যেমন ইচ্ছা তেমন ঘুরে বেড়াতেন–”কখনও চটিপায়ে, কখনও খালি গায়ে, কখনও গেরুয়া পরিয়া, কখনও বা খালি কৌপীন আঁটিয়া, অনেক সময় হাতে থাকিত হুঁকা বা লাঠি।…তিনি থাকিতেন আপন নির্জন মানসভূমিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দ।”

একাধিক স্মৃতিকথায় দেখা যাচ্ছে, শেষ দিকটায় স্বামীজি মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন।

স্বামী অখণ্ডানন্দ বলেছেন, “বরং গোখরো সাপ পোষ মানে, তবে মানুষ বসে আসে না। স্বামীজিও শেষ দিকটায় মানুষের উপর বিরক্ত হয়ে, শরীর ছাড়বার আগে মায়ার বন্ধন কাটাতে মানুষের সংস্রব একরকম ছেড়ে দিয়েছিলেন।”

অন্য এক দৃষ্টিকোণ থেকে–মানুষের উপর বিশ্বাস মোটেই টলেনি, কিন্তু বাল্যের কিছু অভ্যাস ফিরে আসতে চাইছিল তার মধ্যে। যেমন পশুপক্ষীর প্রতি প্রবল আগ্রহ।

পায়রার শখটা স্বামীজি পেয়েছিলেন তার মামাহীন মামার বাড়ির দিক থেকে। জননী ভুবনেশ্বরীও পায়রা ভালবাসতেন বলে বাড়িতে বরাবর পায়রা থাকতো। ছোটবেলায় স্বামীজির খেয়াল হল ময়ূর, ছাগল, বাঁদর ইত্যাদি পুষবেন। তিনি নিজের হাতে এদের খাওয়াতেন। ময়ূরটিকে পাড়ার লোকরা ঢিল মেরে মেরে শেষ করল। বাঁদরটি এমন উৎপাত করত যে তাকে বিদায় করার পথ রইল না। মেজভাই মহেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ছাগলটি গৌরমোহন স্ট্রিটের ঠাকুরদালানের নিচে কিছুদিন ছিল।

স্বামীজির বেশ কিছু বাল্যস্বভাব দুর্জয়ভাবে ফিরে এল মহাসমাধির কিছু আগে। স্বামীজি নিজে দাঁড়িয়ে সব জানোয়ারকে খাবার খাওয়াতেন। “কতকগুলো চিনেহাঁস, রাজহাঁস, পাতিহাঁস একদিকে, ছাগল-ভেড়া একদিকে, পায়রা একদিকে এবং গরু একদিকে।”

স্বামীজি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদের খাওয়া দেখতেন। বেলুড়ের চিড়িয়াখানায় আরও সভ্য ছিল–যেমন কুকুর, সারস, বেড়াল, গাভী, ভেড়া ও হরিণ। এদের সঙ্গে তিনি শুধু কথা বলতেন তা নয়, এদের সুন্দর সুন্দর নাম দিয়েছিলেন। যেমন চিনা হাঁসের নাম যশোবতী, রাজহাঁসের নাম বম্বেটে, ছাগলের নাম হংসী, ছাগলছানার নাম মটরু। প্রিয় কুকুরের নাম বাঘা, আর দুটি কুকুরের নাম মেরি ও টাইগার।

মটরুর গলায় তিনি ঘুঙুর পরিয়ে দিয়েছিলেন। সে স্বামীজির পায়ে পায়ে ঘুরত, স্বামীজিও ছোট ছেলের মতো তার সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতেন।

মটরু মরে গেলে স্বামীজি দুঃখ করেছিলেন, “কী আশ্চর্য, আমি যেটাকে একটু আদর করতে যাই, সেটাই যায় মরে।” আর একদিন বলেছিলেন, “মটরু নিশ্চয় আর জন্মে আমার কেউ হত!”

মাঝে মাঝে ছাগলী হংসীর কাছে গিয়ে তিনি চায়ের দুধের জন্য এমনভাবে অনুনয়-বিনয় করতেন, যেন দুধ দেওয়া না-দেওয়া হংসীর ইচ্ছাধীন।

স্বামীজির এই সময়কার চিঠিপত্রে তাঁর প্রিয় পশুপাখিদের অনেক খবর পাওয়া যাচ্ছে। স্বামী গম্ভীরানন্দ তাঁর বইতে নিবেদিতাকে লেখা স্বামীজির চিঠির উল্লেখ করেছেন। “আমার সেই বিশালাকায় সারসটি এবং হংস হংসীগুলি খুবই স্ফুর্তিতে আছে। আমার পোষ কৃষ্ণসারটি মঠ থেকে পালিয়েছিল এবং তাকে খুঁজে বার করতে আমাদের দিনকয়েক বেশ উদ্বেগে কাটাতে হয়েছে। আমার একটি হংসীদুর্ভাগ্যক্রমে কাল মারা গেছে। প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।…একটি রাজহংসীর পালক খসে যাচ্ছিল। আর কোন প্রতিকার জানা না থাকায় একটা টবে খানিকটা জলের সঙ্গে একটু কার্বলিক এসিড মিশিয়ে তাতেই কয়েক মিনিটের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।…তা হংসীটি এখন ভাল আছে।”

১৯০২ সালে স্বামীজি স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কাশী গিয়েছিলেন, কিন্তু তখন তার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। ডায়াবিটিসের দাপটে একটি চোখ প্রায় নষ্ট। তখনও কিন্তু তিনি চিঠিতে বেলুড়ে ব্রহ্মানন্দকে অনুরোধ করছেন, “ছাগলটাকে একটু দেখো।”

সিস্টার ক্রিশ্চিনকে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজি এক চিঠিতে (২৭ মে ১৯০২) জানাচ্ছেন, “দুটি ছাগলছানা ও তিনটি ভেড়া সদ্য আমার ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আরও একটি ছাগলছানা ছিল, কিন্তু সে হলদে রঙের মাছের চৌবাচ্চায় ডুবে মরেছে।”

ডাক্তারের নির্দেশনা মেনে পরিবারের নতুন সদস্যদের দেখতে বেরোবার আগে বিবেকানন্দ লিখছেন, “একটা রাজহাঁস একেবারে বোকা এবং ভীতু সবসময় হতাশ আর কাতর। সে একলা থাকতে চায়, বেচারা বড্ড দুঃখী।”

পশুপালন সম্পর্কে জুন ১৯০১ সালের শেষদিকে বেলুড় মঠ থেকে স্বামীজি তাঁর স্নেহের শিষ্যা ক্রিশ্চিনকে আর একটি চিঠি লেখেন। “আমার এখানে কয়েকটি ছাগল ভেড়া গোরু কুকুর এবং সারস রয়েছে। সারাদিন ধরে আমি তাদের দেখাশোনা করছি। আমার সুখের জন্যে এই চেষ্টা নয়–তার প্রয়োজন কী? আমরা অসুখীও বা হব না কেন? দুটোরই কোন মানে হয় না। আমি স্রেফ সময় কাটাবার চেষ্টা চালাচ্ছি।”

কয়েকমাস পরে ক্রিশ্চিনের কাছে লেখা চিঠিতে জানা যাচ্ছে, নবজাত দুটি শাবককে বাঁচাবার জন্য তাদের গোরুর দুধ খাওয়াচ্ছেন স্বামীজি, কিন্তু রাতের অন্ধকারে তারা মারা গেল।

“আমার দুটি হাঁস তাদের ডিমে তা দিচ্ছে। যেহেতু এ দুটি তাদের প্রথম সন্তান এবং যেহেতু পুরুষ হাঁসের কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু আমি নিজেই খাইয়ে-দাইয়ে তাদের শক্তি অটুট রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি। এখানে চিকেন প্রতিপালন হয় না–এই বস্তুটি এখানে নিষিদ্ধ।”

স্বামী অখণ্ডানন্দ কিন্তু নিজের মত পরিবর্তনে রাজি নন। তিনি বলে যাচ্ছেন : “স্বামীজি শেষটায় মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে হতাশ হয়ে জীবজন্তু নিয়ে থাকতেন।…দস্তুরমতো একটা চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। নিজের সেবার টাকা থেকে তাদের জন্য ১০০ টাকা খরচ করতেন।”

স্বামী ব্রহ্মানন্দের উপর ছিল বাগানের ভার এবং পশুদের হাত থেকে বাগানের ফসল রক্ষার জন্য যে বেড়া দেওয়া হচ্ছে তাও বিদেশিনী ভক্তরা স্বামীজির চিঠি থেকে নিয়মিত জানতে পারছেন। দুই গুরুভাই প্রায়ই বাগান ও গোচারণভূমির সীমা-বিভাগ নিয়ে মধুর কলহে প্রবৃত্ত হতেন এবং তাতে মঠবাসীরা খুব আমোদ উপভোগ করতেন।

স্বামীজির অতিপ্রিয় সারমেয় বাঘা নিতান্ত সাধারণ কুকুর নয়, সে মঠের জনসংযোগ অধিকর্তার দায়িত্ব পালন করত, বিশিষ্ট অতিথিদের মঠের গেট থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে এনে দিত। এ-বিষয়ে শঙ্করীপ্রসাদ বসু যে বিবরণ সংগ্রহ করে দিয়েছেন তা পাঠকদের আনন্দ দেবে।

স্বামীজির শেষদিনগুলিতে বুঝতে গেলে বাঘাকেও জানা দরকার। “একবার অত্যধিক দুষ্টুমির জন্য তাহাকে গঙ্গার পরপারে নির্বাসনে যাইতে হয়। কিন্তু বাঘা এই ব্যবস্থা মানিয়া লইতে সম্মত ছিল না–সে মঠকে ভালবাসিত, বিশেষত স্বামীজিকে ছাড়িয়া থাকিতে পারিত না। সারাদিন অতীব দুঃখে কাটাইয়া সে সন্ধ্যাকালে এক ফন্দি আঁটিল এবং খেয়া নৌকায় উঠিয়া বসিল। নৌকার মাঝি ও আরোহীরা তাহাকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলেও সেনামিলনা,বরং দন্ত বাহির করিয়া ও গর্জন করিয়া ভয় দেখাইতে লাগিল।…এপারে আসিয়া সে রাত্রিটা এদিক-ওদিক লুকাইয়া কাটাইল। ভোর চারিটায় স্বামীজি স্নানাগারে যাইতেছেন, এমন সময় পায়ে কী একটা ঠেকায় তিনি চমকিয়া উঠিলেন ও চাহিয়া দেখিলেন বাঘা! বাঘা তাহার পায়ে লুটাইয়া মিনতিপূর্ণ কণ্ঠে ক্ষমাভিক্ষা ও পুনঃপ্রবেশাধিকার ভিক্ষা করিতে লাগিল।…স্বামীজি তাহার পিঠ চাপড়াইয়া আদর করিলেন ও আশ্বাস দিলেন, অধিকন্তু সকলকে বলিয়া দিলেন, বাঘা যাহাই করুক, আর তাহাকে তাড়ানো চলিবে না।”

স্বামী অখণ্ডানন্দর স্মৃতি থেকে আমরা স্বামীজির দেহাবসানের পরে পশুশালার শেষ পরিণতির কিছু দুঃখজনক খবরও পাই। অন্য কোথাও এই বিবরণ আমার চোখে পড়েনি। স্বামী অখণ্ডানন্দ লিখেছেন, “আশ্চর্যের বিষয়, স্বামীজির দেহরক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভক্ত পশুপাখী সব মরে যায়। তিনি যাকে যা দিয়ে গিয়েছিলেন, তার একটিও বেশিদিন বাঁচেনি। ভক্তেরা বলেন, তারা সব উদ্ধার হয়ে গেল।”

স্বামীজির দেহাবসানের পর খোকা মহারাজ (স্বামী সুবোধানন্দ) কয়েকটি পশুপক্ষী স্বামী অখণ্ডানন্দকে দিয়েছিলেন। শুনুন তাদের শেষ পরিণতির কথা। “একটি বেড়াল স্বামীজির পায়রাটিকে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। অমূল্য মহারাজ (স্বামী শঙ্করানন্দ) সেইসময় আশ্রমে ছিলেন। তিনি বিড়ালটিকে এমন ঘুষি মেরেছিলেন যে তাঁর হাত থেতলে গিয়েছিল।”

একমাত্র প্রিয় বাঘাই অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবী হয়েছিল। স্বামীজির লীলাসংবরণের অনেককাল পরে বাঘার মৃত্যু হইলে তাহার দেহ গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হইল। জোয়ারের সময় সে শরীর ভাসিয়া চলিয়া গেলেও ভাটার সময় সকলে সবিস্ময়ে দেখিলেন, উহা মঠের সীমানার মধ্যেই গঙ্গার পলিমাটির উপর পড়িয়া আছে। ইহাতে মঠের প্রতি বাঘার প্রাণের টানের পরিচয় পাইয়া মঠবাসী একজন ব্রহ্মচারী অপরদের অনুমতিক্রমে ওই দেহ ওই স্থানেই সমাধিস্থ করিলেন।”

ডায়াবিটিস ধরা পড়ার সামান্য কিছুদিনের মধ্যে স্বামীজির শরীর কীভাবে ভেঙে পড়ে তার নানা ইঙ্গিত ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন চিঠিপত্রে এবং নানা স্মৃতিকথায়। মহাসমাধির কিছুদিন আগে কলকাতার বলরাম বসুর বাড়িতে সেকালের একজন প্রখ্যাত চিকিৎসককে ডাকা হয়েছিল স্বামীজিকে দেখতে। বিভিন্ন চিকিৎসায় স্বামীজি তখন যে কতখানি ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে বড় ডাক্তার সম্পর্কে তার মন্তব্যে। তিনি বলেন, “কী ছাই জানে! দু’চারখানা বই পড়ে ভাবে–আমরা সব মেরে দিয়েছি। আমরা সব জানি। আমরা সব বুঝি।”

দেহত্যাগের এক সপ্তাহ আগে উত্তর কলকাতার বাগবাজারে শিষ্য অসীম বসুর সঙ্গে স্বামীজির দেখা হলো। শিষ্যের বাড়ির সামনে দ