.
ঘটনাচক্রে পটলাদার আর এদেশে ফিরে আসা হয়নি; বিদেশেই তিনি ঘর সংসার পেতেছেন, কিন্তু বিবেকানন্দ-অনুসন্ধান কখনও ত্যাগ করেননি। বেশ কিছু চিঠিপত্র নানা খবরে বোঝাই করে বিমান ডাকে তিনি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমিও কিছু কিছু খবর বিক্ষিপ্তভাবে সংগ্রহ করেছি নানা সূত্র থেকে, যার মধ্যে বিবেকানন্দর নিজের লেখা, নিজের চিঠি, নিজের বক্তৃতা ছাড়াও রয়েছে নানাজনের স্মৃতিকথা। এইসব সংগৃহীত হতে মহাসমাধির পরেও এক শতাব্দী লেগে গিয়েছে। শতাব্দীর সন্ধানেও সব খবর যে এখনও সংগৃহীত হয়নি তা জোরের সঙ্গেই বলা চলে। এক রান্নার পর্ব শেষ হতে না হতেই আরেক রান্নার সময় এসে যায়, কিন্তু কোথাও তো অপেক্ষমাণ অতিথিদের জানাতে হবে, খাবার রেডি, আসুন, মহামানব বিবেকানন্দকে নতুন এক ভূমিকায় দেখুন এবং আমাদের মতন আপনিও বিস্ময়ে অভিভূত হোন।
.
মাতা ভুবনেশ্বরী দেবীর পিতৃকুল ছিলেন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব, শুধু নিরামিষ নয় সেখানে পরিবার সদস্যদের গোবর-তুলসীও নিয়মিত গ্রহণ করার রীতি ছিল। এই প্রভাব শুরুতে সিমুলিয়ার আমিষভক্ষক দত্তপরিবারেও পড়েছিল। আমরা একটি দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি–গৌরমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে খেতে বসে বালক নরেন পাতে কিছু নিতে রাজি হচ্ছেন না, কারণ তরকারির সঙ্গে মাছের স্পর্শ ঘটেছে এবং পরিবেশিকা দিদি স্বর্ণময়ীর সঙ্গে তার বাদানুবাদ চলেছে। পিতৃদেব বিশ্বনাথ নিজেও ছিলেন একজন ভোজনরসিক ও রন্ধন-বিলাসী। বাড়িতে বাবুর্চি আনিয়ে নানা মোগলাই খাদ্যের আয়োজন তিনি প্রায়ই করতেন। ভাই-বোনের কথা কাটাকাটির আওয়াজ শুনে স্নানের জায়গা থেকে পিতৃদেব বিশ্বনাথ বিরক্তি প্রকাশ করলেন, “ওর চোদ্দপুরুষ গেঁড়িগুগলি খেয়ে এল, আর এখন ও সেজেছে ব্রহ্মদত্যি, মাছ খাবে না!”
ব্রহ্মদত্যিরা যে মাছ-মাংস স্পর্শ করে না তা সেই প্রথম জানলাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিমুলিয়ার দত্তপরিবারে যে যথেষ্ট রুচিপরিবর্তন ঘটেছে তাও দেখা গেল তখনকার সি পি অর্থাৎ সেন্ট্রাল প্রভিন্সেসের পথে। মা-বাবার সঙ্গে নরেন, ভ্রাতা মহিম ও বোনরা চলেছে রায়পুরে। ঘোড়াতালাওতে মাংস রান্না হল। দিদিমার প্রভাবে মেজভাই মহিম তখন মাছ-মাংস মুখে দেয় না। পরবর্তীকালে মহেন্দ্রনাথ লিখছেন : “আমি খাব না, বমি আসতে লাগল। দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল–’খা। তারপর আর কি? বাঘ নতুন রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।”
মঠ-মিশন প্রতিষ্ঠার আগে নরেনের সাংগঠনিক শক্তির প্রথম প্রকাশ দেখা গিয়েছে এই রান্নার ক্ষেত্রেই। নরনারায়ণের সেবার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে এক অভাবনীয় প্রতিষ্ঠান ‘গ্রিডি ক্লাব’ সংগঠন, যার বাংলা মহেন্দ্রনাথ করেছেন ‘পেটুক সঙ্ঘ’–যার উদ্দেশ্য কেবল ভোজন নয়, সেই সঙ্গে রান্না নিয়ে রীতিমত রিসার্চ। প্রতিষ্ঠাতার দৃষ্টি সারা বিশ্বের দিকে প্রসারিত। ভবিষ্যতের বিশ্ববিবেক এই সময় পুরনো বইওয়ালার কাছ থেকে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত ফ্রেঞ্চ রান্নার বই কিনতে আরম্ভ করেছেন। যে ফরাসী জাত অর্ধসভ্য ইউরোপকে ভদ্রস্থভাবে রান্নাবান্না করে খেতে দেতে শিখিয়েছে, যে ফরাসীজাত ও সভ্যতার গুণগানে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ একদিন মুখর হবেন, তার আদিতে কমবয়সের ফ্রেঞ্চকুকিং এর সাধনা। ফরাসীরা বড়ই সৃষ্টিশীল, এঁদের সংস্পর্শে যাঁরাই আসেন তাঁরাও সৃষ্টিশীল হয়ে ওঠেন। আমরা তার স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছি গ্রিডি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতার গবেষণামূলক রন্ধনে। এই পর্যায়ে নরেন্দ্রনাথের সফলতম আবিষ্কার হাঁসের ডিম খুব ফেটিয়ে চালে মাখিয়ে কড়াইশুটি ও আলু দিয়ে ভুনি-খিচুড়ি। পলোয়ার চেয়ে এই রান্না যে অনেক উপাদেয় একথা বহুবছর পরেও বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেছেন! বাবা রাঁধাতেন কালিয়া এবং পলোয়া, আর সুযোগ্যপুত্র আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে নতুন ডিশের মাধ্যমে পূর্বপশ্চিমকে একাকার করে দিলেন।
কিন্তু শুধু হাইলেভেলের রান্না নয়, এই ক্লাবের অন্যতম সভ্য হয়েছিলেন রাখাল, যিনি পরে স্বামী ব্রহ্মানন্দ নামে এক দুর্যোগপূর্ণ সময়ে রামকৃষ্ণ মঠমিশনের প্রকৃত রক্ষাকর্তা হয়েছিলেন। কুস্তিগীর রাখাল যে প্রতিদিন শরীরচর্চার পরে আধসের কচুরি ও আনুপাতিক আলুচচ্চড়ি খেতেন তা এখন আমাদের অজানা নয়। বলাবাহুল্য, তখন কচুরির সের ছ’আনা, আরও আগে নাকি তিন আনা সের ছিল, কিন্তু বিবেকানন্দ ভ্রাতা মহিমবাবু সেই স্বর্ণযুগ দেখেননি!
কিন্তু কচুরি, সিঙাড়া, খিচুড়ি, পলোয়ার বাইরেও আর একটি খাদ্যের প্রতি স্বামীজির প্রবল টানের প্রমাণ আমাদের কাছে রয়েছে। পরবর্তী জীবনে জেলা জজ নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, কম বয়সে নরেন তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত আসতেন, “কৈলাস খাবারওয়ালা নানা রকমারি খাবার ঝুড়ি ভরে রোজ বাড়িতে আনত। সব ছেলেরা মিলে পরমানন্দে জলপান করা হত। আমাদের সব কারুর দু’পয়সা বরাদ্দ, কারুর চারপয়সা, কারুর দু’আনা।…স্বামীজির সিনিয়র গ্রেড, ন’কাকার র্যাঙ্কের…জিবে গজা ওঁর বড়ই প্রিয়, একদিনের কথা, ওঁর বখরায় যা পেলেন, তাতে সন্তুষ্ট নন। একখানা গজা হঠাৎ তুলে নিয়ে সব্বাইয়ের সামনে নিজের জিবে ঠেকালেন এবং অম্লান বদনে হাঁড়ির মধ্যে টপ করে ফেলে হো হো করে হেসে বললেন, ওরে তোরা কেউ গজা খাসনি–এই য্যা–সব এঁটো হয়ে গেল। হাঁড়িসুদ্ধ একাই মেরে দিলেন। কী আমোদই করতেন!”