জানি আব্বা।
আব্দুল মতিন গর্জন করে উঠলেন, তবু খেলাপ করলে কেন?
সুরাইয়া শ্বশুরের ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলল, ফেঁপাতে ফেঁপাতে বলল, ইকবাল হোসেন স্যার হিসাবে যখন এসেছিল তখন থেকে বড় আপার পরিবর্তন লক্ষ্য করি। খুব কম খাওয়া দাওয়া করে। আমাদের সঙ্গে আগের মতো কথাও বলে না। ইদানিং বড় আপা সারারাত জেগে নামায পড়ে, কুরআন পড়ে, ডাইরি লেখে। দিন দিন খুব। রোগা হয়ে যাচ্ছে। আমার কেবলই মনে হয়, বড় আপা অল্প দিনের মধ্যে কঠিন
অসুখে পড়বে। তাই আমি ভয় পেয়ে–।
আব্দুল মতিন আবার ধমক দিয়ে গর্জে বললেন, তুমি এ বাড়ির বৌ হয়ে মাত্র কয়েক বছর এসেছ। আমাদের বংশের মান ইজ্জত কত, তা এখনো জাননি। তোমার সাহস দেখে আমি খুব অবাক হচ্ছি। একটা কথা জেনে রেখ, বংশের মান ইজ্জৎ রক্ষার জন্য শুধু একটা রুকসানাকে নয়, দশটা রুকসানা থাকলেও সবাইকে দু’টুকরো করে উঠোনে পুঁতে ফেলতাম। আর একটা কথা, তুমি কি এই ব্যাপারটা কাউকে জানিয়েছ?
শ্বশুরের কথা শুনে সুরাইয়া ভয় পেয়ে কাঁপছিল। তাই আপনা থেকে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, জি না আব্বা, কাউকেই বলিনি।
আব্দুল মতিন কর্কশ স্বরে বললেন, জীবনে কোনোদিন কাউকেই বলবে না। আর তুমি রুকসানার ডাইরি পড়ে যা জেনেছ, তা ভুলে যাও। সাবধান করে দিচ্ছি, এর পরও যদি কোনো কিছু কানে আসে, তাহলে এ বাড়িতে তোমার স্থান হবে না। যাও, এবার তুমি যেতে পার।
সুরাইয়া চোখ মুছতে মুছতে ফিরে এসে সবাইকে শ্বশুর যা কিছু বলেছেন বলে বলল, তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই লাগে, এসব কথা নিয়ে আর কোনোদিন কানাকানি কর না। কিছুদিন চুপচাপ থাক, আব্বার রাগ পড়লে উনি হয়তো তোমাদেরকে ডাকতে পারেন। তখন যা বলার বলো।
রুকসানা আব্বার রুম থেকে এসে বাথ রুমে গিয়েছিল। ফেরার সময় সুরাইয়াকে আব্বার রুমে যেতে দেখে সন্দেহ হল। দরজার আড়ালে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমে সুরাইয়ার কথা শুনে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছিল। তারপর আব্বার কথা শুনে মনে হল, জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কোনো রকমে টলতে টলতে এসে বিছানায় শুয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অনেকক্ষণ কাদার পর হঠাৎ তার মন বলে উঠল, কাল সকালে মা বাপের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? তার চেয়ে মরণ ভালো। ইকবালকে পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। তাকে জীবনেও পাবে না। বেঁচে থেকে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। তোমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। বেঁচে থাকলে তোমার আব্বা হয়তো ইকবালকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। তাই আজ রাতেই তুমি গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাও। রুকসানা উদভ্রান্তের মতো ঘরময় পায়চারী করতে লাগল। হঠাৎ আবার কে যেন তার মনের ভিতর থেকে বলে উঠল, তুমি না ধার্মিক মেয়ে, তুমি কি জান না, আত্মহত্যা করা মহাপাপ? আত্মহত্যাকারী চিরকাল জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে?
এবার রুকসানা খুব ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল।
রুকসানা প্রতিদিন সকালে ফজরের আজানের সময় উঠে সবাইয়ের দরজা নক করে জাগিয়ে বলে, ফজরের নামাযের সময় হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে নামায পড়।
আজিজা বেগম অবশ্য আযানের সাথে সাথে উঠে প্রথমে স্বামীকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যান। বাথরুমের কাজ শেষ হলে বাইরে এনে অজু করিয়ে ঘরে এনে মসল্লা বিছিয়ে বসিয়ে দেন। আব্দুল মতিন বসে নামায পড়েন। স্বামীকে মসল্লায় বসিয়ে নিজে অজু করে এসে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করেন। আজও সময় মতো উঠে নামায পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, আজ রুকসানার গলা পেলাম না কেন? তাহলে কি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি? কুরআন বন্ধ করে রুকসানার রুমের দিকে যাওয়ার সময় ভেন্টিলেটরের দিকে লক্ষ্য পড়তে বুঝতে পারলেন, রুমে আলো জ্বলছে। ভাবলেন, ঘুমোবার সময় হয়তো, আলো নেভাতে ভুলে গেছে। কাছে এসে তাকে জাগাবার জন্য দরজা নক করতে যেতে দরজা খুলে গেল। ভিতরে তাকাতে দেখতে পেলেন, আলুথালু বেশে রুকসানা ঘরের মেঝেয় শুয়ে আছে। আতঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি তার কাছে গিয়ে গায়ে হাত রেখে নাড়া দিয়ে বললেন, এই রুকসানা, মেঝেয় শুয়ে আছিস কেন? কয়েকবার নাড়া দিয়ে ডেকে সাড়া না পেয়ে মুখে হাত দিয়ে জানতে পারলেন, অজ্ঞান হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি জগ থেকে হাতে পানি নিয়ে মুখে ঝাঁপটা দিয়ে নাম ধরে কয়েকবার ডাকলেন। কাজ না হতে আব্দুর রশিদ ও সুরাইয়াকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে এলেন।
তারা এসে রুকসানাকে খাটে শুইয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল।
আজিজা বেগম অন্য দু’ছেলে ও বৌকে ঘটনা জানিয়ে যেতে বলে স্বামীর কাছে এলেন।
আব্দুল মতিন বললেন, কি ব্যাপার? কুরআন পড়া বন্ধ করে এদিক ওদিক করছ কেন?
আজিজা বেগম রুকসানার কথা বলে স্বামীকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিয়ে এলেন।
সবকিছু দেখে শুনে আব্দুল মতিনের সন্দেহ হল। ভাবলেন, তাহলে কী রুকসনা আমার ও বৌমার কথা শুনে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেয় পড়েছিল?
বেশ কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর রুকসানার জ্ঞান ফিরল। সুরাইয়া পানি ঢালা বন্ধ করে ঝাড়ন দিয়ে মাথার চুল মুছে দিল।
আব্দুল মতিন জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছিল মা? মেঝেয় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি কেন?
রুকসানা উঠে বসে প্রথমে পরিস্থিতি উপলব্ধি করল। তারপর বলল, এক ঘুমের পর বাথরুমে গিয়েছিলাম। ফিরে আসার সময় হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই। তারপর। আর কিছু মনে নেই।