- বইয়ের নামঃ ভাঙ্গাগড়া
- লেখকের নামঃ কাসেম বিন আবুবাকার
- প্রকাশনাঃ আফসার ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. গ্রীষ্মের অপরাহ্ন
ভাঙ্গাগড়া – ইসলামিক প্রেমের উপন্যাস – কাসেম বিন আবুবাকার
০১.
গ্রীষ্মের অপরাহ্ন। বেলা তখন তিনটে। রোদের তেজ কমেনি। লোজন ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছে। যুবাইদা খানম চার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমাচ্ছেন। শবনমের চোখে ঘুম নেই, তবু ঘুমের ভান করে পড়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে মাথা তুলে মা, মেজভাই ও হোট দুভাই বোনের দিকে তাকিয়ে দেখল, তারা ঘুমিয়ে পড়েছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে চৌকি থেকে নেমে আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে এসে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চেীধুরীদের বাগানের দিকে ছুট দিল। বাগানটা বেশি দূরে নয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাগানের ভিতরে ঢুকে আতাহারকে দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল।
আতাহার আগেই এসেছে। শবনমের দেরি দেখে রেগে ছিল। তারপর তাকে আসতে দেখে সাজা দেওয়ার জন্য একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে তার দিকে লক্ষ্য রাখল।
শবনম তাকে খুঁজে না পেয়ে ভাবল, তাহলে আতাহার কি এখনও আসেনি? তারপর একটা গাছের গোড়ায় বসে পথের দিকে চেয়ে রইল।
আতাহার পিছন দিক থেকে পা টিপে টিপে এসে দুহাতে তার দুচোখ চেপে ধরল।
শবনম চমকে উঠে তার হাত ধরে বুঝতে পারল আতাহার। মুখ ভার করে বলল, যাও তোমার সঙ্গে কথা বলব না। আমার ভয় করেনা বুঝি? আসা অবধি তোমাকে না দেখে এমনিতেই ভয় লাগছিল।
আতাহার চোখ ছেড়ে দিয়ে তার পাশে বসে বলল, কিসের ভয় শুনি?
কিসের আবার? এই ভর দুপুরে কেউ কোথাও নেই। তুমি না হয়ে যদি অন্য কেউ হত?
এই সময় কেউ এদিকে ভুলেও আসবে না। আশ পাশের সবাই জানে চৌধুরীদের বাগানে ভূতের আড্ডা।
ভূতেরা যদি আমাকে ধরতে আসত?
আতাহার হেসে উঠে বলল,আরে দূর, ভূত বলে আবার কিছু আছে না কি?
এক্ষুণি তুমি তো বললে।
লোকেরা বলে, তাই বললাম। আমি ভুত-টুত বিশ্বাস করি না। কতদিন থেকে আমরা এখানে খেলাধুলা করছি, কই কোনোদিন ভূত দেখেছি? ভুত বলে কিছু থাকলে, তারা আমাদেরকে কিছু বলেনি কেন?
তোমার কথা অবশ্য ঠিক। কিন্তু গ্রামের সবাই তবে বলে কেন? তা ছাড়া আম্মার মুখে শুনেছি। ভূতের অত্যাচারে চৌধুরীরা এখানে বাস করতে পারেনি। সবকিছু বেচে দিয়ে ঢাকা চলে গেছে।
আমিও আম্মার মুখে ঐ কথা শুনেছি। তবে আব্বার কাছে শুনেছি, চৌধুরীরা হিন্দু ছিল। তারা ভুত বিশ্বাস করে। আসলে ভূত বলে কিছু নেই। হিন্দুরা জ্বীনকেই ভূত বলে।
জ্বীনেরাও তো মানুষের ক্ষতি করে। শেখ পাড়ার কসিবুড়িকে মাঝে মাঝে জ্বীনে ধরে। তুমিও তো সে কথা জান?
হ্যাঁ জানি! জ্বীন হল আগুনের তৈরি। তাই তারা খুব উগ্র। আর মানুষের মতো তাদের মধ্যেও অনেক জাত আছে। যারা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছে, তারা ভালো। আর অন্যরা মানুষের ক্ষতি করে। তবে সহজে করে না।
শবনম ভয় পেয়ে বলল, এখানে যদি জ্বীন থাকে?
তা থাকতে পারে? তাতে আমাদের কি?
তারা যদি আমাদেরকে মেরে ফেলে।
আতাহার হেসে উঠে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আল্লাহ যার যতদিন হায়াৎ রেখেছে, তার এক সেকেন্ড আগেও কেউ কাউকে মেরে ফেলতে পারবে না। তবে ভয় দেখাতে পারে। আমার মনে হয়, এখানে আগে জ্বীনেরা থাকলেও এখন নেই। তা না হলে এতদিনে তাদের কিছু না কিছু আলামত আমরা পেতাম।
শবনম ভীতকণ্ঠে বলল, তোমার কথা হয়তো ঠিক। তবু আমার যেন কেমন ভয় ভয় করছে। এখানে থাকতে আর মন চাইছে না।
আতাহার বলল, তুমি বড় ভীতু। ঠিক আছে, এক কাজ করবে, এখানে আসবার আগে অজু করে বিসমিল্লাহর সঙ্গে একবার সূরা এখলাস, সূরা ফালাক সূরা নাস পড়ে দুহাতে তালুতে ফুঁক দিয়ে হাত দুটো সারা শরীরে বুলোবে। এভাবে তিনবার করলে গা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর আর জ্বীনেরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
শবনম বলল,সত্যি বলছ?
হ্যাঁ সত্যি বলছি। এ কথা অনেক আগে আম্মা আমাকে বলেছে। আমি আগে রাত্রে ঘুমিয়ে স্বপ্নে ভয় পেয়ে খুব কাঁদতাম। আম্মা তা জানতে পেরে আমাকে বলল, ঘুমোবার আগে অজু করে ঐ তিন সূরা পড়ে গা বন্ধ করে ঘুমোতে। যে দিন থেকে আমি আম্মার কথামত গা বন্ধ করে ঘুমাই, সেদিন থেকে আর ভয়ের স্বপ্ন দেখিনি।
ঠিক আছে, আমিও তাই করব। কিন্তু আম্মার চোখকে ফাঁকি দিয়ে আর এখানে আসা যাবে না।
কেন?
এখানে এসে তোমার সাথে খেলাধুলা করতে আম্মা নিষেধ করেছে।
কেন?
তা আমি জানি না।
চল এক্ষুনি তোমার আম্মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, কেন তোমাকে আসতে নিষেধ করেছে। এই কথা বলে শবনমের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করল।
দুজনেরই বাড়ি দৌলতখান গ্রামে। তবে এপাড়া ওপাড়া। আতাহার যখন চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে তখন শবনম দ্বিতীয় শ্রেনীতে। একদিন টিফিনের সময় খেলার মাঠে আতাহার শবনমকে কাঁদতে দেখে তার কাছে এসে বলল, এই মেয়ে তুমি কাঁদছ কেন?
শবনম হেঁচকি তুলতে তুলতে একটা ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ঐ ছেলেটা আমাকে শুধু শুধু মেরেছে।
আতাহার বলল, শুধু শুধু কেউ কাউকে মারে বুঝি? তুমি নিশ্চয় তার সঙ্গে কিছু করেছ?
শবনম বলল, আমাকে খেলতে ডেকেছিল, আমি যাইনি বলে মেরেছে।
আতাহারের বয়স আট নয় বছর হলে কি হবে, বেশ লম্বা। স্বাস্থ্য খুব ভাল। শবনমকে বলল, তুমি এস আমার সাথে তারপর সেই ছেলেটার কাছে এসে বলল, একে মেরেছ কেন?