রুকসানার চোখেও পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, দুঃখ কেন দিলাম বুঝলি না? তুই-ই বল না, আমি চৌধুরী বংশের বড় মেয়ে। গ্রামের ছোট বড় সবাই আমাকে শ্ৰেণীমতো ভক্তি শ্রদ্ধা করে। ছোট ভাইবোনেরা আমাকে সম্মান করে এবং আব্বা আম্মা কত স্নেহ করে, কত বিশ্বাস করে। স্বপ্ন সার্থক করতে গেলে তাদের কাছে কত ছোট হয়ে যাব চিন্তা করে দেখ। তাছাড়া চৌধুরী বংশের যে গৌরব রয়েছে তা ধূলায় মিশে যাবে। সবকিছু চিন্তা করে আমি নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। তোরাও তাই কর। তারপর নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আসমার চোখ মুখ মুছে দেওয়ার সময় বলল, থাকতে যখন পারবি না তখন আর দেরি করিসনি। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে। চল সয়ার সঙ্গে দেখা করি।
আসমা চাচা-চাচির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রুকসানার সঙ্গে নিচে এল।
বিয়ের পর দাইহান যখন আসমাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে প্রথম আসে তখন রুকসানাকে সবাই বড় আপা বলতে শুনে সেও তাকে বড় আপা বলে সম্বোধন করে ছিল। শুনে রুকসানা বলেছিল, দাইহান ভাই, তুমি আমার থেকে বড় ও আমার সইয়ের স্বামী। আমাকে তুমি বড় আপা বলছ কেন? নাম ধরে ডাকবে। দাইহান বলেছিল তুমি বয়সে ছোট হলেও সব দিক থেকে আমার থেকে অনেক বড়। তাই তোমাকে বড় আপাই বলব।
দাইহান স্ত্রীর অপেক্ষায় বসেছিল। আসমার সঙ্গে এসে রুকসানা সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছ দাইহান ভাই?
দাইহান বলল, ভালো আছি বড় আপা, কিন্তু তুমি তো দেখছি একদম শুকিয়ে গেছ।
রুকসানা মৃদু হেসে বলল, মানুষ সব সময় কি একরকম থাকে? কোলের বাচ্চাকে রেখে না এলে আজ তোমাদেরকে যেতে দিতাম না। বেশি বেলাও নেই, তাই দেরি করাব না। আবার যখন আসবে তখন বাচ্চাকে নিয়ে আসবে।
ফেরার পথে রুকসানার সঙ্গে যা কিছু আলাপ হয়েছে আসমা স্বামীকে বলল।
দাইহান বলল, আমরা যে এখানে এসেছি হোসেন জানে না। তাই বলছিলাম, এসব কথা তাকে এখন জানাবার দরকার নেই।
আসমা বলল, আমিও তাই ভেবেছি। এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে অন্য কোনো উপায় আছে কিনা।
দাইহান বলল, তাতো করতেই হবে।
.
রুকসানা মরামুখ দেখার ভয় দেখিয়ে নিষেধ করা সত্ত্বেও সুরাইয়া একদিন স্বামী, দুই দেবর ও দুই জাকে নিয়ে বৈঠক করল।
সবাই আসার পর বলল, আব্বা অসুস্থ। আম্মা তাকে নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। এ সংসারে সমস্ত দায়-দায়িত্ব বড় আপার উপর। তার পরেও সে সমাজ কল্যাণের কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের কি উচিত না, তার ভাল মন্দের দিকে লক্ষ্য রাখা?
বড় আব্দুর রশিদ বলল, নিশ্চয় উচিত।
তাহলে সে যে দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছে, কই তোমরা তো কোনো লক্ষ্য করনি?
ছোট আব্দুল করিম বলল, আমরা আর কতক্ষণ ঘরে থাকি। খাওয়ার সময় ছাড়া বড় আপার সঙ্গে তেমন দেখা হয় না। এ বাড়ির বড় বৌ হিসাবে সকলের দিকে তোমারই তো লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব। তুমি বললে আমরা ডাক্তার নিয়ে আসব।
মেজ আব্দুস সামাদ বলল, করিম ঠিক কথা বলেছে।
সুরাইয়া বলল, তাই যদি হয়, তাহলে বড় আপার অসুখের ও তার চিকিৎসা করার ব্যাপারে যা বলব, তা মেনে নেবে তো?
আব্দুর রশিদ বলল, অসুখ হলে চিকিৎসা করাবে এতে মানা না মানার প্রশ্ন তুলছ কেন?
সুরাইয়া বলল, প্রশ্ন আছে বলেই তুলেছি।
মেজ জা আরেফা বড় আপার রোগ অনুমান করতে পেরে বলল, বড় আপাকে সুস্থ করার জন্য যে চিকিৎসার দরকার তা করাতে আমাদের কারো আপত্তি থাকা উচিত নয়। তুমি কিভাবে চিকিৎসা করাতে চাও বল বুবু।
মেজ আব্দুল করিম বলল, আরেফা ঠিক কথা বলেছে। তুমি বল।
সুরাইয়া বলল, আমরা সবাই মনে করতাম বড় আপার চোখ খুব বড় বড় বলে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। আসল ঘটনা হল, বড় আপা ছোটবেলা থেকে একটা ছেলেকে ভালবাসে। ছেলেটা খুব ছোট ঘরের। কিন্তু প্রতিভা ও অধ্যাবসায়ের দ্বারা সে উচ্চ শিক্ষা নিয়েছে এবং বিদেশে চাকরি করে প্রচুর টাকা পয়সা উপার্জন করে ফিরে এসেছে। এখন সে প্রতিষ্ঠিত ও সুনামের অধিকারী। দীর্ঘ একুশ বাইশ বছর ছেলেটার সঙ্গে বড় আপার যোগাযোগ না থাকলেও তার প্রতীক্ষায় ছিল। তাই বিয়ে করতে রাজি হয়নি। আর ছেলেটাও ছোটবেলা থেকে বড় আপাকে ভালবাসে। তাই আজও সে বিয়ে করেনি। এখন সে প্রতিষ্ঠিত হলেও ছোট ঘরের ছেলে বলে বড় আপার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এবং বিয়ের প্রস্তাব দিতেও সাহস করেনি। কিছুদিন আগে দৈব দুর্ঘটনার মধ্যে ছেলেটার সঙ্গে বড় আপার দেখা। প্রথমে বড় আপা তাকে চিনতে না পারলেও পরে আলাপের মাধ্যমে চিনতে পারে এবং জানতে পারে ছেলেটাও তার প্রতিক্ষায় আজও বিয়ে করেনি। নিজের ও তোমাদের মান সম্মান ও বংশ মর্যাদার কথা চিন্তা করে বড় আপা মনের কথা কাউকে প্রকাশ করতে না পেরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। তাই দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, কথাটা আমি অনেক চেষ্টা করে জেনেছি। বড় আপাকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে হলে তোমাদের বংশের মান সম্মানের দিকে না তাকিয়ে সেই ছেলের সঙ্গে বড় আপার বিয়ে দিতে হবে। এখন সবাই চিন্তা করে বল, কি করবে। আমার মতামত আগেই বলছি, বড় আপাকে সুস্থ ও সুখী করার জন্য এই কাজ করতে আমি রাজি।
অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।
সুরইয়া বলল, কি হল? তোমরা কিছু বলছ না কেন?
বড় আব্দুর রশিদ গম্ভীর স্বরে বলল, ছেলেটার পরিচয় নিশ্চয় তুমি জান?