প্রেমের কথা না ভেবে শুধু বয়সের খোরাক জোগাবার জন্যে যে বিয়ে হয় তা হয় বড় নিকৃষ্ট। প্রেমের স্পর্শে নারী-পুরুষের মিলন জগতে স্বর্গ রচনা করে। প্রেম মানুষকে নীচ ও দীন জীবন হতে বহু উর্ধ্বে নিয়ে যায়, তার দৃষ্টি হয় কত গভীর, তার হৃদয় হয় কত বিরাট, তার মমতা হয় কত ব্যাপক।
হজরত বলেছেন, তাকেই বিয়ে করো যাকে তুমি ভালবাসতে পারবে।
২. শহর ও পল্লী জীবন
পল্লীতে যারা বাস করে, তারা ভাবে–শহরের সবাই বড়লোক, সম্মানী এবং সুখী। বড়লোক শহরে থাকে সত্য, তাদের আয়ও হয় অনেক টাকা, দালানে তারা বাস করে; কিন্তু টাকা থাকলেই যে মানুষ সুখী হয় তা ঠিক বলা যায় না। পাপ ও অন্যায় হতে যে মুক্ত, সেই প্রকৃত সুখী। শহরের অনেক অর্থশালীর মন পাপে ভরা। অনুভূতি নাই বলে তাদের মনে কোনো শঙ্কার উদয় না হতে পারে; কিন্তু প্রকৃত সুখী তাদের বলা যায় না। দস্যু যদি মানুষ খুন করে হাসতে থাকে তাহলে কি তাকে সুখী বলা যায়? পাপ করবার প্রথম অবস্থায় তার মন হয়তো আপত্তি তুলেছিল, কিন্তু সে তা শোনে নি।
মহা মানুষ যাঁরা, তাঁরা মানুষকে একটা কঠিন কথা বলে বেদনায় হয়তো সারা রাত্রি ঘুমান না। আবার যারা নিকৃষ্ট তারা অনবরত অন্যায় করে মহানন্দে জীবন কাটায়। অন্ধের মতো তারা নিজেদের সুখী ভাবতে পারে, কিন্তু সত্যি করে তারা মোটেই সুখী নয়।
এক সাধু একটা ভার মাথায় করে একস্থানে যাচ্ছিলেন। অনেক পথ চলে তিনি দেখতে পেলেন, বোঝার উপর একটা পিঁপড়ে ব্যাকুল ভাবে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। তার মনে হল, পিঁপড়াটাকে তার বন্ধু-বান্ধব ও পরিজনদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তিনি নিয়ে এসেছেন, তাই হৃদয় বেদনায় এদিক ওদিক, সে ব্যাকুলভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। সাধু অবিলম্বে ফিরে তাঁর প্রথম যাত্রার স্থানে এলেন এবং বোঝাটাকে মাটিতে নামিয়ে পিপড়াটাকে মাটিতে ছেড়ে দিলেন। সাধুর মনে খুব আনন্দ হল। তার কষ্ট স্বীকারের মাঝে–যে একটা আনন্দ রয়েছে সে আনন্দের সন্ধান অত্যাচারী ও বড় লোকেরা সব সময় খুঁজে পাবে না। সাধুর কাজের ভালোমন্দ বিচার করতে চাই নে। দেখতে হবে তাঁর মনের সহানুভূতি, ন্যায়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি।
ন্যায়-অন্যায়ের কথা না ভেবে বিবেককে হত্যা করে বহু মানুষ অর্থ জমিয়ে বড়লোক হয়। তাদের গৌরবে ও সম্মানে দশদিক মুখরিত হতে থাকে। কত মানুষ তাদের ওষ্ঠের একটু মৃদু হাসির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে, কত দাস-দাসী, কত খানসামা, দারোয়ান তাদের সম্মুখে মাথা লুটায়। অফুরন্ত সুখ, অজস্র আনন্দ তাদের চিত্তকে সুখাবেশে মত্ত রাখে, কিন্তু সত্যি কি এরা সুখী? এই অবোধ মানুষগুলির হাসিতে কি গোরস্থানের মৃত্যুগীত ধ্বনিত হয় না? কে তাদেরকে বোঝাবে–সুখ কোথায়?
এক ভদ্রলোক রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। বয়স তার অনেক হয়েছিল। হঠাৎ একদিন তার মনে হলো আমি যে বেতন পেয়ে থাকি তার প্রতিদানে ঠিক ওজন মতো কাজ দিতে পাচ্ছিনে। এই কথা মনে হওয়া মাত্র তিনি কাজ ত্যাগ করলেন। ঘুষ দিয়ে কাদাকাটি করে অনেক মানুষ চাকরি বজায় রাখে; তাদের জীবনে উল্লাস চাঞ্চল্য যথেষ্ট। সে শুধু নিজে সুখী হয় না, তার পত্নী ভাই, বন্ধু যারাই তার সংস্পর্শে আসে তাদের মনও আনন্দপূর্ণ হয়ে ওঠে।
মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুখ-দুঃখের জ্ঞান বদলাতে থাকে। হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে অনেক সুখের উপাদান দেওয়া হয়েছিল, সে সব তিনি গ্রহণ করেন নি। তাঁর জীবনের আনন্দ ছিল সত্য ও ন্যায়কে জয়যুক্ত করায়।
শহরের বড়লোকদের মতো জীবনকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরে না তুলতে পারলে জীবন সার্থক হল না। এ চিন্তা করা ভুল। মানুষকে নিজের অধীনে আনতে পারাতেও লোক সুখ। বোধ করে! মানুষ ভয়ে ভয়ে তোমাকে দেখে দিন কাটাবে; এ সুবিধাটুকু শহরে সম্ভব নয়, শহরের লোক সবাই স্বাধীন; কেউ কাউকে গ্রাহ্য করে না। পল্লীগ্রামে জমিদার এবং কতকগুলি অর্থশালী লোকের পক্ষে মানুষকে পরাধীন ও ভীত শঙ্কিত করে রাখা সম্ভব শহরে নয়। অসভ্য ও অনুন্নত সমাজে কোনো বড় কাজ করবার জন্যে লোকের উপর আধিপত্য প্রয়োজন হয় বটে, কিন্তু শুধু মানুষের উপর সর্দারির উদ্দেশ্যেই মানুষকে অধীন করে রাখা পাপ।
দেশ ও মানুষের কল্যাণের জন্যে সহস্র সহস্র কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পার; কিন্তু অনবরত টাকা সংগ্রহ করে লোহার বাক্সে জমা করে কী লাভ? মরবার পর অপদার্থ পুত্র-কন্যারা সে টাকা হয়তো পানির মতো বিপথে উড়িয়ে দিবে।
চরিত্রহীন বড়লোকের ছেলেরা দুদিনেই লক্ষ টাকা উড়িয়ে দেয়। এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক পাওয়া যায়। এক উচ্চ রাজকর্মচারীর ছেলে ছোটকালে বড় সুখে পালিত হয়েছিলেন। বাল্যে দশজন দাস-দাসী তার পেছনে পেছনে হাঁটতো। খোকা যখন যুবক হয়ে উঠলেন তখন বৃথা আমোদ-প্রমোদে হাজার হাজার টাকা ব্যয় করতে আরম্ভ করলেন। বন্ধু মহলে তার কত প্রশংসা হতো। শেষকালে প্রৌঢ় বয়সে তার এত দুঃখ হয়েছিল যে দুই পয়সার মাছের জন্যে তাকে দুই মাইল পথ পায়ে হেঁটে যেতে হতো।
টাকা খরচ করতে আমি নিষেধ করি নি, কিন্তু উপায় করবার জন্যেও সাধনা চাই। শহর যেমন খরচের জায়গা, উপায় করবার পথ তেমনি অনন্ত রয়েছে। আমার বাপ একজন বড় রাজকর্মচারী ছিলেন; অতএব কি করে আমি হীন হয়ে টাকা উপায় করবো–এ কথা ভাবলে জীবনের দুঃখ আরও বেড়ে যাবে। দয়াভিক্ষা না করে পরের গোলামী না করে। স্বাধীনভাবে পয়সা উপায় করবার জন্যে মনপ্রাণ ঢেলে দাও। লোকে কি বলে, এই সর্বনাশ। চিন্তা মানুষকে শয়তান অপেক্ষাও অধম করে ফেলে। মনের এই সঙ্কোচ দারিদ্র্যকে। একেবারে চেপে মেরে ফেলতে হবে, নইলে জীবনের চরম অধঃপতন হবে। লোকে যাই বলুক, যা সত্য বলে জেনেছে, তা করতেই হবে। স্বাধীনচিত্ত ব্যক্তিকে মানুষ কোনোকালে কিছু বলে না; লজ্জা সংকোচ আমাদের মনের ভিতর।