বাগ্মী শেরিডন কুমারী লিনলেকে নিয়ে পালিয়ে যান। ভাগ্যিস, তাকে শেষে বিয়ে করেছিলেন, নইলে বালিকাটির মাথায় কি কলঙ্কই না চাপতো। তখন শেরিডনের বয়স মাত্র বাইশ।
দুঃখ অভাবের চাপে পড়ে তিনি প্রথমে বই লেখা আরম্ভ করেন। দেনাদারেরা অনেক সময় তার ঘরের দুয়ারে এসে হল্লা করত। বিখ্যাত বাগী শেরিডনের কথা সবাই জানেন। তাঁর পারিবারিক দুঃখ-ক্লেশ যথেষ্ট থাকলেও সে জন্যে তিনি কিছুমাত্র মিয়মাণ হতেন না। পত্নী লিনলের ব্যবহার তার সতী হৃদয়ের অসীম ভালবাসা শেরিডনকে পরিপূর্ণ আনন্দে সকল চিন্তা সকল ভাবনা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। লিনলের মৃত্যুতে শেরিডন বালকের ন্যায় যখন তখন অশ্রু বির্সজন করতেন। তিনি বড় বাগ্মী হয়েছিলেন। তাঁর যশ কীর্তিতে দেশ ভরে উঠেছিল, কিনরউ লিনলের শোক তাঁকে অধীর করে তুলেছিল। কয়েক বৎসর পরে আবার বিয়ে করেছিলেন। পুত্র-পত্নী তার জীবনে সুখময় করে তোলার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। তবে শেরিডন জীবনে সুখ করতে পারেন নি। আয়-ব্যয়ের কোনোই হিসাব থাকত না। দুর্বহ। জীবনের টান সহ্য করতে না পেরে পরী সেবা-যত্নের মাঝে তিনি শেষকালে প্রাণত্যাগ করেন।
স্টিলের অবস্থাও অনেকটা শেরিডনের মতোই ছিল। পাওনাদারদের ভয়ে তিনি অনেক সময় বাড়ি হতে পালিয়ে কফিখানায় আড্ডা দিতেন। সেখানে তার আনন্দ উচ্ছ্বাসের সীমা থাকত না। পাওনাদাররা বাড়িতে পত্নীর কাছে এসে রিক্ত হস্তে ফিরে যেতে বাধ্য হতো। প্রাণে নানা দুঃখ অশান্তি থাকলেও পরীর সামনে স্টিলের মুখে সদাই হাসি লেগে থাকতো। পত্নীর সদ্ব্যবহার আদর ভালবাসা তাকে দুঃখ অশান্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। স্টিল বলতেন, আমার পরী হচ্ছেন বেহেশতের হুরী, তার স্নেহে জীবনের ব্যথা দূর হয়ে যায়। এরূপ পত্নী যার ভাগ্যে জুটেছে তার আর কিছুরই দরকার নাই।
কবিদের সঙ্গে বিয়ে জুড়তে নারীদের সর্বদাই সতর্ক হওয়া চাই। কারণ এদের সৌন্দর্য জ্ঞান অতি প্রবল। এই প্রকৃতির লোক কোন সময় যে কী করে বসে তা বলা কঠিন। কবি জীবন সম্বন্ধে এই অপ্রিয় কথাগুলি দুঃখের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে। তারা অনেক সময় এমন কতকগুলি অন্যায় করে বসেন যার আঘাত সহ্য করা সরলা নারীদের পক্ষে খুব কঠিন। মিলটনের দাম্পত্য জীবন খুব বিশ্রী। অনেক নারীকেই ঘোল খেয়ে তার কাছ থেকে পোটলা বেঁধে বিদায় নিতে হয়েছে। চার্চিল সতের বছরের সময় বিয়ে করেন। বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে মনের দুঃখে বিষ খেয়ে মরেন। কবি শেলীর বৌ স্বামীর হৃদয়হীন ব্যবহারে জলে ডুবে প্রাণ ত্যাগ করেছিলেন। সকল কবির দাম্পত্য জীবনই যে খুব অশান্তিপূর্ণ নিরানন্দময় তা বলা যায় না। স্যার ওয়ালটার স্কট, ওয়ার্ডসওয়ার্থ বেশ সুখে পত্নীর সঙ্গে ঘর করে গিয়েছেন।
এক মায়ের পেটের তিন বোনকে বিয়ে করেছিলেন কবি সাদী, কোলরিজ এবং লভেল। সাদী বড় ভালো মানুষ ছিলেন। তার দুই কবি বন্ধুর পরীরই ভরণ-পোষণ করতে হতো তাঁকে। কোলরিজ ছিলেন বেপেরোয়া। পত্নীকে সাদী ঘাড়ে ফেলে রেখে তিনি নিরুদ্দেশ হলেন। কয়েকটা ছেলেমেয়ে রেখে লভেল মারা গেলেন। সাদী তাদের সকলকে পরিবারের মতোই টেনে নিয়েছিলেন। মৃত্যু পর্যন্ত তাদের ব্যয়ভার নিজে বহন করেছিলেন। সাদীর দ্বিতীয় পত্নী সাদীর মতোই একজন খুব ভালো কবি ছিলেন।
টমাস উডের পত্নী মায়ের স্নেহে স্বামীকে যত্ন করতেন। স্বামীর রোগ শয্যার পাশে কত বিদ্রি রজনী কতদিন কাটিয়ে দিতেন। কতকগুলি স্বামী আছেন যাদের মেয়েরা প্রাণ দিয়ে ভালবাসলেও প্রতিদান পায় না। রোগশয্যায় ব্যাধিযন্ত্রণায় যে পত্নী কত আঁখিজলে স্বামীকে সেবা করেছে, কত গভীর নেশায় উঠে স্বামীর মঙ্গলের জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে, সেই স্বামী যখন ভালো হন তখন পত্নীর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া দূরে থাক রূঢ় ও কর্কশ ব্যবহার করতে লজ্জা বোধ করেন না। পত্নীর গুণ তার নজরে আসে না, আসে কেবল দোষগুলি। নিজের চরিত্রে কি কোনো দোষ থাকে না যে পরের দোষ ধরি? শুধু দোষ ধরে কোনো কালে কারো চরিত্র ভালো করা যায় না। ভুলগুলি উপেক্ষা করে সদ্ব্যবহার ও জ্ঞানপূর্ণ কথার দ্বারা মানুষকে ভালো করতে হবে। মানুষকে বড় করবার এক প্রধান পথ তাকে পুস্তকের সঙ্গে পরিচিত করে দেওয়া। বিপদকালে পত্নীর সেবা-যত্ব গ্রহণ করা আর পরে তাকে ব্যথা দেওয়া বড়ই অন্যায়। যে বিদ্রোহী হতে পারে না, নিজেকে রক্ষা করবার যার অধিকার নাই, তাকে ব্যথা দেওয়া নিতান্তই কাপুরুষতা। শক্তি ও অর্থ আছে বলে পত্নী অপমান করা মহাপাপ।
উড তাঁর পত্নীর কাছে নিয়ত কৃতজ্ঞতার সংগে বলতেন–তুমি আমার জীবনের শান্তি। তোমার মঙ্গল প্রভাবে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। সে কথা শুনে পত্নী আনন্দিত হতেন।
পত্নীকে ভালো হবার জন্যে উপদেশ দিলে চলবে না। পুরুষেরা যদি নিজেদের স্বভাব ও ব্যবহারগুলিকে সুন্দর না করেন তাহলে শুধু নারীকে ভালো হবার জন্যে যতই কথা বলা হোক না কেন, কোনো কাজ হবে না। যত আঘাত করবে মানব-আত্মা ততই বিদ্রোহী হবে। হীন নরপিশাচের স্পর্শে এলে অতি ভালো লোকও জঘন্য প্রকৃতি হয়ে ওঠেন। স্বামী স্ত্রী পরস্পরকে যদি প্রেম ও শ্রদ্ধা করেন, তাহলে মানুষের জীবন কত সুখময় হয়।