পিতার অজ্ঞানতার দরুণ বহু মানুষের জীবন বিফল হয়, এও সত্য কিন্তু সে কথা তোলবার অধিকার পুত্রদের নেই। যে অবস্থায়ই হোক না মানুষকে সকল অবস্থার ঘাড়ে চড়ে জীবনের পথ কেটে নিতে হবে। বাধা-বিপত্তি সকল প্রকার অন্তরায়কে সত্য বলে গ্রহণ করে তোমাকে অগ্রসর হতে হবে।
যুবক বয়সে জীবনে একটা বড় বিপদ আসে, সেটা হচ্ছে অহঙ্কার। পল্লীর দীন মা বাপের কুটির ছেড়ে এসে প্রাসাদবাসী বন্ধুদের সঙ্গে মিশে মনের গোপন কোণে অজ্ঞাতসারে একটা অহঙ্কার জাগে। বাড়ি যেয়ে ময়লা কাপড় পরা, দরিদ্র পিতামাতা, ছিন্নবসনা ভাইবোন, পল্লীবাসীদের অশুদ্ধ ভাষা, অনুন্নত জীবন দেখে মনে অহঙ্কারে বলে ওঠে, বড় বিরক্তকর। যখন উচ্চ জ্ঞান ও উচ্চস্তরের লোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে, তখন সাবধান, আপনার জনের সঙ্গে কখনও দাম্ভিক ব্যবহার করো না-বাপ-মায়ের সঙ্গে কখনও উগ্রভাবে কথা বলো না। অসভ্য ভাইবোনদের সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করো না; এতে তোমার মনের দীনতারই পরিচয় পাওয়া যায়।
বিয়ের পরে অনেক সময় পত্নী গর্বের অহঙ্কারে মা-বাপকে ব্যথা দিতে পারেন। গরীবের ছেলে বড় ঘরে বিয়ে করলে পত্নীর মনে এরূপ অহঙ্কার আসা সম্ভব।
গরীবের ছেলের পক্ষে উচ্চঘরে বিয়ে করতে যাওয়া মূর্খতা ও লজ্জাজনক। যারা তোমার পিতামাতাকে এতকাল বংশমর্যাদায় ছোট বলে মনে করে এসেছে, তোমার যদি আত্মমর্যাদা জ্ঞান থাকে, তা হলে সম্মানের আশায় তাদের ছায়া স্পর্শ করো না। বিয়ে করে ভদ্রলোক হবার চেষ্টা করবার মতো অপমান জীবনে আর নেই।
স্বামী যদি বিলক্ষণ টাকা উপায় করেন, অথবা পত্নী যদি অর্থশালিনী হন, তা হলেও তার মনে অহঙ্কার আসতে পারে। সাধারণত নারীর মন অনুন্নত। অনুন্নত মানুষ অর্থ ও ক্ষমতা পেলে তার স্বভাব তো কিছু উগ্র হবেই। পত্নীর ব্যবহারে যদি পিতামাতা কিছু আহত হয়ে থাকেন, তা হলে সাধ্যমত বাপ-মায়ের সন্তোষ বিধান করবে; তাদের যথেষ্ট সম্মান করবে।
এ সম্বন্ধে পত্নীর সঙ্গে কোনো কথা তুলবে না, তাতে বিপরীত ফল হবেই। মাতাপিতার প্রতি তোমার ভক্তি দেখে তোমার পত্নী নিশ্চয়ই লজ্জিতা হবেন। যদি এতেও কোনো ফল না হয় তবে পত্নীকে কৃপার পাত্র বা বুদ্ধিহীনা মনে করে তার কথা সকলকে অগ্রাহ্য করতে হবে। তার সঙ্গে পিতামাতা সম্বন্ধে কোনো কথা উঠলেই নীরব হয়ে যাবে। এই সমস্ত কথা নিয়ে মনকে নিরন্তর শান্তিহীন করে তোলাও ঠিক নয়।
মৃত্যুর পূর্বে পিতা যদি তার সম্পত্তি কোনো শুভকার্যে দান করে যেতে চান, তা হলে কদ্যপি তাকে বাধা দেবে না, বরং সেই সমস্ত কাজে উৎসাহ দেবে। মানুষের অভাব কোনো কালেই পূর্ণ হবে না। পিতা যদি কোনো দান করবার শুভ কল্যাণ পোষণ করেন তবে তাতে বাধা না দেওয়া ঠিক। পুত্র এবং কন্যাদের জন্যে সম্পত্তির কতটুকু রাখা দরকার তা পিতাই ঠিক করে দেবেন। পুত্র-কন্যাকে ভিখারি করে যাওয়া পিতার পক্ষে খুবই কষ্টকর। তবে ছেলেমেয়েদের জন্যে সর্বস্ব না রেখে যদি কিছু সম্পত্তি দীন-দুঃখী বা কোনো সদানুষ্ঠানে দিয়ে যেতে চান, তাতে পুত্রকন্যার মনে আনন্দ হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
পুত্র-কন্যার জন্যে মানুষ কত না পাপ করে। জীবন ভরে রাশি রাশি অর্থ জমিয়ে মানুষ রেখে যাচ্ছে কেবল ছেলেমেয়েদের জন্যে। জাতি যখন মানুষের ছেলেমেয়েদের কথা ভুলে শুধু নিজের ছেলেমেয়েদের কথা বেশি ভাবে, তখন বুঝতে হবে তারা পতিত।
দুটি যুবকের কথা জানি; তারা ঝগড়া করে বাপকে বন্দুক দিয়ে খুন করে ফেলেছিল। পিতার গালি ও দুর্ব্যবহার সহ্য করবার মতো বল যদি বুকে না থাকে, তা হলে বাড়ি ছেড়ে দূর দেশে চলে যাও, সেও ভালো, বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে কাজ নেই। পিতাকে হত্যা করে মহা অন্যায় করো না। জগতে কেউ বাপকে হত্যা করেছে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল। সংসারের সমস্ত অর্থ যদি লাভ হয়, তা হলেও এমন কাজ করা যায় না।
আর দুটো যুবককে জানি, তারা বাপের সঙ্গে কথা বলে না। সর্বত্র বাপের কুৎসা বর্ণনা করে। তবুও মানুষের অপবাদ সহ্য করে, চুপ করে থাকাই উপযুক্ত পুত্রের কাজ। বুঝতে নাপেরে পিতা অন্যায় আচরণ করতে পারেন, তাই বলে তুমি পিতার প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করতে পার না। যদি তুমি তাই কর, তাহলে তোমার পিতৃ-ভক্তির পরীক্ষা হবে না। মনুষ্যত্বের জন্য বেদনা সহ্য করলে বড় মনুষ্যত্বের পরিচয় দেওয়া হবে।
মা বা মামুদের সম্পত্তি লাভ করে অনেক পুত্র পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়। এরূপ বিদ্রোহী হওয়াতে জীবনের গৌরব কতখানি নষ্ট হয় তা ভাষায় কেমন করে প্রকাশ করবো। পিতা নতুন বিয়ে করেছেন তিনি অত্যাচারী হলেও তার নিন্দা পুত্রের মুখে শোভা পায় না। সর্বদা নিজেকেই অপরাধী বলে মানুষের কাছে প্রকাশ করবে। তাতে কোনো দোষ নেই। আর এরই নাম পিতৃভক্তি।
পিতার নব বিবাহিত পত্নীর নিন্দা প্রচার করাও দোষের। বুক ভেঙ্গে যদি বেদনা গুমরে ওঠে, জনহীন আকাশতলে অথবা নির্জন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে কাঁদ, কিন্তু এই অশ্রুকে ক্ষমা করো না। চিত্তকে ডেকে বলো–ওরে মন, তাঁর সুখেই কি সুখী হতে পার না? কেন এ দুর্বলতা, কেন এ ছেলেমি; যদি মৃত মায়ের কথা মনে হয়, তা হলে মনকে বলো, মন, এ জগতে অনন্ত মানুষ এসেছিল; এখন কোথায় তারা? সকলকেই যেতে হবে, কেন বৃথা এ আখিজল।