মা-বাপ ছোট হলে তার পরিচয় দিতে কখনও লজ্জা বোধ করো না। যদি কেউ ঘৃণা করে তার সঙ্গে তুমি সম্বন্ধ নষ্ট করে ফেলো। যে বন্ধু তোমার বাপকে স্বীকার করে না, তার সঙ্গে তোমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। বাপের অপমান শুনে তোমার বন্ধুরা প্রকাশ্যে না হোক অন্তরালে হাসতে পারেন, তা হলেও তোমার লজ্জা বোধ করবার দরকার নেই। তুমি যখন। তোমার পাগল বাপের মুরব্বীয়ানা সহ্য করতে পেরেছ, তখন তোমার বন্ধুরা কি দুই মিনিটের জন্য তা পারবে না? সভার মাঝে হোক, গোপনে হোক, পিতামাতার সঙ্গে দেখা হলেই সমাজের রীতি অনুসারে তাকে সম্ভ্রম জানাবে।
বাপের নামের সঙ্গে কোনো উচ্চ উপাধি নেই বলে লজ্জাবোধ করবার দরকার নেই। তাঁর নাম লিখতে অনর্থক একটা মুনশী উপাধি লাগালে তাকে অপমান করা হয়। উপাধি ব্যবহার জিনিসটা নিতান্তই আপত্তিজনক। নামের সঙ্গে যারা আজকাল চৌধুরী, খ ও কাজী উপাধি লাগান, তারা হয়তো বলতে চান আমরা অন্যান্য মুসলমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। খুব বিস্ময়ের কথা সন্দেহ নেই।
প্রবন্ধ লেখকের বংশকে লোকে জরদার বংশ বলে থাকেন। জরদার অর্থ স্বর্ণ অথবা ধন-সম্পত্তির মালিক। বড়লোক ছাড়া কারো এই উপাধি হয় না। নদীয়া জেলায় এক ব্রাহ্মণের এ উপাধি আছে; সুতরাং এ উপাধি ব্যবহার করতে মনে গর্ব ছাড়া লজ্জা আসে না। কিন্তু বিবেকের কাছে অনুমতি চাইলে সে জিজ্ঞাসা করেছে তোমার অর্থ কই? আর অর্থ যদিই থাকে, তবে তা লোকের কাছে প্রচার করা কী প্রকার ভদ্রতা?
কোন্ সালের টাকা, কে আমাকে দিয়েছে, এর পূর্বে কার বাক্সে ছিল তা আমার জানবার দরকার নেই–আমি শুধু একটিবার তাকে বাজিয়ে দেখব।
সংসার যখন ভারী হয়ে ওঠে, যখন ছেলেপিলে, দাসদাসী, আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভর্তি হয়ে পড়ে, তখন অনেক সময় বুড়ো বাপ-মায়ের বড় অসম্মান হয়।
এক বাড়িতে আমি দেখেছিলাম, পিতার জমিদারি সবাই ভোগ করছে অথচ সকলের খাওয়া শেষ হলে বাইরে অতিথির মতো পিতাকে ভাত দেওয়া হয়। খাবার সময় তাকে পানি দেবার লোকও থাকে না।
ছেলের মাথার চুল পেকেছে বলে কী সে বাপকে ‘বাপ’ বলে ডাকতে লজ্জা বোধ করবে? কে এই নরাধম? আমি তাকে ঘৃণা করি।
পিতা বা বুড়ো মায়ের অনর্থক বকাবকি শুনে যে ধৈর্য হারিয়ে উপহাসের হাসি হাসে, সে অপদার্থ। মানুষ বড় হলে শিশু হয়, শিশুর মতোই তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরতে হবে।
এক ইংরেজ পরিবারের বুড়ো দাদাকে নিয়ে ছেলেমেয়েরা কৌতুক করতো। বুড়োকে যেন তারা বানর বলেই মনে করতো। বুড়োর নিজের ছেলেও যেন এজন্য বেশ আনন্দ উপভোগ করতেন। বাঙালি পরিবারে বুড়ো দাদাকে নিয়ে যেন কোনো কৌতুক রঙ্গ না হয়।
ক্রুদ্ধ হয়ে বাপকে বাপ’ বলে ডাকতে কখনও লজ্জাবোধ করো না; শিশুকালে কতবার তোমার মা তোমাকে কোলের কাছ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, অপমানজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে ‘মা’ ‘মা’ বলে তার বুকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছ। আজ বড় হয়ে ছেলেমেয়ের বাপ হয়ে সে কথা ভুলে গিয়েছ? জননীর বুকের ক্ষীরধারা এখনও যে তোমার মুখে লেগে রয়েছে। সম্ভব হলে জননীর পাশে শেষ শয্যা গ্রহণ করো তবু মায়ের অঞ্চল ছেড়ো না।
মা-বাপ নিচে বসলে তুমি কখনও উচ্চাসনে বসবে না। উপার্জনক্ষম হয়ে মা-বাপকে রেখে কখনও দধির প্রথম অংশ এবং মাছের মাথা খাবে না, তোমার ছেলেপেলেকেও দেবে না।
বিপন্ন হয়ে, ব্যাধিপীড়িত হয়ে যদি তোমার পিতামাতা বিছানায় মল ত্যাগ করেন, তা হলে নিজ হাতে তা ধুয়ে দেবে। তোমার পত্নী যদি বুদ্ধিমতী হন তা হলে তিনিও তোমার সঙ্গে এসে তোমার পিতামাতার সেবা করবেন।
তুমি এবং তোমার পত্নী ছাড়া পুত্র-কন্যা দিয়ে পিতামাতার সেবা করাবে না। পিতার ধন-সম্পত্তির লোভ বেশি না করে তার সদ্গুণগুলি আয়ত্ত করবার জন্যে তোমার আগ্রহ যেন বেশি হয়। সেইটেই হবে তোমার যথার্থ পিতৃভক্তি।
মহাপুরুষকে ভক্তি কর, কিন্তু তার জীবনকে নিজের জীবনে ফুটিয়ে তোলবার জন্য যদি তোমার কোনো সাধনা না থাকে, তা হলে তোমার ভক্তির কোনো মূল্য নেই। গান্ধী। বা বুদ্ধের মূর্তি পূজা করে কোনো লাভ হবে না, যদি তাদের শিক্ষাকে গ্রহণ না করা হয়।
বহু মানুষ হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর মহাজীবনের গুণকীর্তন করে, কিন্তু তাঁর জীবনের শিক্ষাকে তারা মানে না। এর মানে কি ভক্তি? পতিত মানুষ এইভাবেই মহাপুরুষের জীবনকে ব্যর্থ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জীবনকেও ব্যর্থ করে।
পিতাকে অন্ধভাবে ভক্তি করেও কোনো লাভ নেই যদি তার চরিত্র মাহাত্ম্যকে তুমি। গ্রহণ না কর। পিতা খুব সম্মানী লোক ছিলেন; তার গুণে ও জ্ঞানে সারা দেশের লোক মুগ্ধ ছিল; তার নামে দোহাই ফিরত এই সমস্ত গল্প করে কাপুরুষতার পরিচয় দিও না। তোমার এই সমস্ত অহঙ্কারের গলাবাজি শুনে মন বিরক্ত হয়ে ওঠে।
পিতা মহাজন ব্যক্তি ছিলেন সে কথা লোক-সমাজে প্রচার করে নিজের পৌরুষতা বাড়াতে চেষ্টা করো না। পিতার চেয়ে শ্রেষ্ঠ হয়ে তাঁর আত্মার তৃপ্তি সাধনা কর। এই আমরা চাই।
উন্নত জীবনকে অনুসরণ করে কত অপরিচিত পথের মানুষ হৃদয়শক্তি সঞ্চয় করেছেন আর তুমি পুত্র হয়ে পিতার জীবনকে অনুকরণ করতে পারবে না? পিতার চেয়ে জীবন্ত আদর্শ আর তোমার সম্মুখে কে?
অনেক স্থলে দেখা যায়, যাদের মহিমা ও কর্মশক্তিতে জগৎ স্তম্ভিত তাঁদের পুত্রগুলি অপদার্থ। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় কী হতে পারে? জ্ঞানে-গুণে পদমর্যাদায় পিতাকে ছাড়িয়ে যেতে হবে, এই প্রতিজ্ঞা তুমি কর, তোমার এ কল্পনায় তোমার পিতা কত সন্তুষ্ট হবেন, তা বলা যায় না। তুমি তোমার পিতারই প্রতিচ্ছবি।